বিকেল বেলায় সূর্যের তাপ মরে এলে লোকে বলত, ধূপছায়া আলো। এই ধূপছায়া আলো পড়তেই বাড়ির মহিলারা 'গড়ান' ছেড়ে উঠতেন। গরম কালে কেউ শুতেন খেজুর পাতার তালাইয়ে, কেউ কেউ মাদুরে। সে-সময় তো মহিলারা বাড়িতে ব্লাউজ পরতেন না। ব্লাউজ নয়, নাম ছিল গায়ের জামা। এক শান্তি চক্রবর্তী মাস্টারমশাইয়ের স্ত্রী ছিলেন শহরের মেয়ে। তিনি ব্যতিক্রম। পরে ইস্কুল কলেজের শিক্ষা দীক্ষার চল বাড়ল। ব্লাউজ ঘরেও চড়ল সবার গায়ে। আজকের আধুনিকরা যদি মাত্র ৪০-৪৫ বছর আগের গ্রাম দেখতেন, এই শরীর দেখিয়ে রিলস বানানোর খেলাটাই জমতো না। স্বাভাবিকভাবেই মহিলারা ব্লাউজ ছাড়াই ঘরের কাজ করতেন। গরিব ঘরের মহিলারা ব্লাউজ ছাড়াই বাইরে বের হতেন। বয়স্ক গুরুজনদের দেখলে গায়ে কাপড়টা জড়িয়ে নিতেন বড়জোর।
আদৌ বিকেলেরটা ঘুম নয়, ছিল গড়িয়ে নেওয়া। আজকের ভাষায় ন্যাপ। একটু গড়িয়ে হাতের কাজ সেরে চুল বাঁধতে বসতেন মেয়েরা। নিজেদের বাড়ির মেয়েরা ছাড়াও পাশের বাড়ির মেয়েরাও আসতো। ভালো চুল বাঁধতে পারা মেয়েদের কদর ছিল আলাদা। বয়স্করা ছোটদের দিয়ে মাথার পাকা চুল বাছাতেন। তারপর দুপুরের তরকারি গরম করে ভাত বসিয়ে একটু ভালো শাড়ি ব্লাউজ বের করে হিন্দু মুসলমান সব বাড়ির মহিলারা তৈরি হতেন সত্যপীরের পালা শুনতে। আমাদের খুব আক্ষেপ ছিল, মা কোনদিন যেতেন না।
কেন?
মনে হয়, বাবা এইসব নিয়ে ব্যস্ত। নিজে যুক্ত হলে সংসার 'উড়েপুড়ে' যাবে।
এটা ছিল মেয়েদের বাঁধা লব্জ।
উড়িয়ে পুড়িয়ে দিলে গা।
এই মেয়েদের একটা বড় অংশের বিনোদন ছিল একসঙ্গে বসে বিকেলবেলায় আড্ডা। অনূঢ়া মেয়েদের দল মাঠের ধারে আলে বসত ধরনের সময়।
ধরন মানে বৃষ্টি বাদলা নাই।
আর বিবাহিত মহিলারা একসঙ্গে বসে পান চিবোতেন বা কেউ তাস খেলতেন।
বামুনপাড়ায় বকুলতলায় বসতো তাস ও পানের আড্ডা। বারোয়ারি তলায় বেনে বউদের গপ্পোগাছার আসর। মাঝের পাড়া উত্তরপাড়া মুসলিম অধ্যুষিত। সেখানে নিজেদের মধ্যে আড্ডা। পনের বিশ দিন অন্তর একবার পাড়া বেড়ানো।
এ-বাড়ি সে-বাড়ি গিয়ে খোঁজ খবর নেওয়া। বিয়ে হওয়া মেয়েরা গ্রামে ফিরলে বোন ভাইঝিদের নিয়ে পাড়া বেড়ানো অবশ্য কর্তব্য।
আর মহিলারা তক্কে তক্কে থাকতেন কবে সত্যপীর বা রামযাত্রার আসর বসছে। সত্যপীরের আসরই বেশি বসতো।
বারোয়ারি তলায় কম। বাড়ি বাড়ি বেশি। কারও মানত থাকলে দুয়েকবার। বেশি হতো মুসলমানদের বাড়িতে ছেলেদের সুন্নত তথা লিঙ্গচ্ছেদ তথা হাজামিতে। একে মুসলমানিই সাধারণভাবে বলা হতো।
যে বাড়িতে সত্যপীরের পালা, সে বাড়ির ছেলে মেয়েরা লোকেদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে আসতো।
সত্যপীরের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করতেন তাঁর হাতে থাকতো একটা বিরাট সাদা চামর। সেটা মাথায় বুলিয়ে তিনি আশির্বাদ করতেন। হিন্দু মুসলমান সবাই সেই আশির্বাদ নিতেন। ১০-২০ পয়সা করে দিতেন মায়েরা সত্যপীরের পালায়। কিশোর ঘোষালদা লিখেছেন, ১৯৮০ র মাঝামাঝি সত্যপীর সত্যনারায়ণ হয়ে গেল।
তা, সত্যপীরের পালায় হিন্দু মুসলমান একতার কথা থাকতো।
আর থাকতো সমাজশোধন প্রচেষ্টা। গাঁয়ে কেউ অন্যায় করলে সত্যপীর ঠারে ঠোরে তার ইঙ্গিত দিয়ে দিতেন। অনেকটা গ্রিক নাটকের আদি পর্বের মতো ছিল বিষয়টি।
পরে এর জায়গায় মূলত প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে বেশি বলা হতে থাকে।
কেউ একজন একটা/দুটো টাকা সেফটিপিন দিয়ে বুকে গেঁথে বা হাতে গুঁজে দিয়ে বলতো, অমুক কেন ... পাড়া দিয়ে সেজেগুজে ঘনঘন যায়।
এখন যদি তুমি ভায়া আমায় না থামাও/ সবকিছু জেনে যাবে গোটা পাড়া গাঁও।
অমনি যার উদ্দেশে বলা সে বেচারা তড়িঘড়ি আরও কিছু বেশি পয়সা দিয়ে মুখ বন্ধ করে ভিন্ন কথা বলতো।
এখনকার পশ্চিমবঙ্গের আদর্শ পরিস্থিতি বোঝা যেত সত্যপীরের আসরে।
নব্বই দশকের ইট পূজা, রামমন্দির বাবরি মসজিদ লড়াই এবং পরে বাবরি মসজিদ ধ্বংস --- বাংলার সাংস্কৃতিক মানচিত্র অনেকটাই বদলে দিল।
এরসঙ্গে যুক্ত হল, বিদ্যুৎ এবং টেলিভিশনের আগমন।
তারপর এল টেলিফোন। সেটা ১৯৯৬ পরবর্তী ঘটনা।
২০০৪ এর পর মোবাইল একটু সহজলভ্য হতেই গোটা বিষয়টি গেল বদলে।
আর পরে নেট এসে গিয়ে সংস্কৃতি খেলাধুলা আড্ডা রাজনীতি সব আলাদা ধরনের হয়ে গেল।
তবু এরমধ্যে দেখেছি, বারোয়ারিতলায় বয়স্ক মহিলাদের সঙ্গে অল্পবয়সী বউদের গল্পগাছা।
পাড়া বেড়ানো কমেছে।
সত্যপীরের আসর শেষ কবে বসেছে, মনে নেই কারও।
রামযাত্রা কেষ্টযাত্রাও অতীত।
যদিও রাম নিয়ে রাজনীতির প্রভাব বেশ পড়েছে গ্রামজীবনেও।