এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  অন্যান্য  মোচ্ছব

  • খালি হাত শাম আয়ি হ্যায়...

    Supratik Chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | মোচ্ছব | ০৩ মার্চ ২০২৫ | ২৩৭ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • অন্ধকার থেকে কর্কশ একটা চিৎকার "চাকরিটা পেয়েছিস?? মাইনে কত দেবে??"
    অন্ধকারের দিকে চোখ মেলে কেউ কেউ উত্তর দেয় "পেয়েছি।"
    অন্ধকার হেসে ওঠে "তাহলে তুইও বিক্রি হয়ে গেলি?"
    হ্যাঁ। বিক্রি হয়ে গেছি। বাজারে মেলে দিয়েছি পাঁজর। কেটে দিয়েছি ডানা। মেরুদন্ডকে বলেছি বাধ্য হতে। চরিত্রকে বলেছি শালীন হও। চোখকে শিখিয়েছি কিছু না দেখা। কানকে শুনিয়েছি অ্যাম্বুলেন্স। হ্যাঁ। আই অ্যাম সোল্ড আউট!

    কাঁঠাল গাছটা বেঁকে গেছিল। কর্পোরেশন থেকে লোকজন এসে কেটে নিয়ে চলে গেল। গাছ কাটার শব্দ হয়। কিন্তু ছায়ারা নিঃশব্দে কেটে পড়ে। লুকিয়ে পড়ে বহুমাত্রিক অন্ধকারের আস্তানায়। জানিনা আত্মহত্যার আগে মাথার ভেতর বৃক্ষ গজিয়ে ওঠে কিনা। আত্মহত্যা নিজেকে অতিক্রম করতে শেখায়? রাত বিরেতে হঠাৎ বলে বসি ভালো লাগে না কিছু। উল্টোদিকের মানুষটারও ভালো লাগে না কিছু। একটু কফি বানিয়ে খাই। গান শুনি। জিন্দেগি অউর কুছভি নেহি.. তবুও ভালো লাগে না কিছু। মন জুড়ে মরা স্রোত। বটগাছটা প্রকান্ড, ঝুরি নামিয়ে দেখছে শতাব্দী থেকে শতাব্দী। সমস্ত না থাকার মধ্যিখানে আছে সে। আমার জ্যাঠামশায়ের মতোন। চোখের সামনে একে একে দেখে গেছেন ছোট ভাইদের চলে যাওয়া। বটগাছের মতো জীবন বড় কষ্টের। মাথার ওপর আকাশ। পায়ের নীচে শেকড়। মধ্যিখানে জরাগ্রস্ত "থেকে যাওয়া"।

    কুয়াশার মতো একটা লোককে রোজ দেখি, ছিপছিপে রাস্তায় সোজা হেঁটে ঠিক বাঁক নেবার মুহূর্তে পিছন ফিরে তাকায়। রোজ হয় এটা। কত লোক কত জায়গায় যাবে জন্য বেরোয়। আবার ফিরে আসে। জেনারেল কামরায় তাস পেটাতে পেটাতে ভোর হয়ে গেছিল। স্প্রাইটের বোতলে রাম পাঞ্চ করে গিলছিল সবাই। ওরা থাকে লেকগার্ডেনে। এখন গাঁয়ে ফিরছে। ওরা সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করে পাশাপাশি সব অ্যাপার্টমেন্টে। গল্প হয়। খুচরো গল্প। ভোরও হয়। শিথিল হয়ে আসে পেশী। স্নায়ু.. ওরা কখন কোথায় নেমে যায় টের পাই না। জ্বর জ্বর লাগলে মায়ের কথা মনে পড়ে। ঠান্ডা হাত। উঠোন জুড়ে শিউলি ছড়িয়ে থাকত আমাদের। আমরা বুঝতাম মহালয়া সামনে। বুঝতাম মা জ্বর সারিয়ে দিতে পারে।

    আমার লেখা আমার কাছে এসে বসে মাঝে মাঝে। দেওয়া-নেওয়ার একটা অন্তরাল তৈরী হয়। ও বলে "ডাকলে কেন?", আমি বলি "আমার ভালো লাগছে না কিছু।" ও তখন আমার জন্য একটা আস্ত মাঝরাত তৈরী করে দেয়। টের পাই আমার ঘরের অনতিদুরেই একটি রেললাইন আছে। গভীর রাতে এক্সপ্রেস একটা যায়। আমার লেখা আমায় বলে শুয়ে পড়তে। শুই না। ঘুম আসেনা। "ভালো লাগে না" র সরণীতে একটি কুঁজো বাঁশিবিক্রেতাকে দেখতে পাই। বাঁশি বাজায়। কাক শোনে। আমার মনে পড়ে একটি কথা, কে একজন বলেছিল বাঁশি বড় অদ্ভুত মায়া, একেবারে বুকের হাওয়ায় বাজে তো! "বুকের হাওয়া" শব্দটি নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। অবচেতনে শুরু থেকেই তৈরী হওয়া একটি আয়তকার ফ্রেমে বাঁশির আওয়াজ লুকিয়ে রাখি। আমার লেখা আমায় জড়িয়ে ধরতে চেয়েও ধরেনা, পাছে প্রেম হয়ে যায়!

    মশারির ভিতর একটি সাহসী জোনাকি ঢুকেছে। ওকে জানালাম আমার কিছু ভালো লাগেনা। পরের জন্মে গাছ হয়ে জন্মাব। সারা গায়ে কুঠার-শপথ মাখব। চলে যাব নিঃশব্দে, যেভাবে অনেকে ঘুমের মধ্যে...

    ছোটবেলায় ঝড় এলে শিমুল তুলো উড়ত। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মেঘের টুকরোর মতো। উড়েই যেত। ভূমি স্পর্শ করত না কেউ সহজে। মনে আছে। কত তুলো চারিদিকে।

    ইচ্ছে হয় একদিন এই তুলোর মতো উড়তে উড়তে ছুঁয়ে যাব সেই বৃদ্ধাকে যিনি তেতলার বারান্দা থেকে অপলক তাকিয়ে থাকেন নীচের মাঠে হওয়া আর্ট এক্সহিবিশনের দিকে। ছুঁয়ে যাব ছেলেটার লেগস্পিন করা হাতের আঙ্গুল, অসম্ভব সুন্দর হাতের গ্রিপ ছিল, এখন ডেটা এন্ট্রি করে। ছুঁয়ে যাব অনন্ত বিরহীদের কাটা ডাণা, ছুঁয়ে যাব আমার প্রিয় লেখকদের লেখার টেবিল! ছুঁয়ে যাব প্রেমিকার নাভি, অশ্বথ্থের বাঁকল... একটা একটা করে বন্ধ হয়ে যাওয়া জানলার কপাট গুলো ছুঁয়ে যাব, অ্যাসবেস্টারস, উনুন, যৌথ পরিবারের ভাঙনকে ছুঁয়ে যাব, আই সি ইউ তে ভর্তি রোগীর শেষবেলা টুকু, নিষ্পৃহ হাতের আঙুল আর বন্ধ চোখের পাতা ছুঁয়ে যাব তুলোর মতো, হালকা শীতল ভাবে। জীবনটা যখন নিভে নিভে আসে, আয়ু যখন মনিটরের ফ্রেমে বিপ বিপ শব্দে বাজে, প্রতিটা শ্বাসের ওঠা নামা যখন বুকের গহন থেকে বেরিয়ে এসে আয়া-নার্স-আত্মীয়দের সামনে কেবল গ্রাফিকাল হয়ে দাঁড়ায়, মনে হয়, এভাবেই সিনেমার শেষটা লেখা ছিল? ভারী দৃষ্টির সামনে ঝাপসা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে মেয়ে বউ .... আয়ুর ফসল এরা। তোমার হল শুরু, আমার হল সারা..

    এক বন্ধুকে নিয়ে শ্মশান পেরিয়ে ধূসর এক টিলার ওপর উঠে সুর্যাস্ত দেখেছিলাম। তারপর তাকিয়ে থাকা। বন্ধুর এক চোখে জল, আর এক চোখে শিশির। আকাশের বেগুনি অধ্যায় তখন শেষ পৃষ্ঠার দিকে গড়াচ্ছে। সবটাই কতটা নিথর। তবু আছে, তবু আছি। বন্ধুর এক চোখে শব, আরেক চোখে প্রসব। যন্ত্রণা! সৃষ্টি কোনো ম্যাজিক নয়, এ এক অভূতপূর্ব বেদনার ইতিহাস। সুর্য নিভে আসে। ফিরে আসি আমরাও। আমাদের কথায় অমীমাংসিত রহস্যগুলো কৃমির মতো কিলবিল করে। ট্রেন চলে আসে।

    রাত বাড়লে ফিসফিসানি বাড়ে। প্রবাসী বন্ধু বার্তা পাঠায়।

    কত সমুদ্র, আকাশ, শহর, গ্রাম, নদী নালা, ঘর বাড়ি, পাহাড় জঙ্গল ভেদ করে সেই খবর আমার কাছে এসে পৌঁছয় সেকেন্ডের ভগ্নাংশে। লেখা থাকে -
    "কিছু ভালো লাগে না। কিছুই ভালো লাগে না আজকাল।"

    শুধু এটুকুই রক্তমুখ! এটুকুই নিখাদ উচ্চারণ!
    আমিও উত্তর দিই "আমারো কিছু ভালো লাগে না।"

    পাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চা মেয়েটা রোজ দিদিমনির সামনে সন্ধ্যাবেলায় গান ধরে "পাশরিব ভাবনা পাশরিব যাতনা..."

    জামবাটির মতো চাঁদ আকাশে। আমি সরলরেখার ওপর বিন্দু গুনতে বসি।

    অন্তর্জালের রহস্য খুলে যায়। ভালো না লাগার গ্রহে কেউ কারো থেকে দুরে নেই আসলে। সবাই ওই নিজের অক্ষের চারিদিকে সাড়ে তেইশ ডিগ্রি হেলে থেকে পাক খাচ্ছে দিনরাত!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • অন্যান্য | ০৩ মার্চ ২০২৫ | ২৩৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অয়নেশ | 2402:3a80:1cd2:820d:378:5634:1232:***:*** | ০৪ মার্চ ২০২৫ ০০:৩৩541471
  • yes
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত প্রতিক্রিয়া দিন