এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  প্রবন্ধ

  • রাজেশ খান্নার "আনন্দ" ও আমরা

    Supratik Chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    প্রবন্ধ | ০৮ মার্চ ২০২৫ | ৮৬ বার পঠিত
  • যে ছবি মোটামোটি সবাই দেখেছে এবং বিশেষ ভাবে যে ছবি মোটামোটি সবারই ভালো লেগেছে সেটা নিয়ে কাঁটাছেড়া করার কিছু মস্ত অসুবিধে আছে। যদি সেই ছবি "আনন্দ" য়ের মতো কাল্ট ছবি হয় তাহলে তো কথাই নেই! ১৯৬৯ থেকে ৭১ অবধি রাজেশ খান্নার অবিশ্বাস্য জয়যাত্রায় যে সতেরোটি ছবি অবদান রেখেছিল তার মধ্যে আনন্দ ই একমাত্র "অন্যরকম" ছবি৷ অন্যরকম মানে?? যা চলতি প্রথার থেকে একটু ভিন্ন৷ মনে রাখতে হবে ছবির নির্মাতা ঋষিকেশ মুখার্জী সেই ভদ্রলোক, যিনি একদা কলকাতার প্যারাডাইস ক্যাফেতে মৃণাল সেন, সলিল চৌধুরী, ঋত্বিক ঘটকদের সাথে আড্ডা দিতেন। ধরা যেতে পারে তাঁর বৌদ্ধিক উন্মেষ এই শহরেই কিছু অনন্য প্রতিভাধর বন্ধুদের সাথেই ঘটেছে। কিন্তু সবকিছুর পরেও আনন্দ একটি চলচ্চিত্র হিসেবে কতদূর সফল সে নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। শুধু ব্যবসায়িক ভাবে দূর্দান্ত সাফল্য পেলে এই লেখা আজ লিখতাম না। কিন্তু কথা হচ্ছে এই ছবিটিকে আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ তিরিশটি ছবির মধ্যে ধরা হয়। চলুন ভেতরে ঢুকি এবার...

    গপ্পোটা সবার জানা। মনে রাখতে হবে ছবিতে "আনন্দ" নামের চরিত্রটি একটি বিগত চরিত্র। পুরো ঘটনাটাই ভাস্কর ব্যানার্জী তাঁর ডায়েরীতে লিখে রেখেছিলেন। সেটাই গল্পের সুত্র। অর্থাৎ ছবিটিতে যা যা কিছু হচ্ছে সেসব কিছুই ডাক্তার বন্ধু ভাস্করের স্মৃতিচারণা! অর্থাৎ আনন্দ চরিত্রটি ভাস্করের দৃষ্টিভঙ্গীতে রিফ্লেক্টেড! মানে এমনটাই হওয়ার কথা! কিন্তু ছবিতে তা হয়নি। এটা দোষের নয়। বহু ছবিই একটি প্রেক্ষিত থেকে আরো বড় কোনো প্রেক্ষিতে চলে যেতেই পারে। নায়ক রাজেশ খান্নার চেয়েও সহঅভিনেতা অমিতাভ বচ্চন, যিনি ছবিতে ভাস্কর ব্যানার্জী, তাঁর চরিত্র গঠনের একটা নিদারুণ প্রয়োজনীয়তা ছিল। অবশ্য আমরা বুদ্ধিমান দর্শক হওয়াতে বুঝে গেছি যে ভাস্কর ব্যানার্জী একজন সৎ, গম্ভীর, প্রফেশনাল, কর্তব্যপরায়ণ, মানবিক ডাক্তার! কিন্তু একই সাথে তিনি পেসিমিস্টিক, নেতিবাচক, কপালে সবসময়ের মরবিড একটা ভাঁজ! তাঁরই সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন আনন্দ, যেন মায়ার রাজপুত্র! জীবনকে গন্ডুষ ভরে পাণ করা যুবক! ছটফটে প্রজাপতির মতো রঙীন!  এই দুই প্রধান চরিত্রের মধ্যে কনট্রাস্ট ফুটিয়ে তুলেছেন নির্মাতা শুধুমাত্র কয়েকটি সংলাপের মাধ্যমে? এটা আমার ব্যক্তিগত খেদের জায়গা। 
    গল্পের মজাটা হল ছবির শুরুতে দর্শক সহ রাজেশ খান্না, মোটামোটি সব্বাই জেনে যায় আর ছ'মাস আয়ু। অর্থাৎ আমরা যেই জেনে গেলাম যে আনন্দের লিম্ফোসারকোমা অফ ইনটেসটাইন হয়েছে, তখন থেকেই মৃত্যুকে সামনে রেখে জীবন দেখতে শুরু করলাম। ভবিতব্য জানা থাকলে আমাদের চারিপাশের আদলটা বদলে যেতে বাধ্য! মায়াটাও কেমন বেড়ে যায়! আমরা চোখ ভরে আনন্দকে দেখতে থাকলাম। কিন্তু একাত্ম হতে পারলাম কি?? আমরা কয়েক আলোকবর্ষ দূর থেকে দেখলাম আনন্দকে, এক ধূসর সন্ধ্যায় আরবসাগরের তীরে বেলুন উড়ে যাওয়া দেখলাম! গোটা ছবিটা বড় দূর থেকে আনন্দকে দেখালো। আনন্দ অসুস্থ, আনন্দ আর কিছুদিন বাঁচবে, কিন্তু আমরা তো সুস্থ! তাই করুণা ছাড়া আর তো কিছু করার নেই! একশোবাইশ মিনিট ধরে আনন্দকে আমরা করুণা দেখালাম। আহা রে! এত প্রাণবন্ত ছেলেটা থাকবেনা?? এটা আমার আরেকটি আপশোষের জায়গা! ছবিটা একবারও, একমুহূর্তের জন্যও আনন্দের সাথে আমাদের মিলিয়ে দিতে পারলো না। বরং পদে পদে ওই দূর্দান্ত স্ফূর্তি আমাদের অবাক করল। ওই অমোঘ সংলাপ গুলি অভিধানে ঢুকিয়ে নিলাম, "মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান.." আমরা বরং অনেক বেশী ভাস্কর ব্যানার্জীর মতোন। একাধারে আমরা চাইছি আনন্দ সেরে উঠুক, আবার আমরাই অপেক্ষা করছি একটি মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য। 

    মৃত্যু বরাবর আমাদের সংস্কৃতিতে ভালো দামে বিক্রি হয়েছে। মৃত্যুর আগের ওই ঝিলমিল জীবন, অভূতপূর্ব মুহূর্ত আলিঙ্গন, প্রাণবন্ততা বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত প্রচুর এলোমেলো অযাচিত সংলাপ ও ঘটনা, কোথাও গিয়ে আমাকে খুব বিরক্ত করে! তখোনি মনে প্রশ্ন জাগে, এত কথা কেন? এই অদ্ভুত বিপন্নতা ও একইসাথে উথলে ওঠা জীবনরসের ব্লেন্ডিং অন্যভাবেও দেখানো যেত না কি? নির্মাতা যেহেতু ঋষিকেশ মুখার্জী, রবি ঠাকুরের "সুভা" যার প্রিয় ছোটগল্প, তাঁর কাছে একটু নৈঃশব্দ আশা করাটা অন্যায় নয়।

    তবুও ছবিটা আমার ভালোলাগার ছবি। কেন জানেন? শুধু মাত্র একটা গানের দৃশ্যায়নের জন্য! ওই সাড়ে পাঁচ মিনিটই গোটা আনন্দ চরিত্রের খোলনলচে দেখিয়ে দেয়। "কয়ি দুর যব দিন ঢল যায়ে..."  সূর্যাস্তের বিষন্ন আলোয় ভেজা বারান্দায় অসীম সমুদ্রের দিকে মুখ করে মৃত্যুপথযাত্রী আনন্দ গান গাইছে "ইয়ে মেরে সপনে, ইয়েহি তো হ্যায় আপনে, মুঝসে জুদা না হোঙ্গে দিল কি ইয়ে সায়ে...." গায়ে কাঁটা দেয়! এই সাড়ে পাঁচ মিনিটে ছবিটা সাব্লাইমে পৌঁছে যায়। গোটা ছবির একমাত্র এই সময়টায় আনন্দের চোখে গোধূলী ঘনিয়ে আসা অন্ধকার, চোখের কোণে চিকচিকে জল... সে যেন জীবনবোধ ও মৃত্যুবোধের বাইরের কোনো অনন্য উপলব্ধির স্তরে পৌঁছে গেছে তখন। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, রাজেশ খান্না তাঁর গোটা কেরিয়ারে যা অভিনয় করেছেন, ওই মাত্র কয়েকমিনিটে তাঁর এক্সপ্রেশন আর মুভমেন্ট সেগুলোকে  দশ গোল দিয়ে দেয়। হাতে ধরা ডায়েরী, তাতে শুকিয়ে যাওয়া ফুল! কোন বিহানে কেউ একজন এই ফুল দিয়েছিল, সে এখন অন্যত্র সংসার করে। এই মেলানকোলির কোনো ফ্ল্যাশব্যাক নেই। শুধু আছে একটা নিস্তব্ধ গোঙানি! মুকেশ ছাড়া এই গান হয় না, সলিল চৌধুরী ছাড়া এই সুর হয় না, সর্বোপরি যোগেশ ছাড়া এই লেখা হয় না। যতদিন বাঁচব এই সাড়ে  পাঁচ মিনিটের মৃত্যুভার সায়াহ্ন আমাকে তাড়া করে বেড়াবে।

    আনন্দ মরে যায়। আমরা জানতাম। মরে যাওয়ার পর টেপে বেজে ওঠা আনন্দের গলা শোনা যায়। আমরা চমকে উঠি। এই দৃশ্যটা রাখাই হয়েছিল চমক দেওয়ার জন্য। আনন্দ মরে যাওয়ার চুয়ান্ন বছর পরেও আমরা আওড়াই "জিন্দেগি লম্বি নেহি,বড়ি হোনি চাহিয়ে..." কিংবা "মওত তু এক কবিতা হ্যায়..."  ছবিটা যতটা না থেকে যায়, তার চেয়ে বেশী থেকে যায় জীবনবার্তা! একটা বোধ! মৃত্যুর প্রতিষ্পর্ধী একটা বিপন্ন উল্লাসের মায়া! এটাই বা কম কীসের??
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • প্রবন্ধ | ০৮ মার্চ ২০২৫ | ৮৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • . | ০৮ মার্চ ২০২৫ ২৩:০৬541541
  • বাবুমশাই। smiley
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় প্রতিক্রিয়া দিন