এই সাইটটি 37,540,967 বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  অন্যান্য  মোচ্ছব

  • আমরা যারা রাস্টিকে চিনি

    Supratik Chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | মোচ্ছব | ২২ মার্চ ২০২৫ | ১০৯ বার পঠিত
  • ক্লান্ত হলে রাসকিনের লেখা পড়তে ইচ্ছে করে। একেকটা বই যেন একেকটা ছোট ছোট পাখি, ডানায় ভর দিয়ে চলে আসে হাতের কাছে। পাখির গায়ে পাহাড়ি রোদ্দুর। মেঘের গন্ধ। মন ভালো করে দেন রাসকিন। পাকদন্ডী পেরোতে পেরোতে, কুয়াশা পেরোতে পেরোতে আজন্ম থেকে যাওয়া ইচ্ছে দাগ গুলো মিলিয়ে নেওয়া যায়। প্রিয় রাস্টি, তুমি নিশ্চয়ই জানো মেঘের দেশে তুলোর ঘরবাড়ি গুলো কতটা হালকা হয়! জানো নিশ্চয়ই স্মৃতির মলাট খুবলে খায় অদৃশ্য উই পোকারা...কেন যে এমন হয়!

    পাতাঝরা বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে বিনির হারিয়ে যাওয়া নীল ছাতাটার কথা। মনে পড়ে ভুটিয়া বস্তির সুব্বার কথা। মনে পড়ে মুসৌরির সকাল গুলো...লালচে সোয়েটার,কফি মাগ, ভিজে পিচ রাস্তার ওপর বসে থাকা অস্থায়ী বাজারটার কথা মনে পড়ে। আরো আশ্চর্যভাবে মনে পড়ে ছবিতে দেখা ভবানীপুর সিমেট্রিতে রাসকিনের বাবার কবরটা। ম্যালিকানে লেখা, ক্ষয়াটে পাথরের ওপর "Bond" টুকু পড়া যায়। রাসকিনের বাবা বলেছিলেন কলকাতা অনেক বড় শহর, দিল্লির মতো ছোট নয়। লেটার্স টু ফাদার বইটার সেই তেরোটা গদ্য রোজ এসে দেখে যায় সেই সমাধি। রাসকিন লেখেন আবার যেদিন তোমার সাথে দেখা হবে, বাবা আমি কি তখন আর ছোট থাকব না?

    স্মৃতির ফলকে হাওয়া বোনে সময়। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছেলেটার দেশ কোনটা? বাবা প্রয়াত,মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে, পরিবার ভাঙন, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা, লন্ডনে ফিরে যাওয়া...একাকী বয়ঃসন্ধির সেই প্রাক্কালে, নিঝুম দুপুরের ছাদের ঘরের চালে পায়রার হুটোপাটি, দেবদারুর জঙ্গল থেকে ভেসে আসা অচেনা পাখির ডাক, দ্রতবেগে ধেয়ে আসা সাইকেলের বেল, রাস্তা জুড়ে বসে থাকা ধম্মের ষাঁড়, কুঁজো ভিখারী, ঠান্ডায় মোড়া মুসৌরির ইউরোপীয়ান কর্ণারের সংক্ষিপ্ত জনপদে নিজেকে খোঁজে রাস্টি। বন্ধুকে খোঁজে। বাবাকে খোঁজে। ভাষা খোঁজে। জীবন খোঁজে। দেশ খোঁজে। রাস্টি ভালোবেসে ফেলে সবকিছু। রূম অন দ্য রূফ...নাবালক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অটোবায়োগ্রাফি... আশে পাশে সবাই তখন হুড়মুড়িয়ে দেশ ছাড়ছে। ছেলেটা থেকে গেল এ দেশে।আর গেলই না!

    আমরা যারা ছোট ছোট শহরতলীতে বড় হয়েছি, আমরা নিকটবর্তী রেললাইনে রেলগাড়ি চলে যাওয়ার আওয়াজ শুনে তলিয়ে গেছি ফ্যান্টাসিতে, টিনের চালে বৃষ্টির বাড়া কমা বুঝতে বুঝতে ঘুমিয়ে গেছি, আমরা একটা মাত্র বাসের জন্য হাইওয়েতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেই গেছি কিংবা শৈশবের পরতে পরতে মেখে নিয়েছি মফস্বলী মিরাকল গুলো, জলপাইগুড়িতে নেমে ফুটফুটে আকাশে হন্যে হয়ে যারা খুঁজেছি পাহাড়ের নীল রেখা, তারপর ঘুরতে ঘুরতে উঠতে উঠতে পৌঁছে গেছি চড়াই উতরাইয়ের মধ্যিখানে, হাতের মুঠো ভর্তি লাল চেরীফল, রাকেশের মতো,যাকে তাঁর দাদু বলেছিল "Nothing is lucky if you put it away". আমরাও দেখেছি বীজ ফুঁড়ে ওঠা অঙ্কুরের মাথা, এক সবুজ পৃথিবীর অনাবিল সম্ভাবনা! বড় হতে হতে দেখলাম নীল চোখের বালকটি মিলিয়ে গেল রেলিং ছুঁয়ে ছুঁয়ে। সন্তর্পণে, ধীরে...লাল নীল পাহাড়ি ফুল গুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে। কোনো এক পাকদন্ডীর শেষেই অপেক্ষা করছে ওর বন্ধুরা, অপেক্ষা করছে ওর দেশ, ও জানে।

    পাহাড়ের প্রতি আমার বা আমাদের যে নাড়ীর টান, আমরা যারা রাসকিন পড়েছি, আমরা জানি, ছোটবেলার ওই গুমোট পড়ার ঘরটাতেও দেরাদুন থেকে ভেসে আসা একখাবলা মেঘ অবলীলায় ভিজিয়ে দিত আমাদের। চিলেকোঠার ঘর,নতুন সোয়েটার, শীতের গন্ধ মেখে আমাদের এই সমবেত বেড়ে ওঠার সামনে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকত বিপুল হিমালয়, রাসকিনের চেয়েও বৃদ্ধ, রাসকিনের মতো সহৃদয়! আমরা যারা রাসকিন পড়েছি, পড়েছি ডাস্ট অন মাউনটেইন, রুম অন দ্য রুফ! ঝাপসা দেখেছি খাদের গায়ে, রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুহীন বয়ঃসন্ধি। লজ্জাবতী পাতা ছুঁয়ে কুঁকড়ে দেওয়া ছোটবেলা।আমার ছেলেবেলায় মুসৌরির পাহাড় ছিল না। তবে দার্জিলিং ছিল,কার্শিয়াং ছিল।এঁকে বেঁকে চলা টয়ট্রেনের গাঢ় কালো ধোঁয়া আর ঝুপ ঝুপ শব্দ, ভেজা বাতাসের দাপট, নেপালি শিশুর মুখে রৌদ্র, পাইন আবৃত জনপদগুলোর সরল এক রূপকথা, কিংবা খুব ছোটবেলায় শোনা ম্যাকগার্ডি গীর্জার ভারী প্রশস্ত ধ্বনি, প্যাগোডার সান্ধ্যস্তব, ঝুরঝুরে মেঘ... সবজে রঙের অক্সফোর্ড বুকশপে সেঁধিয়ে দেখেছি রাসকিনের বই গুলো পরপর সাজানো। মলাট ছুঁয়ে ছুঁয়ে শেষে একটি বইয়ে এসে থামা৷ লোন ফক্স ডান্সিং! রাসকিনের আত্মজীবনী!

    রাস্টির বয়স কত হল??নব্বই পেরিয়েছে? সে এখোনো পালিয়ে যেতে চায় মুসৌরির পাহাড়ে?? তাঁর এখন অনেক বন্ধু হয়েছে নির্ঘাত! চিঠি লেখে?? সবুজ পাতায় মাখিয়ে রাখে বিগত মৌসুমী চিহ্নগুলো? খুদে হিলস্টেশন গুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে তুমুল সেই আর্তস্বর, " Until death comes,all is life". ওই যে কথাটা,রাসকিন লিখেছিলেন, সব যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরেও প্রজাপতিটা সুন্দরই থাকবে... এটুকুই তো প্রত্নচেতনা, এটুকুই নির্মান। শূন্যতার বিরুদ্ধে দুরূহ লড়াই!

    আমরা বুড়িয়ে যাচ্ছি রাস্টি। আমরা এদেশে তোমার চেয়েও বেশী প্রবাসী৷ আমাদের দেশ শেখাও। সমস্ত ভাবনা আর কথা ক্রমশ কসমেটিক হয়ে পড়ছে আমাদের। তুমি যদি কোনোদিন না লিখতে, একটা শব্দও যদি খরচ না করতে, কার কী হত জানি না, আমার সর্বনাশ হয়ে যেত। নৈঃশব্দের অন্তরালের ধ্বনি কে আর কবে এভাবে শোনাতে পেরেছে?
    Nothing is insignificant; nothing is without consequence in the intricate web of life.

    কিয়ারোস্তামির সিনেমা দেখার বহুপূর্বেই জেনে গেছিলাম প্রাজ্ঞরা সত্যিই অন্ধের ছুঁয়ে দেখার মতো করে গল্প বলেন।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • অন্যান্য | ২২ মার্চ ২০২৫ | ১০৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি 37,540,970 বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন