কেনা জানে সব গল্পের একাধিক ফ্যাকড়া বা বয়ান থাকে। গ্রামের কচে ভাই সহস্র এক আরব্য রজনীর ঢঙে গল্প বলতেন। প্রতিটি গল্প শেষ হতো এক টানটান রহস্য রেখে। কচে ভাইয়ের গল্প বলার মজুরি ছিল সামান্য। কয়েকটি বিড়ি।
ভূমিজ পদবী ছিল কচে ভাইয়ের। কত শত মাটির গল্প ছিল অলৌকিকতা রোমান্টিকতা আর রহস্য মোড়া। বাবার এক বন্ধু সেগুলো নথিভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু তা এক অজানা কারণে গত ২০ বছর খাতা বন্দি।
আমাদের বিরিয়ানি গল্পের ফ্যাকড়াটি এইরকম। সবার মুরগির মাংস জোটেনি। তখন ১৯৮৫, শত শত পোল্ট্রি হয়নি আর অলিতে গলিতে মুরগির মাংসের দোকান সকাল সন্ধে খুলে বসেনি।
কয়েকজনকে ডিমের ঝোল ভাত খেতে হয়েছিল। তার মধ্যে নাকি আম্মো ছিলাম।
তা খাওয়া দাওয়া শেষে দুই কিলোমিটার পথ হেঁটে সুরে বেসুরে গান গাইতে গাইতে হোস্টেল ফেরা। তখন ভালোই রাত হয়েছে। সব কটা সিনেমা হলের নাইট শো শেষ। দোকানপাট ঝাঁপ বন্ধ।
আমাদের কলেজের তখন পাঁচিল হয়নি। বিরাট মাঠ ছিল। পাশে একটা বড় পুকুর। সেই মাঠে গিয়ে বসতে হলো।
কেন?
ছোটরা ঠিক করেছে, দৌড় প্রতিযোগিতা হবে।
পাগল এত রাতে দৌড়? যা সব!
আরে ন্না, তোমাদের দৌড়তে হবে না। শুধু দুজন দৌড়াবে।
মইনুল আর তারক।
তারক জেলা চ্যাম্পিয়ন। মইনুল ওর সঙ্গে পারবে? চল, ঘুমোবি সব।
মইনুল বললে, ভাই তুমি চুপ করে থাকো। দেখোই না আমার খেল।
দৌড় শুরু হল।
আমাকে দু একজন ঘিরে গল্প করতে লাগলো। দৌড় যাতে দেখতে না পাই।
এক দৌড়ে তারক মাঠের ওই প্রান্তে পৌঁছে গেছে দেখে নিয়েছি। এবার ফিরবে।
একটু পরেই দেখি, চিৎকার।
তারক হেরে গেছে। মইনুল জিতে গেছে।
কী ব্যাপার মইনুলকে তো দেখিনি তারকের ধারে কাছে।
পরে যা বুঝলাম, মইনুল মাঝ মাঠ গিয়েই ফিরে এসেছে। এটাই সবাই মিলে পরিকল্পনা করে ঠিক করেছে।
তারক মাঠের উত্তর প্রান্তে পৌঁছে ফিরেই দেখে মইনুল মাঝমাঠের পরে দক্ষিণ প্রান্ত তথা শুরুর দিকে দৌড়াচ্ছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সবাই বলছে, মইনুল ফার্স্ট। আজ তারক পারে নি।
তারক কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে এসে বলল, তুমি বলো কে ফার্স্ট হয়েছে?
সবাই বলছে, ও কী করে বলবে, ওতো গল্প করছিল।
আমি পড়লাম মহাঝামেলায়।
তারককে হারানো কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
টিউশন করে চালায় । আমিই হোস্টেলে থাকার ও কয়েকটি টিউশন দেখে দিয়েছি।
খুব ভালো ছেলে। সকালে অঙ্কুরিত ছোলা খেয়ে অন্তত ১০ কিলোমিটার ছোটে।
মইনুল তারক অনাথ জইনুল কিবরিয়া সবাই এন আর হোস্টেলে থাকতো। পরিত্যক্ত হোস্টেলে আগে একা বাবরদা থাকতেন আর কিছু কর্মচারী। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সীতা মাসি। কলেজের কর্মী। পরিষ্কার করার দায়িত্বে। আমাকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতেন। এটি পূজায় আমাকে খাওয়ালেন। বলতেন, আমার শিউজি।
মাঝে মাঝে পরোটা করে আনতেন। খাবি তুই, সবাইকে দিয়ে দিবি না।
সীতা মাসির সঙ্গে আমার জীবনের একটা বড় গল্প আছে। পরে বলতেই হবে।
তো তারককে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ওদের কথা ছাড়।
তোকে কে হারাবে?
তারক বলছে, আরেকবার দৌড়াতে হবে। তুমি জাজ হবে। বাকি কারও কথা মানবো না।
তুমি বললেই আবার দৌড় হবে।
ও তো জানে না, সবাই ওকে ক্ষ্যাপাবার জন্য এই সব করেছে।
সত্যি দৌড় হলে মইনুল কেন, কেউ পারবে না।
ফলে ওরা রাজি হলো না।
তারক কোথায় আছে কে জানে?
হোস্টেলের মন্টুদা বিডিও হয়েছিল। গণিতের। দেবাশিস চট্টোপাধ্যায় পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনে ইংরেজির নামী শিক্ষক। সদ্য অবসর নিল। প্রজিত পড়ায় আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতিহাস।
অনাথ ইংরেজিতে ভালো ছাত্র। আমার জীবনে বহু মানুষের অবদান। দেবাশিসদা আমার শক অ্যাবজরবার। অনাথ আমি খেতে না গেলে খাবার নিয়ে এসে থাকতো। আমি ওদের সঙ্গে খেতাম। টিউশন করে আমি পাঁচ লিটারের একটা হকিন্স প্রেসার কুকার কিনেছিলাম ১৯৮৪ তে। ২২০ টাকা দামে। কিস্তিতে। প্রথমে ৬০ টাকা তারপর প্রতি মাসে ২০ টাকা।
আমি বাবার সঙ্গে জেদ করে ১৯৮৩ থেকেই আর টাকা নিতাম না।
ওই প্রেসার কুকারে ভাত ডিম আর আলু সেদ্ধ। বেশিরভাগ দিন।
যেদিন ডাল হতো, অনাথ বলতো আগে আসবি। একসঙ্গে খাবো।
পরে সবার টিউশন পড়ার চাপ বেড়ে গেলে একজন রান্নার লোক রাখা হল।
সেলিম বলে পাশের বসতিতে একজন থাকতো। নেশারু। বউ খুব ভালো মেয়ে। বউকে খেতে দেয় না। আমি তখন ওই বসতিতে নৈশ স্কুল করে পড়াই। এবং পার্টি করি। সবাইকে চিনি। ৫২ টা ঘরকেই। সবার সঙ্গে আত্মীয়তা। সেলিমের বউকে রাখা হলো।
এবার ডিম আলুর ঝোল ডাল হলো। তিনি সবেতেই শুধু হলুদ দেন।
মুসলিম মেয়ে ভালো রান্না জানবে বলে সবার আশা।
একদিন মুরগির মাংস করা হয়েছে। তখন ১৫ টাকা কিলো মুরগি। দু কিলো মাংস। সবার মন খুশ।
ওমা খেতে গিয়ে দেখি, এতেও শুধু হলুদ। আর কোনও মশলা দেননি।
বুঝলাম, গরিবের মেয়ে, হলুদ ছাড়া আর কোনও মশলার ব্যবহার জানেন না
মনটা খারাপ হয়ে গেল, দেশের মানুষের কী করুণ দশা।
আর কোনও মশলার ব্যবহার জানেন না।