মায়ের বিয়ে হল। বড় বাড়ি। সাদা চকচকে অ্যাম্বাসেডার এসে থামল সর্ষেক্ষেতের পাশে। নীল চাঁদ আকাশে। মা আগে কোনোদিন গ্রাম দেখেনি। রাত তখন কত কে জানে! ক্ষেতের আল ধরে লাল চেলীর মেয়েটা এগিয়ে গেল নতুন বাড়ির দিকে। চরাচরের নৈশব্দকে চুরমার করে হঠাৎ কোথায় উলু আর শাঁখ বেজে উঠল!
মা লজ্জা পেল। এরকম লজ্জা মেয়েরা জীবনে একবারই পায়। বাবা ভীষণ অন্ধকারে! মা আলোর কাছে এসে দাঁড়াল। বাবার ধূসর মুখ! মায়ের মুখে দক্ষিন কলকাতার ঝলকানি!
"গুড়ের সন্দেশ খাও তো মা??"
নতুন বউ! কপালে চন্দন! অবসন্ন শৃঙ্গার!
নতুন বউ! অনন্ত আব্রু! অলীক কামনা!
এ গাঁ ও গাঁ থেকে সব ছুট্টে এল দেখতে! কলকেতার কণে এয়েচে গো! মুখ খানা ঠিক যেন শাবানা আজমি! এটা সেটা কত কিছু বলল ওরা! মা ভেজা শালিক পাখির মতো সংকুচিত শরীরে রাণীর মসনদে উপবিষ্টা! একদিনের সিংহাসন! কেউ জিজ্ঞাসা করল না পড়াশোনার কথা!
লোয়ার ডেপথস হয়েছিল মনে আছে?? রক্তকরবীর নন্দিনী হয়েছিলে,মনে আছে?? সেই অপূর্ব করাঘাত গুলোর ওপর চ্যাটচেটে মধু ঢেলে দিল সংসার! অবশ হয়ে গেল মায়ের শরীর,হাত,পা,মুখ! মায়ের শরীরে লাগাম! আমি দেখেছি! চাকা চাকা লাল দাগ!
একটা স্যাতসেতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে রইল জন্মবেলার অভিশাপ! আমরা, সন্ততিরা, রাজহাঁসের মতো দৌড়োলাম পরিত্যক্ত রানওয়ে দিয়ে! আমাদের পাখার ঝাপটে এলোমেলো হল মায়ের শৃঙ্গার!
বাবা তখোনো ধূসর!
বটিতে ঘ্যাঁচ করে কেটে গেল মায়ের আঙ্গুল! ফিনকি দিয়ে রক্ত!
আমরা, সন্ততিরা, মলয় বাতাসের নীল ঘুড়িরা, খোঁজই নিইনি সেই ক্ষত শুকিয়েছিল কবে!
গতজন্মের সব শিহরণই মনে আছে। হারমোনিয়ামটা কোথায়??
সপ্তসুরের ওঠানামা! গানের দিদিমনি! চিত্রাঙ্গদা!
মায়ের একদিন মন খারাপ। বারান্দায় জমাট মেঘ! পিকলুদের বাড়িতে দেবব্রত বিশ্বাস..
"আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে..."
মা স্নান করেনি সেদিন। কিছু একটা ঘটেছে খুব নির্জনে..
এঁদো বাছুরের মতো পেছন পেছন ঘুরছি! মার চোখে জল! ওই গভীর নির্জনতা পেরিয়ে দু ফোঁটা সমুদ্রের পানি! কী হয়েছে মা??
-কাউকে কোনোদিন দুঃখ দিস না বাবু..
স্বগতোক্তি??
বেণীমাধবকেও দেখলাম! বেণীমাধব একটা বেড়ালের নাম। সে এক বর্ষার বিকেলে মনের সুখে বারান্দায় পায়চারি করছিল! পা টা খানিক পিছলে গেল! কেউ একজন ওর সামনে একটা বাটি রেখে গেল! বাটি ভরা উচ্ছিষ্ট! টিনের চাল থেকে সরু হয়ে জল পড়ছে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ির ভেতর! এফ এমে মহম্মদ রফি! মা কে কোথাও দেখলাম না! নিশ্চয়ই ঘরে! উপুড় হয়ে বই পড়ছে!
কী বই??
শরৎচন্দ্র!
কী গল্প?
অভাগীর স্বর্গ!
শরৎচন্দ্র তোমার ভালো লাগে?
কথাশিল্পী! ভালো লাগবে না?
বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা শরৎ সমগ্র! তার ভেতর গিজগিজ করছে গ্রামবাংলার অন্ধকার পাড়া গুলো! সন্ধ্যা প্রদীপ! সাদা থান! অকাল বৈধব্যে ঠাসা পৃথিবী! আটপৌঢ়ে সমাজের পান্ডুলিপি!
ধূ ধূ চরাচরে মায়ের দাহ সেরে ফিরে আসছে কাঙাল! সৎকারের ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে রথের মতোন ভাসছে আকাশে!
মা! কেন এরকম গল্প লিখতেন লোকটা??
মশারির ভিতর জোনাকি! বালাপাড়ার মাঠে খোলের দমক! অষ্টকালীন! জানলার পাশ দিয়ে মড়া নিয়ে গেল কারা! সেঁধিয়ে গেলাম মায়ের গর্ভে!
যখোনি ভয় পেয়েছি তখোনি মা আমায় গর্ভে ধরেছে!
বেণীমাধব মরে গেল তুলসীতলায়! কীভাবে মরল কেউ জানেনা! কেউ চায়না জানতে! চটের বস্তায় ভরে ওকে রেখে আসা হল কোরক দীঘির পাশে! ওটুকুই দায়! ওটুকুই মায়া!
পৃথিবীর ভিতরে পৃথিবী!
মা, একটা চমৎকার কভার ড্রাইভ মেরে আমার মনে হয়েছিল তুমি যদি দেখতে পেতে!
একটা চমৎকার কবিতা লিখে তোমায় যদি পড়াতে পারতাম!
তুমি কভার ড্রাইভও বুঝতে না,কবিতাও বুঝতে না! শুধু বুঝতে পারতে আমি সকাল থেকে কিছু খাইনি! সব চেয়ে সত্য বোঝা! মুখ শুকনো! ঠোঁট শুকনো! কঙ্কালের মতো শরীর আমার! নিভৃত অলিন্দ! চুড়ির আওয়াজ থামলে বুঝি মা থেমে গেছে!
তারপর একলা একলা উঠে গেছে পরিবারের ছাদে! তারপর! সব ঝাপসা!! গলে যাওয়া বিগত জীবন! মোমের মতো গলে যাওয়া বাপের বাড়ি! গলে যাওয়া ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি! গলে যাওয়া সিনেমা হল, ফুটপাথ, মনমোহন দেশাইয়ের সিনেমা!গলে যাওয়া জালুকবাড়ি,ট্রামডিপো,হস্টেলের মাঠ! তুমি সেই ছাদেই পৃথিবীর সমস্ত মৃত্যুসংবাদ জেনে নেবে! তারপর ঘুটঘুটে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসবে অন্দরমহলে!
আচমকা ঘুমের ভিতর রোদ পড়বে! হেমন্তের কাচা রোদ্দুর! সোঁদা মেঝের ওপর পড়ে আছে খেলনা বাটি! ভাঙা ভাঙা! মেয়েবেলার মালঞ্চ! তুমি সব বাসন চিনে নিয়েছিলে সেই কোন কালে! তোমার রঙপেনসিলের বাক্সে রামধনু! নববর্ষের পোষ্টকার্ড! তোমার মেজোমামার চিঠি! তোমার শরীর বেয়ে ওঠা শাড়ির গুল্ম! কপালের টিপ! বড়ো লাল টিপ! রেখার মতোন!
সন্তান যতো বড়ো হয় তত হলুদ হয়ে যায় অ্যালবামের চৌকো ছবি গুলো। সাদা কালো বাৎসল্য! ফাংগাস পড়ে যায় স্মৃতির ওপর! তুমি হাত বুলিয়ে শৈশব খোটো! গভীর ঘুমে তুমি চমকে ওঠো! আয়নার সামনে এলে মনে পড়ে সন্ততিরা কাছে থাকে না আর! সময় বদলেছে! মাথায় পাকা চুল সামান্য! কেমন একটা হয়ে যাও তুমি! চারাগাছ ধীরে ধীরে বৃক্ষ হয়ে যায়! আর তুমি মাটির মতো আকড়ে রাখো শিকড়! একটু আলগা হলেই মৃত্তিকা তার চিরকালের কৌলীন্য হারাবে! ভয়! স্বপ্ন! আনন্দ!
কোন অচিনপুরে বেড়ালশিশুর কান্নার আওয়াজ তোমায় স্পর্শ করে তখন! মা! সবারই নিভৃত একটা গুম ঘর থাকে! আমারো আছে! থরে থরে জিনিষ সাজানো! কত এলোমেলো হাবিজাবি পথ্য! বই,গোলাপ,গান,সিনেমা, মধুশালা,প্রেম...স্টেশনের পর স্টেশন! গ্রামের পর গ্রাম! জঙ্গলের পর জঙ্গল!কত মানুষ! একদিন খুলে দেব ঘরটা! এসে দেখে যেয়ো! আমি সব আসবাবকে ঢেকে রাখি তোমার ছাপা শাড়িটা দিয়ে!
সম্ভব হলে তোমার ঘরটাও একদিন দেখিয়ো আমায়। খানিকটা মেঘ মেখে আসব! কাঁচা সবজির গন্ধ, হলুদ মাখা হাতের গন্ধ, খানিকটা শরৎচন্দ্র শিখে আসব। তারপর ফিরে আসব আবার এই জন্মে!
এই জন্ম!
এই স্থিতি!
এই মায়ার আঁচলে!!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।