পরিবেশ আইন সংশোধনী ২০২৫ - তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সালফার আইন শিথিল
এ বছরের জুলাই মাসে, কেন্দ্রীয় সরকার নিজেদেরই ২০১৫ সালে আনা পরিবেশ আইন সংশোধনীর রদবদল করে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলিতে সালফার নির্গমন বা ইমিশন কম করার জন্যে এফ জি ডি বা ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজেশন ইউনিট স্থাপনের নির্দেশাবলী এমন শিথিল করে দিয়েছে যার ফলে দেশের অধিকাংশ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রই আর এই নিয়মের আওতায় আসছে না।
২০১৪ সালে অর্জিত স্বাধীনতার পরের বছরই পরিবেশ মন্ত্রক পরিবেশ আইন ১৯৮৬ র সংশোধন করে দেশের তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলির জন্যে নতুন ইমিশন স্ট্যান্ডার্ড বা নির্গমন মাত্রা নির্ধারণ করে। পি এম বা পারটিকুলেট ম্যাটার গুলির পরিবর্তিত মাত্রা স্থির হয় এবং এর সাথে নতুন যোগ হয় সালফার ডাই অক্সাইড (সক্স), নাইট্রিক অক্সাইড (নক্স) এবং মারকিউরি আর মোট জল খরচ সংক্রান্ত বিধি, জিরো টোট্যাল ওয়াটার কনজাম্পশন।
প্রথমে প্রতিটি উৎপাদনকারী ইউনিটগুলির বয়স ও রকম অনুযায়ী স্থির হয় মাত্রা। সবচেয়ে কঠোর মান নির্ধারণ করা হয় সালফার বা সক্সের ক্ষেত্রে। পাওয়ার সেক্টরে কাজ করা লোকজন বিশেষ করে যাদের পাওয়ার প্ল্যান্টের টেকনিক্যাল বা টেকনো কমারশিয়াল দিকগুলির সঙ্গে পরিচয় আছে, তারা প্রায় সবাই জানে যে ভারতবর্ষে এতকাল ধরে তাপ বিদ্যুতে সালফারের নির্গমন নিয়ে কড়াকড়ি হয়নি কারণ এদেশের কয়লা হল লো সালফার কোল, বা ভারতে উৎপন্ন কয়লাতে সালফারের পরিমাণ অত্যন্ত কম থাকে, বিদেশী কয়লার তুলনায়।এদিকে আমাদের দেশের মাটিতে মজুত কয়লার পরিমাণ পর্যাপ্ত, তাই বিদেশী কয়লার দরকার আমাদের হওয়ার কথা নয়। এই যুক্তির ভিত্তিতেই পূর্বের সরকাররা বা পরিবেশ মন্ত্রকের দায়িত্বপ্রাপ্তরা সক্সের মাত্রা নিয়ে মাথা ঘামায়নি।
কিন্তু এরপরে এল সেই স্বাধীনতার মাহেন্দ্রক্ষণ, এবং আমাদের চারিপাশে পরিবর্তনের জোয়ার, যার ফলে পূর্বের সমস্ত প্রচলিত নিয়মনীতি বদলে যেতে থাকল এক এক করে। অবশ্য পরিবেশ আইন সংশোধনের পিছনে বড় কারণ ছিল, ২০১৫ প্যারিস কপ২১, প্যারিসের আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তি।
কপ২১ এর প্রেক্ষাপটে ভারতের প্রধান প্রতিশ্রুতিগুলির একটি ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০% অ-জীবাশ্ম জ্বালানি (Non-fossil fuel) থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন, এছাড়া ছিল গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন হ্রাস। আরও ছিল ২০৩০ এর মধ্যে অতিরিক্ত গাছ ও বনের আচ্ছাদনের মাধ্যমে ২.৫ থেকে ৩.০ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইডের সমতুল্য কার্বন সিংক তৈরি করা।
বন আচ্ছাদন বাড়ানোর জায়গায় আজকে দাঁড়িয়ে সিংরৌলির জঙ্গল, মহারাষ্ট্রের বিস্তৃত ম্যানগ্রোভ, ছত্তিসগড়ের হাসদেও জঙ্গল এবং যা নিয়ে আজ ও কাল প্রতিবাদের ঝড় বয়ে চলেছে সেই আরাবল্লীর পাহাড়ের ধ্বংসের যে ব্লু প্রিন্ট বানানো হয়েছে তা দেখে আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় দেওয়া এইসব প্রতিশ্রুতির কতটা কী সারবত্তা রয়েছে সে নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়!
আজকে দাঁড়িয়ে চারপাশের কান্ডকারখানা দেখে মনে হচ্ছে যে পরিবেশ নামক একটি স্পর্শকাতর বিষয় যা আমাদের আজ ও আগামীর অস্তিত্ব নির্ধারণ করে তা নিয়ে যেন চারিদিকে ছেলেখেলা চলছে। দেশের আইনকানুনেরও অবস্থা সেরকমই, সংশোধনের নামে যখন খুশী যা খুশী বদল নিয়ে আসা যায়, কাদের সুবিধে করতে সে কথা সবাই জানে। পাহাড়ের এই একশ মিটারের আইন এনে যেমন আরাবল্লীর আশি শতাংশকেই না-পাহাড় বানিয়ে দিয়ে বেআইনি খননকার্যকে আইনের খোলা ছাড়পত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করা হল, ঠিক তেমনই এফ জি ডি আইন শিথিল করে মূলত বেসরকারী তাপ বিদ্যুৎ কম্পানি গুলিকে একটি ব্যয়বহুল প্রজেক্ট থেকে রেহাই দেওয়া হল।
দশ বছর পরে, ২০২৫ এর জুলাই মাসে পরিবেশ আইনের হালের সংশোধনে দশ বছর আগের তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সালফারের মাত্রা সম্পর্কিত আইনটিকে প্রায় আশি শতাংশ পাওয়ার প্ল্যান্টের ইউনিট গুলির জন্যে এক রকম রিকল করা বা তুলে নেওয়া হল। কিছু মিডিয়া রিপোর্ট বা দু চারজন পরিবেশ সংক্রান্ত এন জি ও গুলি যে অল্পবিস্তর আপত্তি ইত্যাদি জানিয়েছে তার উত্তরে পরিবেশ মন্ত্রক জানিয়েছে যে সম্প্রতি কিছু স্টাডি ও রিসার্চে জানা গেছে যে ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে বায়ুমণ্ডলে সালফারের উপস্থিতি বিশেষ করে তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে, ও তার থেকে পরিবেশে ক্ষতির সম্ভাবনা খুবই নগণ্য। সেই তুলনায় সালফার কমানোর জন্যে আইন করে যে এফ জি ডি বা ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজেশন ইউনিট বসানোর বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল ২০১৭ তে এই একই পরিবেশ মন্ত্রকের দ্বারা, তার খরচ খরচা বিশাল, এবং তুল্যমুল্য বিচারে দশ বছর পরে সেই একই সরকারের একই পরিবেশ মন্ত্রকের মনে হচ্ছে, এতে লাভের চেয়ে ক্ষতি অনেক গুণ বেশী।
২০১৫ র আইনে সালফার নির্গমনের মাত্রা কড়াকড়ি করার দু বছর পরে ২০১৭ সালে সিপিসিবি বা কেন্দ্রীয় পল্যুশন কন্ট্রোল বোর্ড একটি নির্দেশিকা জারী করে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলিকে তিন ভাগে ভাগ করে, এ, বি এবং সি, শহর থেকে তাদের দুরত্বের ওপর ভিত্তি করে। এছাড়া উৎপাদক ইউনিটগুলির ক্যাপাসিটি, বয়স ইত্যাদি দেখে প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে এফ জি ডি ইউনিট লাগানোর সময়সীমা ধার্য করা হয়।
এত বছর ধরে বার বার সংশোধনী নিয়ে এসে সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে বেশ কিছু বার যাতে কম্পানিদের পেনাল্টি না দিতে হয়।২০২৪ শেও সম্ভবত ডিসেম্বরে সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। তারপরে ২০২৫ এর জুলাইয়ে টাইপ সি, অর্থাৎ প্রায় আশি শতাংশ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্যে এফ জি ডি লাগানো আর বাধ্যতামূলক নয়!
যে স্টাডি গুলির রেজাল্টের ওপর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সরকার দাবী করছে, সেই স্টাডিগুলো সরকারের উদ্যোগে হয়েছে।প্রশ্ন ওঠা উচিত যে এই স্টাডি গুলি ২০১৫ থেকে ২০১৭ র যে সময়, এফ জি ডির মত একটি ব্যয়সাপেক্ষ প্রজেক্ট ব্ল্যাংকেট বাধ্যতামুলক করার আগে হয়নি কেন? কারণ এই স্টাডি গুলিতে নতুন কিছু নেই। এবং অনেক স্টেকহোল্ডাররাই সেসময় এই পয়েন্ট গুলো তুলেছিল। যথা আমাদের কয়লা লো সালফার হওয়ার দরুন তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্গমনের কারণ পরিবেশে সালফারের মাত্রার খুব বেশী হেরফের হয় না। সে জায়গায় একটি এফ জি ডি ইউনিট অপারেট করতে গেলে যা জল ও অতিরিক্ত ইলেক্ট্রিসিটি লাগে তার প্রভাব ওভারঅল কার্বন ইমিশন বাড়ায়। এছাড়া এফ জি ডি সাপ্লায়ারের সংখ্যা অনেক কম হওয়ার দরুন খরচ খুব বেশী, এবং এর ফলে ইলেকট্রিসিটির ফিক্সড কস্ট যা বাড়বে তা সাধারণ জনগণকে বহন করতে হবে।
এইসব যুক্তি দিয়েই এখন সরকার তাদের নির্দেশ শিথিল করছে অথচ দশ বছর আগেও এই কথা গুলো উঠেছিল এবং আলোচনায় এসেছিল। তাহলে কী কারণে সরকার তখন এসব সত্বেও এফ জি ডি আইন চালু করেছিল, তার উত্তর তো অবশ্যই জানতে চাওয়া উচিত বিশেষ করে সরকার যখন একই ছিল!
দশ বছর পরে যা হয়েছে তা হল সরকারের তাড়াতে বেশীর ভাগ সরকারী রাষ্ট্রায়ত্ত কম্পানি গুলিতে এই কাজ অনেক এগিয়েছে। ২০১৭ র আশেপাশে এফ জি ডি স্থাপনের খরচ ছিল প্রতি মেগা ওয়াট ছিল .৮ কোটি, এখন তা বেড়ে হয়েছে ১.২-১.৩ কোটি প্রতি মেগাওয়াট।সরকারের এও এক যুক্তি যে খরচ প্রচুর বেড়ে গেছে। কিন্তু আট বছর আগের .৮ কোটি আজকে ১.২ কোটি কি খুব বাড়া হল?
২০২৫ এর ফেব্রুয়ারি তে রাজ্যসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে দেওয়া মন্ত্রীর এক বিবৃতি অনুযায়ী মোট ৫৩৭ টি ইউনিটের মধ্যে ৪৯ (২৫.৫ মেগাওয়াট) ইউনিট এফ জি ডি স্থাপনা সম্পূর্ণ হয়েছে। ২১১ (৯১.৮ মেগাওয়াট) টি ইউনিটে হয় কমিশনিং এর কাজ চলছে নয় কন্ট্রাক্ট দেওয়ার কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে।
এই আইন বদলের পরে একটি রুলিং এ দেখা যাচ্ছে রেগুলেটরী কমিশন পরিস্কার বলে দিয়েছে যে যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র আর এফ জি ডির নিয়মের আওতায় আসছেনা তাদের জন্যে ডিসকম এফ জি ডি র খরচা ফিক্সড কস্টে আর ধরবেনা।এছাড়া যাদের কন্ট্র্যাক্ট দেওয়া হয়ে গেছে তাদের বলা হয়েছে ক্যান্সেল করে দিতে। ক্যান্সেল করার পেনাল্টিও এই সব কম্পানিকেই বহন করতে হবে।যাদের কন্ট্র্যাক্ট দেওয়া হয়ে গেছে তারা অনেকেই জানিয়েছে যে এর জন্যে দরকারী সিভিল ওয়ার্ক বা অন্যান্য প্রস্তুতিতেও তাদের অনেক টাকা খরচা হয়ে গেছে।অর্থাৎ যে খরচ ইলেক্ট্রিসিটির দাম থেকে উঠে আসবে ভাবা হয়েছিল তা আর হবেনা।
এখনো এটা পরিস্কার নয় যে ৪৯ টি ইউনিট যেখানে এফ জি ডি এই নিয়ম বদলের আগেই স্থাপনা হয়ে গেছে, তার মধ্যে যারা সি ক্যাটেগরির তাদের ক্ষেত্রে সরকার বা রেগুলেটরি কমিশন কী সিদ্ধান্ত নেবে। এবার যদি এদের এফ জি ডি র খরচা ফিক্সড কস্টের মধ্যে ধরতে ডিসকমকে বাধ্য করা তাহলেও সেই জনগণের একাংশকে এই অতিরিক্ত এবং সরকারী মতে অনাবশ্যক খরচ বহন করতে হবে।
এই দুই স্টাডি নিয়ে এবং এদের সুত্র ইত্যাদি নিয়ে বিশদ কথা পরবর্তীতে বলব। এখন শুধু বলি যে উপরোক্ত ২৬০ টি ইউনিট যাতে কাজ অনেক এগিয়ে গেছে তার বেশীরভাগই সরকারী (রাজ্য/কেন্দ্র) রাষ্ট্রায়ত্ত কম্পানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই পুরো খরচ টার অনেকটাই হচ্ছে যাকে বলে জনতার পয়সা। সরকার যখন স্টাডি গুলো শুরু করেছিল দু বছর আগে তখনও যদি এফ জি ডি সংক্রান্ত কাজকর্ম সাময়িক বন্ধ করতে নির্দেশ দিত তাহলে অনেকটা খরচ বাঁচানো যেত। অথচ সেরকম কিছু করা হয়নি যদিও স্টাডির ধরন দেখে মনে হতেই পারে যে অবজেক্টিভ আগে থেকেই সেট ছিল!
এই নিয়মের বদল এবং এই দুই স্টাডির সারবত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা উচিত যা সেরকম ভাবে উঠছে না।সরকার এমন দু চারটি যুক্তি সামনে রাখছে যার জন্যে পুরো বিষয় টি তে লোকে সেরকম কথা বলতে পারছে না। সালফারের ক্ষতি সেরকম মারাত্মক নয়, সালফার অক্সাইডের মাত্রা যা মেপে দেখা গেছে তা সীমার মধ্যেই আছে এবং পি এম বা পারটিক্যুলেট ম্যাটার যার জন্যে এ কিউ আই বা বায়ুদূষণ এত ভীষণ আকার নিয়েছে তাতে বাতাসে সালফারের কারণে কোনো হেরফের হয় না।
কিন্তু সেরকমটা হলে এত খরচ খরচার কী দরকার ছিল, এবং ভালো করে স্টাডি করার আগেই কেন এরকম একটা নির্দেশ জারী করা হয়েছিল? প্রত্যেক পলিসি বা আইন রিভিউ করার সময়সীমা থাকে, নিয়মনীতি থাকে, দশ বছর কেন লাগল এই পলিসি যাকে বলে একেবারে রিভারসাল করতে?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।