১৯৮০র দশক থেকেই অল্প অল্প করে কনজিউমারিজম ঢুকতে লাগল পার্টিতে। সম্মেলনগুলোতে মাছ ভাতের বদলে মাংস ভাত খাওয়ালে অভ্যর্থনা সমিতির লালসেলাম একটু বেশি হতো। নেতাদের দেখা গেল, মিল মালিকের ছেলের বাইকের পিছনে ঘুরতে। ১৯৮০ সালের একটা কথা মনে আছে। রায়নায় পার্টির লোকাল কমিটির সম্মেলন। তখন জোনাল কমিটি এরিয়া কমিটি এসব নাম কেউ শোনেননি। একটা থানা এলাকায় একটাই লোকাল কমিটি। রায়না বিরাট এলাকা। দুটো পঞ্চায়েত সমিতি। ভারতের শস্যাগার বলা হয় বর্ধমানকে। বর্ধমানের শস্যাগার রায়না। ধান আলু সব্জি বিশেষ করে খাসকানি চাল বা সুগন্ধি গোবিন্দভোগ চাল এখানকার সুবিখ্যাত। যিনি খেয়েছেন তিনি ভুলতে পারবেন না। দামোদরের বন্যার ফলে জমিও ছিল খুবই উর্বর। আলু চাষ দুর্দান্ত। ধান আর বান দুইই ছিল বৈশিষ্ট্য। ১৯৭৮ এর পর সেভাবে আর বন্যা হয়নি দীর্ঘদিন। তো এই এলাকায় মিল মালিকরাই ছিলেন বড়লোক। বালি খাদ, সার, সিমেন্ট, মিল ব্যবসায় তখনও কংগ্রেসের দাপট। সিপিএম দাঁত ফোটাতে পারেনি।
সবে তিন বছর ক্ষমতায় এসেছে। তো সেবার রায়নায় পার্টির সম্মেলন। সম্মেলন হলে তো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবেই। এবং কবি সম্মেলন।
কিশোর কবি হিসেবে আমার একটুস খ্যাতি হয়েছে। পার্টি সম্মেলনের স্মরণিকায় পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কাকাবাবু মুজফফর আহমেদের ওপর একটা বড় কবিতা বের হয়েছে। জামার অদৃশ্য কলার একটু উঁচুতে। নবম শ্রেণিতে পড়ি। পাশে হাপুরে মায়ের খালাতো বোনের বাড়িতে রাতে থাকা। ওখানেই বেশ কিছু চমৎকার পুঁথি দেখেছিলাম। ওই গ্রামেই আমাদের বাড়িতে কাজ করতেন একজন তাঁর বোনের বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতেও পুঁথি দেখেছি। চালের বাতায় গোঁজা। সোরাব রুস্তমের কাহিনি নিয়ে পুঁথি। ডানদিক থেকে বামদিকে ছাপা। আরবি রীতিতে।
এখন যে টাইপোগ্রাফি খুব জনপ্রিয় হয়েছে প্রচ্ছদ এবং পোস্টারে, সেই মতো হরফ ছিল্। একটু বড় আকারের।
তো সেই সম্মেলন স্থল চট দিয়ে ঘেরা। হঠাৎ শুনি বাবার গলা। মাইকে। আমার বাবা ছিলেন সহৃদয় কিন্তু অতি ঠোঁট কাটা।
সেজন্যই বোধহয় জাগতিক আর্থিক সুখ তেমন পাননি। মানসিক শান্তি ছিল প্রচুর। কিন্তু পার্টিতে তাঁর অনেক পরে আসার দর বড় বড় পদ পেলেও তাঁকে দিতে নেতারা ভয় পেতেন। এলাকার বিধায়ক রামনারায়ণ গোস্বামীর খুব প্রিয় ছিলেন। সর্বভারতীয় কৃষক সমিতির নেতা করে তাঁকে দিল্লি না পাঠালে হয়তো বাবার পক্ষে একটু বেশি ভালো হতো।
যাক, বাবার গলা শুনে চিন্তিত হলাম। কিছুদিন আগেই একটা মিলে চারজন শ্রমিক পুড়ে মারা গেছে। বাবা বারবার বলা সত্ত্বেও তেমন আন্দোলন করছে না পার্টি। কিছুদিন আগে বাড়িতে একটা ব্রাঞ্চ মিটিং হয়েছে। চাপা স্বরে কথা। কিছু শুনতে পাই নি। আর বাবা দাদা এঁরা তখনকার রীতি অনুযায়ী পার্টির ভেতরের কথা বাড়িতে বা বন্ধু দের কাউকে বলতেন না।
খালি মিটিং শেষে এক পার্টি নেতার কথা শুনলাম, বাবাকে বলছেন, এনাম পার্টিতে আমার শিকড় অনেক ভিতরে। তুমি কিছু করতে পারবে না।
চারজন শ্রমিক বয়লারে পুড়ে মরলেন তারপর পরে জেনেছি লোকমুখে ওই নেতাসহ দুই নেতার ছয় বিঘা করে জমি বেড়েছে।
তা বাবা কী বলেন, সেই নিয়ে খুব ভয় ছিল। বাবার প্রতি আক্রোশ ছেলেমেয়েদের ওপরও নামতো তো।
শুনছি বাবা বলছেন, এই পার্টি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়বে বলেছিল, নেতারাই দুর্নীতির কবলে।
লোকাল কমিটির ২০ জনের মধ্যে মাত্র তিনজন সৎ।
পার্টি সদস্যদের মধ্যে বাবার খুব জনপ্রিয়তা ছিল। রসিক মানুষ, যাত্রা থিয়েটার দাবা তাস এবং আড্ডা ও খাওয়ানোয় দরাজ দিল মানুষ।
আমাদের এলাকার মানুষ মাটির মতোই খুব রসিক।
কয়েকজন চেঁচিয়ে উঠলেন ভাই টীকা লাগে।
বাবার গলা একটু উঠল।
বললেন, আগে দেখতাম পার্টির লোকাল সম্পাদক আমাদের মতোই সাইকেলে ঘোরেন। সেদিন পলাশন বাজারে দেখা। দাঁড়িয়ে আছেন। ভাবলাম, বাসে যাবেন। ভালো।
একটু অবাক হলাম ছয় কিলোমিটার রাস্তা সাইকেলে গেলে চার আনা পয়সা বাঁচে পার্টির। তো শরীর খারাপ বোধহয়। আমিও মিটিংয়ে যাবো। বললাম, সাইকেলের পেছনে ওঠেন কমরেড।
উনি বললেন, না অশো... আসবে।
তা ওঁর ছেলের নাম।
ওমা একটু পর দেখি মিল মালিকের ছেলে অশো.. রাজদূত মোটর সাইকেল নিয়ে হাজির।
তাঁর বাইকের পেছনে চড়লেন।
তো যাঁরা দেখলেন, তাঁদের কাছে কী বার্তা গেল।
মিল মালিকরা আমাদের শ্রেণি মিত্র হয়ে গেছে? আর বিবাদ নাই?
আবার আওয়াজ বাকিদের কী দোষ?
সে তো আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন। এখন বিড়ি খেতে লজ্জা চারমিনার ক্যাপস্টান খাচ্ছেন। তা পয়সা আসছে কোথা থেকে?
আগে এত ইস্ত্রি করা জামাকাপড় পরা নেতা দেখিনি।
সবাই জ্যোতি বসু হতে চাইছেন।
ভদ্দরনোক।
প্রসঙ্গত, আমার বাবা জ্যোতি বসুকে একদম দেখতে পারতেন না। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে দেখার পর একটু মনোভাব বদলায়। সদয় হোন।
বাবার কথা ছিল, জ্যোতিবাবু পার্টিটাকে মধ্যবিত্তের পার্টি বানিয়ে দিচ্ছেন। নিজের ছেলেকে পার্টিতে আনেননি।
সেই দেখে নেতাদের ছেলেমেয়েরাও কেরিয়ার গড়ছে। বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছে না।
বাবা সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছিলেন, বাবার এক অতি ঘনিষ্ঠ খেতমজুর কমরেড যখন ২০০ টাকার পার্টি হোলটাইমার হয়ে জমিতে কাজ করা ছেড়ে মাড় দেওয়া ইস্ত্রি করা ধুতি পাঞ্জাবি পরে ঘুরতে লাগলেন। বললেন, তপন সিংহকে কংগ্রেসের লোক বলি। উনিই কমিউনিস্টদের আসল শিল্পী।
'সাগিনা মাহাতো' দেখো।
কেমন করে বদলে যায় পার্টি নেতা।
'আতঙ্ক' ছবি তাঁকে খুব ভাবিয়েছিল।
আপনি কিন্তু কিছু দেখেননি মাস্টারমশাই।
১৯৭৭ এ সরকারে এসে সিপিএম মধ্যবিত্ত অখুশি হবে জেনেও বেশকিছু মার্কসবাদী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
অপারেশন বর্গা
খেতমজুরদের মজুরি বৃদ্ধি
পঞ্চায়েতে তপশিলি জাতি উপজাতির জন্য আসন সংরক্ষণ ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে সেই আসনে প্রার্থী করা
গ্রাম বা পাড়ার নাম জাত দিয়ে ডাকা বন্ধ করা
যথা চাঁড়ালপাড়া, মুচি পাড়া, বাগদি পাড়া, সাঁওতাল পাড়া
বদলে এলাকা পুকুরের নামে নামকরণ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'সহজ পাঠ'- এ খেটে খাওয়া মানুষদের আপনি সম্বোধন নেই বলে তুলে দেওয়া
প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ইংরেজি তুলে দেওয়া।
এর পাশাপাশি মধ্যবিত্তদের জন্য বেশ কিছু কাজ করে।
প্রথমে নবম দশম পরে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে বেতন মকুব করা
আড়াই একর পর্যন্ত জমির খাজনা মকুব করা
শ্রমিক ও শিক্ষক অধ্যাপক এবং সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি ও যতটা সম্ভব নিয়মিতকরণ করা
বছরে দু বার ডিএ ঘোষণা
গরিব মানুষকে সম্মান দেওয়া
এর ফলে সিপিএমকে বেশ কিছু ঝক্কি পোহাতে হয়। শহরের কলেজগুলোতে ১৯৮০ র পর ছাত্র সংসদ নির্বাচনে হারতে শুরু করে। শহরে ভোট কমে।
শহরে কর্মক্ষেত্রে বা কারখানায় যিনি বামপন্থী গ্রামে তাঁর জমি আছে।
খেতমজুরদের মজুরি বৃদ্ধি আর বর্গাদার প্রথা চালু তাদের বেশ চটিয়ে দিল।
আমাদের পাশের গ্রাম রামবাটির একজন গ্রামে ছিল কংগ্রেসি কিন্তু দুর্গাপুরের কারখানায় সিটুর বড় নেতা।
মজুরি বেতন বৃদ্ধি ও অধিকার এবং ক্ষমতার প্রশ্নে সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন সিটুকে তাঁর দরকার।
এদিকে আর একটা মজার ঘটনা ঘটে।
প্রাথমিকে ইংরেজি না থাকায় তীব্র সমালোচনা শুরু হল।
আনন্দবাজার যুগান্তর দুটি প্রধান সংবাদপত্র তার নেতৃত্ব দিল। রাতদিন গালাগাল। এস ইউ সি নামল পথে। সুশীল মুখোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, নীহাররঞ্জন রায় প্রমুখ পরিচিত মুখদের নিয়ে আন্দোলন। সভা সমিতি।
সিপিএমও এলাকায় এলাকায় প্রাথমিকে ইংরেজি কী ক্ষতি করছে এবং 'সহজপাঠ' কেন রবীন্দ্রনাথের মূল ভাবাদর্শের বিরোধী তা নিয়ে সভা সমিতি মিছিল মিটিং করে চলল।
আমার জীবনে এইরকম আদর্শগত লড়াই আর দেখিনি।
অবস্থা সাঙ্ঘাতিক।
প্রাথমিকে ইংরেজি না থাকার পক্ষে হাতিয়ার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা, উদ্ধৃতি আর অন্যদিকে 'সহজপাঠ' তুলে দেওয়ার পক্ষে যুক্তি।
এইসময় প্রবোধচন্দ্র সেন প্রবলভাবে বামফ্রন্টের পাশে দাঁড়ান। আরেকজন মানুষ জ্যোতির্ময় ঘোষ বহু লেখা লেখেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্ধৃত করে। ভবেশ মৈত্র, অনিলা দেবী, গোলকপতি রায়, গোকুলানন্দ রায় প্র মুখ শিক্ষক নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরমেশ আচার্য অনেক লেখা লেখেন।
বর্ধমানে অধ্যাপক জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য, হরেকৃষ্ণ কোঙারের ছেলে অরিন্দম কোঙার দেশ বিদেশের শিক্ষা বিজ্ঞান থেকে তথ্য আহরণ করে এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাদর্শন নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ বক্তব্য পেশ করতেন।
আড়াই ঘণ্টা তিন ঘন্টা ধরে বলতেন।
লোকে মনোযোগ দিয়ে শুনতেন সেসব। উশখুস করতেন না।
তবে ওই সময় থেকেই দেখলাম, পার্টির লোকদের মধ্যে ইংরেজি বলার প্রবণতা বেড়ে গেল।