আমাদের স্বপ্ন ছিল ছোট ছোট।
লন্ডন নয়, লন্ঠনের বদলে টেবিল ল্যাম্প। বড় নয় সরু হবে কাচ।
নিমন্ত্রণ বাড়িতে লেবু নুন পাতা বিলি করতে দিলে আনন্দ স্বর্গীয়।
স্বপ্ন দেখতাম কবে বড় হয়ে, কোমরে গামছা বেঁধে নিমন্ত্রণ বাড়িতে পরিবেশন করবো?
তার আগের ধাপ ছিল, আসন পাতা। আসন পাতার আগে জল ছিটিয়ে দেওয়া। জল ছিটানোর আগে ঝাঁট।
এগুলো করতে দিলে মনে হতো, পদোন্নতি হচ্ছে।
বড়দের স্বীকৃতি মিলছে।
আরেকটা স্বপ্ন ছিল, আমরাও কাঁধে করে কাউকে আট কিলোমিটার দূরে রায়না হাসপাতালে নিয়ে যাব। সারারাত জাগবো।
কাঁধে করে রায়না হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ছাড়া সব কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।
হাসপাতালে রাত জেগেছি বহু। বর্ধমান, কলকাতায়।
গাছতলায় বসে বা ঘুমিয়ে কাটিয়েছি আমরা।
শ্মশান, কবরস্থানে গিয়েছি।
কাঁধে করে বয়েছি দেহ। আমরা।
দুর্ঘটনায় পড়া রক্তাপ্লুত দেহ নিয়ে ছুটেছি আধ কিলোমিটার।
আমি। আমরা।
আমাদের বেড়ে ওঠা তো এইসব হাতে হাত রাখার নিয়মে।
কিন্তু ছোটবেলায় আমরা ছিলাম খুব যুদ্ধপ্রিয়। বলা ভালো যুদ্ধপ্রেমী। ঐতিহাসিক যাত্রা বড়দের ভালো লাগতো না, কিন্তু, আমাদের, ছোটদের ছিল অসম্ভব পছন্দের।
গ্রামের দিকের যাত্রা শুরু হতো কোনও কারণ ছাড়াই বেশি রাতে।
পেন্টার চলে এসেছে প্রধান চরিত্রকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর অতিরিক্ত উদ্বেগে গলা খুসখুস। যাকে বলে, গার্গল, করেই যাচ্ছে করেই যাচ্ছে।
বা খলনায়ক নেই।
আমরা তো ভোর থেকে জায়গা দখল করে এসেছি। তালাই বা চট বা শতরঞ্জি বিছিয়ে রেখে এসেছি। পাহারাও চলছে। যাতে কেউ সরিয়ে দিতে না পারে। মঞ্চের কাছে না বসলে ভালো করে সব দেখা যায় না।
সারাদিনের অতিরিক্ত পরিশ্রমে যাত্রা শুরু হওয়ার কিছু পরেই চোখ খুলে রাখা দায় হতো। বড়দের বলে রাখতাম, যুদ্ধের দৃশ্য, আমাদের ভাষায়, সিন, এলেই জাগিয়ে দিতে। কেরিচু কেরিচু ক্যাঁ বলে একটা বাজনা বাজতো। আর তলোয়ার নিয়ে সে কী লড়াই। একটু পড়তে পারার পর থেকেই যাত্রার বইগুলো আমার মুখস্থ হয়ে যেতো। কোন বই ( যাত্রা) এবার ধরা হবে, সে-নিয়ে চর্চা শুরু হয়ে যেত মাঘ মাসের যাত্রা শেষ হওয়ার পরদিন থেকেই। কিন্তু মহলা সেই আশ্বিন কার্তিক মাসে। তার আগে কত পালা দেখা পড়া চলতো। বই পড়া আর তার সঙ্গে রোজ সন্ধ্যায় মহলা দেখা-- এই নিয়ে বই তো মুখস্থ হবেই। তবু আমরা যাত্রার কোন দৃশ্যে কার প্রবেশ বা ঘটনার সারাংশ, দলের নাম যাত্রার নাম, রচনাকারের নাম, নির্দেশক, সুরকার, পোশাক ও বাজনা দলের নাম, আলোদাতা, মানে হ্যাসাক পেট্রোম্যাক্সওয়ালার, স্মারক বা প্রম্পটারের নাম, চরিত্র ও চরিত্রাভিনেতার নাম দিয়ে লিফলেট বের হতো। লিফলেট নয়, অন্য কিছু নাম ছিল। এখন মনে পড়ছে না। সেটা ১০ পয়সা দিয়ে কিনতাম। বহু সংগ্রহে ছিল। যাযাবর জীবনে সব হারিয়েছি।
কারও কাছে আছে?
অমূল্য এই সম্পদ।
তা যুদ্ধের দৃশ্যে জাগিয়ে না দিলে তুলকালাম। আমাদের পিসি, বড় সরল মানুষ। যাত্রার সঙ্গে একাকার হয়ে যেতেন কেঁদে হেসে ভাসিয়ে দিতেন। তাঁকে দায়িত্ব দিলে ভুলে যেতেন। যাত্রার পরদিন আমরা দু ভাই এবং পাশের বাড়ির ছেলেরা ও বন্ধুরা মিলে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তলোয়ার বানিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা খেলতাম। ঐতিহাসিক পালায় বন্দুকের ব্যবহার তেমন ছিল না। সেগুলো সামাজিক পালায়।
আট আনা একটাকা দিয়ে খেলনা বন্দুক কিনতাম। গুলি করার খেলা খেলতাম।
তারপর যখন রাশিয়ান বই পড়তে শিখলাম, ইশকুল ইত্যাদি, জাহাজ বানিয়ে পুকুরে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা।
কয়েকটি কলাগাছ জুড়ে ভেলা, সেই ভেলা থেকে আরেক ভেলার কাছে গিয়ে বাঁশের কঞ্চির তলোয়ার দিয়ে লড়াই।
রাম লক্ষ্মণ সেজে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তীর ধনুক বানানো তো সত্তর আশির দশকের ছোটদের প্রিয় বিষয়।
একটু বড় হতে বুঝলাম যুদ্ধ খারাপ।
তার আগে বন্দুক যে ভালো নয়, সেটা কেন্দ্রীয় বাহিনী, তখন বলা হতো, সিআরপি, তাদের বাড়ি বাড়ি অভিযান দেখে শিখেছি।
কংগ্রেস সত্তর দশকে এলাকায় শান্তিবাহিনী গড়েছিল।
সেই শান্তিবাহিনীতে একজন প্রাক্তন সিপিএম থেকে নকশাল, নকশাল থেকে কংগ্রেস-- একজন পাইপগান হাতে গ্রাম টহল দিতেন।
বিরক্তির সেই শুরু।
গ্রামে একবারই বোমা পড়ে ১৯৭২-এ।
কাচের পেরেকের টুকরো পড়ে থাকতে দেখছি।
এইসব দেখে বাড়িতে বাবা দাদা এবং পার্টির কমরেড কাকুদের কাছে শুনে যুদ্ধ খারাপ কিন্তু বিপ্লব ভালো বুঝলাম।
এখন ভাবি, অস্ত্র ছাড়া কী করে বিপ্লব হতো?
যুদ্ধবিরোধী গান শুনতাম বাবার মুখে। শান্তি কাকুদের কাছে। পার্টির জনসভায়। ছাত্র ফেডারেশনের বৈঠকে।
নিজেও বেসুরো গলায় গাইতে লাগলাম।
এরমধ্যে নবম শ্রেণিতে পেলাম সীতেশবাবুকে। সীতেশ দত্ত। ছোটখাটো শান্ত শিষ্ট মানুষ। প্রধান শিক্ষক যতটা দাপুটে সহকারী প্রধান শিক্ষক ততটাই নিরীহ।
তিনি পা ঠুকে ঠুকে ইংরেজি কবিতা পড়াতেন। তখন মজা পেতাম। এখন, সেদিন, ৪৫ বছর পরও দেখলাম, বন্ধুদের সবার মনে আছে সীতেশবাবুর পড়ানো ইংরেজি কবিতাগুলো।
উনি পা ঠুকে ঠুকে বলতেন, আমরাও গ্রামে এসে অন্যদের শোনাতাম নকল করে।
কিন্তু এখন বুঝি, পড়াটা উনি আনন্দের সামগ্রী করে দিয়েছিলেন । ভার করে তোলেননি।
একটা যুদ্ধবিরোধী কবিতা পড়িয়েছিলেন, হোম দে ব্রট হার ওয়ারিয়র ডেড।
যুদ্ধ যে রোমান্টিক নয়, যুদ্ধ মানে মৃত্যু, যুদ্ধ মানে সৈনিক ও সৈনিকদের পরিবারের কাছে চরম যন্ত্রণা শিখিয়ে দিয়েছিলেন সীতেশবাবু।
এরপর তো কোজিনেৎসেভের 'হ্যামলেট' দেখেছি, যুদ্ধক্লান্ত সেনাদের পা টেনে টেনে চলা। পড়েছি, কলেজে, বার্নার্ড শ'-র যুদ্ধ ও অস্ত্র বিরোধী নাটক, আর্মস অ্যান্ড দ্য ম্যান, এরিখ মারিয়া রেমার্কের 'অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট', 'থ্রি কমরেডস', দেখেছি, ওয়ার অ্যান্ড লাভ, ওয়ার অ্যান্ড পিস ( পড়েছিও)।
যুদ্ধ মানে রোমান্টিকতা নয়, হিংস্রতা, ধ্বংস আর অমানবিকতার উল্লাসধ্বনি শিখিয়েছেন সীতেশবাবু, কমিউনিস্ট পার্টি এবং আরও অনেক শিক্ষক।
তাঁদের অন্যতম রাধারমণ মণ্ডল। বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল স্কুলের বাংলার শিক্ষক।