বেতার ও দূরদর্শন ভদ্রলোক ভারতীয় এবং মধ্যবিত্ত জীবনদর্শন নির্মাণে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৪৭ এর পর দেশে চলছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক মডেলের আদলে পুঁজিতন্ত্রের আধা মিশেলে একটা মিশ্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জগৎ গড়ে তোলা।
জওহরলাল নেহেরু, ঐতিহাসিক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ভাষায়, জেন্টল কলোসাস, দেশের গণতান্ত্রিক শিক্ষার প্রসারে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, হুমায়ুন কবীরদের সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গড়লেন, মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রসারের জন্য একাধিক কমিশন গড়লেন, দেশজুড়ে প্রাথমিক স্তরে অবৈতনিক শিক্ষা চালু করলেন। দেশে বিজ্ঞান চিন্তা বিস্তারে একাধিক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, আইআইটি, আইটি আই, পলিটেকনিক কলেজ গড়লেন। পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বিস্তৃত করার জন্য রাজ্যে রাজ্যে অতি অল্প বেতনে সরকারি মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ, ফার্মাসিউটিক্যাল কলেজ গড়লেন। সমুদ্র বিজ্ঞান মহাকাশ কৃষি বিজ্ঞান চর্চার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করলেন।
সবগুলোই মধ্যবিত্ত শ্রেণি নির্মাণে সহায়তা করল। তপশিলি জাতি জনজাতির জীবন ও শিক্ষার মানোন্নয়নে চাকরি ও শিক্ষা ক্ষেত্রে ২২+৭ = ২৯ শতাংশ সংরক্ষণ চালু হল।
এই সংরক্ষণের সুবিধা মুসলিম সম্প্রদায় পেল না।
ছোটবেলায় খুব শুনতাম, মুসলমানদের সংরক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল, তখন মুসলমানরা বলে, আমরা নবাবের জাত। সংরক্ষণ কেন নেবো?
আসল কথা এই, ভীমরাও আম্বেদকর, যিনি মুসলমানদের ভোটে গণপরিষদে গিয়েছিলেন, মুসলমানদের সংরক্ষণের জন্য সাংবিধানিক রাস্তা রেখেছিলেন। গণপরিষদের অধিকাংশ সদস্যের বিরোধিতায় তা কার্যকর হয়নি।
ফলে অর্থনৈতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক বঞ্চনার মুসলমান সমাজে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় গড়ে উঠতে বহু সময় লাগছে। বেতার ও দূরদর্শনে মুসলমানদের দেখা গেল না।
সংবাদপত্রেও মুসলমানদের কথা থাকল না।
তাঁরা প্রান্তিক গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হল।
যদিও বলিউডে খান ভাইদের আগেও বহু মুসলমান মুখ দেখা গেল।
এঁদের মধ্যে কেউ কেউ নাম পরিবর্তন করতে বাধ্য হলেন।
ইউসুফ খান হলেন দিলীপকুমার। মীনা কুমারী, মধুবালা দুজনেই মুসলমান সম্প্রদায়ের মেয়ে। নাম পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন।
বাজারের কথা ভেবে।
বাজার তো অনেক কিছুর নিয়ামক।
বাজারের বিকাশ হয়েছে। হবে। কিন্তু প্রযুক্তি যদি বিপুল উন্নতি করে এবং তা মূলত অতি ধনী ও রাষ্ট্রের একপাক্ষিক ব্যবহার হয়, তাহলে সমাজ রাজনীতি অর্থনীতি সংস্কৃতি মনোজগৎ দ্রুত বদলে যায়।
গত এক হাজার বছরে বাঙালি বা ভারতীয় বা পৃথিবীর যেকোনও দেশের নাগরিক খেয়াল করবেন গত চার দশকে মানুষের মনোজগতে এক বিপুল পরিবর্তন হয়েছে।
রেডিও এবং দূরদর্শন প্রথমদিকে মধ্যবিত্তের কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক জগতকে সযত্নে লালন করেছে। এবং দূরদর্শনে সিরিয়ালের আগমন পারিবারিক জীবনে পরিবর্তন আনতে শুরু করে। প্রথম প্রথম প্রতিবেশী বা আত্মীয় এলে একসঙ্গে বসে সিরিয়াল বা খবর বা খেলা দেখার চল ছিল। এরপর মধ্যবিত্ত পরিবারে সিরিয়ালের সময় কেউ এলে বিরক্তি উৎপাদন শুরু হল।
তারপর তো ঘরে ঘরে টিভি। এবং আরও পরে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে ঘরে ঘরে মোবাইল সম্পর্ককে যান্ত্রিক করে তুলল।
আগে বিনা এত্তেলায় আত্মীয় বা অতিথি বা প্রতিবেশী আসা ছিল অতি স্বাভাবিক ঘটনা।
সেটা কমে যেতে যেতে লুপ্তপ্রায়।
এখন মোবাইলে কথা, কথাও নয়, টেক্সট।
পাশাপাশি বসে আছে বন্ধুরা। কথা বলছে না। ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপ করছে বা গেমস খেলছে।
১৯৮৩-৮৪তে টিভিতে একটা বিজ্ঞাপন আসে।
ওনিডা টিভির অশ্লীল বিজ্ঞাপন-- পড়শীর ঈর্ষা আপনার গর্ব। নেবারস এনভি ওনার্স প্রাইড।
দেখা যেত, টিভির পর্দায় কেউ ঢিল মেরেছে। এবং মাথায় শিংওয়ালা একজন হাত বের করে আসছে।
এই বিজ্ঞাপন হোর্ডিং আকারে এল ১৯৯৭-৯৮ তে।
দুঃখের ব্যাপার, কোথাও কোনও প্রতিবাদ হলো না। উল্টে ওনিডা টিভির বিক্রি হু হু করে বেড়ে গেল।
বামপন্থীদের কাছে মানুষ বেশি আশা করেন। করতেন। তাঁরাও কেউ কেউ বক্তৃতায় কেউ কেউ বিষয়টি উল্লেখ করলেও কোনও বিক্ষোভ মিছিল করলেন না।
ওনিডা টিভির কোনও দপ্তরের সামনে জমায়েত হলো না। ২০২৫ এ এই কথাটা ব্যবহার করলেন এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল।
আসলে ১৯৮৬ থেকে একটা পরিবর্তন এসে গেল।
বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে।
আগে কোকাকোলাকে ইয়াঙ্কি সংস্কৃতির প্র তীক হিসেবে দেখা হতো।
১৯৮৬ র পয়লা মে কোকাকোলার রঙিন বিজ্ঞাপন বের হলো পশ্চিমবঙ্গের দুটি সংবাদপত্রের প্রথম। তখনও প্রথম পাতায় দু কলম ২৫ সেমির বেশি বিজ্ঞাপন নেওয়ার চল ছিল না।
এই প্রথম ব্যতিক্রম ঘটল।
দুটি মতাদর্শগতভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত মতের সংবাদপত্র কোকাকোলার বিজ্ঞাপন পেল। এবং ছাপল। আনন্দবাজার এবং গণশক্তি।
দিনটি লক্ষ্যণীয়। পয়লা মে।
এর দুই দশক পরে নজরুল মঞ্চে সিপিএমের সম্মেলনে বিনা পয়সায় কোকাকোলার ফাউন্টেন দেখা যাবে।
এগুলো ভাবা যেত না।
জর্জ ফার্নান্ডেজ ১৯৭৭ তে ক্ষমতায় আসার পর এদেশে কোকাকোলা পেপসি কোলা নিষিদ্ধ করেন।
পরে এই নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়।
আমাদের দেশের মাটির তলার জল তুলে ভূগর্ভস্থ এলাকা ফাঁকা করে দেশকে লুটছে। ফসফরিফো থাকায় হাড় ক্ষণ ভঙ্গুর হচ্ছে। লোকজন বিশেষ করে শিশুরা খিটখিটে হচ্ছে কোক পেপসি খেয়ে। হৃদরোগ বাড়ছে। কাচের বোতল তুলে প্ল্যাস্টিকের বোতল।
ফলে ক্যান্সার বাড়ছে।
এসব নিয়ে কথা বলার লোক কোথায়? ২০০০ থেকে ভাষা ও চেতনা সমিতি কোক পেপসির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে।
আম পোড়া শরবতের পুনরুজ্জীবন ঘটাই আমরা। বাণিজ্যিকভাবে আমপোড়া শরবত এল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো কোনও আন্দোলন আজও গড়লেন না।
অথচ কোক পেপসি নানা দেশে সরকার পরিবর্তন করার জন্য টাকা ঢালে। ১৯৯৩ এর তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে ছাত্র বিক্ষোভে পেপসির বোতল দেখানো হয়েছিল।
কলম্বিয়ায় শ্রমিক নেতাদের খুন করেছে কোক কোম্পানি।
সম্প্রতি নেপালের সরকার পরিবর্তনে কোকাকোলার টাকার কথাও শোনা যাচ্ছে।
টিভি নিয়ে আলোচনায় কোক পেপসি কেন?
কারণ টিভিতে বিজ্ঞাপনের জায়গার বড় অংশ নিল এরা।
নিল খেলার জগতেও।
ফুটবল খেলায় অত বিজ্ঞাপন দেখানোর সুযোগ নেই। ক্রিকেটে আছে। প্রতি ওভারে বিরতি। এমনকি বল করার মাঝেও। ফলে ক্রিকেট হয়ে উঠল বিজ্ঞাপনের গন্তব্য।
এবং দক্ষিণ এশিয়ার মতো যৌন বুভুক্ষু মানসিকতার দেশে যৌনগন্ধী অশ্লীল বিজ্ঞাপন বাড়ল।
ফুটবল পিছনে চলে গেল।
১৯৮৩ তে তথাকথিত বিশ্বকাপ জয়ের পর মাঝরাতে মিছিল গোটা ক্রীড়া মানচিত্রই বদলে দিল।
ফুটবল মানসিকতা বেশি বাড়ে বিশ্বকাপ ফুটবলের সময়। বাকি সময় বেশিরভাগ এলাকায় খেলা বলতে ক্রিকেট।
ব্যতিক্রম কি নেই? আছে। কম।
কোক পেপসি কোম্পানি বহুজাতিকদের ধর্ম যে দেশীয় সংস্থা ধ্বংস--সেটাও দেখিয়ে দিল।
আগে ভারতে থামস আপ, সেভেন আপ, মাজার বোতল পাওয়া যেত। দেশের সংস্থা। বেচতে চায়নি নিজেদের। তাদের ছিল কাচের বোতল। বোতল কিনে খেয়ে বোতল ফেরৎ দিলে এক টাকা পাওয়া যেত। কোক পেপসির লোকরা খালি বোতল বেশি পয়সা দিয়ে কিনে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল।
নিজেদের বোতল ২০০ মিমির বদলে ২৫০/৩০০ করে দিল।
দাম একই।
লোকসানের ঠেলায় দেশের সংস্থাগুলো নিজেদের একদা অতি জনপ্রিয় ব্রান্ড বেচে দিতে বাধ্য হল।
এর আগে সচেতন মানুষ ও বামপন্থীদের মধ্যে গরম লাগলে ডাব ও লস্যি বা শরবত খাওয়ার চল ছিল।
ডাব নিয়ে একটা জনপ্রিয় বিজ্ঞান পত্রিকা বিরোধী প্র চার চালাতে লাগল। কেন কে জানে? এর উৎস কী? মানুষ কি জানবে?
টিভির বিজ্ঞাপনের দৌলতে ছেলে ছোকরাদের মধ্যে কোক পেপসি ফ্যাশন হয়ে দাঁড়ায়। হাঁটা চলার কায়দাই বদলে গেল অনেকের।