এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • স্মৃতির ভেতর রাষ্ট্র রাষ্ট্রের ভেতরে আমি অয়ন মুখোপাধ্যায়

    Ayan Mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ | ৫৯ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • স্মৃতির ভেতর রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের ভেতর আমি
     
     অয়ন মুখোপাধ্যায়
     
    আমার প্রথম পরিচয়পত্র দিয়েছিল আমার পাড়া  বলাগড় মন্দির তলা যদিও সকলের জীবনে প্রথম পরিচয় পত্র দেয় যে যার পাড়া সেখানে কাউকে কিছু কিছু বলতে  লাগতো না এই যে আমি মানে আমার ছোটবেলা থেকে গলির মোড়ে দাঁড়ানো মানুষগুলো জানত আমি কার ছেলে, কোন স্কুলে পড়ি।বাজারে স্টেশনে যেখানেই যাই না কেনো কোথাও কোনো দিন আমার পরিচয়ের জন্য কোনও কাগজ লাগে নি এটাই স্বাভাবিক এবং সবার জন্য এটাই সত্য। মুখটাই ছিল প্রমাণ। ভুল করলে বকা, ভালো করলে মাথায় হাত রাখা—এই ছিল নাগরিকত্বের প্রথম পাঠ।তারপর বড় হলাম। রাষ্ট্র ধীরে ধীরে আমার  কিংবা আমাদের জীবনে ঢুকল। প্রথমে পরীক্ষার ফর্মে, পরে চাকরির কাগজে, তারপর দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি শ্বাস প্রশ্বাসে। আমাকে বলা হল—চিন্তা কোরো না, শুধু প্রমাণ জমা দাও। প্রমাণ মানেই নিরাপত্তা।
     
    কিন্তু কবে থেকে জানি না, প্রমাণ দিতে দিতে আমি নিজেই সন্দেহভাজন হয়ে উঠলাম।একদিন লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সামনে একজন বৃদ্ধ মানুষ। হাতে কাগজের ফোল্ডার। ঘামছে। বারবার ফাইল খুলে দেখে নিচ্ছে—সব ঠিকঠাক আছে তো? তাকে দেখে আমার বাবার কথা মনে পড়ে গেল। আজ বেঁচে থাকলে আমার বাবাও এমনটাই হয়তো করতেন কারন আমার বাবা ঠাকুমা দাদু পিসি সকলেই ছিলেন পাকিস্তানের লাহোরের বাসিন্দা, বাবা আজ বেঁচে থাকলে হয়তো ভাবতেন যেন একটা কাগজ হারালেই মানুষটা হারিয়ে যাবে।সেদিন বুঝলাম—রাষ্ট্র আমাদের নাগরিক বানায়নি, রাষ্ট্র আমাদের অভিযুক্ত বানিয়েছে। আমরা নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য সারাজীবন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি।
     
    আমি ইতিহাস পড়াই। ছাত্রদের বলি—রাষ্ট্র কীভাবে গড়ে ওঠে, ক্ষমতা কীভাবে কাজ করে। ক্লাসের বাইরে এসে দেখি, সেই ইতিহাসই আমার বুকের ওপর বসে আছে। নাগরিক মানে আর অধিকার নয়, নাগরিক মানে এখন শর্তসাপেক্ষ অস্তিত্ব।রাষ্ট্র আমার কাছে স্মৃতিও চায়। আমার জন্ম কোথায়, আমার বাবা কে, তার বাবা কে—সব জানতে চায়। অথচ আমার মায়ের চোখের ক্লান্তি, বাবার নিঃশব্দ ভয়, আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের ছোট ছোট লড়াই—এসব জানতে চায় না। কারণ এই বিশ্বায়নের দিনে পুঁজির জলোচ্ছ্বাসে স্মৃতিগুলো কোনও কাজে লাগে না।
     
    একদিন এক ছাত্র জিজ্ঞেস করেছিল—“স্যার, আমরা কি আগে মানুষ, না আগে নাগরিক?” আমি উত্তর দিতে পারিনি। কারণ আমি নিজেও জানি না।
     
    লক্ষ্য করে দেখবেন আমাদের জীবনের সবচেয়ে রাজনৈতিক মুহূর্তগুলো ঘটেছে নীরবতায়। টিভির সামনে বসে, খবরের কাগজ পড়ে, হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির ছত্রছায়ায় আমরা কোনদিন কোন প্রশ্ন করিনি কখনো সখনো নিজের মধ্যে চিৎকার করেছি কোন রাস্তা খুঁজে পাইনি কিন্তু ভেতরে ভেতরে নিঃশব্দে ভেঙে পড়েছি। রাষ্ট্র আমাদের এই ভেঙ্গেপড়াটা কেই পছন্দ করে—চুপচাপ ভাঙা মানুষ, যারা প্রশ্ন করে না।
     
    আমাদের বলা হয়—ভয় পাওয়ার কিছু নেই, যদি তুমি ঠিক হও। কিন্তু “ঠিক” হওয়া মানে কী? ঠিক নাগরিক? ঠিক পরিচয়? ঠিক মতাদর্শ? এই “ঠিক”-এর সংজ্ঞা কে দেয়? আমি আমার ছাত্রদের চোখে ভয় দেখেছি। তারা প্রশ্ন করতে চায়, কিন্তু থেমে যায়। কারণ প্রশ্ন করা এখন ঝুঁকিপূর্ণ। প্রশ্ন মানেই সন্দেহ। সন্দেহ মানেই নজর।
    এইখানেই রাষ্ট্র সবচেয়ে সফল। সে আমাদের শিখিয়েছে—নিজেদের ওপর নিজেকেই পাহারা দিতে।
    কখনও মনে হয়, আমার শৈশবের পাড়া যদি আজ থাকত, তাহলে রাষ্ট্র আমাকে চিনতে পারত না। কারণ সেখানে মানুষ আগে, কাগজ পরে। সেখানে পরিচয় ছিল সম্পর্কের, সংখ্যার নয়।
     
    আজ আমি যখন নিজের দিকে তাকাই, দেখি—আমার ভেতরে দুটো মানুষ। একজন কাগজে থাকা মানুষ, যে সব নিয়ম মেনে চলে। আর একজন স্মৃতির মানুষ, যে এখনও অন্যায় দেখলে অস্বস্তিতে ভোগে, রাতে ঘুমোতে পারে না।এই স্মৃতির মানুষটাই বিপজ্জনক। রাষ্ট্র তাকে পছন্দ করে না। কারণ সে প্রশ্ন করে—আমি কেন প্রমাণ দেব যে আমি মানুষ? পরিচয়পত্রে ধরা পড়ে না যে মানুষটা—সে আসলে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
    আর সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা।
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 2601:84:4600:5410:d142:53a6:1b01:***:*** | ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ ০১:৩৭737451
  • ভাল লেখা 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন