এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  অন্যান্য  মোচ্ছব

  • ওরা কখোনো ভেজে না

    Supratik Chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | মোচ্ছব | ২৮ এপ্রিল ২০২৫ | ৩৮ বার পঠিত
  • দীঘলপাহাড়িতে এসেও মন ভালো নেই। কেন ভালো নেই জানিনা। কথা গুলো ঠিক কোথাও গিয়ে পৌঁছচ্ছে না। শব্দ গুলো এতটাই খামখেয়ালী ও অন্যমনস্ক,সহজেই মাড়িয়ে দেওয়া যায়। পোক্ত কিছু নেই যেটাকে ধরে ঘষটে ঘষটে হাঁচড়ে পাঁচড়ে দেওয়াল বেয়ে ওঠা যায়। পুরোনো ঘরটায় ম্যাগাজিন জমানোর নেশা ছিল। আউটলুক কিনতাম। কুরুক্ষেত্র নামের একটি ম্যাগ রাখতাম। এখন কৃত্তিবাস গুলো ডাঁই হয়ে আছে। প্রেম গুলো মিইয়ে যাচ্ছে। একটা ঝকঝকে সাদা পাতায় হিসেব কষি ঠিক কতকিছুকে ঠিকঠাক মন দিয়ে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। আকুল হয়ে ওঠে আমার মিডিয়োক্রিটি। জঙ্গল পেরিয়ে ভূতের মতো সামনে এসে দাঁড়ায় গোবিন্দ সোরেন। 
    রান্না হবেক লাই?? 
    বেগুনের দাম বেড়েছে। শিকারি পাড়ার হাটে মেয়ে-বউরা গেলাসে গেলাসে মদ বিক্রি করছে। আজিব সুকুন ওয়ালা দৃশ্য! মশারির ভিতর ভুল করে একটা জোনাকি ঢুকে গেছিল। জোনাকি কামড়ায়?? জানা নেই। ব্লিঙ্ক করছে শরীর। যে খাটে শুয়েছি সে খাটে নিখিলদা মরে ছিল। স্যাঁতসেতে শীতের এক রাত্রে। ঘুমিয়ে ছিল, আর ওঠেনি। খাটটা তারপর থেকে বেশ ভারী। আমার পা বেড়িয়ে থাকে অনেকটা। নিখিলদাকে মনে পড়ে। ডেকে ওঠে বাইরের একটা কুকুর। ঠাকুমা থাকলে নির্ঘাত বলতেন এটা অশনিসংকেত! নিখিলদা জোনাকি হয়ে জন্মায়নি তো? ব্লিঙ্ক করছে শরীর! ফেলে আসা খাটের ওপর.... হতেই পারে। সব সত্যিই, ক্যাপ্টেন স্পার্ক বলেছিল। এত বেশী অন্ধকার কেন আজ? আমার কেন মনে পড়ছে পনেরো বছর আগে দেখা ছোটকাকার ঝুলন্ত শরীরটা? হাঁ হয়ে থাকা মুখটা আর গড়িয়ে পড়া ফেনা? কেন মনে পড়ছে চিতার ওপর অর্ধেক ঝলসানো সেজোজ্যাঠার শরীরটার কথা? আমি তো মনে করতে চাইছিনা এগুলো, তবুও কেন?? ভারী হয়ে আসছে কেন চারিদিক? শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কেন? একটু মুখে চোখে জল দেব? তার জন্যও তো যেতে হবে বাইরের নলকূপ অবধি! সাহস পাচ্ছিনা কেন? বাইরে বিপুল জঙ্গল এত নিস্তব্ধ কেন? জোনাকিটাও আর নেই! কেবলই মনে হতে থাকল যে বেরোলেই সেই ঝলসানো মুখ আর বিকৃত শরীরগুলোকে পড়ে থাকতে দেখব উঠোনে। আমি কি ভীতু?? না না না না!! আই অ্যাম নট! যাকগে, রাত কাটল। বৃষ্টি হল। শুন্য শুন্য! গোবিন্দ মুড়ি খাচ্ছে দাওয়ায় বসে। সকালটা যেন ঈশ্বরের পোজ দেওয়া হাসিমুখ! পোড় খাওয়া বৃদ্ধ পাহাড়াটা আর পুঁচকে হামিংবার্ডের ফরফরানি! একটা লজঝড়ে বাস যায়, এই রাস্তা দিয়ে। দুমকার দিকে। একটাই বাস একদিন। ভরভরন্ত লোক। বাসের ছাদে উঠে যাই। হঠাৎ পাশের জনকে দেখে খৈনী ডলতে ইচ্ছে করে। দুমকায় পৌঁছে বিডিওর সাথে দেখা করতে হবে। ইনফ্যাক্ট এটা জরুরী। পয়ষট্টি কিলোমিটার চুল উড়িয়ে.... আগেও গেছি, বাসের মাথায় চেপে রামগড়-গুমলা ইত্যাদি। জেনারেলি মোবাইলে গান চালিয়ে খুচখাচ কাজ গুলো করি। যেমন দাঁত ব্রাশ করতে করতে শুনছি "দুরন্ত ঘূর্ণির এই লেগেছে পাক..." গানের সাথে সাথে গুনগুন করে গলা মিলিয়ে দিতে ভালো লাগে। গলা মেলানো যায় বলেই সম্ভবত চেনা গানের প্রতি একটা পক্ষপাত কাজ করে। শুধু গানই বা কেন! যেকোনো কিছুই, যেখানে নিজেকে বেশ সেঁধিয়ে দেওয়া যায় তার প্রতি একটা বাড়তি ইনটারেস্ট থাকে। এটাই কি কমফোর্ট জোন? 
    এই আরণ্যক পৃথিবীতে সবকিছুই কেমন একলা একলা৷ মানুষ প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে। রাত্রিবেলা ঘরের পাশে কুঁয়োর কাছটায় একটি পরিবার থাকে। চৌকির ওপর বাবা মা আর দুটো শিশু। অনেকবার বলেছি বারান্দায় উঠে আসতে, শোনেনি। আমি নাকি উঁচু জাত! উঁচু জাতের লোকের সমান্তরালে বিচরণ করতে নেই। বাবাটি, অর্থাৎ লোকটি মজুরের কাজ করে। মহিলাটি নেপালি। ঝাড়খন্ডের দেহাতি বউ নেপালি হল কেন? সেই একই গল্প! সর্বনাশা প্রেম। ওরা পালিয়ে বিয়ে করেছিল। সে বিশাল ঝামেলা! বউটা বাচ্চার মাথার উকুন বেছে দিতে দিতে এসমস্ত কথা বলেছিল। হাসছিল, একটু দ্বিধা ছিল, একটু লজ্জা... চিকচিক করছিল মুখটা। ফরসা রঙটা অনেকটা তামাটে হয়ে গেছে এই প্রদেশে। পাহাড়ে ছাগল চরাতে যায় বউটা। বাচ্চাদুটোকে খেলনা আর চকলেট কিনে দিলাম। গোবিন্দ সবটাই জানে। রাত্তিরে আগুন জ্বালালে সবাই গোল হয়ে বসে হাড়িয়া গেলে। শিকারীকুঠি হাট থেকে সস্তায় শুয়োরের মাংস কিনে আনা হয়। ওই আগুন টুকু ছাড়া চরাচর অন্ধকার, সেই অন্ধকারে ভূতের মতো ঘুরি আমি। খোলা গলায় গান করি। "জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে..." ওরা বলে আমার গানের গলা ভালো। তবে মানে বুঝতে পারেনা। আমি ক্রমশ অন্ধকারের আরো গভীরে গিয়ে দুর থেকে ওই আগুন আর লোক গুলোকে দেখতে থাকি। চিতার মতো লাগে। জ্বলছে। আমার আবার মনে পড়ে ঝলসানো কবিতার শরীরগুলো। মূর্মু পাড়ায় বাজনা বাজে। ওদিকটা খ্রীষ্টানদের বস্তি। কেক টেকের বালাই নেই। ওই একটু দেশী মদ আর সনাতন প্রার্থণা! রাতের খাওয়া চুকিয়ে মশারিতে ফিরি। জোনাকিটাও ফেরে। ব্লিঙ্ক করে শরীর... পেচ্ছাপ চাপে। আমি দোর খুলে উঠোন পেরিয়ে কুঁয়োর পাশটা দিয়ে যাই। চৌকির ওপর নজর পড়ে। ওরা সংখ্যায় একজন বেড়েছে। এখন পাঁচজন। একটি কুকুরছানা ওদের সাথেই অ্যাডজাস্ট করে নিয়েছে। আমার কেন জানি খুব কষ্ট হয়। আমার মনে হয় কলকাতায় ফেরাটা জরুরী। কলকাতার বন্ধুরা জরুরী। অনেক আলো জরুরী। অন্ধকারে ভয় ভয় করে। শিমুল গাছটা জুড়ে জোনাকি আর জোনাকি... আমি ফের ঘরে ঢুকে খিল এঁটে দিয়ে চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি। তখন আর কিসসু মনে পড়ে না। স্বপ্নে দেখি ধূলো উড়িয়ে একটা ভাঙাচোরা জীর্ণ বাস এগিয়ে আসছে আমার দিকে। শুধু এগিয়েই আসছে, এগিয়েই আসছে, আমি অবধি আর পৌঁছচ্ছে না সেটা। ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। বারান্দায় যাই। চৌকি সমেত ওরা উঠে এসেছে বারান্দার টালির নীচে। আমায় দেখে চমকে উঠে ওরা বলে বৃষ্টি কমলেই আবার কুঁয়োর পাশে চলে যাবে। আমি মনে মনে প্রার্থণা করি বৃষ্টি যেন না কমে। যে বৃষ্টি জাত-পাত ভুলিয়ে দিতে পারে সেই বৃষ্টি আজীবন নেমে আসুক পৃথিবীর বুকে। ওই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে শুধু একটা মোবাইলের টর্চ জেগে আছে আলো দিয়ে। বউটা আমায় গান শোনাতে বলে। আমি খোলা গলায় গান করি "আমরা সবাই রাজা আমাদেরি...." ওরা হাতে হাতে তাল দেয়। রাত সাড়ে তিনটে। জোনাকিরাও গান শুনতে আসে। বৃষ্টি পড়েই যায়।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • অন্যান্য | ২৮ এপ্রিল ২০২৫ | ৩৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন