এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • কফিহাউস ও রবীন্দ্রনাথ

    Supratik Chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ১০ মার্চ ২০২৫ | ২৬ বার পঠিত
  • কফি হাউস নিয়ে একটা ফ্যাসিনেশন আছে। কেন আছে জানিনা। ছোটবেলা থেকে কফিহাউস আমার কাছে ছিল এমন একটি অদেখা জায়গা, যেখানে প্রতিটা টেবিলেই নাকি স্বপ্ন প্রসব হয়। কবি, সাহিত্যিক,দার্শনিক, ফিল্মমেকাররা তাদের ঝুলি উপুড় করে দেন টেবিলের ওপর। একটা ইনটালেকচুয়াল হাব বলা যেতে পারে, অন্তত এই শহরটা থেকে বহু বহু দূরে বেড়ে ওঠা একটি বালকের চোখে এভাবেই সেজে উঠেছিল কফিহাউস, মূলত সেটা যে  বই ও সিনেমার গুনেই, বলা বাহুল্য। তারপর একদিন যেদিন এসে দাঁড়ানো গেল সেখানে, চুরমার হল ইলিউশন। টেবিলে বসে জুলজুল করে চারিদিক তাকাতে তাকাতে ভাবা হল যে এরা সবাই ইনটালেকচুয়াল? সবাই একটা স্বপ্নের ঘোরে ভাসতে ভাসতে বাড়িটার দোতলায় উঠে আসছে? এটা সম্ভব? কিন্তু ভালো লেগে গেল জায়গাটা। চেনা হয়ে গেল কিছু মুখ। বোঝা গেল কফি নয়, হাউসটাই এখানে মুখ্য। আরেকটা ব্যাপার আছে,  ওই যে ছবিতে দাঁড়িয়ে আছেন, কুড়ি বছরের রবীন্দ্রনাথ,  বাল্মীকির সাজে। এই ছবিটা আমার ভালো লাগে। সেদিন মানস বলল যে রবীন্দ্রনাথের হাইট কত ছিল?  ছয় -দুই য়ের কম তো হতেই পারেনা। শালা! দেখলেই মনে হয় বড়লোক! কফিহাউস গেলেই কোনো না কোনো সময় এই ছবিটা নিয়ে কথা হবেই। মানস বলল দ্যাখো, আঙ্গুল টা দেখো, কী লম্বা লম্বা আঙ্গুল! কুড়ি বছরের ছেলের তর্জনী এরকম হয় নাকি?? নাটকটা বাল্মীকি প্রতিভা! দস্যুর মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে যাওয়া সেই শ্লোক

    মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
    যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।

    তারপর তো সরস্বতী এসে বর দিলেন। কাকে দিলেন? বাল্মীকি নাকি কুড়ি বছরের রবীন্দ্রনাথকে? যাইহোক,  কফিহাউসের অনেকেই এই ছবিটার ছবি তোলেন। এরকমও শুনেছি পাশের টেবিল থেকে, " মালটা রামমোহন না??" না " মালটা" রামমোহন নয়, বরং রমণীমোহন বলা যেতে পারে। কোটি কোটি বার প্রেমে পড়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর একদিন মৈত্রেয়ী দেবীকে ফস করে বলে বসলেন " তোমরা যাকে ভালোবাসা বলো তেমন করে আমি কাউকেই ভালোবাসিনি"। এ তো জানা কথা! বেশী আবেগ নিয়ে আবেগের বেসাতি করা যায় না! মৈত্রেয়ী দেবী তো শুনে থ! আমরাও থ! চিরকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি প্রেমিক ভদ্রলোকটি রামকিঙ্করকে বলছেন " যেকোনো সম্পর্ক ছিবড়ে করে দিয়ে তার থেকে রসটা নিয়ে বেরিয়ে আসবি। " এসব শুনেটুনে নৈতিক মূল্যবোধে থরথর মধ্যবিত্ত আমরা বলে উঠেছি ছি! এসব তো লম্পটরা বলে! রবীন্দ্রনাথ কোনো সম্পর্ককেই বিশ্বাস করতেন না, আর করতেন না জন্যই মানুষের ওপর তাঁর ছিল অগাধ একটা সম্ভ্রম। কিন্তু এখানে কফিহাউসের বাল্মীকির সাথে এগুলোর কী সম্পর্ক??

    ওয়েস্টার্ণ ওয়ালে একটা সাদা বোর্ড, ভয়েস অফ ক্যালকাটা! গণকন্ঠ! মানুষ কী বলিতে চাহে? কিছুই না। সাদাবোর্ডটাই আস্ত একটা লেখা। জেনারেলি ফাঁকা সময়ে কফিহাউস অন্যরকম সুন্দর। নির্বিঘ্নে বইটই পড়া যায়, মাঝে মাঝে চোখ চলে যায় সেই সাদা বোর্ডটার দিকে। একটা তেরচা রোদ। কে একজন সেখানে লিখে রেখেছে " তোমার আছে ডাঙা, আমার আছে জল/ তোমার বসে থাকা,আমার চলাচল..." 

    লাইনটা নিয়ে ভাবি। এক প্রজন্ম যেন বিগত প্রজন্মকে এই কথা বলছে। 
    আবার সেই কুড়ি বছরের ছেলেটার দিকে তাকানো! কুড়ি বছর বয়সী ছেলেরা রাগী হয়? বিরক্ত? ফ্রাসট্রেটেড? ছেলেটা বিরক্ত না হলে সেসময় লিখল কী ভাবে " এরা আপন মায়ে রে নাহি জানে..." 

    হঠাই প্লাবনের জলের মতো ভরে যায় কফিহাউস। ছেলে মেয়ে বুড়ো বুড়ি  খাদক সম্পাদক কবি রিলমেকারস! সবাই লম্বা সিলিং ফ্যানগুলোর নীচে খুপড়ি খোঁজে! তারপর বসিয়া ধূম্রপান করিতে করিতে নানাবিধ স্থূল কথাবার্তায় নিমজ্জিত হইয়া যায়। কত রকম কথা,কত রকম অনুরাগ, কত রকম ঝগড়া, উৎকন্ঠা,দ্বিধা তুলোর মতো উড়তে থাকে হাউসের বাতাসে। কত লোক পাশের চেয়ারে অন্যকারোর জন্য জায়গা রেখে নিজেই একসময় জায়গা ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। কুড়ি বছরের ছেলেটি লিখেছিল " এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম/প্রেম মেলে না,শুধু সুখ চলে যায়.."  কফিতে চুমুক দিই। বিকেলের দিক। পাশের টেবিলে যুগল। বহুদিন আগের সহপাঠী। বোধহয় প্রেসিডেন্সি। দেখা হয়েছে। নির্মেদ বাংলায় কথা বলছেন তাঁরা। বহুদিন পর দুজনে কলকাতা ফিরেছেন। বহুদিন পরের সাক্ষাৎ। সব পাল্টে গেছে কি? না বোধহয়, ওই তো তেলছবির বিশাল ক্যানভাসটা! ওই তো বাল্মিকীর দৃপ্ত সাজ! "আঘাত হয়ে দেখা দিল,আগুন হয়ে জ্বলবে..."কলকাতা একইরকম আছে।

    কুড়ি বছরের ছেলেটা বছর বছর সব টেবিলের সব কথা শুনে আসছে৷   বেলা ফুরোলে, আলো নিভলে, জনশূন্য হয় কফিহাউস! মাঝরাতের কফিহাউস কেমন সে নিয়ে আমার কল্পনা একটু বাড়াবাড়ি রকমের। রাস্তা থেকে হালকা নীল আলো ঢোকে বোধহয় এসময় বড়ো ঘরটার ভেতর। ছোট ছোট টেবিল গুলো আবছা আবছা টের পাওয়া যায়। ঘরটা তখন যেন প্রাগৈতিহাসিক অনাবিষ্কৃত একটি প্রশস্ত গুহা! ছবিটা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসেন কুড়ি বছরের রবীন্দ্রনাথ। নতুন করে লেখেন "সভ্যতার সংকট"।  সংকটের রূপ ও মাত্রা পাল্টেছে। নতুন সংস্করণ প্রয়োজন। তবুও তবুও, একটা লাইন কিছুতেই পাল্টাতে পারে না ছেলেটা। 

    "মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি।"

    রাত বাড়ে। ছেলেটার বয়স বাড়ে না।

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ১০ মার্চ ২০২৫ | ২৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন