

যে কোনও স্বাভাবিক ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়া যায়, কিন্তু যদি কোনও ঘটনা অস্বাভাবিক হয়, সেই ঘটনার পর্যালোচনা কি করা সম্ভব? বিহারের নির্বাচনের ফলাফল এতটাই অস্বাভাবিক, যে তার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা বা পর্যালোচনা করা সম্ভব হচ্ছে না। বিরোধীরাও পারছেন না, এমনকি দীর্ঘদিন ধরে যাঁরা ভোট বিশেষজ্ঞ বলে পরিচিত তাঁরাও বুঝে উঠতে পারছেন না। ২০ বছর শাসন করার পরেও মুখ্যমন্ত্রী নীতিশকুমারের এই জনপ্রিয়তার উৎস কী, সেটাও বহু মানুষের জিজ্ঞাস্য। শুধু কি মহিলাদের ১০ হাজার টাকার অনুদান ঘোষণা এবং তার প্রতিদানেই মহিলারা দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করেছেন নীতিশকুমারকে? নাকি নির্বাচন কমিশনের প্রত্যক্ষ মদতেই এইরকম ফলাফল হয়েছে, যাকে বিরোধীরা এখনও ব্যাখ্যা করে উঠতে পারেনি?
অনেকে বলতেই পারেন এগুলো সব হেরোদের যুক্তি, অনেকে বলতেই পারেন বিরোধী জোটের অপদার্থতাই এই ফলাফলের জন্য দায়ী, কিন্তু যে নির্বাচন কমিশনের প্রতিটি দলের জন্য সমান সুযোগ দেওয়ার কথা, তারা কি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছেন? নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার ৭ দিন আগে যখন বিহারের ১.৩০ কোটি ‘জীবিকা দিদি’দের জন্য ১০হাজার টাকা এককালীন অনুদান হিসেবে ঘোষিত হয়, তারপর সেই ‘জীবিকা দিদি’দেরই আবার নির্বাচনের কাজে নেওয়া হয়, তাহলে তাঁদের ভূমিকাকে কি নিরপেক্ষ বলা চলে? বহু মানুষ বলছেন, অন্য রাজ্যেও তো এই ধরনের প্রকল্প চলে, তাহলে সেটা নিয়েও তো প্রশ্ন তুলতে হয়। অবশ্যই প্রশ্ন করতে হবে, যদি কোনও ক্ষমতাসীন দল সারা বছর গরীবদের বিভিন্ন দাবী দাওয়াকে উপেক্ষা করে ভোট কেনার জন্য এই রকম কোনও অনুদান ঘোষণা করে, তাহলে তার অবশ্যই বিরোধিতা করা উচিৎ। সঙ্গে অবশ্যই বলতে হবে, নির্বাচন কমিশন কি অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রে এইরকম চোখ বুজে নির্বিবাদে সব কিছু মেনে নেয়? রাজস্থানে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলটের স্মার্ট ফোন প্রকল্পটি নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তেলেঙ্গানায়, ২০১৮ সাল থেকে চলমান রাইথু বন্ধু প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে নির্বাচনের আগে। অন্ধ্রপ্রদেশে, ওয়াইএসআর চেউথা ডিবিটি প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এমনকি উড়িষ্যার নবীন পট্টনায়েকের প্রকল্পটি ২০১৮ সালে যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সেই উদাহরণ কিন্তু আছে। আগামী বছর বাংলার নির্বাচনের আগে চলতে থাকা লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পও যে বন্ধ করে দেওয়া হবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা কি আছে?
এই প্রশ্ন নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে, যে বিজেপি লক্ষীর ভান্ডারকে কী চোখে দেখে, সেটা তো না হয় বাংলার বিষয়, কিন্তু বিহারের নির্বাচনের এই ফলাফলকে ব্যাখ্যা করতে গেলে প্রথমেই SIR বা বিশেষ নিবিড় সংশোধনী নিয়ে কথা বলতে হবে। বেশীরভাগ বিরোধীদের আত্মসমালোচনা করতে হবে, যে তারা এই বিশেষ নিবিড় সংশোধনী হয়েছে, তার প্রভাব যে এতটা সুদূরপ্রসারী হবে তা আন্দাজ করতে পারেননি। যে সময়ে ঐ প্রক্রিয়া চালু হলো, সেই সময়ে অজিত আঞ্জুমের মতো বেশ কিছু সাংবাদিক কিন্তু রোজ তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে খবর করছিলেন, যে বিহারের বহু গ্রামাঞ্চলে বুথ লেভেল অফিসাররা বাড়িতে বাড়িতে ইনিউমারেশন ফর্ম না দিয়ে, নিজেরাই ভর্তি করে জমা করছিলেন। যাঁরা ঐ সময়ের অজিত আঞ্জুমের ইউটিউব খেয়াল করেছেন, তাঁরা জানেন যে বেশীরভাগ গরীব, প্রান্তিক মানুষ জানতেই পারেননি ঐ বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর বিষয়টি সম্পর্কে। এমনিতে সবাই জানে যে একবার ভোটার তালিকায় যদি নাম উঠে যায়, তাহলে তাঁর একমাত্র কাজ নির্বাচনের সময়ে ভোট দেওয়া। এইরকম কোনো প্রক্রিয়া যে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে, সেটাই অনেকে জানতেন না। জানতেন না বহু পরিযায়ী শ্রমিক যাঁরা বাইরের রাজ্যে কাজ করতে গেছেন। শুধু এইটুকুই নয়, অজিত আঞ্জুম বিহারের গ্রামে গ্রামে, বিভিন্ন জেলা সদরের অফিসে গিয়ে দেখেন, একমাসের মধ্যে কাজ শেষ করার তাগিদে যে কোনোরকম ভাবে ফর্ম ভর্তি করা চলছে। জানিয়ে রাখা ভালো এই সমস্ত খবর করার জন্য অজিত আঞ্জুমের বিরুদ্ধে এফআইআর অবধি হয়েছে। যে সময়ে এই প্রক্রিয়া নিয়ে নানান প্রশ্ন উঠছে, সেই সময়ে কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এই সংক্রান্ত মামলার শুনানিও চলছে। যখন কথা ছিল বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার তখন কথা শুরু হলো বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর প্রযুক্তিগত সমস্যা নিয়ে। দেখে শুনে মনে হলো দেশের সর্বোচ্চ আদালতের যেন দায় আছে যে কোনও ভাবে এই প্রক্রিয়া শেষ করে ভোট করাতে হবে। তাঁদের ও যেন অলিখিত নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেন তেন প্রকারেণ সময় কাটিয়ে শুনানির জন্য একের পর এক তারিখ ফেলে কোনোভাবে একটা ভোটার তালিকা বানিয়ে ভোট করাতে হবে।
বিহারের ভোটের ঠিক আগে যে বিশেষ নিবিড় সংশোধনী হলো, তার ফলে প্রাথমিকভাবে যে বিভিন্ন বিধানসভা ক্ষেত্র থেকে ভোটারদের বাদ দেওয়া হলো, তার একটা তথ্য আজকের সময়ে দেওয়া জরুরি। যে সমস্ত ভোট বিশেষজ্ঞ শুধু নীতিশকুমারের ১০ হাজার টাকা দেওয়া, কিংবা নির্বাচন কমিশনের তা দেখেও না দেখাকেই শুধু এই বিপুল জয়ের কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন, তাঁদের আরো দু একবার এই তথ্য দেখতে হবে। যে সমস্ত সাংবাদিক বলছেন, অতি পিছড়ে বর্গের নীতিশকুমারের প্রতি সমর্থনকে জয়ের কারণ বলছেন, তাঁদের ও আরো একবার ভাবতে হবে।
শুধু সাংগঠনিক দক্ষতা, বা শুধু বিজেপি কিংবা আরএসএসের নিবিড় কাজের ফলেই বিহারে এই ফল হয়েছে সেটাও যেমন বিশ্বাসযোগ্য নয়, তেমনই যখন বিহারে বিভিন্ন মানুষকে বাদ দেওয়া হচ্ছিল, তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে আক্রমণ না করাটাও একটা কারণ। যাঁরা বলছেন রাহুল গান্ধী যখন তাঁর সাংবাদিক সম্মেলনে বেশ কিছু মানুষকে দেখালেন, যে তাঁরা বেঁচে থাকা সত্ত্বেও তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের নিয়ে কেন নির্বাচন কমিশনের কাছে গেল না? অবশ্যই গিয়েছেন। সিওয়ানের মিন্টু পাসওয়ানকে সুপ্রীম কোর্টে হাজির করা হয়েছিল সিপিআইএমএলের পক্ষ থেকে। এই রকম আরো মানুষকে হয়তো হাজির করা উচিৎ ছিল, কিন্তু তখন নির্বাচনী প্রচার শুরু হয়ে গিয়েছিল। ফলে গোটা বিষয়টা নিয়ে খুব বেশী আলোচনা হয়নি।
বাংলাতেও এই মূহুর্তে বিশেষ নিবিড় সংশোধনী চলছে। এমনিতেই ২০০২ সালের তালিকা খুঁজে, কোন বুথে কে ভোট দিয়েছিলেন, তা মনে রেখে নিজের বা বাবা-মায়ের নাম খোঁজা এক অসম্ভব কঠিন কাজ। মোবাইলে খোঁজা আরো কঠিন। খুঁজে পেলেও ঠিকঠাক ঐ বিশেষ নিবিড় সংশোধনী’র নির্দিষ্ট ফর্ম ভর্তি করা আরো কঠিন কাজ। বুথ লেভেল অফিসাররা ঐ সমস্ত ফর্ম দেখে শুনে জমা নিচ্ছেন। এরপর তাঁরা নিজেদের মোবাইল থেকে ঐ সমস্ত তথ্য নির্বাচন কমিশনের জন্য জমা করবেন। এমনিতেই মানুষজন এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতনতা কম, মানুষজন বুঝতেই পারছেন না ভুল হলে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে। কেউ নাম লিখছেন ‘পূর্ণিমা দাস’ সই করছেন ‘পূর্ণিমা দে’। কেউ মোবাইল থেকে দেখে আগের ভোটের এপিক সংখ্যা লিখতে গিয়ে, ঠিক তার নীচের সংখ্যা লিখে দিয়েছেন দেখে বুথ লেভেল অফিসার বললেন, ঠিক করতে। কেউ বাবার নাম নেই বলে কাকার নাম দিয়েছেন দেখে অফিসার বললেন, এই রকম তথ্য যে নেওয়া যাবে তা কমিশন এখনো নির্দেশ দেয়নি। মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা আছে, ভয় আছে আবার কেউ বিষয়টার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারছেন না। ভাবছেন খুব মজা হচ্ছে। যে বুথ লেভেল অফিসাররা এই কাজটা করছেন এবং তারপর তথ্য আপলোড করবেন, তাঁদের ও ভুল হতে পারে। মানুষ তো, ভুল হতেই পারে। ৪ঠা ডিসেম্বর অবধি এই প্রক্রিয়া চলার পরে ৯ই ডিসেম্বর খসড়া তালিকা প্রকাশিত হবে। অনেকে ভাবছেন সমস্যা মিটলো। না, একেবারেই মিটবে না। খসড়া তালিকায় যার নাম নেই, সেই তালিকা জানা যাবে, যাঁর নাম আছে তিনি জানতেও পারবেন না, তাঁর নাম থাকলেও অন্য বুথে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কি না। মিডিয়া জুড়ে ভাষ্য তৈরী হবে, এই এত কোটি বাদ গেল, সব বাংলাদেশী, রোহিঙ্গা। বহু সঠিক মানুষের নাম বাদ যাবে, যেমনটা বিহারে হয়েছে। মূলত মহিলা, যাঁরা লক্ষ্মীর ভান্ডারের উপভোক্তা তাঁরা বাদ যাবেন। (পরে মিলিয়ে নেবেন)। তারপর মানুষকে প্রমাণ করতে হবে তিনি জীবিত এবং বৈধ, এবং তাঁর হয়রানি বাড়বে। জেলা সদরে দৌড়াদোড়ি শুরু হবে, পাতার পর পাতা জেরক্স হবে, উকিলদের কাজ বাড়বে, রোজগার হবে, আর গরীব মানুষ সর্বস্বান্ত হবেন। ঠিক যেমন আসামে হয়েছে, বিহারে হয়েছে বাংলাতেও হবে। তারপর ভুয়ো ভোটারদের অনুপ্রবেশ ঘটবে। তারপর নির্বাচন ঘোষণা হয়ে যাবে। তারপর কী হবে তা জানা নেই, কিন্তু যে যে কথাগুলো বলছি, তেমনটাই হবে নিয়ম মেনে।
অনেকে ভাবছেন আমরা তো বিশেষ নিবিড় সংশোধনী’র কাজ চালানোর জন্য সহায়তা কেন্দ্র খুলেছি, তা হলে সমস্যা কোথায়? সমস্যাটা যদি বিহার দেখে না বোঝা যায়, তাহলে বাড়িতে বসে কার্টুন চ্যানেল দেখা ভালো। বিশেষ নিবিড় সংশোধনীতে বাংলাদেশ, মায়ানমার এবং নেপাল থেকে অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিত করে অপসারণ করার কথা ছিল। কিন্তু ইসিআই কর্তৃক প্রকাশিত সমগ্র ডেটাসেটে, একজনও অবৈধ অভিবাসী পাওয়া যায়নি। আসলে যা ঘটেছিল তা হল এই সংশোধনীর নামে একটি পাইকারি শুদ্ধিকরণ, যা বিজেপি এনডিএ’র গত ২০ বছরের শাসনকালে দুর্ভোগ পোহাতে থাকা দরিদ্র এবং দুর্বল ভোটারদের অপসারণ করা। বাংলা থেকে বেছে বেছে বিজেপি বিরোধী ভোটার বাদ যাবে, যাবেই। বিহারে তালিকা থেকে তাঁদের বাদ দেওয়ার পরেও বিষয়টা থামেনি, যাঁদের ভোটাধিকার ছিল ভোটের দিনে তাঁদের ভোট দিতে বাধা দেওয়া হয়েছে। বিজেপি তারপর তাঁদের সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে এই কাজটা করেছে। বাংলাতে হয়তো সেইটা হবে না। বিহারে নির্বাচনের দিনে বিভিন্ন সাংবাদিক দেখেছেন কীভাবে মহিলারা ভোটের দিনে গিয়ে দেখেছেন, তাঁদের নাম বাদ গেছে। যদি বিহারের নির্বাচনের এই ফলাফলের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই কথাগুলো না বলা হয়, তাহলে বিষয়টা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কী করতে হবে, তা রাজনৈতিক দলেরা ঠিক করবে, আমাদের মতো মানুষদের কাজ তথ্য সামনে নিয়ে আসা, না হলে বাংলার অবস্থাও বিহারের মতো হবে। ভাষ্য তো তৈরীই আছে, এখন সেটার বাস্তব রূপায়নের কাজটুকুই যা করার বাকি।