১৫ ডিসেম্বর ২০২০সুধীর চক্রবর্তীর চলে যাওয়ার দিন ।
স্মৃতিকথার চিরাচরিত নিয়মে এই সব কথা এখন আসার নয়। তবু এল। কারণ মনে পড়ল। কাঁথিতে গতকাল বইমেলা উদ্বোধন করতে এসেছি। এখন ভোর। ভোরের আলোয় ভেসে উঠছে সুধীর স্মৃতি।
রবীন্দ্রসদনে গানের আসর বসেছে। একজন গায়িকা গাইছেন। সুন্দর গায়কী। গাওয়ার পর নেমে এসে সামনের আসনে বসা দুজনকে প্রণাম করতে এলেন। একজন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রতুল গুপ্ত। আরেকজন শিল্পী জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। দুজনেই গুরু। একজন শিক্ষা আরেকজন সঙ্গীত জগতের। উপাচার্য প্রতুল গুপ্ত বললেন, বড়ো ভালো গেয়েছো মা।
পাশের জন বললেন, থাম। চুপ কর।
ছাত্রী উপাচার্য দুজনেই হতভম্ব।
জ্ঞানপ্রকাশ মেয়েটিকে বললেন, বড়ো ভালো গেয়েছো।
প্রতুলবাবু বললেন, আমিও তো একই কথা বললাম। থামালি কেন?
দুজনেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তবু গায়ে লেগেছে। থামতে বলায়। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ বন্ধুর অনুভূতি বুঝেই বললেন, ও কেমন গায় সেটা বিচার করবো আমি। তুই বলার কে? আমি গানের মানুষ। ও কেমন পড়াশোনা করে সেটা তুই বলবি, তুই শিক্ষা জগতের লোক। আমি বললে কি ঠিক শোনাবে?
গল্পটি শোনা বাংলা আকাদেমিতে সুধীর চক্রবর্তীর ভাষণে। সেখানে সেদিন তিনঘন্টা টানা বলেছিলেন।
তখনো গলা বিশ্বাসঘাতকতা করে নি। গান গেয়েই উদাহরণ দিতেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রজনীকান্তের বহু গান গেয়ে গেয়ে বক্তৃতা করেছিলেন।
কোনটা ঠিক গায়কী কোনটা ভুল-- তাও বলেছিলেন।
এই প্রসঙ্গে শুনিয়েছিলেন আরেকটি গল্প। রবীন্দ্রগানে সুর সংযোজনের রেওয়াজ এসেছিল সে-সময়। সে প্রসঙ্গ টেনেই চলে গেলেন রবীন্দ্রনাথের জীবনের এক ঘটনায়।
রবীন্দ্রনাথের কাছে একদল এসেছেন তাঁরা রবীন্দ্রনাথের গান 'ইম্প্রোভাইজ' করতে চান। কী বক্তব্য? জানতে চান।
রবীন্দ্রনাথ তাঁদের কিছু না বলে চা খেতে বললেন। চা এলো। কাপ ও প্লেটে। রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, অভ্যাগতদের, ভালো কাপ প্লেট কাকে বলে জানেন? কেউ বললেন, সুন্দর হলে। কেউ অন্যরকম উত্তর দিলেন। রবীন্দ্রনাথ কোনো কথা না বলে দুটো চা ঢেলে দিলেন দুটো প্লেটে। একটায় উপচে গেল। আরেকটায় স্থির। কানায় কানায় পূর্ণ টলটল করছে উপচে যাচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথ বললেন, দ্বিতীয়টা হল আসল কাপ প্লেট। এক কাপ চা ঢাললে প্লেটে তা টলটল করবে, উপচে যাবে না, কমও হবে না।
আমার গানও তাই। যতটুকু দরকার ততটাই লিখেছি সুর স্বর আর সঙ্গীত মিলিয়ে। আপনাদের যদি দরকার হয় নিজেরা গান লিখুন, তাতে সুর দিন। আমার গানে কারিকুরি করতে যাবেন না। এটাও সুধীরবাবুর কাছেই শোনা।
সুধীরবাবু আমার একবার চরম বিপদের কারণ হয়েছিলেন। আমি কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজে পড়াতে যাই। যে কলেজে তিনি দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন। অধ্যাপক মহলে ঈর্ষার কারণে নানা সত্যমিথ্যা গল্প চালু ছিল তাঁকে নিয়ে। কিন্তু আমি তো তাঁর লেখা পড়ে মুগ্ধ। আর এ-টুকু কিছুকাল পড়িয়েই বুঝেছি, সহকর্মীদের চোখ দিয়ে সহকর্মী ও বৌয়ের চোখ দিয়ে স্বামীকে বা স্বামীর চোখ দিয়ে বৌকে বিচার না করাই ভালো।
সরকারি কলেজে ফাইল হয়। ফাইলের ওপরে দেখি সুধীর চক্রবর্তীর নাম কেটে আমার নাম বসানো। আমি চলে গেলে যিনি আসবেন, তাঁর নাম বসবে। দেখে তো আমি থ। ভাগ্যিস তখনো তাঁর ভাষণ শুনিনি, শুনলে তো পড়াতেই পারতাম না হীনম্মন্যতায়।
তো ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুন। পরীক্ষার পাহারা দিচ্ছি ১০ নম্বর ঘরে। আমার সঙ্গে ডিউটি পড়েছিল শুভলক্ষ্মী পাণ্ডে দিদির। ইতিহাসের অধ্যাপিকা। প্রচুর বই পড়তেন। শুভদির হাতে সেদিন দেখি 'নির্বাস'। সুধীর চক্রবর্তীর লেখা। শুভলক্ষ্মীদি সুধীরবাবুর খুব প্রিয় জানতাম। শুভলক্ষ্মীদিকে বললাম, বইটা দাও। পড়ি। তোমার এখন থাকার দরকার নেই। আমি হলে আছি। তখন কড়া পাহারা দেওয়ার জন্য আমার খুব কুখ্যাতি। একটা ছেলে দেখি, দেখতে সুদর্শন, খুব বিরক্ত করছে। টুকলি উদ্ধার করলেও আবার ম্যানেজ করে ফেলছে। আমি চেয়ার থেকে উঠে ওর পাশে গিয়ে বসে বই পড়তে শুরু করলাম। ছেলেটি আর টুকতে পারলো না।
পরীক্ষা শেষ। ফিরছি। কলেজ গেট থেকে রিক্সা ধরলে ছয় টাকা। আর নেদেরপাড়ার মোড় থেকে ধরলে শেয়ারে মেলে। দেড় টাকা করে তিন টাকা। কম বেতন। হাজার আষ্টেক টাকা। তার উপর ভাষা ও চেতনা সমিতি করি। সংগঠনের খরচ চালিয়ে মাসের শেষে পকেটে কিছু থাকে না। তখন কৃষ্ণনগরে শেয়ারে রিক্সা চাপা যেতো। এ-নিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে একটা বিখ্যাত গান আছে।
রিক্সায় ফিরছি। দেখি এবং শুনি রাণাঘাট কলেজের একদল ছেলে আমাকে দেখে খুব গাল দিচ্ছে। তাকিয়ে দেখি, সেই ছেলেটি মধ্যমণি। তা স্টেশনে এসে পিছনের দোকানের কাছে দাঁড়িয়েছি। ছেলেটি দলবল নিয়ে হাজির। আমাকে খুব গালাগাল চললো। বললো, ওদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিয়েছি টুকতে না দিয়ে। কয়েকজন ওদের সমর্থন করলেন। ছি ছি টুকতে দেয় নি, ছেলেগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে। আমি প্রতিবাদ করলাম, কী বলছেন, এভাবে পরীক্ষা হয়।
আমরা টুকছি তোর বাপের কী? বাকিরা তো কিছু বলে না, তোর কেন এতো-- বলে মারতে শুরু করলো দলবল মিলে।
কিছুদিন আগেও ছাত্র রাজনীতি করেছি, সাংবাদিকতা পেশা ছেড়েছি, কিন্তু একটু আধটু করতেই হচ্ছে, আমিও রুখে দাঁড়ালাম। দু এক ঘা পাল্টা দিলাম। সবাই বিপক্ষে। শুধু এক গরিব মহিলার কন্ঠস্বর শোনা গেল, 'কলেজের মাস্টারকে মারছে। আর তুমরা দেঁড়িয়ে দেঁড়িয়ে দেখছো। মেয়েছেলের অধম সব'। 'মেয়েছেলের অধম' বলাতে হয়তো কয়েকজন রেলযাত্রীর সম্বিৎ ফিরলো। এরপর থানায় ডায়েরি হলো। কাগজে বের হলো। কিছুই হলো না। শেষে অন্নদাশঙ্কর রায়, অশোক মিত্র, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, কুমার রায়, অমিয় বাগচী, দেবেশ রায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় সহ ৩০ জন চিঠি লিখলেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে। এ-চিঠি লেখায় উদ্যোগ নিয়েছিলেন নবব্যারাকপুর একুশে স্মরণ মঞ্চের মানিকদা, অধীরদা আর প্রেমানন্দ রায়দা।
ছেলেটি ধরা পড়ল পরে। সে আরেক গল্প। পরে বলবো।
এই 'নির্বাসে' একটি ঘটনার কথা লেখেন সুধীর চক্রবর্তী। অশোক মিত্র চিঠি লেখেন সুধীরবাবুকে বিশদ জানতে চেয়ে। আমি সুধীরবাবুর বাড়ি গিয়ে সে চিঠি পৌঁছে দিই। এক বিকেলে। অশোক মিত্র চেয়েছিলেন, যে কাহিনি তিনি লিখেছেন, যাঁদের নিয়ে লিখেছেন তাঁদের ঠিকানা ও যোগাযোগ করতে।
তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে।
সে উত্তর আসে নি।
এটা বেদনাদায়ক।
সত্যের সঙ্গে গল্প মিশে গেলে মুশকিল।
২০০৬ এর ১৫ সেপ্টেম্বর ১৫ সেপ্টেম্বর চন্দননগর সরকারি কলেজে বাংলা বিভাগের পুনর্মিলন উৎসবের আয়োজন করেছি। উৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানালাম। এলেন। বললেন ঘন্টাখানেক। এরপর কথা হয়েছে 'আরেক রকম' পত্রিকায় লেখা নিয়ে। অশোক মিত্রের হয়ে তাগাদা দিয়েছি। কথা হয়েছে কলেজ স্ট্রিটের মেস জীবন নিয়ে, বাউল সঙ্গ নিয়ে।
কথা এখনও হবে।
মনে মনে।