বাবা,
আমার তিরিশ বছরের জীবনে এই প্রথম তোমাকে মেল করছি, বা বলা ভাল, তোমাকে, শুধু তোমাকেই উদ্দেশ্য করে কিছু লিখছি। তোমার ব্যক্তিগত ইমেল ঠিকানায় লিখছি, অফিসের ঠিকানায় নয়। আমি জানি, এই মেল তুমি কালেভদ্রে একবার খোলো, ব্যক্তিগত খাতা খুলে দেখাতে চিরকালই গভীর অনীহা তোমার। দিনে প্রায় বারো ঘন্টা অফিস, মাসে মাসে ফরেন ট্যুর, সেমিনার, আরও অজস্র পেশাগত কর্মকান্ড-এই তো তোমার কাছে জীবনের মানে। A workaholic is a person who works a lot of the time and finds it difficult not to work - এই সংজ্ঞাটা মনে হয় তোমাকে দেখেই কেউ লিখেছিল। তাই ভাবছিলাম, কবে তুমি অতিব্যস্ত জীবনের ফাঁকে আমার এই লেখা খুলে পড়বে, কে জানে!
তবু লিখছি বাবা, খুব দরকার ছিল এটা।
নাহ্, নিজের কাজ নিয়ে তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের বারো ঘন্টা ব্যস্ত থাকলেও আমাকে তুমি কখনই অবহেলা করো নি, সে কথা আমাকে মানতেই হবে। আমি দিল্লির বিখ্যাত সেন্ট কলম্বাস স্কুলের ছাত্র ছিলাম,তারপর দিল্লি টেকনলজিকাল ইউনিভারসিটিতে পড়েছি ইলে্কট্রনিকস অ্যান্ড টেলিকমুনিকেশন্স নিয়ে। আমার লেখাপড়া, শরীরস্বাস্থ্য, ক্রিকেট কোচিং, গীটার- সবদিকে তোমার সজাগ দৃষ্টি ছিল। প্রতিদিন ডিনারের পর আধঘন্টা কথা বলে তুমি আমার সারাদিনের কার্যকলাপের একটা চমৎকার রিপোর্ট নিয়ে নিতে, প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা করে ফেলতে কোনদিন এতটুকু দ্বিধা করো নি বা সময় নষ্ট হতে দাও নি। অতন্দ্র মনোযোগ, আন্তরিক যত্ন, মূল্যবান গাইডেন্স,আর্থিক স্বাচ্ছল্য- সব তুমি আমাকে দিয়েছ বাবা, তার জন্য আমি কৃ্তজ্ঞ।
এত যত্ন্রের মধ্যে শুধু যদি একটু ভালবাসা থাকত, বাবা !
আমার জন্য নয়, মার জন্য।
তুমি হয়ত ভাবো,মার কথা আমার মনে নেই। মা যখন চলে যায় (পৃথিবী থেকে,না কি শুধু আমাদের জীবন থেকে? এই মর্মান্তিক প্র্রশ্নচিহ্ণটি বুকের গভীরে নিয়ে আমি গত কুড়ি বছর কাটিয়েছি, অনেক নির্ঘুম রাতে যা আমাকে রক্তাক্ত করেছে) তখন আমার বয়েস দশ বছর ছ মাস, ফিফথ স্ট্যান্ডার্ডে পড়ি।
তাই, মাকে আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমার ছোটখাট মায়ের গায়ের রঙ কালো ছিল, মুখশ্রী সুন্দর ছিল না, ছিল শুধু বড় বড় পাতায় ঘেরা অপরূপ দুটি চোখ। ওই চোখ দুটির জন্য মাকে আমি বড় সুন্দর দেখতাম। না, এম এ পাশ হলেও আমার মায়ের তে্মন ব্যক্তিত্ব ছিল না, গুছিয়ে কথা বলতে পারত না, কোথায় কী বলতে হয় জানত না- সেই বয়সে যা বুঝতাম এগুলোই ছিল মায়ের ওপর তোমার বিরক্তির প্রধান কারণ। আশ্চর্য এই যে, বিদেশিনীদের মত ফর্সা আমার দিদা ও আমে্রিকাবাসিনী দুই মাসি অসাধারণ রূপ, গূণ ও ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী ছিলেন। দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে তিনতলা বাড়িতে কাজের লোকজন নিয়ে দিদা সম্রাজ্ঞীর মত বাস করতে্ন। অথচ আমার মা ছিল একদম অন্যরকম, সহজ, সরল, যে কোন আত্মীয় এসে মাকে মিথ্যে বুঝিয়ে টাকাপয়সা নিয়ে চলে যেত, অন্য সুবিধে নিত, মহানন্দে সাত আট দিন কাটিয়ে যেত। না, তুমি সেজন্য চেঁচিয়ে মাকে বকাঝকা করতে না, শুধু দাঁতে দাঁত চেপে বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে খুব আস্তে কিছু কথা বলতে। মা হয় ভীষণ অপ্রতিভ মুখে একটা বোকাহাসি মাখিয়ে মুখ নিচু করে থাকত, অথবা নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকত আর বড় বড় শ্বাস ফে্লত। এই শেষের কাজটা করত, যখন মা জানত যে সে কোন দোষ করে নি, অবশ্য আত্মীয়দে্র টাকা দেওয়া, বাড়িতে রাখা এইধরণের দু তিনটে কাজই মার দোষের তালিকায় ছিল।
তুমি কি জানতে বাবা, মা কী আশ্চর্য রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইত? চারদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি এলে মা বারান্দায় বসে গাইত, আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে, বরষে রিমঝিম ঘন ঘন রে, মহারাজ এ কি সাজে, এলে হৃদয়পুর মাঝে, বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল, আরও কত গান। শ্রোতা আমি, এক নয় দশ বছরের শিশু।
আমার সঙ্গে মার একটা জিনিস নিয়ে খুব কথা হত বাবা-সেটা হল লাইট হাউস। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে এই সব বাতিঘর যেখান থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় আলো ফেলে সমুদ্রে জাহাজের নাবিকদের দিক নির্দেশনা দেওয়া হয় এবং জলের অগভীর অঞ্চল সম্পর্কে সতর্ক করা হয়- এই মিনারগুলো আমাদে্র খুব টানত। আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর, টরিসিলির বাতিঘর, Tower of Hercules, রোমান লাইট হাউস এইসব নাম আমাদে্র মুখস্ত ছিল। একটা খাতায় আমি য্ত্ন করে যত লাইটহাউসে্র নাম পে্তাম লিখতাম, ছবি পে্লে লাগাতাম, তথ্য জোগাড় করে লিখে রাখতাম। বিকে্লে্র আলোয় বারান্দায় বসে আমি আর মা দেখতাম সেইসব ছবি আর লেখাগুলো। খাতায় লিখেছিলাম বিশ্বের সর্বপ্রথম মাঝ সমুদ্রের বাতিঘর এডিস্টোন রক লাইট হাউজের কথা, যা বানিয়েছিলেন হে্নরী উইনস্ট্যানলি। পাঁচ বছর ধরে এই বাতিঘরের আলোর সংকেত জ্বলার পর এক ভয়ংকর সামুদ্রিক ঝড়ে দ্বীপে্র গাছপালা, লাইট হাউস সহ স্থপতি উইনস্ট্যানলি ও তাঁর দলবল সম্পুর্ণ নিশ্চিহ্ণ হয়ে যান। আমি আর মা বসে বসে এইসব অদ্ভুত গল্প পড়তাম আর প্ল্যান করতাম, আমি যখন বড় হব,তখন দুজন মিলে দেশে্র সব লাইটহাউস দেখে বেড়াব, একটাও বাদ দেব না।
তখন অবশ্য মা আর আমার একসঙ্গে ভ্র্রমণের দৌড় ছিল আমাদের হাউসিং কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে একশ মিটার দূরে মিষ্টি আর বইখাতার দোকান পর্যন্ত। খাতা, চার্ট পেপার, ক্রেয়ন এইসব কিনে আমরা দুটো করে গরম ল্যাংচা খেতাম। বুকের ভেতর থেকে একটা সবুজ সাটিনের ওপর পুঁতি দিয়ে কাজ করা ছোট্ট পার্স বের করে মা টাকা দিত। আমি জানতাম ঐ পার্সে আছে সামান্য টাকা, আমাক কোলে নিয়ে বাবা আর ঘোমটা টানা তোমার একটা ফোটো, যেটার বড় কপি আমার পড়ার টেবিলে স্ট্যান্ডে রাখা আছে, তোমার ভিজিটিং কার্ড, খাতার ছেঁডা পাতায় মার হাতে লেখা “নিবিড় ঘন আঁধারে- ” গানে্র আধখানা আর আমার ছোটবেলার একটা লোহার চুড়ি।
আমাদে্র দুজনে্র এই দুনিয়ার অস্তিত্বই তুমি জানতে না বাবা। কিন্তু একদিন হঠাৎই তুমি সে্খানে ঢুকে পড়েছিলে। পে্টে্র গন্ডগোল হওয়াতে তুমি হয়তো জীবনে প্রথম বার হাফ ডে ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছিলে। আমি আর মা তখন আমাদে্র সেই খাতাটা খুলে অনেক বার পড়া লেখাগুলো আবার পড়ছি। তুমি কখন ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকেছ, তা আমরা খেযাল করিনি, কিন্তু অনেক ক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে তুমি আমাদের কথা শুনছিলে তা বুঝতে পারলাম যখন তুমি আমাকে নিজে্র ঘরে ডেকে কয়েকটা প্রশ্ন করলে।
আমাদে্র এই ছোট্ট সংসারে যে ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছিল বলে আমি অনুমান করছি, তার সূত্রপাত কি সেদিনই হয়েছিল বাবা ?
তিনদিন পরেই তুমি অফিস থেকে ফিরে জানালে তুমি আর মা গোয়া বেড়াতে যাবে সাতদিনের জন্য। খুব আশ্চর্য লেগেছিল, কারণ ওই শিশু বয়সেও আমি বুঝতে পারছিলাম, কয়েকদিন ধরেই তুমি রাত্রে মার সঙ্গে তুমুল অশান্তি করছিলে। দরজা বন্ধ করার ব্যাপারটা নতুন লাগাতে আমি আড়ি পে্তে শোনার চেষ্টা করে কিছুই বুঝতে পারিনি, কেবল কানে এসেছিল একটা নাম- রীতেশ বা হিতেশ, আর মার সেই বড় বড় নিঃশ্বাসের শব্দ। আমাকে তোমরা রেখে গেলে দিদার কাছে। মা জীবনে প্রথমবার সাহস করে অচ্চিকে অর্থাৎ আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিল বটে, কিন্তু যথারীতি কোন লাভ হয় নি। (এইখানে বলে রাখি,আমার অর্চিস্মান নামটা ছোট করে তুমি ডাকো আর্চি, কিন্তু মায়ের মুখের অচ্চি ডাকটা শতগুণে মিষ্টি লাগত।)
তোমার গোয়া থেকে ফে্রার দিনটা আমার সারা জীবন মনে থাকবে বাবা। রক্তে্র মত টকটকে লাল চোখ, উসকো খুসকো চুল, গাড়ি থেকে নে্মে উন্মাদের মত দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে তুমি দিদার ঘরে গে্লে, আর দিদাকে এক মিনিটে্র মধ্যে কিছু বলে বে্রিয়ে এসে আ্মাকে টানতে টানতে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে গাড়ির মধ্যে ছুঁড়ে ফে্লে দিলে। দিদা ছুটে এসেছিলেন, তাঁর আর্তস্বর শোনা যাচ্ছিল, "বিশ্বাস করি না, আমি বিশ্বাস করি না, ইটস আ লাই, ইটস আ লাই”-
ভয়ে আমি কেঁদে ফে্লেছিলাম, চিৎকার করছিলাম “মা? মা কোথায়?” কিন্তু দশ বছরের ছেলে্কে সান্ত্বনা দেওয়ার বদলে তুমি গর্জন করে উঠেছিলে, ”আর্চি, জীবনে কোনদিন তুমি মায়ের কথা আমার কাছে জানতে চাইবে না, সি ইজ ডেড, সি ইজ ডে্ড, আন্ডারস্ট্যান্ড?”
বারবার এককথা শুনতে এত ভয় লাগছিল যে বলতে বাধ্য হয়েছিলাম “তুমি যা বলছ, তাই করব, বাবা।”
তুমি জানো, আমি সারাজীবন আমার কথা রেখেছি, মায়ের কথা তোমাকে কোনদিন ভুলেও জিজ্ঞেস করিনি। তারকদা, বীণাদির কাছে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠেছি, অনেক বিকেলে শূন্যচোখে সেই খাতাটা নিয়ে একা বারান্দায় বসে থেকেছি, কিন্তু তোমাকে কোনদিন একটি প্রশ্ন করিনি।
দিদার সঙ্গে তুমি এরপর আর কোন সম্পর্ক রাখো নি, আমাকেও দিদার ত্রিসীমানায় যেতে দাও নি। জীবিত অবস্থায় দিদাকে আমি আর একবার মাত্র দেখেছিলাম। আমি নিশ্চিত, বাবা, সেই রবিবারটার কথা তোমারও সারা জীবন মনে আছে। এম বি এর পর ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ দিয়ে আমি তখন একটি বহুজাতিক সংস্থায় যোগ দিয়েছিলাম। জীবনে এই প্রথম তোমার অনুমতি ছাড়াই আমি কোন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আর তুমিও চুপচাপ শুনে গিয়েছিলে আমার জীবনে এই নতুন অধ্যায়ের কথা।
রবিবারের সকাল, তুমি, আমি যথারীতি নিশ্চুপ বসে খবরের কাগজ পড়ছি আর কফিতে চুমুক দিচ্ছি। এমন সময় কলিং বেল ভীষণ জোরে বাজতে লাগল,যে এসেছে তার হাতে যেন এক মুহূর্ত্তও সময় নেই। পড়ি কি মরি করে তারকদা দরজা খুলে দিতেই তাকে প্রায় ঠেলে ফে্লে দিয়ে আগুন্রে্র গোলার মত ঢুকে এলেন ইন্দ্রাণী সে্নগুপ্ত, আমার দিদা। রাগে তাঁর মুখ লাল,হাত কাঁপছে, তোমার মুখের ওপর একটা কাগজ ছুঁড়ে দিয়ে তিনি চাপা স্বরে হিস হিস করে উঠলেন,
“সি দিস ডেথ সারটিফিকেট, জাস্ট সি। দেশমুখ ডায়েড ইন নাইন্টি ফাইভ, দ্যাট টু ইন স্টেটস। আই টোল্ড দ্যাট ডে, ইউ আর এ লায়ার, এ লায়ার্, দ্য মোস্ট হেটফুল ক্রীচার অন আর্থ। আই অ্যাম ইনফরমিং দ্য পোলিস।”
ছুটে বেরিয়ে গে্লেন, শেষ দেখা বলেই হয়তো দিদার পরিশীলিত উচ্চারণ, ঐ মানসিক অবস্থা্র মধ্যেও পরিপাটি পরা ক্রীমকালার তসর সিল্ক,বহুমূল্য ঘড়ি প্রতিটি খুঁটিনাটি আমার মনে ছবি হয়ে আছে। না, পুলিশে যাওয়ার সময় তিনি পান নি, একমাসের মধ্যে আমি দিদাকে লোদী রোড ক্রিমেটোরিয়ামে অনেক ফুলে্র মধ্যে শুয়ে থাকতে দেখেছিলাম।
এই মেল প্রায় শেষ হয়ে এল বাবা। ইদানীং তুমি একটু শান্ত হয়ে গেছ, সব কথা খুঁটিয়ে জানার অত ইচ্ছা বা শক্তি কমে আসছে মনে হয়। কোন বিষয়েই আর তে্মন কাটাকাটা মন্তব্য করো না।
শুধু একবার বন্ধুদে্র সঙ্গে গোয়া বেড়াতে যাব শুনে, কেন জানি না প্রচন্ড বাধা দিয়েছিলে। গোয়া ভাল জায়গা নয়, তোমারও নাকি শরীর খারাপ, এইসব বলে টিকিট ক্যানসেল করিয়ে তবে নিশ্চিন্ত হয়েছিলে।
কাজে্র জগতে অবশ্য তুমি আগে্র মতই সুপারম্যান। সেপ্টেম্বরের শুরুতে হঠাৎ দুদিনের নোটিশে ইয়োরোপ চলে গেলে একমাসের জন্য।
আমি এখন বড় হয়ে গেছি বাবা, কোন কাজে বাধা পেলে সেটাই করার ইচ্ছা ছোটবেলায় অনেক দমিয়ে রেখেছি, কিন্তু এখন সেই ইচ্ছেগুলোকে আকাশে উড়িয়ে দিতে মন চায়। গোয়াতে থাকে আমার স্কুলবেলার বন্ধু মণীশ মালহোত্রা। সে আমাকে অনেক দিন ধরে ছুটি কাটাতে ডাকছে।
এবার তাই চলেই এলাম সাতদিনের ছুটি নিয়ে। মণীশরা স্বামী স্ত্রী খুব যত্ন করল,কোঙ্কনী উপকূল, গণেশ মন্দির, চার্চ আরও কত কী দেখাল, নিজে্র হাতে রান্না করে ভীষণ সুস্বাদু সমুদ্রের মাছ খাওয়াল। তারপর একদিন বলল, "আর্চি, তোকে একটা দারুণ জিনিস দেখাব, একদম সবুজ একটা দ্বীপ। জানিস, লোকে বলে, ১৯২৭ সালে এই দ্বীপের অধিবাসীরা শপথ নিয়েছিল, বাইরের কোন মানুষকে এরা জমি লীজ দেবেনা, কল কারখানা বা ট্যুরিস্ট স্পট তৈরী করতে দেবে না। দ্বীপটা তাই আজও সেই আদিম, নির্মল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরে আছে, কোন দূষণের বিষ নেই। আমি তো কবিতা টবিতার দশ মাইলে্র মধ্যে নেই, তাও যতবার যাই মনে হয়, দ্বীপটা ঈশ্বরের নিজে্র হাতে লেখা কবিতা। তবে দ্বীপের বেশির ভাগই জঙ্গল, দক্ষিণ পশ্চিম উপকুলে্র কাছে কিছু পুরনো বাড়ি আছে, আর আছে একটা অসাধারণ সুন্দর সাদা ধবধবে চার্চ, একটা বহু পুরনো লাইটহাউস।
লাইটহাউস!! শুনেই আমার মধ্যে বহুদিনে্র ভুলে যাওয়া একটা ঘন্টা বে্জে উঠল। সেই ঘন্টার শব্দে জড়িয়ে ছিল আমার দশ বছর বয়স, আমার মার ভীতু ভীতু গলার স্বর, আমার লুকনো খাতা।
মণীশকে অবশ্য অতশত বুঝতে দিলাম না, শুধু জিজ্ঞেস করলাম, "লাইট হাউসে আলো জ্বলে?”
হো হো করে হাসল, ও খুব হাসে কথায়,কথায়, “না রে,লাইট হাউসে্র চারদিকে ভীষণ জঙ্গল, কতদিন কেউ ভেতরে ঢোকে নি, আলো জ্বলা দূরের কথা। দূর থেকে দেখে চলে আসবি। আমার ছুটি নেই, নইলে আমিও যেতাম।”
পরদিন সিলভার গেট নামে একটা ভীষণ রোমান্টিক চেহারার ব্রীজ পেরিয়ে দ্বীপে গিয়ে হাজির হলাম। সত্যিই স্বর্গের মত দ্বীপ, অতুলনীয় সৌন্দর্য, মনে হয় পৃথিবীর বাইরে এসে পড়েছি। ঠিক করেছিলাম প্রথমে চার্চ দেখতে যাব, তারপর লাইটহাউস। তে্মনভাবে ঈশ্বর বিশ্বাসী না হয়েও চার্চে ঢুকে কী অসীম শান্তি পে্লাম, তা ভাষায় বলতে পারব না। অসাধারণ ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মূর্তি, দেওয়াল ভরা অলৌকিক সব ছবি, ভক্তরা নীরবে বসে প্রার্থনা শুনছেন। মনে হল, প্রভু যীশু যদি পৃথিবীতে ফিরে আসে্ন তবে তিনি এখানেই আসবেন।
তখনও জানি না এরপর কী ঘটতে চলেছে।
প্রার্থনা শেষ হয়ে গেছে, ভক্তরা আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছেন, আমি একটু বসে ছিলাম। একজন দীর্ঘদেহ সুপুরুষ ফাদার বে্রিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ আমার ওপর চোখ পড়াতে তিনি যেন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।
“আপনি বাঙালি?”
“ইয়েস, ফাদার,” আমি উঠে দাঁড়ালাম।
“বেড়াতে এসেছেন?”
“হ্যাঁ, বড় সুন্দর আপনাদে্র দ্বীপ।”
“যদি কিছু মনে না করেন, কোন অসুবিধা না হয়, দশ মিনিটে্র জন্য একটু আসবেন আমার সঙ্গে?”
মন্ত্রমুগ্ধের মত ঘাড় নেড়ে আমি তাঁর পিছনে চললাম।
কাছেই ছোট্ট বাড়ি। আমাকে বসিয়ে তিনি ভিতরে গেলেন, ফিরে এলেন একটি ট্রেতে জল ও ছোট একটি প্যাকে্ট নিয়ে।
“ইয়ং ম্যান, আমার স্পর্ধা ক্ষমা করবেন, কিন্তু আমার মনে হল এই প্যাকেটটি দেবার জন্য আপনিই সবচে্যে উপযুক্ত মানুষ।
ব্রাউন পে্পারের প্যাকেটটি খোলা মাত্র আমার পায়ের তলার মাটি দুলতে লাগল। আমি কে, কোথায় আছি, এখানে কেন এসেছি, সবকিছুর ওপর যেন ভারী পর্দা নে্মে এল।
মায়ের পার্স, সেই সবুজ পার্স যা মায়ের ব্লাউজে গোঁজা থাকত, এত বছর পরেও চেনা যায়। হঠাৎ মনে হল, একই পার্স অন্য কারও কাছেও থাকতে পারে। পার্সের চেনে জং ধরে গেছে, জোর করে টেনে খুলে ফেললাম।
না, কোন ভুল নেই, আমাদে্র সেই ছবি, মায়র হাতে লেখা “নিবিড় ঘন আঁধারে” গান, একটা দশ টাকার নোট, আমার শিশু হাতের চুড়ি- কত বছর পে্রিয়ে এই সব জিনিস আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল।
শুনলাম আমি ফাদারকে প্রশ্ন করছি, ”আপনি এটা কোথায় পেলেন?"
“আপনার মুখের চেহারা বলছে, প্রভুর অনন্ত কৃপায় আমি ঠিক লোককেই খুঁজে পে্যেছি। খুব সংক্ষেপে ঘটনাটা বলি-
"আঠারো বছর আমি এই চার্চে আছি। চিরকালই আমি খুব ডানপিটে, ভয়ডর ছিল না, অনেক ট্রেকিং করেছি, বহু দুর্গম জায়গা একা ঘুরে এসেছি। এখানে আসার পর লাইট হাউসটার কথা শুনে খুব ভাল লেগেছিল, ঠিক করেছিলাম চূড়ায় উঠব। দুতিন দিনের মধ্যেই গিয়ে দেখে এসেছিলাম। চার্চ থেকে একটু দূরে, প্রচুর ঝোপজঙ্গল আর আগাছায় চারদিক ভরা। সাপখোপের ভয়েই হয়ত লোকজন কাছে ঘেঁষত না। তবে আমি হার মানার বান্দা নই কোনকালেই, গামবুট পরে, মজবুত লাঠি নিয়ে একদিন ঢুকে পড়লাম লাইটহাউসে। বেশ শক্ত সিঁড়ি, সাপ বা অন্য কিছুর দেখা পে্লাম না, উঠে গেলাম দুশো পঞ্চাশটা ধাপ। কিন্তু পরের ধাপে পা দিয়েই কে্মন একটা অদ্ভুত ফীলিং হল, ধাপটা একটু চওড়া মত, মনে হল কোণে্র দিকে কেউ যেন বসে আছে। মনের ভুল ভেবে জোর করে চোখ ফিরিয়ে ওপরে উঠে গে্লাম। গোল বারান্দা আছে ওপরে, যতদূর চোখ যায় আরব সাগরের ঢেউ, অপার্থিব দৃশ্য, কিন্তু্ কেন জানি দেখতে ভাল লাগল না। ধাপ গুণে নে্মে এলাম সেই জায়গাটায়, আর আলো আঁধারিতে চোখ সইয়ে ভাল করে দেখলাম।
না,আমার ভুল হয় নি। সিঁড়ির কোণে বসে আছে একটি নরকঙ্কাল। তার গায়ে, আশপাশে সম্ভবত তার পোশাকের অংশ, পায়ের কাছ এই পার্স।
কী সাংঘাতিক বিভীষিকা! সম্পুর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে হঠাৎ এই ভয়ানক বীভৎস দৃশ্য দেখে কিছুক্ষণ আমার মত সাহসীরও জ্ঞান ছিল না। সদাপ্র্রভুর অসীম কৃপায় কীভাবে চেতনা ফিরে পেয়েছিলাম, মাথা ঠান্ডা রেখে আবার সেই আড়াইশো ধাপ নেমে বাইরে বে্রিয়ে এসেছিলাম, তা আজও জানি না। পার্স টা কখন তুলে নিয়েছিলাম তাও মনে করতে পারি নি। তবে রেখে দিয়েছিলাম যত্ন করে, ফটোটি দেখতাম মাঝে মধ্যে। তোমার মুখে্র সঙ্গে ছবির পুরুষটির হুবহু মিল দেখে মনে হল পরম্ পিতার করুণায় আমার দায়িত্ব বোধহয় আজ শেষ হল। এইটুকুই আমার বলার ছিল।”
কপালে, বুকে আঙুল ছুঁইয়ে ফাদার ক্রস আঁকলেন, উচ্চারণ করলেন আশীর্বাণী “In the name of the Father, and of the son, and of the Holy Spirt, Amen”
বাবা, ফাদারের যীশু হয়তো আমার প্রতিও লক্ষ্য রেখেছিলেন, কারণ কীভাবে সেই ব্রীজ পে্রিয়ে পাঞ্জিম ফিরে এলাম, একটা হোটেলে উঠলাম, মণীশকে ফোন করে দিলাম কিছুই মনে নেই। হোটেলের ওয়াই ফাই পাসওয়ার্ড নিয়ে তোমাকে মেল করতে বসেছি, এইটুকু শুধু খেয়াল আছে।
কুড়ি বছর আগে ঐ দ্বীীপের লাইটহাউসে যা ঘটেছিল, গত বারো ঘন্টা ভেবে আমি তার দূটো সম্ভাবনা বে্র করেছি।
হিতেশ বা রীতেশ দেশমুখ হয়তো মার কুমারীকালে্র বন্ধু অথবা পরিচিত ছিল। তাকে জড়িয়ে মাকে তুমি নোংরা সন্দেহ করতে। বিন্দুমাত্র প্রমাণ না পেয়েও সেই সন্দেহ, যা একধরণের মানসিক বিকার, তা বাড়তে বাড়তে এমন পর্বতপ্রমাণ হয়ে উঠেছিল যে, তুমি মাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চাইছিলে। তা ছাড়া, তোমার হিসেবে মা ছিল নির্বোধ, তোমার পাশে দাঁড়ানোর অযোগ্য।
তাই অনেক প্ল্যান করে মাকে প্রথমে গোয়া, তারপর ওই দ্বীপে নিয়ে গিয়েছিলে। লাইট হাউসের প্রতি মার অদম্য আকর্ষণ ছিল, তা আমিই তোমাকে বলেছিলাম। জীবনে প্রথমবার লাইট হাউস দেখে আমার সরল মা আত্মহারা হয়ে পড়বে, ওপরে উঠতে চাইবে তা তুমি জানতে। মা যে এর আগে নিজে্র চোখে লাইট হাউস দেখে নি বাবা, কখনো তোমাকে অবিশ্বাসও করে নি। তাই ঐ মিনারের চুড়ার কাছে মাকে নিয়ে যাওয়া তোমার কাছে অতি সহজ ছিল।
তারপর?
তারপর কি তুমি মাকে গলা টিপে মে্রে ফে্লে ওইখানে বসিয়ে দিয়ে এসেছিলে?
না কী, জীবন্ত অবস্থাতেই হাত পা বে্ঁধে বসিয়ে রেখে চলে এসেছিলে, আর দিনের পর দিন একলা বসে বসে আমার মা নিদারুণ অভিমানে, হতাশায় ক্লান্তিতে, ক্ষিদেতে একটু একটু করে মরে গিয়েছিল?
দিল্লি ফিরে এসে তুমি দিদাকে বলেছিলে মা দেশমুখের সঙ্গে চলে গেছে, কিন্তু দিদা জানতেন তুমি মিথ্যে বলছ। তিনি সম্ভবত দেশমুখকে চিনতেন তাই দেশমুখে্র মৃত্যুর অকাট্য প্রমাণ জোগাড় করতে পেরেছিলেন, তোমার মুখের ওপর সেই দলিল ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। এইসব ঘটনার পাঁচ বছর আগে সে দূর বিদেশে মারা গিয়েছিল। ঘরবন্দি, নিরীহ মার সঙ্গে তার যোগাযোগ থাকা অসম্ভব ছিল। পুরো ব্যাপারটাই ছিল তোমার সদা উত্তপ্ত মস্তিষ্কের রুচিহীন কল্পনা।
বাবা, আমি জানি তুমি তোমার মত করে আমাকে ভালবেসেছিলে, সেখানে কোনদিন ফাঁক ছিল না। তাই তোমাকে বলে যাই, আমি আর দিল্লি ফিরব না। তোমার সামনে দাঁড়িয়ে কৈফিয়ৎ চাইবার ইচ্ছাও নেই, তাতে তো মা ফিরবে না। তোমার বসন্তকুঞ্জের রাজকীয় ফ্ল্যাট, ছত্তরপুরের ফার্ম হাউস, অগাধ সম্পত্তি কোন কিছুতেই আমার আর প্রয়োজন নেই। কাল আমি ওই লাইট হাউসে যাব, দেখব মা এখনো বসে আছে কিনা, থাকলে আমিও পাশে বসে থাকব।
আর না থাকলে?
আমি একাই বসে থাকব, মা নিশ্চয়ই আমাকে দেখতে পাবে।
মা যে অনেকদিন একলা আছে, বাবা।
অর্চিস্মান।