এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  অন্যান্য  মোচ্ছব

  • না বলে চলে যেতে নেই

    Supratik Chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | মোচ্ছব | ১৪ মার্চ ২০২৫ | ৫৫ বার পঠিত
  • চোখে না দেখে কত মানুষের চলে যাওয়ার খবর শুনি। পথের পাঁচালীর হরিহর যেমন ফিরে এসে শুনেছিল দুর্গা আর বেঁচে নেই। অপু যেমন খবর পেয়েছিল প্রসব হতে গিয়ে স্ত্রী অপর্ণার... মেয়েটিও তেমনি জেনে গেছিল বাবা আর নেই। বাবার মৃতদেহ সে দেখেনি। তাই সে আজও প্রবল দ্বিধায়, যাকে চলে যেতে দেখেনি,  সে সত্যিই কি গেছে কোথাও? বাবাই তো বলত নিজের চোখে না দেখে কিছু বিশ্বাস করবি না। তাহলে? দশ বছরের মেয়েটি জেনেছিল বাবা নেই। নেই মানে আশেপাশে নেই। নেই মানে আছের বিপরীতে।  টেলিফোনে জেনেছিল। তারপর যত বড় হয়েছে তত দ্বিধা বেড়েছে। মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছে। বাবা নেই,বিশ্বাস করিনা,কারণ নিজের চোখে দেখিনি।
    এরকম তো কতই হয়। কর্মক্ষেত্র থেকে যতবার মফস্বলের বাড়িতে ফিরি, প্রতিবার শুনি পাড়ায় কেউ না কেউ ঠিক চলে গেছে। কারোর বয়স হয়েছিল, কেউ বিরক্ত হয়েছিল, কেউ হঠাৎ করেই...  আড়ালে চলে গেছে ওরা। অগোচরে যা ঘটেছে তাকেই সত্যতার মুকুট পরিয়ে সারাজীবন একটা শুন্যস্থান বইতে হয়। যা ছিল তা এতটাই ছিল যে এখনের একটুও না থাকাকে মন মানতে চায় না। শুধুই কি মানুষ? বিয়াল্লিশ বছর বিলেতে কাটানোর পর শেষ বয়সে কলকাতায় ফিরে এসে যে  বৃদ্ধ জানতে পারেন ফেভারিট কেবিন আর নেই। লাইটহাউস নেই। বহু ট্রাম উঠে গেছে৷ বহু রাস্তার পুরনো নাম আর নেই। এটাও তো একরকম চলে যাওয়া। ফেলে আসা বাঁকের একেকটা আলো-ছায়ার ফিউশন কবে কোথায় কীভাবে উবে গেল জানা যায় না। শুধু রৌদ্রের বয়স বেড়ে চলে। এ গলি সে গলি ঘুরতে ঘুরতে হতোদ্যম আগামীর কানে কানে বলে ওঠা, এখানে হরিজ্যাঠাদের ঠেক ছিল, ওইপাশটায় বটগাছ, আরো ডানদিকে এগিয়ে গেলে বুড়ো শিবমন্দির ছিল একটা... এক বুড়ি থান পেঁচিয়ে প্রদীপ জ্বালতেন সন্ধ্যায়। কিছুই আর নেই। 'নেই' য়ের সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে 'আছে'র ঢেউতে ধাক্কা অবিরত।
    যে মৃত্যু চোখে দেখিনি, যে দেহকে পুড়তে দেখিনি, যে শব আমার কাছে একসময়ের উত্তপ্ত জীবন ছিল, যে চলে যাওয়া আমার সামনেই ঘটেনি, তার জন্য মনখারাপ তীব্র হয় না। বরং  কুয়াশার মতো আবছা থাকে চৈতন্য।  সেই দশ বছরের মেয়েটি যেমন, বাবার কোনো ছবিই রাখেনি ঘরে। আয়তকার ফ্রেমে মৃত্যুকে বাঁধা যায়? মৃত্যুর তো কোনো পোজ হয় না, মৃত্যু বরাবর ক্যানডিড।পড়শিরা জিজ্ঞাসা করেছিল " হ্যাঁ রে, তোর বাবার কোনো ছবি নেই তোদের ঘরে?" মেয়েটি উত্তর দিয়েছিল " না গো। বাবা একজায়গায় বসে থাকার লোকই না.. " মেয়েটি হাসত৷ বাবার হাতের লেখার ওপর আঙ্গুল বোলাতে বোলাতে বলত " লোকে বলে তুমি নেই, তাই আমিও বলি। রাগ কোরো না..."
    এই মেদুরতায় আমার প্রয়োজন হয় একমাত্র রবীন্দ্রনাথকে। মেয়েটিরও দরকার হয়। এই প্রয়োজন সাংস্কৃতিক নয়, আনুষ্ঠানিক নয়, বরং একেবারে নিভৃতের ব্যক্তিগত প্রয়োজন। আমরা গাইতে পারিনা, লিখতে পারিনা, বলতে পারিনা। মঞ্চে দাঁড়িয়ে রবি ঠাকুরকে নিয়ে দুটো কথাও হয়ত বলতে পারব না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সমস্ত বিশ্লেষনের বাইরে বেরিয়ে এসে বাবার খালি ঘরটায় মেঘের মতো এসে দাঁড়িয়ে থাকেন।  "জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে..." বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে মেয়েটির৷ বাবা তাহলে জীবনেও নেই,মরণেও নেই?? কোথায় আছে তবে? রবীন্দ্রনাথ বলেন " এ মোর হৃদয়ে বিজন আকাশে..." মেয়েটি সব দ্বিধার উত্তর পেয়ে যায় যেন। বাবা যায়নি কোথাও। আছে। যেখানে থাকার কথা সেখানেই আছে।
    প্রতিটি মৃত্যুসংবাদ ও শোকের ময়নাতদন্ত করতে করতে দেখা হয়ে যায় একজন সদ্য বিধবার সাথে। সন্ধ্যার একটু আগে যার স্বামীকে সৎকারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আশেপাশের শোকার্ত ভিড় কমতে শুরু করেছে ঘরের ভিতর। ভদ্রমহিলা আমায় সামনে পেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন " গোটাটা পুড়ে যেতে কত সময় লাগে রে?" আমি উত্তর দিতে পারিনি৷ বলতেই পারিনি যে গোটাটা তো কখোনো পোড়েনা কাকিমা। তারপর উনি চুপচাপ বসে রইলেন অনেকক্ষণ। আমার আর কাকিমার মাঝখানের হাত চারেক দুরত্বে সেদিনও দাঁড়িয়ে ছিলেন সেই রবীন্দ্রনাথ। " সুদূর কোন নদীর পাড়ে গহন কোন বনের ধারে গভীর কোন অন্ধকারে হতেছ তুমি পার??" রবীন্দ্রনাথ কি চলে যাওয়া এতই স্পষ্ট দেখতে পেতেন?
    অন্ধকার পার হওয়ার রহস্য তো কেউ জানেনা। মানুষ কেবল অতর্কিত একটা শুন্যস্থানের সামনে এসে ধাক্কা খায়, তারপর নিখুঁত ভাবে সেই শুন্যস্থানকেও বসিয়ে নেয় জীবনের গর্ভে। সয়ে যায় শোক৷ সয়ে যায় শান্তি।
    মেয়েটি জানে বাবা আসবে একদিন অন্য শহর থেকে। না এলে ও নিজেই যাবে একদিন বাবার কাছে। চলে যাওয়া গুলো মিলিয়ে দিলেই তো একটা থেকে যাওয়া তৈরী হয়। কিশোর অপু কলকাতা থেকে নিশ্চিন্দিপুর ফিরে এসে জানতে পেরেছিল সব আছে,কেবল মা নেই। কত পাখি সকালে উড়তে বেরিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে এসে দেখে গাছটা আর নেই, বাসাটা আর নেই। অগোচরে থাকা প্রস্থান গুলোর কাছাকাছি আর পৌঁছনো যায় না। এরকম কত না থাকা অজান্তেই ঘটে যাবে..
    মেয়েটি এখন বড় হয়েছে। ও জানে চলে যাওয়ার সাক্ষী কেবল সেই হয় যে চলে যাচ্ছে। আর কেউ নয়।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • অন্যান্য | ১৪ মার্চ ২০২৫ | ৫৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন