

৩.১ মনুসংহিতায় জাতিভেদঃ
মনুসংহিতা কখনই শূদ্রদের মানুষের মর্যাদা দেয়নি। চারবর্ণের উৎপত্তি দেখুন।
“লোকবৃদ্ধির জন্য (স্রষ্টা) মুখ , বাহু, উরু ও পদ থেকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র সৃষ্টি করলেন।“ (১/৩১)
মনু বলছেনঃ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য—এই তিন বর্ণ হল দ্বিজ, কারণ এদের পৈতে হয়ে দ্বিতীয় জন্ম হয়।চতুর্থ বর্ণ শূদ্রের একই জন্ম (দ্বিজত্ব নেই); কোন পঞ্চম বর্ণ নেই(১০/৪)।
ব্রাহ্মণের কাজ অধ্যাপনা, অধ্যয়ন , যজন,যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ।
ক্ষত্রিয়ের লোকরক্ষা,দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন ইত্যাদি।
বৈশ্যের কাজ পশুপালন, কৃষি, সূদে টাকা খাটানো, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন।
শূদ্রের একটি মাত্র কাজ—বাকি তিনবর্ণের সেবা। (১/৮৮ থেকে ৯১)।
আবার মুখ বা উত্তমাঙ্গ থেকে উদ্ভূত এবং বেদজ্ঞাতা বলে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ।(১/৯৩)
সৃষ্টির মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ বলে ১/৯৪ থেকে ১/১০৩ পর্য্যন্ত বর্ণনা করা হয়েছে।
এবার জন্মের পর সন্তানের নামকরণ দেখুন।
ব্রাহ্মণের নাম হবে শুভসূচক, ক্ষত্রিয়ের বলবাচক, বৈশ্যের ধনবাচক, এবং শূদ্রের নাম নিন্দাবাচক হবে। এই চারবর্ণের উপনাম হবে যথাক্রমে শর্ম, বর্ম, ভূতি ও দাস। (যেমন শুভশর্মা, বলবর্মা, বসুভূতি এবং দীনদাস প্রভৃতি)। (২/৩১ এবং ৩২)।
আজীবিকা এবং দৈনন্দিন জীবনে শূদ্রঃ দাসত্ব
শূদ্র ব্রাহ্মণের দাসত্বের জন্যেই ব্রহ্মা কর্তৃক সৃষ্ট হয়েছে। প্রভু কর্তৃক অন্য দাসেরা মুক্ত হলেও শূদ্র দাসত্ব থেকে মুক্ত হয় না। দাসত্ব তার স্বভাবজাত(৮/৪১৩, ৪১৪)।
উচ্চ তিন বর্ণের উপনয়ন হয়ে দ্বিজ বা দ্বিতীয় জন্ম হয় ।শূদ্রের উপনয়নে অধিকার নেই, সে বেদপাঠের অধিকারী নয় । দ্বিজের মত উপবীত বা অন্যান্য চিহ্ন ধারণ করলে শূদ্রের মৃত্যুদন্ড বিধেয়(৯/২২৪)।
ব্রাহ্মণের তপস্যা জ্ঞান ,ক্ষত্রিয়ের তপস্যা রক্ষা করা, বৈশ্যের তপস্যা কৃষি-গোপালন, শূদ্রের দ্বিজগণের সেবা(১১/২৩৫)।
কোন প্রকার সংস্কারে শূদ্রকে অধিকার দেওয়া হয়নি(১০/১২৬)।বর্ণত্রয়ের সেবাই শূদ্রের একমাত্র বৃত্তি। প্রভুপরিত্যক্ত জীর্ণবস্ত্র, ছত্র, পাদুকা, তোষক প্রভৃতি শূদ্র ব্যবহার করবে।প্রভুর উচ্ছিষ্ট তার ভক্ষ্য। (১০/১২৩,১২৫)
যজ্ঞে প্রদত্ত দ্রব্য ব্রাহ্মণ কখনও শূদ্রকে দেবেন না (৪/৮০)।
শূদ্রের নিষিদ্ধদ্রব্য ভক্ষণে পাপ নেই, সে উপনয়নাদি সংস্কারের যোগ্য নয়, ধর্মে তার অধিকার নেই ।(১০/১২৬)।
দাসবৃত্তি থেকে শূদ্রের কোন প্রকার মুক্তি নেই।“ন স্বামিনা নিসৃষ্টোঅপি শূদ্রোদাসাদ বিমুচ্যতে”( মেধাতিথির ভাষ্য )।
মনু বলছেন যে শূদ্র সক্ষম হলেও ধনসঞ্চয় করবে না । কারণ শূদ্র ধনলাভ করলে গর্ববশে ব্রাহ্মণকে পীড়া দিতে পারে (১০/১২৯)। ব্রাহ্মণ কখনও শূদ্ররাজার রাজ্যে বাস করবেন না (৪/৬১)।
যে পথ দিয়ে উচ্চবর্ণের লোকেরা যাতায়াত করেন, সেই পথে শূদ্রের মৃতদেহ বহন করা চলবে না (৫/৯২)।
বিবাহ সম্বন্ধে মনুর বক্তব্য নিজের নিজের জাতে বিয়ে করাই ভাল, নইলে সন্তান বর্ণসংকর (বাস্টার্ড) হয় । তবে অনুলোম বিবাহ, অর্থাৎ পিতা উচ্চবর্ণের মাতা নিম্নবর্ণের, সিদ্ধ । তাতে সন্তানের জাত মায়ের থেকে উচ্চ কিন্তু পিতার থেকে নিম্ন হবে। সে পিতার ভাল গুণ পাবে।কিন্তু প্রতিলোম বিবাহ – মাতা উচ্চবর্ণের, পিতা নিম্নবর্ণের—অসিদ্ধ। এদের সন্তানের স্থান পিতার থেকে নিচে, এরা পিতার নীচ গুণ পাবে। যেমন শূদ্র ব্রাহ্মণীকে বিয়ে করলে সন্তান ‘নরাধম চন্ডাল’ হবে (১০/১৬)।
এদেরই মনু আসল বর্ণসংকর মনে করতেন এবং বলতেন এটা বাড়লে রাজ্য ও সমাজ রসাতলে যাবে। ব্রাহ্মণ থেকে শূদ্রাতে জাত সন্তান ‘আর্য’ হয় , কিন্তু শূদ্র থেকে ব্রাহ্মণীতে উৎপন্ন সন্তান ‘নিকৃষ্ট’ হয় (১০/৬৭)।
সুলেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারীর আত্মজীবনীমূলক “ইতিবৃত্তে চন্ডাল জীবন” বইটি পাঠককুলে সমাদৃত। কিন্তু চন্ডালদের প্রতি অমানবিক ব্যবহার মনুর বিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, দেখুন মনু কী বলছেনঃ চন্ডালদের আশ্রয় গ্রামের বাইরে।এদের ধন বলতে কুকুর ও গাধা। এদের জলপাত্র দিতে নেই।এদের খাবার দিতে হবে চাকরের হাত দিয়ে ভাঙা বাসনে। এরা পরবে শ্মধানের মড়ার কাপড়, লোহার গয়না, বইবে অনাথ শব, কিন্তু রাত্তিরে গ্রামনগরে ঘুরে বেড়ানো মানা। রাজাদেশে দন্ডিত ব্যক্তিদের বধ করা এদের কাজ—মানে আজকালকার জেলের ফাঁসুড়ে।(১০/৫১ –৫৬)।
পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার সম্বন্ধে মনু বলছেন দ্বিজ তিনবর্ণের পুরুষ চারজাতের নারীকেই বিয়ে করতে পারেন। উত্তরাধিকারে সমস্ত সম্পত্তির দশভাগ করে ব্রাহ্মণীর পুত্র চারভাগ, ক্ষত্রিয়ার পুত্র তিন, বৈশ্যার পুত্র দুই এবং শূদ্রার পুত্র একভাগ পাবে। যদি শূদ্রা ছাড়া অন্য স্ত্রীদের একটিও সন্তান না থাকে তবু সেই সন্তান দশভাগের একভাগই পাবে, বেশি নয়। (৯/১৫৩, ১৫৪)। উচ্চ তিন দ্বিজ জাতির পিতার শূদ্রা স্ত্রীর পুত্রের সম্পত্তির অধিকার নেই , পিতা যা দেবে তাই (৯/১৫৫)।
এবার জাতিভেদে অপরাধের শাস্তিঃ
ইচ্ছুক বা অনিচ্ছুক ব্রাহ্মণ নারীর সঙ্গে অবৈধ যৌন সংসর্গের অপরাধে মনু শূদ্রের মৃত্যুদন্ডের বিধান দিয়েছেন। কিন্তু ব্রাহ্মণের ‘অরক্ষিত’ ভার্যার সঙ্গে সহবাসে ‘লিঙ্গচ্ছেদ’ বিধান(৮/৩৭৪)।
কিন্তু শূদ্রানারীর সঙ্গে অনুরূপ সংযোগের অপরাধে ব্রাহ্মণকে কিছু জরিমানা দিলেই চলবে(৮/৩৮৫)।
যে অপরাধে অন্য বর্ণের প্রাণদন্ড বিধেয়, সেখানে ব্রাহ্মণের মাথা মুড়িয়ে দিলেই হবে(৮/৩৭৯)।
ব্রাহ্মণের নিন্দা করলে শূদ্রের জিহ্বা ছেদন বিধেয়(৮/২৭০); কিন্তু শূদ্রের প্রতি ব্রাহ্মণ অনুরূপ ব্যবহার করলে সামান্য জরিমানা(৮/২৬৮)।
ব্রাহ্মণকে চোর বলে গাল দিলে ক্ষত্রিয়ের সামান্য অর্থদন্ড, বৈশ্যের দেড়শ’ বা দু’শ পণ অর্থদন্ড, কিন্তু শূদ্রকে বধ করা হবে (৮/২৬৭)।
শূদ্র যদি ব্রাহ্মণের গায়ে হাত তোলে তাহলে তার হাত কেটে ফেলা হবে, পদাঘাত করলে পা (৮/২৮০)। ব্রাহ্মণের সঙ্গে সমান আসনে বসলে তার কোমরে গরম লোহার ছ্যাঁকা দিয়ে নির্বাসিত করা হবে, অথবা তার নিতম্ব এমন ভাবে ছেদন করা হবে যেন তার মৃত্যু না হয় (৮/২৮১)। ব্রাহ্মণের গায়ে থুতু দিলে শূদ্রের ওষ্ঠছেদন হবে। মূত্রপুরীষ নিক্ষেপ করলে তার লিঙ্গ ও বাতকর্ম করলে তার গুহ্যদ্বার ছেদন করা হবে(৮/২৬২)।
শূদ্র তিন দ্বিজজাতিকে জাত তুলে গাল দিলে শাস্তি হবে তার মুখে জ্বলন্ত দশাঙ্গুল প্রমাণ লৌহশঙ্কু ঢুকিয়ে দেওয়া (৮/২৭১)।
আর শূদ্র যদি ব্রাহ্মণকে জ্ঞান বা ধর্মোপদেশ দেয় তাহলে রাজার নির্দেশে তার মুখে ও কানে গরম তেল ঢালা হবে(৮/২৭২)।
ব্রাহ্মণ কর্তৃক শূদ্রহত্যা ‘উপপাতক’ মাত্র(১১/৬৬) , অর্থাৎ সামান্য পাপ যা গোধা, পেচক, নকুল, ভেক, বিড়াল, কুকুর বা কাকবধের তুল্য(১১/১৩১)। কিন্তু শূদ্র ব্রহ্মহত্যা করলে মৃত্যু বিধেয়।
ব্রাহ্মণের ‘রক্ষিতা স্ত্রী’ গমনে অন্য বর্ণের শুধু অর্থদন্ড হবে, কিন্তু শূদ্রের সর্বস্বহরণ করে মৃত্যুদন্ড বিধেয়। যদি ব্রাহ্মণ ভার্যা ‘অরক্ষিতা’ হন, তাহলে সেই নারী গমনকারী শূদ্রের খালি লিঙ্গচ্ছেদ হবে।(৮/৩৭৪)
বিচারালয়ে শপথ নেবার সময় শূদ্রকে বলতে হবে যে মিথ্যা বললে সে সকল পাপের ভাগী হবে। এটা অন্য তিন বর্ণের প্রতি প্রযোজ্য নয় (৮/১১৩)। শূদ্রকে আদালতে স্ত্রী এবং সন্তানের মাথায় হাত রেখে দিব্যি গালতে হবে । এছাড়াও আছে জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর হাঁটানো বা জলে ডুবিয়ে রাখা। এ দুটো থেকে অদগ্ধ এবং না ডুবে ভেসে উঠলে বুঝতে হবে যে শূদ্র সত্য কথা বলছে(৮/১১৪ এবং ১১৫)।
ব্রাহ্মণের বিশিষ্ট স্থানঃ
(মহাপরাধে) স্বায়ংভুব মনু শারীরিক দন্ডবিধানের দশটি স্থান নির্দেশ করেছেন। কিন্তু সেটা ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য তিন বর্ণের জন্যে প্রযোজ্য। ব্রাহ্মণ অক্ষত দেহে দেশ থেকে বহির্গত হবেন। তাঁকে অর্থদন্ড দিতে হবে না । অন্য তিনবর্ণকে দোষের হিসেবে নির্বাসিত হওয়ার আগে আর্থিক এবং শারীরিক দন্ড ভোগ করতে হবে(৮/১২৩, ১২৪)।
ব্রাহ্মণের মৃত্যুদন্ড হলে শুধু মাথা মুড়িয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে। অন্য তিনবর্ণের ক্ষেত্রে শাস্তিটি প্রাণঘাতী হবে। সকল অপরাধে অপরাধী হলেও রাজা ব্রাহ্মণকে কখনও হত্যা করবেন না । তাঁকে সমগ্র ধন সহ অক্ষত দেহে শুধু রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত করবেন। পৃথিবীতে ব্রাহ্মণবধ অপেক্ষা গুরুতর অধর্ম নেই । সুতরাং, রাজা তার বধ চিন্তাই করবেন না(৮/৩৭৯, ৩৮০, ৩৮১)।
ব্রাহ্মণ শূদ্রহত্যা করলে প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ অন্য কোন ব্রাহ্মণকে একটি বৃষ ও দশটি শুক্লবর্ণ গাভী দান করবেন। বেড়াল, নেউল, চাতকপাখী, ব্যাঙ, কুকুর, গোসাপ, প্যাঁচা বা কাক মেরে শূদ্র হত্যার প্রায়শ্চিত্ত করবেন(১১/১৩০, ১৩১)।
জাতিকর্ম কি গুণদোষের ভিত্তিতে শ্রম বিভাজন, না জন্মজাত বৃত্তি?
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেনঃ চাতুর্বর্ণং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ। গুণ ও কর্মের হিসেবে আমি চার বর্ণ সৃষ্টি করেছি।
মনু বলছেনঃ নিজধর্ম গুণবর্জিত হলেও ভাল, পরের ধর্ম সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হলেও ভাল নয় , অপরের ধর্মানুসারে জীবনধারণ করলে (মানুষ) তৎক্ষণাৎ জাতিভ্রষ্ট হয় (১০/৯৭)। খেয়াল করুন , ভগবদগীতাতেও ঠিক এটাই বলা হয়েছে। “শ্রেয়ান স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎস্বনুষ্ঠিতাৎ। স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরধর্মো ভয়াবহঃ।। অর্থাৎ কোন ব্যক্তির জন্মসূত্রে প্রাপ্ত জাতিধর্ম যদি নিকৃষ্টও হয়, তবু অন্য জাতির উন্নত ধর্ম পালনের চেয়ে নিজের জাতিধর্ম পালনে মৃত্যুবরণ শ্রেয়স্কর।
এখানে ধর্ম মানে অবশ্যই ধর্মশাস্ত্র(মনু, পরাশর, গৌতম আদি স্মৃতিশাস্ত্র) অনুযায়ী নির্দিষ্ট জাতিধর্ম। তখন ভারতবর্ষে অন্য কোন ধর্ম ছিলনা।
যে অধম জাতির লোক উৎকৃষ্টজাতির কর্মদ্বারা জীবনধারণ করে, রাজা তাকে নির্ধন করে শীঘ্র নির্বাসিত করবেন(১০/৯৬)।
ব্রাহ্মণের সেবাই শূদ্রের বিশিষ্ট কর্ম বলে কথিত হয় । এ ছাড়া সে যা করে তা নিষ্ফল হয় (১০/১২৩)।
এই প্রবন্ধটি লেখার সময় আমার জনৈক বন্ধু রবীন্দ্রনাথের “ব্রাহ্মণ” কবিতাটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন—ব্যতিক্রমও ছিল।
উক্ত কবিতাটির বহুপরিচিত কাহিনী অনুযায়ী মাতা ‘ভর্তৃহীনা জবালার’ গোত্রহীন পিতৃপরিচয়হীন পুত্র সত্যকাম যখন ঋষি গৌতমের কাছে অকপটে মায়ের ‘বহু-পরিচর্যার ফল’ হিসেবে নিজের জন্ম-বৃত্তান্ত বর্ণনা করেন তখন মহর্ষি গৌতম তাকে সত্যবাদিতার জন্যে ‘ব্রাহ্মণ” বলে স্বীকার করে নেন। কারণ এমন সত্যভাষণ কেবল ব্রাহ্মণের পক্ষেই সম্ভব! এই “জাবাল সত্যকাম” পরে উপনিষদের ঋষির সম্মান লাভ করেন।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই “প্রাচীনত্ব বা ঐতিহ্যমুগ্ধতা”র মধ্যে নিহিত রয়েছে একটি “আয়রনি”।
একই কাহিনীর সম্পর্কে ব্রহ্মসূত্র কী বলছে দেখুনঃ
ব্রহ্মসূত্রের প্রথম খন্ডের(সঠিক ব্যাখ্যার দ্বারা সমনয়) ত্রৃতীয় ভাগের নবম পরিচ্ছেদের বিষয় হল শূদ্রের বেদপাঠে বা অন্য সংস্কারকর্মে অধিকার আছে কি নেই? তাতে
তৈত্তিরীয় উপনিষদের শ্লোক(৭.১.১.৬) উদ্ধৃত করে বৈদান্তিক বলছেন “শূদ্র যজ্ঞের অধিকারী নয়”। সূত্র ৩৫ শে জানশ্রুতি ও রৈক্কের গল্প উল্লেখ করে বলা হচ্ছে জন্মসূত্রে যে শূদ্র সে সংস্কারের অধিকারী নয়।
এবার ৩৭ নম্বর সূত্রের ব্যাখ্যায় ছান্দোগ্য উপনিষদের শ্লোক (৪/৪/৫) উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছে গৌতম জবালাপুত্র সত্যকামের ব্রাহ্মণজন্ম সম্বন্ধে নিসন্দিগ্ধ হয়ে তাকে শিষ্য বলে স্বীকার করে নিলেন।“কারণ কোন অব্রাহ্মণ এমন কঠিন সত্য উচ্চারণ করতে পারে না”। রবীন্দ্রনাথ তাই লিখলেন—“অব্রাহ্মণ নহ তুমি তাত , তুমি দ্বিজোত্তম, তুমি সত্যকুলজাত”।
একটা কথা; একসময় দিল্লির উপকন্ঠে লাখো কৃষক প্রায় দু’মাস ধরে হাড়কাঁপানো শীতের মধ্যে খোলা আকাশের নীচে ধর্নায় বসেছিলেন। এই কৃষি হল বৈশ্যের কর্ম বা জাতিধর্ম। কিন্তু মনু কী বলছেনঃ “কৃষিকে কেউ কেউ ভাল মনে করেন। কিন্তু ওই বৃত্তি সজ্জনকর্তৃক নিন্দিত। যে কাঠের মুখে লোহা আছে তা জমিকে, এবং জমিতে যে প্রাণী আছে তাদের নষ্ট করে”।(১০/৮৪)।
শূদ্রের পরিত্রাণ কিসে?
মনু বলছেনঃ বেদজ্ঞ গৃহস্থ কীর্তিমান ব্রাহ্মণদের সেবাই শূদ্রের স্বর্গাদিশ্রেয় লাভ জনক ধর্ম।এমন শূদ্র পরের জন্মে ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মাতে পারেন।(৯/৩৩৪,৩৩৫)।
বাদ সেধেছেন আর এক ব্রাহ্মণ রবীন্দ্রনাথ। তাঁর ‘দুরাশা’ গল্পের নায়িকা এক মুসলমান নবাবপুত্রী ব্রাহ্মণ হবার চেষ্টায় সারাজীবন শাস্ত্র অধ্যয়নের পর এই উপলব্ধিতে পৌঁছয় যে ‘ব্রাহ্মণত্ব’ আসলে একটি অভ্যাস মাত্র। তাহলে পরিণাম?
‘মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে কোলে তুলে দাও নাই স্থান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান’।
জাতিভেদ ধরে রাখতে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা দেখুনঃ
শূদ্র যে রাজার সভায় ধর্মবিষয়ক বিচার করে, তাঁর রাজ্য চোখের সামনে কাদায় বসে যাওয়া গরুর মত অবসন্ন হয়।যদি রাজ্য শূদ্রবহুল,নাস্তিকাকীর্ণ ও দ্বিজহীন হয়, তাহলে গোটা রাজ্যটাই দুর্ভিক্ষ ও রোগে শীঘ্র বিনষ্ট হয় ।(৮/২১,২২)।
লিস্টি আর লম্বা করতে চাই না। কিন্তু আজ যখন খোদ আমেরিকাতে “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার” আন্দোলনে মার্কিন রাষ্ট্রের কিছু ইতিহাস পুরুষের স্ট্যাচু নিয়ে নতুন করে মূল্যায়নের প্রশ্ন উঠেছে তখন আধুনিক রিপাব্লিক ভারতে মনুর মূর্তি স্থাপন করার আগে একটু চিন্তা করলে হয় না? আমাদের সংবিধানে যে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আইনের চোখে সবাই সমান! কিন্তু যেভাবে এক যোগীর রাজত্বে দলিত নারীরা ধর্ষিত ও নৃশংস ভাবে নিহত হচ্ছে, চারদিকে ঘৃণার বিষবাষ্প, তখন বোধহয় আমাদের সবার আগে তাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলা উচিত—“ক্ষমা করো”। পারব কি ?
(চলবে)
হীরেন সিংহরায় | ১৯ নভেম্বর ২০২৫ ০১:৩৪735911