এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • মায়ের বিয়ে

    Supratik Chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ২৮ মার্চ ২০২৫ | ৮৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • মায়ের বিয়ে হল। বড় বাড়ি। সাদা চকচকে অ্যাম্বাসেডার এসে থামল সর্ষেক্ষেতের পাশে।  নীল চাঁদ আকাশে। মা আগে কোনোদিন গ্রাম দেখেনি। রাত তখন কত কে জানে! ক্ষেতের আল ধরে লাল চেলীর মেয়েটা এগিয়ে গেল নতুন বাড়ির দিকে। চরাচরের নৈশব্দকে চুরমার করে হঠাৎ কোথায় উলু আর শাঁখ বেজে উঠল!
    মা লজ্জা পেল। এরকম লজ্জা মেয়েরা জীবনে একবারই পায়।  বাবা ভীষণ অন্ধকারে! মা আলোর কাছে এসে দাঁড়াল। বাবার ধূসর মুখ! মায়ের মুখে দক্ষিন কলকাতার ঝলকানি!
    "গুড়ের সন্দেশ খাও তো মা??"
    নতুন বউ! কপালে চন্দন! অবসন্ন শৃঙ্গার!
    নতুন বউ! অনন্ত আব্রু! অলীক কামনা!

    এ গাঁ ও গাঁ থেকে সব ছুট্টে এল দেখতে! কলকেতার কণে এয়েচে গো! মুখ খানা ঠিক যেন শাবানা আজমি! এটা সেটা কত কিছু বলল ওরা! মা  ভেজা শালিক পাখির মতো সংকুচিত শরীরে রাণীর মসনদে উপবিষ্টা!  একদিনের সিংহাসন! কেউ জিজ্ঞাসা করল না পড়াশোনার কথা!

    লোয়ার ডেপথস হয়েছিল মনে আছে?? রক্তকরবীর নন্দিনী হয়েছিলে,মনে আছে?? সেই অপূর্ব করাঘাত গুলোর ওপর চ্যাটচেটে মধু ঢেলে দিল সংসার! অবশ হয়ে গেল মায়ের শরীর,হাত,পা,মুখ! মায়ের শরীরে লাগাম! আমি দেখেছি! চাকা চাকা লাল দাগ!
    একটা স্যাতসেতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে রইল জন্মবেলার অভিশাপ! আমরা, সন্ততিরা, রাজহাঁসের মতো দৌড়োলাম পরিত্যক্ত রানওয়ে দিয়ে! আমাদের পাখার ঝাপটে এলোমেলো হল মায়ের শৃঙ্গার!
    বাবা তখোনো ধূসর!
    বটিতে ঘ্যাঁচ করে কেটে গেল মায়ের আঙ্গুল! ফিনকি দিয়ে রক্ত!
    আমরা, সন্ততিরা, মলয় বাতাসের নীল ঘুড়িরা, খোঁজই নিইনি সেই ক্ষত শুকিয়েছিল কবে!

    গতজন্মের সব শিহরণই মনে আছে। হারমোনিয়ামটা কোথায়??
    সপ্তসুরের ওঠানামা! গানের দিদিমনি! চিত্রাঙ্গদা!
    মায়ের একদিন মন খারাপ। বারান্দায় জমাট মেঘ! পিকলুদের বাড়িতে দেবব্রত বিশ্বাস..
    "আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে..."
    মা স্নান করেনি সেদিন। কিছু একটা ঘটেছে খুব নির্জনে..
    এঁদো বাছুরের মতো পেছন পেছন ঘুরছি! মার চোখে জল! ওই গভীর নির্জনতা পেরিয়ে দু ফোঁটা সমুদ্রের পানি!  কী হয়েছে মা??
    -কাউকে কোনোদিন দুঃখ দিস না বাবু..
    স্বগতোক্তি?? 

    বেণীমাধবকেও দেখলাম! বেণীমাধব একটা বেড়ালের নাম। সে এক বর্ষার বিকেলে মনের সুখে বারান্দায় পায়চারি করছিল! পা টা খানিক পিছলে গেল! কেউ একজন ওর সামনে একটা বাটি রেখে গেল! বাটি ভরা উচ্ছিষ্ট! টিনের চাল থেকে সরু হয়ে জল পড়ছে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ির ভেতর! এফ এমে মহম্মদ রফি! মা কে কোথাও দেখলাম না! নিশ্চয়ই ঘরে! উপুড় হয়ে বই পড়ছে!
    কী বই??
    শরৎচন্দ্র!
    কী গল্প?
    অভাগীর স্বর্গ!
    শরৎচন্দ্র তোমার ভালো লাগে?
    কথাশিল্পী! ভালো লাগবে না?
    বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা শরৎ সমগ্র! তার ভেতর গিজগিজ করছে গ্রামবাংলার অন্ধকার পাড়া গুলো! সন্ধ্যা প্রদীপ! সাদা থান! অকাল বৈধব্যে ঠাসা পৃথিবী! আটপৌঢ়ে সমাজের পান্ডুলিপি!
    ধূ ধূ চরাচরে মায়ের দাহ সেরে ফিরে আসছে কাঙাল! সৎকারের ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে রথের মতোন ভাসছে আকাশে!
    মা! কেন এরকম গল্প লিখতেন লোকটা??

    মশারির ভিতর জোনাকি! বালাপাড়ার মাঠে খোলের দমক! অষ্টকালীন! জানলার পাশ দিয়ে মড়া নিয়ে গেল কারা! সেঁধিয়ে গেলাম মায়ের গর্ভে!
    যখোনি ভয় পেয়েছি তখোনি মা আমায় গর্ভে ধরেছে! 
    বেণীমাধব মরে গেল তুলসীতলায়! কীভাবে মরল কেউ জানেনা! কেউ চায়না জানতে! চটের বস্তায় ভরে ওকে রেখে আসা হল কোরক দীঘির পাশে! ওটুকুই দায়! ওটুকুই মায়া!
    পৃথিবীর ভিতরে পৃথিবী!
    মা, একটা চমৎকার কভার ড্রাইভ মেরে আমার মনে হয়েছিল তুমি যদি দেখতে পেতে!
    একটা চমৎকার কবিতা লিখে তোমায় যদি পড়াতে পারতাম!
    তুমি কভার ড্রাইভও বুঝতে না,কবিতাও বুঝতে না! শুধু বুঝতে পারতে আমি সকাল থেকে কিছু খাইনি! সব চেয়ে সত্য বোঝা! মুখ শুকনো! ঠোঁট শুকনো! কঙ্কালের মতো শরীর আমার!  নিভৃত অলিন্দ! চুড়ির আওয়াজ থামলে বুঝি মা থেমে গেছে!
    তারপর একলা একলা উঠে গেছে পরিবারের ছাদে! তারপর! সব ঝাপসা!! গলে যাওয়া বিগত জীবন! মোমের মতো গলে  যাওয়া বাপের বাড়ি! গলে যাওয়া ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি! গলে যাওয়া সিনেমা হল, ফুটপাথ, মনমোহন দেশাইয়ের সিনেমা!গলে যাওয়া জালুকবাড়ি,ট্রামডিপো,হস্টেলের মাঠ! তুমি সেই ছাদেই পৃথিবীর সমস্ত মৃত্যুসংবাদ জেনে নেবে! তারপর ঘুটঘুটে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসবে অন্দরমহলে!
    আচমকা ঘুমের ভিতর রোদ পড়বে! হেমন্তের কাচা রোদ্দুর! সোঁদা মেঝের ওপর পড়ে আছে খেলনা বাটি! ভাঙা ভাঙা! মেয়েবেলার মালঞ্চ! তুমি সব বাসন চিনে নিয়েছিলে সেই কোন কালে! তোমার রঙপেনসিলের বাক্সে রামধনু! নববর্ষের পোষ্টকার্ড! তোমার মেজোমামার চিঠি! তোমার শরীর বেয়ে ওঠা শাড়ির গুল্ম! কপালের টিপ! বড়ো লাল টিপ! রেখার মতোন!
    সন্তান যতো বড়ো হয় তত হলুদ হয়ে যায় অ্যালবামের চৌকো ছবি গুলো। সাদা কালো বাৎসল্য! ফাংগাস পড়ে যায় স্মৃতির ওপর! তুমি হাত বুলিয়ে শৈশব খোটো! গভীর ঘুমে তুমি চমকে ওঠো! আয়নার সামনে এলে মনে পড়ে সন্ততিরা কাছে থাকে না আর! সময় বদলেছে! মাথায় পাকা চুল সামান্য! কেমন একটা হয়ে যাও তুমি! চারাগাছ ধীরে ধীরে বৃক্ষ হয়ে যায়! আর তুমি মাটির মতো আকড়ে রাখো শিকড়! একটু আলগা হলেই মৃত্তিকা তার চিরকালের কৌলীন্য হারাবে! ভয়! স্বপ্ন! আনন্দ!
    কোন অচিনপুরে বেড়ালশিশুর কান্নার আওয়াজ তোমায় স্পর্শ করে তখন! মা! সবারই নিভৃত একটা গুম ঘর থাকে! আমারো আছে! থরে থরে জিনিষ সাজানো! কত এলোমেলো হাবিজাবি পথ্য! বই,গোলাপ,গান,সিনেমা, মধুশালা,প্রেম...স্টেশনের পর স্টেশন! গ্রামের পর গ্রাম! জঙ্গলের পর জঙ্গল!কত মানুষ! একদিন খুলে দেব ঘরটা! এসে দেখে যেয়ো! আমি সব আসবাবকে ঢেকে রাখি তোমার ছাপা শাড়িটা দিয়ে!
    সম্ভব হলে তোমার ঘরটাও একদিন দেখিয়ো আমায়। খানিকটা মেঘ মেখে আসব! কাঁচা সবজির গন্ধ, হলুদ মাখা হাতের গন্ধ, খানিকটা শরৎচন্দ্র শিখে আসব। তারপর ফিরে আসব আবার এই জন্মে!
    এই জন্ম!
    এই স্থিতি!
    এই মায়ার আঁচলে!!

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ২৮ মার্চ ২০২৫ | ৮৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন