আমি একবার ইস্কুলের জানালার বাঁশের কঞ্চির শিক ভেঙে পালিয়ে পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। গুটিবসন্তের টীকা নেওয়ার ভয়ে। সেটা ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। ক্যাম্বিসের ব্যাগ নিয়ে একজন স্বাস্থ্যবান মানুষ আসতেন গ্রামে। বিরাট গোঁফ। আজম বলে, ওর মনে হতো, এই আসল যমদূত। আজরাইল। মানুষ সেজে আসতো। তাঁর ব্যাগে টিটেনাসের ইঞ্জেকশন। নিতে হতো। কাটা ছেঁড়া দেখলেই ফুঁড়ে দেন। ইঞ্জেকশন নিয়ে বেদম জ্বর।
আর তখন তো রোজ কাটা ছেঁড়া। দুই পায়ের মাঝের আঙুলের নখ তো প্রায় কারুরই থাকতো না। ঘটিং-এ লাগতো। বা শুকনো উঁচু এবড়ো খোবড়ো রাস্তায়। তখন তো পিচের পাকা রাস্তা বা কংক্রিটের হবে গ্রামে কেউ স্বপ্নও দেখেনি। উদাসীন পথ চলি। রাস্তায় কাগজ ঠোঙা পেলে কুড়িয়ে কুড়িয়ে পড়ি। পড়ার তীব্র খিদে। এ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরি। বই জোগাড় করি। এতো বই কোথায়? একবার, রায়নার কাছে হামিরপুরে মায়ের খুড়তুতো বোনের বাড়ি গিয়েছিলাম। কতো কতো পুঁথি। সেই প্রথম পুঁথি পড়া। চালের বাতায় গোঁজা ছিল। ডানদিক দিয়ে লেখা।
আরবি কায়দায়।
পুঁথি পড়ার খুব ইচ্ছে। কেউ সন্ধান দিতে পারেন?
তা রাস্তায় কাগজ পড়ার সুবিধার কথা তো বলেছি, আলেকজান্ডারের মায়ের নাম কী? অলিম্পিয়া। এটা জানানোর কথা পাঠকের জানা। সেকালে গল্পের বইকে বলতো, আউট বই।
আউট বুক পড়ায় নাম জোটে।
লোকে বলতে লাগলো, ব্রেনি ছেলে। সেকালে বুদ্ধিমান নয়, ব্রেনি বলা হতো।
তো সেই যমদূত দেখি থ্রিতে টীকা দিয়ে আমাদের দ্বিতীয় শ্রেণিতে ঢুকছে। একটু আগে বাবারে মা রে, মেরে ফেললে রে-- শুনেছি।
ইঞ্জেকশনে আজও ভয় করে, আর এ ব্যাটা হাতে ফুটফুট করে একবার নয়, পাঁচ সাতবার ফোটাবে।
যমদূতকে দেখেই আমি জানালার বাঁশের কঞ্চির শিক ভেঙে ঝাঁপ দিয়েছি। বাঁকা পুকুর ছিল পাশেই। পুকুরের পাড় গড়ানে হয়। গড়িয়ে গড়িয়ে পুকুরে।
কাজী পাড়ার মাস্টারমশাই ছিলেন ছেলেধরার মাস্টার। কেউ স্কুল না এলে তার বাড়িতে চার পাঁচজন ষণ্ডা ছেলে পাঠিয়ে দিতেন।
যা ধরে আন।
চ্যাংদোলা করে ধরে আনতো সব।
তো আমাকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হলো পুকুরের জল থেকে।
মাথায় গায়ে জলে ভর্তি।
ওই অবস্থায় একটু মুছিয়ে দেওয়া হল টীকে।
আমরা টীকেই বলতাম।
কাজীপাড়ার মাস্টার মশাইয়ের সামনে শম্ভুবাবু বললেন, তুই না চে গুয়েভারা হবি, বিপ্লবীরা কি ভয় পায়?
তো, চে গুয়েভারার নামে নিজেকে সাহসী দেখাতে হলো।
কিন্তু মনে মনে ভাবলাম, শ্লা, আজরাইল, তোকে ফাঁকায় যদি পাই গুলতি মেরে গোঁফ খুলে নেবো।
টীকার জেরে খুব জ্বর এলো।
পুকুরের লাফ ঝাঁপ করে টীকার শোক ভোলা গেল।
করোনা ভ্যাকসিন টীকার কথা মনে করিয়েছে।
পুকুরে একটা জনপ্রিয় খেলা ছিল: ঝালঝাপটা।
মানে পুকুরের পাড়ের গাছ থেকে জলে ঝাঁপ দেওয়া। একজন পাহারাদার। ধরবে।
সেই খেলা খেললাম সব টীকে ওয়ালারা। জল শান্তি দিল। বাড়িতে বললো, জলের জন্য জ্বর।
আমরা বুঝি, টীকের জ্বর।
জল জ্বালা ভুলিয়েছে।
ঝালঝাপটা খেলায় একজন পাহারাদার। বাকিদের কাজ জলে ঝাঁপ দেওয়া। পাহারাদারের ছোঁয়া এড়িয়ে। তবে সময় সময় পাহারাদার গাছেও উঠতো পারতো। তাঁর সামনে তিনটে পছন্দ।
এই ছড়া বলা হতো:
ঝাল ঝাপটা, পানের বোঁটা
রাখাল ছেলে কি লেঙ্গা?
সর্ব লিঙ্গা/পানি লিঙ্গা/ গাছ লিঙ্গা?
মানে কোথায় কোথায় গিয়ে ছোঁবে খেলিকে?
সর্বলিঙ্গা? সব নেবে?
জল/ পানি?
না গাছ?
পাহারাদারের কাজ বলা।
এই ঝালঝাপটা খেলতে খেলতে একবার তালপুকুরে পায়ে কাচের ভাঙা বোতল ঢুকে গেল।
ইঞ্জেকশনে নেওয়ার ভয়ে কাপড় বেঁধে ছিঁড়ে গেছে বলে চালানো হল।
খুব কষ্ট গেল কদিন।
পায়ের তলা কাটা অনেকটা।
পুনশ্চ: সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার বসন্ত হয়। যদিও সেটা গুটি বসন্ত নয়। বসন্তের টীকার দাগ কিন্তু বয়ে বেড়াচ্ছি।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আরেকটি গল্প খুব মনে পড়ছে। লেখা যাক।
বল, কে বিয়ে করবি? যোগ্যতা কী? মাস্টারমশাইয়ের
প্রশ্ন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ছাত্রদের দুজনকে।
স্বাধীন দেশে রাজা এবং প্রজার ধারণা এক মানসিক দাসত্ববৃত্তি থেকে আসে। তাই সাধারণতন্ত্র না বলে প্রজাতন্ত্র দিবস বলেন কেউ কেউ। । আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খুব ঘটা করে পালন হতো ২৬ জানুয়ারি ও ১৫ আগস্ট। প্রধানশিক্ষক ছিলেন আমার বড়োমামা। কংগ্রেসের বড়ো নেতা। বোঁদে দেওয়া হতো। পতাকা তোলার পর গোটা গ্রাম মিছিল করে ঘোরা শেষে। মাঝপথে কেউ যাতে না পালায়, তাই শেষে মিষ্টি। আমরা সিপিএম বাড়ির ছেলে। পিছনের দিকে থাকতাম। বন্দে বলে আওয়াজ উঠলেই আলতো করে বলে উঠতো কেউ কেউ, বোঁদে ছাগলের পোঁদে।
তবে বোঁদে খাওয়ার সময় এ-সব কারও মনে থাকতো না। আমার মনে পড়ে না জুনিয়র হাইস্কুলে এ-সব পতাকা উত্তোলনের রেওয়াজ ছিল কি না! তবে সেহারা স্কুলে পড়ার সময় বেশ ভিড় হতো। ছাদে। বক্তৃতাও হতো। মিল মালিকের ছেলে কংগ্রেসের অবদান বললে, তেড়ে আধঘন্টা বক্তৃতা করে ধুইয়ে দিয়ে বলেছিলাম, ইয়ে আজাদি আধা হ্যায়।
টাটা বিড়লা গোয়েঙ্কারা দেশ লুঠছে। তখন তো আদানি আম্বানিদের দেখি নি। তাহলে কী বলতাম জানি না। তখন বলেছিলাম, মাথাপিছু ৬০০ টাকা ঋণ।
এখন দেশের ঋণ ধরলে মাথা পিছু দুই লাখ টাকা।
কিন্তু কোনও বক্তব্যে সে-সব আসে না।
কেন? কে বলবে!
আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মান খুব ভালো ছিল। সুনীল হাজরা, শম্ভুনাথ থান্দার, কুর্চিগড়ের মাস্টারমশাই অসাধারণ ছিলেন। খুব অনুপ্রাণিত করতে পারতেন। মাস্টারমশাইদের এক দুজন করে প্রিয়পাত্র থাকতেন। সুনীলবাবুর যেমন সেলিম মামা ও আজম। আমি শম্ভুবাবুর।
ছাত্রদের নিয়ে খুব আশাবাদী ছিলেন মাস্টারমশাইরা।
কাজীপাড়ার মাস্টারমশাইয়ের কোনো বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিল না। সবার কাছে তিনি বন্ধু। সম্পর্কে দাদু হতেন। ভূগোল পড়াতেন। মজা লাগতো। অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ড আমেরিকা-- এমন ভাবে হাত দেখিয়ে দেখাতেন, মনে হতো পাশের পাড়া। অ্যাটলাস ছিল একটা বড়ো মাপের। তাতে দেখাতে হতো।
ম্যাপ টাঙিয়ে দিতেন। লাঠি দিয়ে নির্দেশ করতে হতো কোথায় কোন সাগর। ভারত মহাসাগর, আরব সাগর, ভূমধ্যসাগর।
আমার মনে হয় কাজীপাড়ার মাস্টারমশাই, আজমের মনে আছে সুনীলবাবুকে। আমাদের ক্লাসে একজন সুন্দরী মেয়ে পড়তো। পড়াশোনায় ভালো। বড়োলোকের মেয়ে। তার প্রেমে পড়ে পাগল অনেকেই। আমাদের ভাগ্নি হয়। আমি আজম কাজেই ওই দলে নাই। দুজন প্রকাশ্যেই বলতো। এবং মারামারিও করতো প্রায়ই। এটা কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণির ঘটনা।
একদিন খুব মারামারির পর মাস্টারমশাই ক্লাসে এসে বললেন, এর একটা নিষ্পত্তি দরকার। তোরা দুজনে বল, তোরা যে বিয়ে করবি, তোদের যোগ্যতা কী?
একজন বলল, আমার বাপের তিনটে বড়ো মড়াই। আরো দুটো ছোটো হয়। এতো বিঘে জমি আছে।
দ্বিতীয় জন বলল, আমার দাদো ব্রিটিশ। আমি ওকে ইংল্যান্ড নিয়ে যাবো।
ব্রিটিশ মানে তিনি ইংরেজ সেনাবাহিনীতে সৈনিক ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়েছেন। পেনশন পেতেন। সবুজ রঙের একটা উর্দি পরে ঘুরতেন। ওই এক পোশাক। আর কিছু পরতেন না।
মজার মানুষ।
তা মেয়েটির মতামত চাওয়া হয় নি।
আজকের দিনে এইসব হলে কী যে হতো!