সত্তর দশককে বলা হতো মুক্তির দশক। নব্বইয়ের দশক উদারীকরণের দশক। আশির দশক?
আমার মতে, পিছনে ফেরার দশক, প্রতিক্রিয়ার দশক।
আশির দশকে বহু ঘটনা ঘটে যার প্রতিফল আজ মিলছে এবং সেই সময়টাকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ ও ব্যবহার করতে না পারার বিষফল ভোগ করতে হচ্ছে।
১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট এল রাজ্যে। দেশে তখন জনতা সরকার। দিল্লিতে বামফ্রন্ট জনতা সরকারকে সমর্থন করছে। রাজ্যে জনতা দল ও কংগ্রেসের সঙ্গে জোর লড়াই। বলাই হয়, ১৯৭৭-এ জনতা দলের প্রফুল্লচন্দ্র সেন এবং সেই দলে থাকা সঙ্ঘ পরিবারের হরিপদ ভারতীরা গোঁয়ার্তুমি না করে কয়েকটি আসন বেশি ছাড়লেই রাজ্যে জনতা দল ও বামফ্রন্টের কোয়ালিশন সরকার হতো। এবং সেই সরকারে জ্যোতি বসু এবং হরিপদ ভারতী দুজনেই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হতেন।
বর্ধমানে কিন্তু জনতা দল, কংগ্রেস, এবং আর এস এস একযোগে সিপিএম বিরোধী।
এর প্রতিফলন দেখা গেল, ১৯৮২-র কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচনে। বেশিরভাগ জায়গায় সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এস এফ আই হেরে গেল। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের জেলা শহরগুলোতে। বর্ধমান রাজ কলেজ এবং বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটোতেই হারল বামপন্থীরা। বিবেকানন্দ কলেজ, মহিলা কলেজেও। মহিলা কলেজে বরাবরই ছাত্র পরিষদের প্রভাব।
বিভিন্ন স্কুলের পরিচালন সমিতি নির্বাচনেও বামপন্থীরা হারলেন। যদিও কিছুদিন আগেই বিধানসভার নির্বাচনে তাঁরা জিতেছেন বহু আসনে।
আসলে, গ্রাম বাংলায় তখন বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে। প্রগতিশীল পদক্ষেপ নেন বামপন্থীরা। এক, পঞ্চায়েতে গরিবের খানিকটা প্রতিনিধিত্ব। দুই, খেতমজুর আন্দোলন। এতে মজুরি বৃদ্ধির দাবি ছিল। বহু জায়গায় টানা দুই মাস ধর্মঘটও চলে। তিন, সহজপাঠ বিতর্ক। সেখানে রবীন্দ্রনাথের বইয়ে খেটে খাওয়া মানুষকে ঠিকভাবে সম্মান দেওয়া হয়নি বলে সহজপাঠ বাদ। চার, বাঙালি মধ্যবিত্তের সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়, প্রাথমিক থেকে ইংরেজির বিদায়।
এগুলো বামফ্রন্টের পক্ষে ভালো হয়নি, শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গিতে।
স্কুলে হয়তো এবিটিএ, দুর্গাপুরে কারখানায় সিটু, কলেজে হয়তো ওয়েবকুটা -- কিন্তু ভোটের বাক্সে তিনি বামফ্রন্ট বিরোধী।
স্কুল কমিটিগুলোর নির্বাচনে জোরদার প্রভাব পড়ল।
শিক্ষক সমাজের একটা বড় অংশ তখন বামপন্থীদের বিরুদ্ধে ভোট দেন।
কারণ বর্ধমানের বাসিন্দা ৯০ ভাগের গ্রামে জমি জমা ছিল। খেতমজুরের মজুরি বৃদ্ধি তাকে খেপিয়েছে। নিজের মাইনে বৃদ্ধির পক্ষে। কিন্তু খেতমজুরের মজুরি বাড়লে রাগ। তাঁর ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়াল, অপারেশন বর্গা।
বামফ্রন্ট সরকারের চার টি ভালো কাজ, পঞ্চায়েত, মাতৃভাষায় শিক্ষা, খেতমজুরের মজুরি বৃদ্ধি, অপারেশন বর্গা -- তখন শাঁখের করাত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রটে গেছে, ছোটলোকদের মাথায় তুলছে সিপিএম। তারা আর আগের মতো মান্যিগণ্যি করে না।
আগে খেতমজুরের দল ভোর ভোর কাজে যেত, বেলা গড়িয়ে ফিরতো, এখন সকাল আটটার সময় কাজে যায়, সওয়া তিনটার বিডিআর ধোঁয়া ছাড়তে না ছাড়তেই সব ঘরমুখো।
এছাড়া পুকুরের মাছ ধরে নিচ্ছে, বাঁশ ঝাড়ের বাঁশ কেটে নিচ্ছে দুলে বাগদির দল--এইসব অভিযোগ হরহামেশা শোনা যেতে লাগলো।
এই অভিযোগে সারবত্তা কতটা ছিল বলতে পারি না, তবে আমার মা-ও মাঝে মাঝেই বাবার আড়ালে এবং সামনে চোটপাট করতেন, পুকুরের মাছ আর থাকবে না। না বলেই মাছ সব সাবাড় করে দিলে।
ওই সময়ই সব পুকুরে পুকুরে ডালপালা সমেত কাটা বাঁশ মালিকরা ফেলতে শুরু করলেন।
মুনিষ ও মালিকে দ্বন্দ্ব বাড়ল। ব্যক্তিগত আনুগত্যের বদলে দলীয় আনুগত্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিল। গরিব মানুষের ছেলে মেয়েরা স্কুলে যেতে শুরু করলেন। আগেও যেতেন। বেশিরভাগ ছেড়ে দিতে বাধ্য হতেন, এখন ড্রপ আউট কিছুটা কমল। এবং একটু উঁচু ক্লাসে, মানে সপ্তম অষ্টম শ্রেণিতে গিয়ে দেখল গেল, প্রথম প্রজন্মের পরীক্ষার্থীরা কেউ কেউ অঙ্কে অসাধারণ ভালো করছেন। বিশেষ করে পাটিগণিতে।
সেই সময় গ্রামাঞ্চলে ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় নেই। জেলা শহরে বা খুব বড় শহরে বড় জোর একটা।
তবে দুয়েকটি বেসরকারি শিশু বিদ্যানিকেতন শুরু হল। মূলত বাংলা মাধ্যমের হলেও দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে তারা ইংরেজি পড়ায়। সরকারি স্কুলে তখন পঞ্চম শ্রেণিতে।
বর্ধমান শহরে সত্তর দশকে শিশু নিকেতন বলে একটা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়েছিল সত্তর দশকে। বামপন্থীদের উদ্যোগে। সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ইংরেজি পড়ানো হতো। বহু বামপন্থী নেতার ছেলে মেয়ে সেখানে ভর্তি হতে লাগলেন। শিক্ষক শিক্ষিকারাও অধিকাংশই বামপন্থী পরিবারের মানুষ। বিদ্যালয়টির সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষাগত সুনাম ছিল।
আর পুরোপুরি ইংরেজি মাধ্যম বলতে সেন্ট জেভিয়ার্স। সেখানে বড় ব্যবসায়ী, কিছু ডাক্তার, মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা বড় অংশের ছেলেমেয়েরা পড়তেন।
আমাদের বিদ্যালয় মিউনিসিপ্যাল স্কুল তখন শতবর্ষের দোরগোড়ায়। জগদীশচন্দ্র বসু এই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। ১৯৮২ পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছর কেউ না কেউ এক থেকে কুড়ির মধ্যে থাকে মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকে।
সেই বিদ্যালয়ে ১৯৮২-র পরিচালন সমিতির নির্বাচনে হেরে গেল সিপিএম।
এমনিতেই বর্ধমান দক্ষিণ তথা শহরের আসনে বিনয় চৌধুরী জিতলেও তিনি শহরে হারতেন, গ্রামের বুথে গিয়ে জিততেন।
যদিও আগে একবার তিনি বর্ধমানের মহারাজাকে হারিয়ে দেন।
তারপর থেকেই মহারাজা আর বর্ধমান শহরে থাকতেন না।
বর্ধমানের পরিচায়ক কার্জন গেটের অদূরে দিল্লি গামী জিটি রোডের বিরাট জায়গা জুড়ে আমাদের বিদ্যালয়। সবমিলিয়ে ৫২ টা ঘর।
শিক্ষক সংখ্যা ৬০ এর উপর।
ছাত্র সংখ্যা ২২০০-র বেশি। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা।
সেই বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে কয়েকজন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন প্রতি বার যেতেন। এবার সংখ্যা একটু বেশি। প্রায় ১০ জন। আরও ১৫ জন পাশের সিএমএস স্কুলে।
স্কুলে একটু মনমরা ভাব।
ভালো বিদ্যালয় শিক্ষক এবং পরিচালন সমিতির দলাদলির জেরে ডুবতে বসেছে --এইরকম হা হুতাশ চারদিকে।
আমার নরেন্দ্রপুর মিশনে পড়া হয়নি কিছুটা আর্থিক ও কিছুটা রাজনৈতিক কারণে। ওখানে না পড়ে এখানে পড়ায় শিক্ষকরা আমাকে একটু আলাদা চোখে দেখলেও আমার ক্লাসের পড়াশোনা তেমন হচ্ছিল না।
একে যাতায়াত করে এতদিন পড়েছি। দুই, ক্লাস তেমন হতো না।
তিন, একটা ছাড়া বই আমার ছিল না। চার, বর্ধমানে অন্য স্যারেদের টিউশনে গিয়ে দেখলাম, বর্ধমান শহরে থাকা ছেলে মেয়েরা আমাদের থেকে পড়াশোনায় বহু এগিয়ে। পাঁচ মাসেই এগারো ক্লাসের পড়া শেষ করে ওঁরা কেউ বারো ক্লাসের পড়া পড়ছে, কেউ আরও এগিয়ে।
জয়েন্ট বা আইআইটির পড়া পড়ছে।
এই সময় বর্ধমানে বহু সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হতো।
বর্ধমান লায়ন্স ক্লাব, নিউটন সায়েন্স ক্লাবের প্রতিযোগিতা ছিল সবচেয়ে নামী।
এছাড়া স্টুডেন্টস হেলথ হোম, রেডক্রসের পাশাপাশি নানা ক্লাব বিতর্ক তাৎক্ষণিক বক্তৃতা কুইজ বসে আঁকো কোলাজ গল্প লেখা প্রবন্ধ লেখা কবিতা লেখা ইত্যাদি প্রতিযোগিতা করাতো।
লায়ন্স ক্লাবের এইসব বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিতেন বর্ধমান আইন কলেজের অধ্যাপক নৃপেন মিত্র। পরে যিনি বাঙ্গালোর ল কলেজের প্রথমে অধ্যক্ষ পরে উপাচার্য হন।
পণ্ডিত মানুষ।
লায়ন্স ক্লাবের প্রতিযোগিতায় সবকটি বিভাগে আমি প্রথম হয়ে গেলাম।ছয়টি বিভাগ বাংলায়। সবকটিতেই প্রথম। বিতর্ক তাৎক্ষণিক কুইজ প্রবন্ধ কোলাজ আর গল্প লেখায়।
তারপর নিউটন সায়েন্স ক্লাবের প্রতিযোগিতা। প্রবন্ধ বিতর্ক তাৎক্ষণিক বক্তৃতা এবং কুইজ। চারটি বিভাগে আমি প্রথম। পরের দিন দুপুরে স্কুলে গিয়ে দেখি স্কুল ছুটি।
কী ব্যাপার।
জয়সওয়াল বলে একটা ছেলে বলল, তোমাদের ক্লাসে ইমানুল বলে একটা ছেলে অনেকগুলো প্রাইজ এনেছে তাই হাফ হলিডে।
আমি চমকে গেলাম।
এ-রকম কখনও হয়, আমার জানা ছিল না। এই ঘটনা আমার জীবনে একটা বিরাট ছাপ রেখে গেল।
স্কুলের ২২০০ ছেলের কাছে আমার নামটা অন্তত পরিচিত হয়ে গেল।
তার সুফল মিলল পরে।