

৪.২ অবিদ্যা ও মায়া
অবিদ্যা ও মায়াঃ সৃষ্টির কারক তত্ত্ব (efficient cause)
বেদান্তের বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টির প্রধান মডেল দুটো ।
এক, রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী মডেল যার হিসেবে ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মের সৃষ্ট জগত দুটোই সত্য।
ব্রহ্ম হলেন সগুণ, সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞ পরমেশ্বর। মায়া হল তাঁর শক্তি। তিনি লীলাচ্ছলে মায়ার শক্তিতে এই বিশ্বব্রহ্মান্ড গড়েন এবং ভাঙেন। জীব হল অসংখ্য ব্যক্তি আত্মা। ব্রহ্মের ইচ্ছায় তাঁর মায়ায় তাঁর অংশ হিসেবে জন্মায় এবং তাঁর কৃপাদৃষ্টি পেলে মুক্ত হয়।কাজেই ব্রহ্ম হলেন সৃষ্টির আদি ও নিমিত্ত কারণ। এই মডেলটি ব্রহ্মসূত্র থেকে সমস্ত পুরাণ ও উপনিষদের ঘোষিত বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হয়।
দুই, শংকরের অদ্বৈতবেদান্তের মায়াবাদী মডেল। যার মানে আসলে কোন কিছুই সৃষ্টি হয় না। ব্রহ্ম তো নির্গুণ। অবিদ্যা বলে চেতনায় এক বিকৃতির ফলে সাময়িক ভাবে ব্রহ্মান্ড মানে বস্তুজগৎ ও জীব স্বতন্ত্র ভাবে আছে বলে মনে হয়। যেই ব্রহ্মজ্ঞানের প্রভাবে অবিদ্যার প্রভাব কেটে গিয়ে সবকিছু ব্রহ্মময় বলে বোধ হয় অমনই এই সৃষ্টির বিভ্রম ‘কোথায় বা কি, ভুতের ফাঁকি মিলিয়ে গেল চট করে’। এই অর্থে ব্রহ্ম নিজেই হলেন একাধারে সৃষ্টির উপাদান এবং নিমিত্ত কারণ।
এই মডেলে অনেকগুলো সমস্যা।
প্রশ্ন ওঠেঃ তাহলে এই আপেক্ষিক সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় নির্গুণ ব্রহ্মের ভূমিকাটি ঠিক কী?
উত্তরে বলা হয়-উনি নিষ্ক্রিয়।উনি কোন কিছু সৃষ্টি করেন না। অবিদ্যার আবিল দৃষ্টিতে এই মায়াময় সংসার অল্পকালের জন্যে বাস্তব বলে প্রতীত হয়।
তাহলে ব্রহ্মের জায়গায় মায়া হবে সৃষ্টির উপাদান কারণ। আর ‘অবিদ্যা’ হবে সৃষ্টির নিমিত্ত কারণ। যতক্ষণ অবিদ্যা এসে চেতনাকে মলিন না করছে ততক্ষণ এই ভ্রান্তির দুনিয়া সৃষ্ট হচ্ছে না। তাই এটি নিমিত্তকারণ। আবার অবিদ্যার সৃষ্ট জগত ব্রহ্মময় নয়, মায়াময়। তাহলে উপাদান কারণ ব্রহ্ম নয় মায়া।
কথা হচ্ছে যদি অবিদ্যা ও মায়াকে ব্রহ্মের বৈশিষ্ট্য বা গুণ বলে মেনে নেওয়া যেত, তাহলে মডেলটি দাঁড়াত। কিন্তু অবিদ্যা তো জ্ঞানের আলোকে ধ্বংস হয়, তাই এটি ব্রহ্মের অংশ অথবা বৈশিষ্ট্য নয়। আবার মায়ার শক্তি ও অবিদ্যাকে ব্রহ্মের শক্তি ধরে নিলে ব্রহ্ম আর নির্গুণ থাকেন না। সোজা রামানুজের সগুণ ব্রহ্ম হয়ে যান।
যেমন রজ্জু ও সর্পের ভ্রান্তিতে রজ্জু ব্রহ্মের মত নিষ্ক্রিয়।আলো-আঁধারি বা চোখের দোষে খানিকক্ষণ সাপ মনে হল, কাছে যেতেই মিলিয়ে গেল, খালি দড়ি পড়ে আছে। এখানে দড়িটি সাপ মনে হওয়ার উপাদান কারণ নয়, সাপে দড়ি নেই। আবার ক্ষণিকের বিভ্রমে তৈরি সাপের নিমিত্তকারণ আলো-আঁধারি বা চোখের দোষ, দড়িটা নয়।
আরও প্রশ্ন আছে। অবিদ্যা নাকি অনাদি? কীভাবে? প্রত্যেক বার জ্ঞানের আলোকে ধ্বংস হওয়া অবিদ্যা আবার নতুন করে জন্মায়? নইলে এত লোকের চোখে এত কাল ধরে মায়ার নকল দুনিয়া অস্তিত্ববান বাহ্যজগত রূপে ধরা দেয় কী করে? তাহলে অবিদ্যার অধিষ্ঠান জীবের চেতনায়?
মানে জীবাত্মা ব্রহ্মের থেকে স্বতন্ত্র অস্তিত্ববান?
না, শাস্ত্রানুযায়ী জীব ও ব্রহ্ম এক এবং অভিন্ন। তাহলে জীবের চেতনা অবিদ্যার প্রভাবে আবিল হয় কী করে? কোন মালিন্য চিন্ময় ব্রহ্মকে আশ্রয় করে না।
সাসপিশাস! হাইলি সাসপিশাস!
শংকর বলছেন—অবিদ্যা সৎ-অসৎ কোনটাই নয়, এ হল অনির্বচনীয়। মানে অবিদ্যার অস্তিত্ব আছে কি নেই—সেটা বলা মুশকিল। এ হল এমন যা শব্দ দিয়ে বোঝানো মুশকিল।
রামানুজ বলছেন—এসব ফালতু কথা। এই অবিদ্যাটি থাকেন কোথায়? একি জীবের ব্যক্তিচেতনায়, নাকি ব্রহ্মের অনন্তচেতনায়?
প্রথমটি সম্ভব নয়, কারণ(তোমার মতে) অবিদ্যায় ব্রহ্ম আবৃত হলে তবেই জীবের অস্তিত্ব শুরু হয়। মানে অবিদ্যা আগে জীব পরে, তাহলে? আবার অবিদ্যার আধার ব্রহ্ম হতে পারেন না, কারণ, ব্রহ্ম হলেন অবিদ্যার বিপরীত, নিজেই বিশুদ্ধ চেতনা বা বিজ্ঞানস্বরূপ; ব্রহ্মচেতনায় অবিদ্যা ধ্বংস হয় (রোদ উঠলে কুয়াশা কেটে যাওয়ার মত)। ফলে অবিদ্যা ও ব্রহ্ম একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে থাকতে পারেনা।
এখানে সাপ ও দড়ির উদাহরণ খাটবে না। কারণ ব্রহ্ম স্বপ্রকাশ, তাঁর অস্তিত্ব অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল নয়। কিন্তু দড়ি অমন নয়, তাকে সাপ না ভেবে ঠিকমত দেখতে পাওয়া অনেকগুলো উপাদানের উপর নির্ভর করে; যেমন দড়িটা কোথায় কীভাবে পড়ে আছে, আলো না অন্ধকার, এবং যে দেখছে তার চোখের দৃষ্টি কেমন।
অতএব রামানুজেরা অবিদ্যার ধারণাটিকে—যা সৎ বা অসৎ কোনটাই নয়, যাকে ভাষায় বর্ণনা করা যায় না- সোজাসুজি খারিজ করছেন। আমার মতে যাকে ভাষার সংজ্ঞায় বাঁধা যায় না এমন নামপদ দার্শনিক আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে না।
আর একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক।
মজার ব্যাপার এই শব্দটি বা দার্শনিক অর্থে এই নামপদটি উপনিষদে অথবা ঋষি বাদরায়ণ রচিত ব্রহ্মসূত্রের বা উপনিষদের কোন শ্লোকে নেই। রামানুজ দেখিয়েছেন যে ‘অবিদ্যা’ যার অস্তিত্ব আছে আবার নেই, মানে যা বাস্তবও নয়, অবাস্তবও নয়—এমন কোন সংজ্ঞা বেদে বা উপনিষদে কোথাও নেই। এটি শংকরাচার্য্যের সৃষ্টি যাতে তাঁর মায়াবাদের মডেলটি দাঁড়ায়।
অনেকবার ‘মায়া’র সঙ্গে ‘অবিদ্যা’কে গুলিয়ে ফেলা হয়। মায়া অসত্য বা মিথ্যা নয়। মায়া হল বিস্ময়কর কিছু সৃষ্টি করার শক্তি। সৃষ্টিশীল প্রকৃতিকেই মায়া বলে সম্বোধন করা হয়।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ বলছেন, ‘মায়াধারী ঈশ্বর মায়ার শক্তিতে এই বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করেছেন এবং সমস্ত জীব মায়ার বাঁধনে বদ্ধ’। এখানে মায়া হল ঈশ্বরের শক্তি,তাই ঈশ্বর হলেন ‘মায়িন’। স্পষ্টতঃ ‘মায়া’ ঈশ্বরের কোন ‘অভাব’ বা ‘বিকৃতি’ বা ‘অবিদ্যা’ নয় বরং জীব মায়ার অধীন। বৃহদারণ্যক বলছে “ঈশ্বর মায়ার শক্তিবলে এক থেকে বহু হলেন’। এখানে মায়া বলতে ঈশ্বরের বহুমাত্রিক শক্তির কথা বলা হয়েছে। আবার গীতায় -
“ দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া।
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মম মায়া তরন্তি তে”।।(৭/১৪)
অর্থাৎ শ্রীভগবান বলছেন-আমার মায়ার শক্তিকে অতিক্রম করা কঠিন। এখানে ‘গুণময়ী মায়া’ বলতে ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতিকেই বোঝানো হয়েছে।
(চলবে)