

ভগবদগীতায় যুদ্ধের নৈতিকতাঃ অন্য চোখে
প্রস্তাবনাঃ
ভারতবর্ষের বৃহত্তর জনসমুদায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এঁদের মূল ধর্মগ্রন্থ বেদ, যদিও হাতে গোণা লোক ছাড়া কেউ বেদ পড়েন না, ভাষাগত কারণে সম্ভবও নয়। তবে আজকাল বাংলা হিন্দি ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় সুলভ অনুবাদ পাওয়া যায়। যাঁরা বেদকে সনাতন অজর অমর এবং ভগবানের মুখনিঃসৃত বলে বিশ্বাস করেন তাঁদের ধর্মাচরণকে এককথায় সনাতন হিন্দুধর্ম আখ্যা দেওয়া হয়। এই সংজ্ঞাটি সম্ভবতঃ আদি শংকরাচার্যের তৈরি।
সনাতন হিন্দু ধর্মের তাত্ত্বিক আশ্রয় হোল তিন প্রস্থান—উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র এবং গীতা, যাকে একসঙ্গে ‘ত্রয়ী’ বলা হয়। শংকরাচার্য প্রতিষ্ঠিত দশনামী সম্প্রদায়ের সমস্ত সন্ন্যাসীদের অবশ্য পাঠ্য হোল ওই ‘ত্রয়ী’।
এই ত্রয়ীর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সহজলভ্য গ্রন্থ হোল ভগবদগীতা বা সংক্ষেপে ‘গীতা’। এর আকারও ছোট, অষ্টাদশ অধ্যায়ে বিভক্ত বইটিতে রয়েছে মোট ৬৮১, এবং গীতামাহাত্ম্য ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় ৭০০ শ্লোক। অন্ততঃ পকেট সংস্করণ গীতা প্রায় সবার বাড়িতে পাওয়া যাবে। শ্রাদ্ধশান্তি বা বিভিন্ন ধার্মিক অনুষ্ঠানে গীতা পাঠের প্রচলন রয়েছে।
বর্তমান সময়ে একটি কথা প্রায়ই শোনা যায়-- গীতা বা তার নির্বাচিত অংশ, সমস্ত স্কুলে পাঠ্য করা হোক। উদ্দেশ্য অল্পবয়েসীদের মধ্যে ভারতীয় ঐতিহ্য ও নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়া। বলা হয় গীতার বাণী আমাদের সমাজে আদর্শ আচরণবিধির জন্যে মডেল হবে।
প্রশ্ন ওঠেঃ গীতার মূল্যবোধ বলতে ঠিক কী বোঝায়?
এখানে ওখানে খামচে প্রসঙ্গের উল্লেখ না করে কয়েকটি শ্লোকের কথা বলা হয়। যেমন, তোমার অধিকার কেবল কর্ম করায়, ফলপ্রাপ্তিতে নয়। তাই ফলের চিন্তা না করে কর্ম করে যাও।(গীতা, ২/৪৭)। অথবা, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের সমাজে গুণ ও কাজের ভিত্তিতে চার বর্ণের সৃষ্টি করেছেন। (গীতা, ৪/১৩)।
অথবা, স্বধর্মে নিধন শ্রেয়ঃ, অন্য ধর্ম ভয়াবহ।(গীতা, ৩/৩৫)। আর রয়েছে—সব ধর্ম ছেড়ে আমার শরণাগত হও, কোন পাপের ভয় কোর না; আমি আছি। (গীতা, ১৮/৬৬)।
কিন্তু গীতার মূল পরিপ্রেক্ষিত, স্থান-কাল- প্রসংগের কথা ভুলে বিচ্ছিন্নভাবে এই শ্লোকগুলোর চর্চা আমাদের বোধকে ঘুলিয়ে দেয়।
আজকাল কোথাও সমগ্র গীতার অন্তর্নিহিত ভাবনা নিয়ে একটি সুসংবদ্ধ লেখা চোখে পড়ে না।
এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমি চেষ্টা করছি গীতার মূল থিমে—আত্মীয় পরিজনের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণে পরাঙ্মুখ অর্জুনকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করতে নীতিকথায়—ন্যায় ও অন্যায় যুদ্ধের ফারাকটুকু বোঝার চেষ্টা করা। কারণ, প্রায় প্রতিদিন ভারতের কোথাও না কোথাও স্বঘোষিত ধর্মযোদ্ধাদের হিংসা ও বিদ্বেষে ভরা ঘোষণা চোখে পড়ছে।
ভগবদগীতা কার রচনা?
মনে হয় গীতা মহাভারতের কাহিনীর উল্লেখ সত্ত্বেও একটি স্বতন্ত্র রচনা। মুখোমুখি কৌরবের একাদশ অক্ষৌহিণী সেনা এবং পাণ্ডবদের সাত অক্ষৌহিণী। রথে বসে ধনুকের টংকার ও দু’পক্ষের শংখধ্বনির মধ্যে যে স্নায়বিক চাপ তার মাঝখানে বসে গম্ভীর মেটাফিজিক্স চর্চা? এগুলো বিভিন্ন সময়ে অনেক কবির সম্মিলিত সংযোজন।
অশোকের শাসনকালে কিছু ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠীলিপির নিদর্শন পাওয়া যায়, তাতে গীতার কোন উল্লেখ নেই। তবে প্রথম সংস্কৃত ভাষা এবং নাগরী লিপির নিদর্শন দেখা যায় জুনাগড়ের তাম্রলিপিতে, যা খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগে যা চারশতক পরের পতঞ্জলির যোগশাস্ত্রের কথা মনে করায়। মনে হয় শুঙ্গ রাজবংশের (পুষ্যমিত্র শুঙ্গ স্থাপিত) থেকে গুপ্ত বংশের শাসনকালের মধ্যে বিভিন্ন কবির হাতের ছোঁয়ায় বর্তমান রূপ ধরেছে ভগবদগীতা।
গীতার দার্শনিক ভাষ্যের কিছু বৈশিষ্ট্যঃ
গীতা হোল আসলে ষড়দর্শনের শেষতম দার্শনিক মত বেদান্ত বা উত্তরমীমাংসার অনুযায়ীদের সৃষ্টি। কারণ ১৮টি অধ্যায়ের প্রত্যেকটি শেষ হচ্ছে “শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসু উপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে” এই ভণিতা দিয়ে। ব্রহ্মবিদ্যা বলে দার্শনিক ধারণাটি একান্তভাবে বেদান্তদর্শনের, অন্য কারও নয়।
ষড়দর্শনের মধ্যে গীতায় শুধু সাংখ্য, যোগ ও বেদান্তের কথা রয়েছে। বাদ পড়েছে, ন্যায়, বৈশেষিক ও পূর্বমীমাংসা। বরং বেদবাদরতাঃ শ্লোকে (২/৪২,৪৪) পূর্বমীমাংসা দর্শনের নিন্দা করা হয়েছে।
কারণ, পূর্বমীমাংসা কেবল বেদের যাগযজ্ঞকেই শুরু ও শেষ মনে করে। নিরীশ্বরবাদী পূর্বমীমাংসা দর্শনে ব্রহ্ম বা ঈশ্বর কিছুই নেই। সাংখ্যে ঈশ্বর নেই, রয়েছে নিষ্ক্রিয় চেতন পুরুষ এবং সক্রিয় প্রকৃতির কথা। গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম সাংখ্য যোগ বটে, কিন্তু তাতে নিরীশ্বরবাদী সাংখ্যের মূল চরিত্র বদলে দিয়ে ঈশ্বর ও পরমাত্মা নিয়ে অনেক কথা ঢোকানো হয়েছে।
ফলে যিনি গীতাকে ভারতীয় দর্শন বা অধ্যাত্ম চিন্তার সার বা সমন্বয় বলবেন, ভারতীয় বা বিদেশি পন্ডিত, তার মধ্যে গোঁজামিল থেকেই যাবে।
গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে বলা হয়েছে – প্রাণের উদ্ভব অন্ন থেকে, অন্নের উদ্ভব বৃষ্টি থেকে, বৃষ্টির উদ্ভব যজ্ঞের ধোঁয়া থেকে, যজ্ঞের উদ্ভব কর্ম থেকে, কর্মের উদ্ভব ব্রহ্ম থেকে এবং ব্রহ্মের উদ্ভব অক্ষর থেকে ( ৩/১৪ এবং ৩/১৫)।
আজ আমরা সবাই জানি বৃষ্টির উদ্ভব কীভাবে হয়, অবশ্যই যজ্ঞের ধোঁয়া থেকে নয়। আর ব্রহ্ম যদি অক্ষর থেকে উদ্ভবের পরিণাম তাহলে তিনি নিত্য সর্বোগতং স্থানু অচলোহং সনাতনঃ হতে পারেন না। কারণ উনি নিশ্চিত ভাবে একটি নির্ধারিত সময়ে একটি তত্ত্ব (অক্ষর) থেকে উদ্ভূত হচ্ছেন, তাহলে অমনই এক সময়ে তাঁর বিনাশ অবশ্যম্ভাবী।
মহাত্মা গান্ধীর গুজরাতিতে লেখা ‘অনাসক্তি যোগ’ ভাষ্যটি সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত বাংলায় ‘গান্ধীভাষ্য’ নামে অনুবাদ করেছেন। গান্ধীজি আবার তাঁর অহিংসার সঙ্গে গীতার হিংসাকে জোর করে মেলাতে চেষ্টা করেছেন। বলছেন—গীতার হিংসা প্রতীকী, আসল শারীরিক হিংসা নয়। কিন্তু মূল পাঠে প্রথম, দ্বিতীয় এবং একাদশ অধ্যায় পড়লে বোঝা যায় –ওটা গান্ধীজির বৃথা চেষ্টা। তেলে জলে মেশেনি।
বরং সমগ্র গীতা জুড়ে রয়েছে ক্ষাত্রধর্ম এবং হিংসার ঔচিত্য, তার জয়গান। খেয়াল করা দরকার যে শ্রীকৃষ্ণ নিজেও ক্ষত্রিয় রাজপুরুষ।
গীতায় মনুসংহিতার জাতিবাদের প্রচন্ড প্রভাব। আধুনিক ব্যখ্যাকারেরা জোর করে মেলাতে গিয়ে শুধু ওই একটা শ্লোকের কথা বলেন- চাতুর্বণং ময়া সৃষ্ট গুণকর্মবিভাগশঃ। ওঁরা উল্লেখ করেন না “স্বনুষ্ঠিতাৎ পরধর্মাৎ বিগুণঃ স্বধর্ম শ্রেয়ান। স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ, পরোধর্মো ভয়াবহঃ”, (৩/৩৫)।
অর্থাৎ অন্যধর্মের (জাতির) নির্দিষ্ট কর্ম ভালভাবে করার চেয়ে নিজের নিজের জাতিধর্মের অনুরূপ কর্ম খারাপভাবে করাই শ্রেয়স্কর । নিজ জাতের অনুযায়ী কর্ম করতে গিয়ে মরে যাওয়া ভাল। নীচু জাত নীচুতেই থাকবে, দক্ষতার জোরে উপরে উঠতে পারবে না, (১৮/৪১-৪৪)।
উপরের সমস্ত টীকা/ব্যাখ্যা ভক্তের দৃষ্টিতে, যেখানে গীতা হচ্ছে শ্রীভগবানের মুখনিঃসৃত বাণী। তা নিয়ে বিচার চলে না। শুধু মুগ্ধ হতে হয়, শুধু মেনে চলতে হয়।
বাংলাসাহিত্যের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘পারাপার’ উপন্যাসে একটি চরিত্র বিমানের সন্দর্ভে বলেছেন যে গীতা হোল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কাব্য! গীতার বেশিরভাগটাই অনুষ্টুপ এবং অল্প একটু অংশ ত্রিষ্টুপ ছন্দে লেখা। কিন্তু কাব্যগুণ? ভিন্নরুচির্হিঃ লোকাঃ।
(চলবে)