এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিসর 

    SHANKAR BHATTACHARYA লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৫ অক্টোবর ২০২৫ | ২৫ বার পঠিত
  • অন্ধকার অভিকর্ষে মানব চেতনা (প্রথম পর্ব)
    —-------- শংকর ভট্টাচার্য্য 
     
    ভূমিকা:
    সামাজিক বাস্তবতা আসলে কৃত্রিম। এটি বস্তু বা প্রাকৃতিক সত্যের উপর নির্ভর করে না, বরং মানুষের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া, ব্যাখ্যা, নিয়ম, সংস্কার, বিশ্বাস ও ক্ষমতার প্রভাব থেকে তৈরি হয়। ভালো-খারাপ, সভ্যতা-অসভ্যতা — এগুলো প্রাকৃতিক নয়, মানুষের তৈরি। কোনো সমাজে যা অশালীন, অন্য সমাজে তা স্বাভাবিক। পরিকল্পনাহীনতা, অপরিচ্ছন্নতা, অব্যবস্থাও সামাজিক বাস্তবতার অংশ, যা মানুষ স্বাভাবিক বলে মেনে চলে। শাসক, প্রভাবশালী মানুষ এবং সাধারণ মানুষ মিলে এই বাস্তবতা গড়ে তোলে, যা একবার তৈরি হলে অদৃশ্য শাসকের মতো কাজ করে। এই মিথস্ক্রিয়া সমাজের মধ্যে জাগতিক শক্তি রূপে প্রতিয়মান হয়। জাগতিক শক্তি বলতে এই আলোচনায় বোঝানো হয়েছে দুই ধরণের জাগতিক শক্তি— অর্থনৈতিক শক্তি (economic power) এবং রাজনৈতিক শক্তি (political power)। এরা একে অপরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। অর্থনৈতিক শক্তি প্রায়শই রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি স্থাপন করে, আবার রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে প্রভাবিত করতে পারে। এই প্রসঙ্গে আলোচনা প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য।
     
    বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা- যেমন ক্ষুধা, পৃথিবীর আবর্তন, আবহাওয়া। 
    সব প্রকৃতির তৈরি। সামাজিক বাস্তবতা অর্থাৎ ভালো-খারাপ, সভ্য-অসভ্যতা, শৃঙ্খলা-অশৃঙ্খলা ইত্যাদি কোনো বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা নয়।‌ এগুলো মৌলিকভাবে ব্যাখ্যা-নির্ভর, সমাজের শিক্ষা, সংস্কার, এবং ক্ষমতার খেলা থেকে তৈরি হয়। ক্ষমতার খেলা যাকে সভ্য সমাজে রাজনীতি বলা হয়। রাজনীতি রূপে যে খেলা আত্মপ্রকাশ করে। শাসক (রাষ্ট্র হোক, সমাজের ক্ষমতাধর গোষ্ঠী হোক) এবং সাধারণ মানুষ – উভয়েই মিলে সামাজিক বাস্তবতা তৈরি করে।
    তাই বিবাদ, হিংসা, কুসংস্কার, অশিক্ষা, পরিকল্পনাহীনতা, অপরিচ্ছন্নতা, শৃঙ্খলার অভাব — এগুলোও সামাজিক বাস্তবতা, যা মানুষ “এটাই তো স্বাভাবিক” ভেবে মেনে নেয়।
     
    রাজনৈতিক শক্তি মানুষের তৈরি সামাজিক বাস্তবতাকে নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। সমাজ কী ভাববে, কী করবে, কোন বিশ্বাসে চলবে — এসব নিয়ন্ত্রণ করাই রাজনীতির ক্ষমতা ধরে রাখার উপায়। এভাবেই মানুষের মন, আচরণ, বিশ্বাস প্রভাবিত করা যায়, ভোট নেওয়া যায়, নির্বাচন ও গণতন্ত্রকে ইচ্ছা করলেই প্রহসনে পরিণত করা যায়, বিরোধী মত দমন করা যায়। নির্বাচনের ভেতর দিয়ে যে ক্ষমতায় আসে যাদের সমর্থনে কোন দল ক্ষমতাসীন হয় তার প্রথম কাজ হয়ে দাঁড়ায় সাধারণ মানুষের স্বাধীন ভাবনাচিন্তার বিকাশের মধ্যে দিয়ে মুক্ত সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা বরঞ্চ নির্বাচনে জেতার পর ঠিক উল্টোটা ঘটে যায়। মানুষের স্বাধীন চিন্তা ভাবনাকে নিয়ে ক্ষমতাসীনরা প্রচারযন্ত্রের কাজ করিয়ে নিতে পারে। দেশে দেশে রাজনৈতিক শক্তি বারংবার সাধারণ মানুষকে নিয়ে এই ঘেরাটোপ বা প্রকষ্ঠাধীন পরিবেশ ধরে রাখতে পারে।
     
    রাজনৈতিক শক্তি সামাজিক বাস্তবতাকে ব্যবহার করে নানা কৌশলে:
     
    (ক) গল্পের ব্যাখ্যা নিয়ন্ত্রণে: রাজনীতি ভালো-খারাপ, সভ্যতা-অসভ্যতা, শত্রু-মিত্র, দেশপ্রেম-দেশদ্রোহিতা, ভাষার শ্লীলতা-অশ্লীলতার সংজ্ঞা তৈরি করে এবং গল্প বদলায়। যেমন — প্রতিবাদকে “দেশদ্রোহিতা” বলা, ভিন্ন পোশাক-খাদ্যকে “অসভ্যতা” বলা, প্রমাণকে “অশ্লীল” শব্দ দ্বারা চিহ্নিত করা, মানুষের ভাষাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অশ্লীলতার মধ্যে নিয়ে যাওয়া— তারপর নিজেকে শিক্ষিত বুদ্ধিমান বলে আখ্যা দেওয়া।
     
    (খ) আইন ও প্রশাসনের মাধ্যমে: নির্দিষ্ট ভাষা, আচার, আচরণ, পোশাক বাধ্যতামূলক করা, আইন আদালত প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রভাব বিস্তার করা, স্থান-নামের পরিবর্তন করা। এতে সমাজ ভাবতে শেখে — “এটাই স্বাভাবিক!”
     
    (গ) শিক্ষা, মিডিয়া, সংস্কৃতির মাধ্যমে: পাঠ্যপুস্তক বদল, ইতিহাস এড়িয়ে যাওয়া, শহীদের অমর্যাদা করা, বিশ্বাসঘাতক দের বীরের চরিত্রে নিয়ে আসা, সিনেমায় কোনো গোষ্ঠীকে ভিলেন দেখানো, মিডিয়ায় একপক্ষীয় খবর ছাপানো। এতে মানুষের ‘মৌলিক বিশ্বাস’ তৈরি হয়।
     
    (ঘ) রাজনৈতিক স্বার্থে বিভাজন: নতুন নতুন দল তৈরি, জাতপাতের বিভাজন, ধর্মের নামে হিংসা ছড়ানো, কোনো গোষ্ঠীকে “অপর” বা “অসভ্য” হিসেবে তুলে ধরা — যাতে মানুষ একজোট না হয়।
     
    সামাজিক বাস্তবতা মানুষের অভ্যাস, সংস্কার, ব্যাখ্যা থেকে তৈরি হলেও রাজনৈতিক শক্তি সেটাকে ব্যবহার করে, বদলায়, বা স্থায়ী করে। তাই রাজনৈতিক শক্তি সামাজিক বাস্তবতাকে হাতিয়ার বানায় — মানুষের মন ও আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য।
     
    এখনকার দুনিয়ায় প্রায় কোনো সামাজিক বাস্তবতাই রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত নয়।
     
    সামাজিক বাস্তবতা একা তৈরি হয় না। একজনকে নিয়ে নয় বরং বহুজনকে নিয়ে তৈরি সামাজিক বাস্তবতা। রাজনৈতিক শক্তি নিজের জন্য তাকে সহকারী করে নেয়, আকার দেয়, নিয়ন্ত্রণ করে, প্রয়োজনে বদলে দেয়। রাজনৈতিক শক্তির কাজকর্ম একজন মানুষ নিয়ে নয়— জনতা চায় অর্থাৎ বহু মানুষকে চায়।
    রাজনৈতিক শক্তির কাছে সামাজিক বাস্তবতা এক শক্তিশালী হাতিয়ার — মানুষের মন, আচরণ, বিশ্বাস নিয়ন্ত্রণের জন্য। রাজনীতি ও সামাজিক বাস্তবতা একে অন্যের থেকে পৃথকভাবে থাকতে পারে না, বরং একে অপরে ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকে এবং যোগাযোগ রাখে।
     
    রাজনীতি সামাজিক বাস্তবতার মাধ্যমে অর্থনীতিও নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থনীতি দেখতে বস্তুগত মনে হলেও, আসলে অনেকটাই সামাজিক চুক্তি ও নিয়মের উপর দাঁড়িয়ে। যেমন, টাকা কাগজ হলেও তার মূল্য সামাজিকভাবে স্থির হয়। বাজারের পণ্য, দাম, কর, রেশন, উন্নয়ন — সবকিছুই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে চলে। কোন শিল্প প্রমোট হবে, কোন এলাকায় রাস্তা হবে, কোন ঠিকাদার কাজ পাবে, কোন সড়ক যোজনা স্বর্নালী ত্রিভুজ হবে, কোন পণ্য ট্যাক্সমুক্ত হবে, কোন অঞ্চলে উন্নয়ন হবে — সব সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক শক্তির হাতেই থাকে, এমনকি গণতন্ত্রের ধারণাকে পছন্দমতো রাজনৈতিক ঢং-য়ে তৈরি করা হয়। রাস্তা দখল করে দোকান থাকবে কি না, মানুষ জন হাঁটবে কি না — সেটাও ভোটের রাজনীতির উপর নির্ভর করে। বড় ব্যবসায়ী বা কর্পোরেটের স্বার্থও অনেকসময় রাজনৈতিক শক্তি রক্ষা করে। অর্থাৎ, ব্যবসা আর রাজনীতি একসঙ্গে চলে। সামাজিক বাস্তবতা বলে প্রতিপন্ন হয়।
     
    রাজনীতি সামাজিক বাস্তবতা ও অর্থনীতি দুটোই নিয়ন্ত্রণে আনে। রাজনীতি সামাজিক বাস্তবতার মানদণ্ড ঠিক করে। সমাজের অভিজাত, ধর্মগুরু, মিডিয়া, বড় ব্যবসায়ী — এদের হাত ধরে রাজনৈতিক শক্তি সামাজিক বাস্তবতা স্থির করে এবং অর্থনৈতিক শক্তি ভাগ করে। মানুষ কী ভাববে, কী কিনবে, কোথায় কাজ করবে, কাকে ভোট দেবে, রাস্তা দখল থাকবে কি না, গণতন্ত্রের অর্থ কি— সব নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।
    সব মিলিয়ে দেখা যায়, রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে মানুষের মন+সামাজিক বাস্তবতা+গণতন্ত্র + অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা।
    রাজনীতির শক্তির উৎস ক্ষমতা। ক্ষমতাই রাজনৈতিক শক্তির ভরকেন্দ্র। সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্র।
     
    বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা মানুষের ইচ্ছায় বদলায় না। সামাজিক বাস্তবতা মানুষের তৈরি, ব্যাখ্যা-নির্ভর। রাজনীতি সামাজিক বাস্তবতার মধ্যে দিয়েই অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। ক্ষমতা দুটোকেই নিয়ন্ত্রণ করতে চায় — মানুষের মনও, মানুষের পকেটও।
     
    মূল কথা, ক্ষমতার রাজনীতি আর সামাজিক বাস্তবতার মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। অসংখ্য রাজনৈতিক দল তৈরির পেছনে এই গভীর সম্পর্কের ন্যায্যতা আছে। পৃথক পৃথক দল তৈরির গল্প (ন্যারেটিভস) থাকে।
     
    অনেক সময় রাজনৈতিক দল চায় না মানুষ সচেতন হোক। কারণ সচেতন মানুষ প্রশ্ন করে, আর তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়। তাই সামাজিক বাস্তবতা স্থিতাবস্থায় পড়ে থাকে। এলোমেলো শহর, দুর্বল নাগরিক পরিষেবা, ভারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, ভাঙ্গা চোরা জলমগ্ন রাস্তা ঘাট, অপরিচ্ছন্নতা, বিশৃঙ্খল ট্রাফিক, যত্রতত্র যান রাস্তার উপর দাঁড় করানো— সবই “স্বাভাবিক” বলে ধরে নেওয়া হয়।
     
    সার কথা: বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা প্রকৃতির সত্য, মানুষের ইচ্ছায় বদলায় না। সামাজিক বাস্তবতা মানুষের তৈরি, ব্যাখ্যা-নির্ভর। রাজনৈতিক ক্ষমতা এই সামাজিক বাস্তবতা, অর্থনীতি এবং গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে। তাই গণতন্ত্রের নামে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়। কিছু উন্নয়ন হয়, কিছু পরিষেবা দেওয়া হয়। কিন্তু সামাজিক বাস্তবতা, নাগরিক চেতনা, শৃঙ্খলা, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা — এই দিকগুলোতে কোনো গভীর, স্থায়ী পরিবর্তন আনা হয় না। ফলে সামাজিক বাস্তবতা সেই পুরনো স্তরেই পড়ে থাকে। ক্ষমতা চায়, এই বাস্তবতাই টিকে থাকুক, যাতে মানুষের নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়।
    রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব গল্প (ন্যারেটিভস) থাকলেও, সময়ে প্রয়োজনে তারা একে অন্যের সঙ্গে মিশে যেতে দ্বিধা করে না। একে বলা যায় “ন্যারেটিভ ফিউশন”—যেখানে আদর্শের ভিন্নতা নয়, সুবিধার বাস্তবতা মুখ্য হয়ে ওঠে।
    এইভাবেই সামাজিক বাস্তবতা, রাস্তা-বাজার থেকে শুরু করে অর্থনীতি, গণতন্ত্র, রাজনৈতিক দল আর ক্ষমতার রাজনীতি — একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকে।
     
    সামাজিক বাস্তবতা ও কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্র:
    সামাজিক বাস্তবতা প্রকৃতির নয়, মানুষের তৈরি এক কৃত্রিম ক্ষেত্র। প্রাচীনকাল থেকে পরিবার, কুল, উপজাতি, গ্রামের পাড়া — ছোট গোষ্ঠীর ভেতরেই গড়ে উঠেছিল নিয়ম, সংস্কার, নেতৃত্ব। এভাবেই মিথস্ক্রিয়ায় উদ্ভব হয়েছিল কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্র, যা প্রকৃতির নিয়ম নয়, ক্ষমতার ব্যাখ্যা আর নিয়মের উপর দাঁড়িয়ে আছে। জাগতিক শক্তি– অর্থনৈতিক শক্তি (economic power) এবং রাজনৈতিক শক্তি (political power) একে অপরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত হওয়ায় জাগতিক শক্তিই প্রবল অভিকর্ষ হয়ে যায়, যার আরেক রূপ ক্ষমতা ধারণ করা ও প্রয়োগ করা, এই বৈশিষ্ট্য আরও স্স্পষ্টভাবে দেখা বা বোঝা যায় কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রে।
     
    অভিকর্ষের ভূমিকা:
    কৃত্রিম ক্ষেত্রের মধ্যে আছে প্রবল “অভিকর্ষ” — নিয়ম, সংস্কার, ট্যাবু, যা মানুষের চিন্তা ও বিশ্বাসকে নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বেঁধে রাখে। মানুষ ভাবে, “এটাই তো স্বাভাবিক!”
     
    রাজনৈতিক শক্তি ও অভিকর্ষ:
    প্রাচীন কালে গোষ্ঠীর নেতা ও তার দুচারজন চেলাচামুন্ডা নিয়ে তৈরি হয়েছিল অভিকর্ষ, ক্ষমতার উৎস এবং ক্ষমতার ব্যাখ্যা। আজ সেই জায়গা দখল করেছে বেশি লোকজন নিয়ে বড় আকারে তৈরি রাজনৈতিক দল। তারা মিডিয়া, শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রযুক্তির সাহায্যে কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রকে নিজের মতো গড়ে তোলে, অভিকর্ষের ভর আরও বাড়িয়ে তোলে।
     
    সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রায় অভিকর্ষের ভর বেড়েই চলেছে। নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের মন আরও গভীরভাবে কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রে বন্দী হচ্ছে। রাজনৈতিক দল জানে, এই ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ মানেই মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি — সব নিয়ন্ত্রণ।
     
    বর্তমান বাস্তবতা দেখায় যে সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণতন্ত্র— সব অভিকর্ষের মধ্যে একত্রিত।
     
    কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্র, ক্ষমতার অভিকর্ষ ও কৃষ্ণগহ্বরের স্প্যাগেটিফিকেশন: 
     
    ১. কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রের জন্ম হয়েছিল প্রাচীন যুগে মানুষের সমাজে ছোট ছোট গোষ্ঠীতে। তখনকার সময়েও শাসক বদলাতো কিন্তু নিয়ম, সংস্কার, ট্যাবু প্রায় একই থাকত। সামাজিক বাস্তবতা সেই একই অভিকর্ষে আবদ্ধ থাকত।
     
    ২. আধুনিক রাষ্ট্রে কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রের বিস্তার:
    সভ্যতা এগিয়েছে। গোষ্ঠী বড় হয়েছে, রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রের পরিসর বিশাল হয়েছে। সামাজিক বাস্তবতার মধ্যে অভিকর্ষের বলও বেড়েছে। প্রযুক্তি, গণমাধ্যম, শিক্ষা, আইনের মাধ্যমে ক্ষেত্র আরও শক্ত হয়েছে।
    আদ্যিকালের গোষ্ঠীর বদলে আজকের যুগে রাজনৈতিক দল সেই ক্ষেত্রের চালক। তারা মানুষের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।
    মিডিয়া, প্রপাগান্ডা, শিক্ষা দিয়ে ক্ষেত্রের অভিকর্ষ বাড়িয়ে তোলে।
    অনেক সময়েই দেখা যায় নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন, গণতন্ত্র অভিকর্ষ বলের আওতামুক্ত থাকে না।
    নতুন নতুন দল ক্ষমতায় আসে। নতুন মুখ, নতুন স্লোগান। মতাদর্শ, ন্যায়, নীতি ক্ষমতার অভিকর্ষে পড়ে বিকৃত হয়ে যায়। কোনো কিছুই নতুন আলো পায় না। কিছু নতুন নেই, শুধু রূপের পুনরাবৃত্তি। পুরোনো সমস্যার নতুন বক্তৃতা, নতুন সমস্যার পুরোনো ব্যাখ্যা, কিন্তু ক্ষেত্রের অভিকর্ষে কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয় না। প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক দলের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে রাজনীতি সেই একই নিয়মে চলে, শুধু নতুন পোশাক পরে। নিজেদের পছন্দমতো করে সামাজিক বাস্তবতাকে রাখে, অর্থনীতিকে রাখে এবং গণতন্ত্রের নামে নির্বাচন আসে, পছন্দসই রাজনীতির মাধ্যমে গদিতে বহাল তবিয়তে থাকতে চায়। 
     
    ৩. কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রের কৃষ্ণগহ্বর-সাদৃশ্য:
     
    কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রকে কৃষ্ণগহ্বরের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কৃষ্ণগহ্বর এখানে একটি রূপক (মেটাফোর) এক ধরনের অলঙ্কার যা একটি বস্তুকে অন্য বস্তুর সাথে তুলনা করে, যেখানে কৃষ্ণগহ্বরেরকে কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রের মধ্যে প্রতিস্থাপন করা যায়, তাদের মধ্যে একটি সাদৃশ্য বা সম্পর্ক বোঝানোর জন্য।
    কৃষ্ণগহ্বর কী করে? এক বিশাল অভিকর্ষের কেন্দ্র। আলোকরশ্মিও বাইরে বের হতে পারে না।
    যা কিছু কাছে আসে, সেটিকে টেনে স্প্যাগেটিফিকেশন (spaghettification)-এর শিকার করে। পদার্থের আকার আর সত্তা ছিঁড়ে ছিঁড়ে দীর্ঘ সরু সুতোয় পরিণত হয়।
     
    কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্র কী করে? সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি একত্রিত হয়ে এক অভিকর্ষের ক্ষেত্র তৈরি করে। মানুষকে টেনে নিয়ে যায় সেই ক্ষেত্রের গভীরে। মানুষের চিন্তাভাবনা, স্বাধীনতা, চেতনা — সবকিছুকে টেনে সরু সুতোয় পরিণত করে।
    মানুষ আর স্বাধীনভাবে আলোক বিকিরণ করতে পারে না। অন্ধকার গহ্বরে অভিকর্ষের মধ্যে মানব চেতনা বন্দি হয়ে যায়।
    “আলো যেমন কৃষ্ণগহ্বর থেকে বাইরে আসতে পারে না, তেমনি কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রে ভেতরে থাকলে মানুষের চিন্তাভাবনার আলো, স্থান, কাল বেঁকে যায়, বিকৃত হয়ে যায়। স্প্যাগেটি হয়ে যায়।”
     
    ৪. মানুষের চেতনার স্প্যাগেটিফিকেশন:
     
    কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রের অভিকর্ষ মানুষের যুক্তি-তর্ক দুর্বল করে। মানুষের স্বাধীন চিন্তা স্পষ্ট হতে দেয় না। মানুষ ভাবে “এইভাবেই তো চলে আসছে।”
    মানুষ আর প্রথা, শাসন, ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। এভাবেই মানুষের চেতনা, মনন, আত্মসত্তা স্প্যাগেটিফিকেশন হয়ে যায়, মানুষ সরু, দীর্ঘ, একরৈখিক চিন্তায় বন্দী হয়ে পড়ে। একমুখী বিশ্বাসে আবদ্ধ হয়। স্বতন্ত্র ভাবনা দূর হয়। আলোর আর বিচ্ছুরণ নেই।
     
    ৫. ক্ষমতার অভিকর্ষের উদ্দেশ্য:
     
    শাসক বা রাজনৈতিক শক্তির উদ্দেশ্য:
     
    মানুষকে সেই কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রের অভিকর্ষে আটকে রাখা। যাতে মানুষ জড়বস্তুর মতো শুধু শাসন মেনে চলে। “মানুষের নিজের আলো— কৌতূহল জিজ্ঞাসা থাকে না। মানুষকে এইভাবে একটা জড়বস্তুর মতো করে নিয়ে কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রে রেখে দেয়া যায়, শাসকের উদ্দেশ্য শাসন কায়েম করা ও ক্ষমতার আসনে থাকা সেটি সফল হয়।”
     
    রাজনৈতিক প্রকোষ্ঠ, কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্র, কৃষ্ণগহ্বর এবং আধুনিক ক্ষমতার জাল:
     
    ১. প্রকোষ্ঠ: এক অদৃশ্য কারাগার
     
    আধুনিক কালের ডানপন্থী, বামপন্থী, মধ্যপন্থী— রাজনীতি একেকটি প্রকোষ্ঠ। এই প্রকোষ্ঠের মধ্যে একবার মানুষ ঢুকলে, আর সহজে বেরোতে পারে না। চিন্তা, অনুভূতি, বিচারশক্তি সব প্রকোষ্ঠের দেয়ালে আটকে পড়ে।
    “প্রকোষ্ঠে কিছু রাখলে বা কিছু ঢোকালে সেটা অনড় হয়ে পড়ে থাকে, নড়াচড়া করে না।”
    সেই প্রকোষ্ঠ হয়ে যায় এক কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্র।
    এখানে মূল কথাটি হলো এই যে— রাজনৈতিক প্রকোষ্ঠ মানুষের ব্যক্তিগত চিন্তা, অনুভূতি, স্বাধীনতা এমনভাবে আটকে রাখে যে, মানুষ নিজের অজান্তেই সেই প্রকোষ্ঠের নিয়মকানুনকে বাস্তব বলে ধরে নেয়। প্রকোষ্ঠের মধ্যে টেনে নিয়ে সাধারণ মানুষের বস্তুনিষ্ঠ চিন্তা ভাবনার স্বকীয়তা রাখতে দেয় না। প্রকোষ্ঠের ব্যাখ্যা অন্যরকম ভাবে উত্থাপন করে। ব্যাখ্যাতে মনে হয় প্রকোষ্ঠের মধ্যে ঢুকে পড়া ছাড়া সমাজের সদগতি নেই।
    রাজনৈতিক প্রকোষ্ঠ কৃষ্ণগহ্বরের মতো অদৃশ্য অভিকর্ষ সৃষ্টি করে।
     
    ২. কৃষ্ণগহ্বর ও কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রের সাদৃশ্য
     
    কৃষ্ণগহ্বর যেমন অদৃশ্য এক বিশাল গহ্বর যার অভিকর্ষের কাছে এলে ভরহীন আলোও বেরোতে পারে না। সমস্ত রকমের ভরহীন ও ভরযুক্ত পদার্থকে টেনে তার মধ্যে নিয়ে স্প্যাগেটিফিকেশন করে।
     
    কৃষ্ণগহ্বরের মতোই কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রও তেমন এক অদৃশ্য শক্তিশালী গহ্বর— যে গর্তের অভিকর্ষ মানুষের চিন্তা, যুক্তি, স্বাধীনতা টেনে নেয়। প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ চিন্তা যুক্তি স্বার্থ উচ্চাশা সম্মিলিত দেহ বা শারীরিক ভর দ্বারা গঠিত এবং বস্তুর মতোই “ভর” বিশিষ্ট। কিন্তু অভিকর্ষের মধ্যে গিয়ে পড়লে মানুষ আর বহির্জগতে আলো দেখে না, মুক্ত চিন্তা করতে পারে না। মানুষ একরৈখিক “স্প্যাগেটি চিন্তায়” রূপান্তরিত হয়। কৃষ্ণগহ্বর সদৃশ কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্র সন্তান সন্ততি, পরিবারের মধ্যেও ক্রিয়াশীল থাকতে পারে। বস্তুনিষ্ঠ চিন্তা লোপ পায়। একনায়কোচিত মাতব্বরী, হুমকি বা জুলুম, বিকারগ্রস্ত উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন, মনগড়া একরৈখিক অনড় মানসিকতা নিয়ে কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রে ব্যক্তি অবরুদ্ধ হয়ে যায়।
     
    এখানে মূল কথাটি হলো এই যে— কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্র হলো এক প্রকার অদৃশ্য কৃষ্ণগহ্বর, প্রবল অভিকর্ষ যেখানে মানুষের মননশীলতা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়। 
     
    ৩. গল্প (ন্যারেটিভস) ও বাইনারির খেলা: 
    যুগ যুগ ধরে গল্প এবং বাইনারি চলমান— গতি বাড়িয়ে চলে। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি যুগের — সত্যযুগে মানুষ নাকি পাপ করত না, আয়ু ছিল লাখ বছর, উচ্চতা ২১ হাত — যদিও তার কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই। ক্রমে যুগগুলো মন্দের দিকে গেছে বলে মনে করা হয়। যেমন, কলিযুগে ন্যায় নীতি নৈতিকতার স্খলন হয়েছে।
     
    সেই সব যুগ পার হয়ে অবশেষে কলিযুগেই ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথা উঠে যায়, রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায়। আগে সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার অভাব, কুসংস্কার, রাজাকে দেবতা মানা, পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র ভাবা, সতী হলে গমন হয় স্বর্গলোকে— এসব গল্প প্রচলিত ছিল।
     
    বাইনারিও ছিল, যেমন —
     “আলো-অন্ধকার”, “সত্যবাদী-মিথ্যাবাদী”, “পাপ-পুণ্য” ,
    ”স্বর্গ-নরক”, “দেবতা-অসুর”, “রাজা-প্রজা”, “পণ্ডিত-মূর্খ
     “আমরা-তারা”, “শুদ্ধ-অপবিত্র”, “সতী-অসতী” 
     “সভ্য-অসভ্য” , নাস্তিক-আস্তিক ।
     
    আজকের যুগেরও রাজনৈতিক দলের প্রকোষ্ঠে গল্প আর বাইনারি নতুনভাবে জন্ম নেয়। যেমন –
    কালো টাকা উদ্ধার ও দেশের মানুষের মধ্যে বন্টন, বছরে দুকোটি চাকরি, দুর্নীতির অবসান ঘটিয়ে সমাজ দেশের উন্নতি— কোনো কিছুই সত্য বলে প্রতিপন্ন হয়নি। অথচ এগুলো বাস্তব বলেই ধারণা তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। বাইনারি ছিল – না খানে দেউঙ্গা না খাউঙ্গা।
    রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ২০২৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে সংসার খরচ, সঞ্চয়ে ঘাটতি, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং আয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির আঁচে মানুষ হতাশ; দারিদ্র্য বাড়ছে। দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উপর বিপুল কর আরোপ করা হয়েছে। ৯১ শতাংশ মানুষ গত মার্চে করা রিজার্ভ ব্যাংকের ঐ সমীক্ষায় জানিয়েছেন, মূল্যবৃদ্ধির কারণে তাঁদের সংসার চালানোর খরচ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে।
    তাহলে দেখা যাচ্ছে, আশ্বাস বিশ্বাস ক্রিয়াকলাপ দ্বারা তৈরি করা গল্পগুলো এক রকম, আর বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা, মানুষের চাহিদা আরেক রকম।
     
    পশ্চিমবঙ্গে বাম আমলে ভোটের বৈতরণী পার হতে— ভূমি সংস্কার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির উন্নতির গল্প ঢাক পিটিয়ে চারিদিকে প্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলে। বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া— অত্যধিক ঘটা করে আরম্ভ অনুষ্ঠানের ফল সামান্যমাত্র। দীর্ঘকাল ক্ষমতাসীন বামদের যেসব “কাজ” কমবেশি চল্লিশ বছরের শাসনে দেখা গেছিল, তার সাথে দলের গল্প-এর কোনো মিল ছিল না। সেখানে প্রতিবাদের অর্থ করা হয়েছিল সমাজবিরোধী। ক্ষমতার দর্শন প্রবাহে ভাবোন্মত্তরা বস্তুনিষ্ঠ ভাবনার বদলে এই বাস্তবতার গল্পে মানুষকে মোহিত করে বাম প্রকোষ্ঠে স্থায়ী বাসিন্দা করতে চেয়েছিলেন। বাইনারি ছিল– শিরদাঁড়া বাঁকা সোজা, শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব। ‘জনতার মুখরিত সখ্য’, ‘বন্ধুত্ব’ ও ‘সেবা’ নানা অনুষ্ঠানে সুবিধা ও পছন্দমতো ব্যবহৃত হয়। সখ্য ও সেবা প্রদর্শনের নামে ব্যক্তিরা অতিথি হন, নাম ছাপা হয় অনুষ্ঠানের সূচিপত্রে, যা একধরনের মর্যাদার উপসর্গে পরিণত হয়েছে। রাজনীতি এ ধরনের উপসর্গকেই স্বেচ্ছাসেবা বা শ্রেণীসংগ্রামের বাস্তব কর্মকাণ্ড হিসেবে উপস্থাপন করে।
     
    ফলে ‘মুখরিত সখ্য’ তার প্রকৃত মূল্য হারিয়ে ফেলে। তা ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান প্রদর্শনের উপায় হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে এক দৃষ্টিনন্দন বাস্তবতা তৈরি হয়, যা আসলে সমাজের কোনো উপকারে আসে না। সখ্য বা বন্ধুত্বের সংস্কৃতি শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্যেই আবর্তিত হয়।
     
    বর্তমানে রাজ্যের অর্থনৈতিক সংস্কৃতির দিকে তাকালে দেখা যায়, দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। দুর্নীতি প্রতিরোধে মা-মাটির পরিশ্রমী মানুষেরা সুস্থ সবল মনন চিন্তাকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম— এমন কোন বাস্তব পরিস্থিতি এই প্রকোষ্ঠে নেই। প্রকষ্ঠাধীন কর্পোরেশন, মিউনিসিপ্যালিটি ও পঞ্চায়েতের রাজনৈতিক নেতারা তা মনেই করেন না। এই বাস্তবতা রাজনীতির পাঠ্যসূচিতে দীর্ঘকাল ধরে অবস্থান করছে। বাইনারি– মা, মাটি, মানুষ।
     
    বাম কিংবা ডান কোনো দলের গল্প (ন্যারেটিভস) এবং বৈপরীত্যমূলক শব্দ (বাইনারি) প্রয়োগ ও প্রচার ব্যবস্থাপনার ঘাটতি দেখা যায় না। বাইনারির উদাহরণ যেমন—- “ম্লেচ্ছ-সভ্য”, “জাত-বেজাত”, “ভন্ড আদর্শবাদী-সৎ আদর্শবাদী”, “যোগী-ভোগী”, “করিৎকর্মা-চোর”, “অনৈতিক চিরকূট-নৈতিক মধ্যস্ততা”, “দালাল-খদ্দের”, “অমুক দেশপ্রেমিক-তমুক দেশদ্রোহী।” “অমুক দলই গরিবের বন্ধু-বাকি সব শোষক।”
     
    এখানে মূল বা গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হলো এই যে— নতুন নতুন রাজনৈতিক গল্প আর বাইনারি মানুষের মনোজগতকে প্রভাবিত করে এবং মানুষ সত্য-মিথ্যা আলাদা করতে পারেন না। ফলে বোঝা যায় যে, রাজনৈতিক দলগুলোর তৈরি ন্যারেটিভস আর বাইনারিই হলো মানুষের চেতনাকে বেঁধে রাখার সবচেয়ে বড় শক্তিশালী উপায়। গল্প তৈরির কারিগর অসংখ্য।
     
    গল্পের কারিগর (ন্যারেটিভস মেকার)। যেমন— 
    ঈশ্বর প্রেরিত কারিকর। মহান বিজ্ঞানী নীতিধারী। 
    জনতার মূখরিত সখ্যে আলোকিত আত্মপ্রচারক (self-promoter)। জাতপাত বিদ্বেষী জ্ঞানী। বিশ্বের তাবৎ বিষয়ে জ্ঞানী ঝাঁক বাঁধা সবজান্তা। সংবাদ উপস্থাপক/উপস্থাপিকা। ইউটিউবার।
    এক্স হ্যান্ডেলার। দৈনিক সংবাদ পত্র।
     রাঘব বোয়াল। 
     
    ৩. নির্বাচনের খেলা— অভিকর্ষের পরীক্ষা:
     
    নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক দল শাসন ক্ষমতায় বারবার ফিরে আসে। কেউ হেরে যায়। কিন্তু সবই নির্ভর করে প্রাক-নির্বাচনী গল্প কতটা কার্যকর হয়েছে। বাইনারি কতটা মানুষের মস্তিষ্কে ঢুকেছে।
     
    এখানে লক্ষ্য করার মতো মূল কথাটি হলো এই যে— “নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, বরং কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রের অভিকর্ষ কতটা প্রভাব ফেলতে পারল, তারই পরীক্ষা।”
     
    নির্বাচনের পর শাসক বদলায়। চেহারা, স্লোগান বদলায়। কিন্তু কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রের অভিকর্ষ বদলায় না। ফলে বোঝা যায় “নির্বাচন যতই হোক, মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটে না, কারণ ক্ষেত্রের অভিকর্ষ অটল থাকে। মানুষের মনন চিন্তনে গণতন্ত্র তার পরিচয় হারায়।
     
    ৪. “মৌলিক পরিবর্তন” বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে সমাজের গঠনগত (structural) পরিবর্তন।
    মানুষের চিন্তার মূল ফ্রেমওয়ার্কের পরিবর্তন।
     
    প্রকৃত মৌলিক পরিবর্তন হলে কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রের অভিকর্ষ দুর্বল হয়ে পড়ে।
    যেমন: মানুষ স্বাধীনভাবে প্রশ্ন করতে শিখবে। গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে।
    কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রের বাইরের বাস্তবতা দেখতে পাবে। গোষ্ঠী, জাতি, দল, ধর্ম— এগুলোর বিভাজন ক্ষমতা হারাবে।
     
    এখানে মূল কথাটি হলো এই যে— মৌলিক পরিবর্তন মানে শুধুমাত্র রাজনৈতিক গদি দখল বদল নয়, বরং মানুষের মানসিক কাঠামোর ভিত ভেঙে নতুন প্রশ্ন করার শক্তি অর্জন। বস্তুনিষ্ঠ সেই শক্তি ফিরে পাওয়া।
     
    কিন্তু বাস্তবতা হলো— শাসক বদলালেও কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রের অভিকর্ষ অক্ষত থাকে। মানুষের “চিন্তার স্প্যাগেটিফিকেশন” আগের মতোই থাকে।
    তাই কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটে না। শাসক সেটাই চায়।
    এই “সমাজের বাস্তবতা (বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা থেকে আলাদা হয়ে) একই রূপে ঠিকে থাকে — মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয় না।”
     
    “মৌলিক পরিবর্তন” বলতে ক্ষেত্রের অভিকর্ষে পরিবর্তন বোঝানো হচ্ছে।
    যা বাস্তবে ঘটে না।
     
    ফলে বোঝা যায় যে, রাজনীতির ঢং বদলায়, কিন্তু মানুষের মুক্তির চাবিকাঠি থেকে যায় সেই অভিকর্ষের হাতেই। চেতনাকে বিকৃত করে অন্ধ আনুগত্য তৈরি করে। বস্তুনিষ্ঠ ধাণাকেই পাল্টে দেয়। রাজনীতি নিজেকে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি রূপে প্রতিষ্ঠিত করে। প্রবল অভিকর্ষ বলের কৃত্রিম বাস্তব ক্ষেত্রের মধ্যে রাজনৈতিক শক্তি তৈরি হয়। 
    (শেষ অংশ/ দ্বিতীয় পর্বে )
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে প্রতিক্রিয়া দিন