

কথায় বলে, ঠেলায় না পড়লে বিড়াল গাছে ওঠে না। আর এটাও শোনা যায়, বিপাকে পড়লেই তবেই সরকার উপুড় হস্ত হয়। বিহারের নির্বাচনের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কথাটা আক্ষরিক অর্থে সত্যি। এইবার বিহারের নির্বাচনে নীতিশ কুমারকে সামনে রেখে লড়লেও, তাঁরা যে হেরে যেতে পারে, তা বিজেপি বেশ বুঝতে পারছে, আর বুঝতে পেরেই, তাঁরা তড়িঘড়ি ২৫ লক্ষ মহিলার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি ১০ হাজার টাকা করে দেওয়ার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। ভোটার তালিকা থেকে মুসলমান ভোটার বাদ দিলেও যে বিজেপি নীতিশ কুমারের জোটের খুব সুবিধা হবে, তা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। এই প্রস্তাব নীতিশ কুমারের সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েই ছিল, কমিশন নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে ফেলার আগেই তাই টাকা দিয়ে দেওয়া হলো। যে নীতিশ কুমার চিরকাল ভোটের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি নেহাত বিপাকে না পড়লে, এই ঘোষণা করতেন কি? যে প্রধানমন্ত্রী কিংবা শাসক দল বিজেপি সারাক্ষণ বাংলার লক্ষ্মীর ভান্ডার জাতীয় প্রকল্পের বিরোধিতা করে থাকেন, বিরোধী রাজ্যগুলোর উপঢৌকনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিরোধিতা করে থাকেন, তিনি হঠাৎ এমন দরাজ হস্ত কেন, সেই প্রশ্ন উঠছে।
এই টাকা পাঠানোর সময়ে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বলেছেন, এই প্রকল্পের টাকার মাধ্যমে বিহারের গ্রামীণ মহিলারা স্বনির্ভর হতে পারবেন। পুতুল, খেলনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ছোট ছোট জিনিষ তৈরী করা কিংবা ছোট দোকান পর্যন্ত দিতে পারবেন মহিলারা। এই ঘোষণা করার মধ্যে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, যে ‘জীবিকা দিদি’রা এই প্রকল্পে যুক্ত হবেন, তাঁদের জন্য পরবর্তীতে আরও বেশ কিছু অনুদান থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী এখনো অবধি এই সমস্ত প্রকল্পে প্রায় ১০০০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে এবং উপকৃত হয়েছেন প্রায় ১ কোটি মহিলা। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিহারের বিজেপি’র দু’জন উপমুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দলকে সরাসরি আক্রমণ করেছেন এবং বলেছেন এখন বিহারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এবং বিহার এরপর আরো উন্নয়নের জোয়ারে ভাসবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যাঁদের জন্য প্রধানমন্ত্রী এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী এই আর্থিক অনুদান ঘোষণা করলেন, তাঁদের কি সত্যিই এই টাকাটা কাজে আসবে? বিহারের গ্রামে গঞ্জের চিত্র কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য কথা বলছে। বিহারের বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে শুরু করে ছোট বড় সমস্ত সংবাদমাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে একটা খবর এসেছে, বিহারের মহিলারা ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে তার সুদ দিতে গিয়ে জর্জরিত। কেউ হয়তো প্রাথমিকভাবে কোনও একটি সংস্থা থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন পরিবারের কোনও মেয়ের বিয়ের জন্য সেই ঋণ শোধ হতে না হতে, আবার হয়তো তাঁকে বাড়ির কারুর চিকিৎসার জন্য অন্য কোনও সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছেন। যা খবর পাওয়া যাচ্ছে, বিহারের বেশীরভাগ মহিলারা যাঁরা এটা পাবেন, তাঁদের ঋণ শোধ করতেই চলে যাবে। আদৌ এই অনুদান তাঁদের কোনও কাজে আসবে না।
অনেকে ভাবতে পারেন, এই ক্ষুদ্র ঋণের বিষয়টি শুধুমাত্র বিহারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কিন্তু বিষয়টা একেবারেই তা নয়, বাংলার ক্ষেত্রেও এই সমস্যা আছে। হুগলী, বসিরহাট, মুর্শিদাবাদ, মালদা সহ নানান জেলায় এই ক্ষুদ্র ঋণের জালে জড়িয়ে আছেন বহু মহিলা। ২০২৯ – ২০ সালের সময়ে যখন কোভিডের প্রভাব বেড়েছিল, যে সময়ে মানুষের কাজ ছিল না, ঐ সময়েই এই টাকা ধার নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছিল। তারপরে সেই টাকা শোধ করতে না পেরে আরো অন্যান্য সংস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছিল। ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে হুমকি এবং অত্যাচারও বেড়েছিল। বিহারে এর ফলে, বহু পরিবার ছন্নছাড়া হয়ে গেছে।
একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার তথ্যচিত্র "Cambodia - How microcredit is making the world's poor even poorer" মাইক্রোফিনান্স বা ক্ষুদ্র ঋণের প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে তার খারাপ দিকটিকে তুলে ধরেছে। এই ঋণ মডেলটি একসময় দারিদ্র্য দূরীকরণের 'সিলভার বুলেট' হিসেবে বিবেচিত হলেও কম্বোডিয়ার হাজার হাজার দরিদ্র পরিবারের জন্য ধ্বংস ডেকে এনেছে। অনেকেই ঋণ গ্রহীতাদের প্রাথমিকভাবে ব্যবসার জন্য মূলধন পেয়ে এটিকে ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখেন, কিন্তু এই ঋণ মডেলের কাঠামোগত দুর্বলতা দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তথ্যচিত্রটি দেখিয়েছে, কীভাবে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলি অত্যধিক আগ্রাসীভাবে ঋণ বিতরণ করে এবং ঋণের উপর অতিরিক্ত সুদ আরোপ করে এবং তা সরকারের আর নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে না। সুদের হার এতটাই বেশি থাকে যে পরিবারগুলো কেবল সুদ পরিশোধ করতেই নিঃস্ব হয়ে যায়। ফলে তারা একটি ঋণ শোধ করার জন্য অন্য জায়গা থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। এই প্রক্রিয়া তাদের 'ঋণের দুষ্টচক্রে' জড়িয়ে দেয়, যার পরিণতি হয় ভয়াবহ। ঋণের বোঝা অসহনীয় হয়ে ওঠায় বহু পরিবার তাদের জমি ও বাড়ি বিক্রি করতে বাধ্য হয়। পরিবার ভেঙে যায়, সন্তানেরা পড়াশোনা ছেড়ে কাজে যেতে বাধ্য হয় এবং চরম মানসিক চাপের কারণে কিছু ঋণগ্রহীতা আত্মহত্যার পথও বেছে নেন। তথ্যচিত্রটি এই কঠিন সত্যকে তুলে ধরে যে নিয়ন্ত্রণের অভাব এবং অত্যধিক বাণিজ্যিকীকরণের কারণে কম্বোডিয়ার মতো দেশে ক্ষুদ্র ঋণ দরিদ্রদের সাহায্য করার কার্যকর হাতিয়ার না হয়ে বরং শোষণকে উৎসাহিত করেছে, যা সকল ক্ষুদ্র ঋণই উপকারী—এই প্রচলিত ধারণাটিকে নস্যাৎ করে দেয়।
ঠিক যে সময়ে, বিহারের বিশেষ নির্বাচনী সংশোধনীতে অসংখ্য মহিলার নাম বাদ যাওয়ার অভিযোগ উঠছে, সেই সময়ে এই টাকা দেওয়া হয়তো নীতিশকুমার এবং বিজেপিকে নির্বাচনী বৈতরণী পেরোতে সহায়তা করতে পারে বলে অনেক নির্বাচনী বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, কিন্তু তাঁদের সময়ের কঠিন বাস্তবতা সম্পর্কে কোনও জানা বোঝা আছে বলে মনে হয় না। আজকের শপিং মলের চকচকে জগতের দিনে, কিংবা ই-কমার্সের এই রমরমা সময়ে ১০ হাজার টাকার যে কোনও মূল্যই নেই, সেটা হয়তো অনেকেই ভুলে গেছেন। একজন মহিলা কীসের ব্যবসা করবেন ঐ টাকায়, কীভাবে সেই ব্যবসার প্রচার করবেন, কারা তাঁর ক্রেতা হবেন, এই কথাগুলোও সামনে আসা উচিৎ। সরকারি জিএসটির অসুবিধা বা সুবিধা তাঁরা কতটা পাবেন? আজকের অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট, উবের, সুইগি বা জোমাটোর যুগে এই মহিলারা কতটা অসহায়, তা আমরা কল্পনাও করতে পারি কি?
মনে পড়ে যাচ্ছে, ২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়া অনিকেত চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত একটি ছবি ‘শঙ্কর মুদি’র কথা। কীভাবে মফস্বলের একটি দৈনন্দিন প্রয়োজনের মুদিখানার দোকান, একটি সেলুন, ছেলেদের বা মেয়েদের পোষাক বানানোর দর্জির দোকান, তাঁদের অঞ্চলেই গড়ে ওঠা একটি বড় শপিং মলের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার অসম চেষ্টা করেও পরাজিত হলো, তা আজকের সময়ে আবার সবার দেখা উচিৎ। উন্নয়ন আর বিকাশের মানে তো শুধু এই ঝাঁ চকচকে শপিং মল বা অ্যাপ নির্ভর কেনাকাটা নয়, উন্নয়ন তো হওয়া উচিৎ মানুষের। সেই মানুষের জীবনযাত্রার মান কি বাড়ছে? নাকি দৈনন্দিন লড়াই করতে করতে এই অসম লড়াইয়ে নেমে হারিয়ে যাচ্ছে শঙ্কর মুদি, কালি বা নারাণরা। মহিলাদের স্বনির্ভরতা কি আদৌ এইভাবে আসতে পারে? বিহারের আনাচকানাচ থেকে এই প্রশ্ন উঠছে, এই ১০ হাজার টাকা অনুদানে কোন ব্যবসা করা সম্ভব, সেই কথাও উঠছে। মহিলাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো জরুরি, তাঁদের স্বনির্ভরতাও জরুরি, কিন্তু তার জন্যে সরকারকে আরো বেশী মানবিক হতে হবে। নজর দিতে হবে, ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার চাপে কারা জর্জরিত, কেন ঐ সংস্থাদের সূদের হার বেশী? সরকারি ব্যাঙ্ক কেন সহজ শর্তে ঋণ দেবে না, এই প্রশ্নও তুলতে হবে বিরোধীদের। বিকল্প ভাষ্য তৈরী করতে হবে, ভুক্তভোগী মহিলাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। না হলে, শুধু বিজেপি খারাপ, আমরা ভালো বললে হবে না, কেন ভালো, সেই কথাও বলতে হবে।
সিপিআইএমএল, যাঁরা বিহারের বিরোধী মহাগঠবন্ধনের অন্যতম শরিক, তাঁদের তরফ থেকে এই মহিলাদের ক্ষুদ্রঋণের সমস্যা নিয়ে একটি তথ্যচিত্র বানিয়ে, মহল্লায় মহল্লায় প্রচারের ব্যবস্থা হয়েছে। এই প্রচারের মধ্যে দিয়ে তাঁরা একটা কথাই বোঝাতে চাইছেন, যে নীতিশকুমারের এই মহিলাদের মন পাওয়ার বন্দোবস্ত আসলে যে ঐ মাইক্রোফিনান্স বা ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাকেই ঘুরিয়ে সাহায্য করতে চলেছে, তা দেখানো। যদিও অন্য বিরোধী দলগুলো, এই বিষয়টা নিয়ে এখনো রাস্তায় নামেনি, কিন্তু সামনের বিহার নির্বাচনে এই বিষয়টা যে প্রভাব ফেলতে চলেছে, তা নীচের তলার কর্মীরা বলছেন। একে ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনের ফলে মহিলাদের নাম বাদ পড়েছে, তার ওপরে মহিলাদের জন্যেই আবার ১০ হাজার টাকার অনুদান সেই কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে না তো? বিহারের নির্বাচন কিন্তু সেই প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজবে।