সারা বিহার জুড়ে এখন প্লাবন চলছে। হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই প্লাবন চলছে। মানুষের প্লাবন নেমেছে। নির্বাচন কমিশন যেদিন থেকে ঘোষণা করেছিল, যে বিহারে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনী করা হবে, সেদিন থেকে বিজেপি বিরোধী সমস্ত দল বলা শুরু করে, এই বিশেষ নিবিড় সংশোধনী আসলে ‘ভোটবন্দী’। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আসলে মানুষকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার চক্রান্ত করছে বিজেপি, আর সেটাকেই আইনগত মান্যতা দিচ্ছে, তাঁদেরই পছন্দের নির্বাচন কমিশন। এই আইন করে পদ্ধতিগত ‘ভোট চুরি’র বিরুদ্ধে রাস্তায় নামার সিদ্ধান্ত নেয় বিহারের বিরোধী ইন্ডিয়া জোট, যার পোষাকী নাম ‘মহাগঠবন্ধন’। সেই রাস্তার লড়াইয়ের একটা আনুষ্ঠানিক নাম দেওয়া হয়- ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’।
লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী কিছুদিন আগে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন যে নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় বিজেপি ভোটার তালিকায় ব্যপক কারচুপি করে ভোটে জিতছে। মহারাষ্ট্র থেকে শুরু করে হরিয়ানা এবং দিল্লিতেও তাঁরা এই অসৎ উপায় অবলম্বন করেই জিতেছে। বিহারের ক্ষেত্রে তাঁরা তাই সম্পূর্ণ অন্য পদ্ধতিতে এই ভোট চুরি করবে বলে রাহুল গান্ধী তাঁর সাংবাদিক সম্মেলনে এবং পরে দিল্লিতে তাঁর বাসভবনে ইন্ডিয়া জোটের বিভিন্ন নেতৃত্বকে বলেন। সেখান থেকেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে বিহার থেকেই নির্বাচন কমিশন এবং বিজেপি’র এই যোগসাজশের মুখোশ খুলে দিতে ‘ভোট চোর গদ্দি ছোড়’ এই শ্লোগানকে সামনে রেখে বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে ভোটার অধিকার যাত্রা শুরু হবে।
সিদ্ধান্ত হয় ১৭ই আগষ্ট এই যাত্রা শুরু হবে বিহারের সাসারাম থেকে। পরিকল্পনা করা হয় স্বাধীনতা দিবসের ঠিক দু দিন পর থেকে এই যাত্রা শুরু হয়ে বিহারের ১৩০০ কিলোমিটার পথ ১৬ দিনে অতিক্রম করে পাটনার গান্ধী ময়দানে ১লা সেপ্টেম্বর শেষ হবে। যাত্রায় উপস্থিত থাকবেন লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী, বিহারের বিরোধী বিধায়ক দলের নেতা তেজস্বী যাদব, সিপিআইএমএলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য ও বিকাশশীল ইনসান পার্টির তরফে মুকেশ সাহানি এবং অন্য বাম দলের বিহারের নেতৃত্ব এই সিদ্ধান্ত হয়। সেই মতো সাংবাদিক সম্মেলন হয়, সামাজিক মাধ্যমে প্রতিটি দলের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয় যে দলের সমস্ত কর্মী সমর্থক যেন এই যাত্রায়, নিজের নিজের জেলায় যোগ দেন।
এমনিতে ২৫শে জুন থেকে বিহারে এই বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর কাজ শুরু হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে প্রতিটি ভোটারকে নতুন করে নাম তোলার ফরমান জারি হয়েছে। ১১টি এমন নথি চাওয়া হয়েছে, এই নাম তোলার জন্য, যা বেশীর ভাগ বিহারের মানুষের কাছে নেই। জন্মের শংসাপত্র বা মাধ্যমিক পাশের প্রমাণপত্রের মতো এমন কিছু নথি চাওয়া হয়েছে, যা জোগাড় করা যে কোনও গরীব, পিছিয়ে পড়া মানুষের পক্ষে মুশকিল। সময়ও দেওয়া হয়েছে মাত্র ১ মাস। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যে বলছিল, এই বিশেষ নিবিড় সংশোধনী আসলে ঘুরপথে নাগরিক পঞ্জীকরণ করার প্রক্রিয়া, তা বিহারের সাধারণ মানুষ এবার হাড়েহাড়ে বুঝতে পেরে সিদ্ধান্ত নেয় স্বত্বস্ফুর্তভাবে যে আইনগত ভোটচুরির যাঁরা বিরোধিতা করছেন, তাঁদের সঙ্গেই থাকবেন।
যেদিন এই ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’ শুরু হবে ঠিক হয়, সেদিনই নির্বাচন কমিশন একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার গুপ্তা সেদিন যেভাবে সাংবাদিক সম্মেলনে, বিরোধী দলনেতার আনা ‘ভোট চুরি’র অভিযোগকে খন্ডন করেন, দেখে এবং শুনে মনে হচ্ছিল যেন কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা সাংবাদিকদের সামনে বিরোধী নেতাকে সমালোচনা করছেন। এই সাংবাদিক সম্মেলনের শরীরী ভঙ্গিমা এতোটাই আক্রমণাত্মক ছিল যে মানুষ তাতে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং এই ভোটার অধিকার যাত্রায় সামিল হতে শুরু করে প্রথম দিন থেকেই।
এরপর বিহার জুড়ে শুধু মানুষের প্লাবন। এই ভোটার অধিকার যাত্রা যত এগোচ্ছে তত মানুষের সমর্থন দেখা যাচ্ছে। রোজ নতুন নতুন দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে। আজকের সময়টা শুধু অক্ষরের নয় বা শুধু কানে শোনার নয়। আজকের সময়টা দৃশ্য স্রাব্যের। কোনোদিন বিহারের নওগাছিয়া থেকে পুর্ণিয়া হয়ে কাটিহার যাচ্ছে ভোটার অধিকার মিছিল। সমস্ত অঞ্চল বন্যায় বিধ্বস্ত, তাও মানুষ তাদের কাগজ খুঁজছেন নির্বাচন তালিকায় নাম তোলার জন্য, সেই কথা এসে বলছেন যাত্রার নেতৃত্বকে। বিহার বিধানসভার বামপন্থী বিধায়কদলের নেতা সিপিআইএমএলের মেহবুব আলমের নেতৃত্বে মিছিল প্রথমে জেলা শাসক দপ্তরে বিক্ষোভ দেখিয়ে তারপরে ভোটার অধিকার মিছিলে যোগ দিচ্ছে মানুষেরা। মাখনা চাষীদের সঙ্গে জলে নেমে কথা বলছেন সংসদের বিরোধী দলনেতা এই দৃশ্য শেষ কবে দেখেছে এই দেশ ? এই লড়াই চলছে নিরন্তর, এ লড়াই চলবে নিরন্তর। একটাই শ্লোগান "ভোট চোর চেয়ার ছাড়"। কোথাও স্কুলের বাচ্চারা স্কুলের বারান্দা থেকে হাত নাড়ছে। অঝোড় বৃষ্টিতে লাল পতাকা নিয়ে মিছিলে হাঁটছেন মহিলারা, সবার একটাই গন্তব্য, রাহুল গান্ধী, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বা তেজস্বী যাদবদের মিছিলে যোগ দেওয়া এবং শ্লোগান তোলা ‘বদলো বিহার বদলো সরকার’। এক যুবক এসে সমস্ত বাধা পেরিয়ে জড়িয়ে ধরতে চাইছেন রাহুল গান্ধীকে। মানুষ যেন উৎসবে সামিল হয়েছেন। বিহারে সরকার বদলের উৎসবে যেন সবাই অংশ নিতে চাইছেন প্রত্যক্ষভাবে। এই দৃশ্য আশা দিচ্ছে, এই দৃশ্য সাহস দিচ্ছে যে সব শেষ হয়ে যায়নি। এখনো দেশে হিটলারী শাসন বা মোদী শাহের স্বৈরতন্ত্র যে শেষকথা বলবে না, তা এই ভোটার অধিকার যাত্রা রোজ জানান দিচ্ছে।
এই আন্দোলন যাতে বিহার থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে তাই মোদীবাবুর পোষা গণমাধ্যম এই ছবি দেখাচ্ছে না। একটা গণতন্ত্রে গণমাধ্যমের কী ভূমিকা হওয়া উচিত? এই নিয়ে যদি কোনও দশম শ্রেণী বা দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রকে রচনা লিখতে দেওয়া হয়, তাহলে সে কী লিখবে? সে অনেক কিছু লিখবে, গণমাধ্যমের কাজ মানুষের কথা সামনে নিয়ে আসা। তাঁদের সুবিধা অসুবিধার কথা রাজনৈতিক ইস্যু যাতে হয়, সেই দিকে লক্ষ্য রেখে খবর করা, ইত্যাদি প্রভৃতি। এই একই রচনা, যদি আজকের ভারতবর্ষের প্রসঙ্গে লিখতে বলা হয়, তাহলে সে কী লিখবে? সে লিখবে আমাদের দেশের প্রচলিত গণমাধ্যমের কাজ রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরী করা এবং সেটা শাসকদলের পক্ষে। এই জন্যেই তাদের ‘গোদী মিডিয়া’ বলা হয়।
সারা বিহার জুড়ে জনজোয়ার নেমেছে। বিশেষ নির্বাচনী সংশোধনীর নামে ভোটার তালিকায় থাকা জীবিত ভোটারদের মৃত ঘোষণা করে দেখানো হয়েছে যে ৬৫ লক্ষ মানুষকে বাদ। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে কানমলা খেয়ে নির্বাচন কমিশন বাধ্য হয়েছে ঐ বাদ যাওয়া মানুষের তালিকা সর্বসমক্ষে আনতে, যাতে মানুষ জানতে পারে কী কারণে তাঁর নাম বাদ গেছে। এই পুরো প্রক্রিয়াটাকে বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ‘আইনগত ভোট চুরি’। তার বিরুদ্ধে এই ১৩০০ কিলোমিটার ভোটার অধিকার যাত্রায় রোজ লক্ষ লক্ষ মানুষের অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে, কিন্তু প্রচলিত গণমাধ্যম এটাকে খবর মনে করছে না। তাঁরা সম্পূর্ণ ব্ল্যাকআউট করেছে, তাঁরা সারাদিন রোহিঙ্গা খুঁজছে, পাকিস্তানি খুঁজছে।
অন্য খবর দেখাচ্ছে, দেখাক। কিন্তু এই জনজোয়ার এবং মানুষের দুর্দশার কথা না দেখালে যে তাঁরা মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, তাঁরা বুঝতেও পারছে না। অন্য ভাষ্য তৈরি করতে গিয়ে যে দেশের সাধারণ মানুষের ভাষ্যকে তাঁরা উপেক্ষা করছে, তার জন্য কিন্তু ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। একজন মানুষ মুম্বাই থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ করে বিহারে এসে ভোটার তালিকায় নাম তোলার প্রক্রিয়াতে যে অংশ নিচ্ছেন, তাঁর এই যাতায়াতের টাকা কে দেবে? এই মানুষেরাই দেশের মধ্যে সংখ্যাগুরু। এঁদের কথা তুলে আনাই গণমাধ্যমের কাজ, কিন্তু এই কাজটা কে করবে ? গত লোকসভা নির্বাচনে যেভাবে মানুষ বিকল্প গণমাধ্যমের ওপর ভরসা করেছিল এবং বিজেপি’র ‘আবকি বার চারশো পার’ এই শ্লোগানকে যেভাবে মানুষ প্রতিহত করেছিল, ঠিক যেন অবিকল সেই দৃশ্যের আবার অভিনয় হচ্ছে। গোদী মিডিয়া না দেখালেও মানুষ খুঁজে খুঁজে বিহারের ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’র ভিডিও দেখছেন, কথা বলছেন। একটি তথ্য বলছে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ কোনও না কোনও ভাবে এই অধিকার যাত্রার সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। রাহুল গান্ধী- তেজস্বী যাদব এবং দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের ছবি আশা দেখাচ্ছে। গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে, ‘কার তাতে কী, আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি’।