২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে যখন মনে হচ্ছিল, এবার রামমন্দিরের উদ্বোধনের দৌলতে বিজেপিকে আর কেউ ঠেকাতে পারবে না, যখন মনে হচ্ছিল কোনও গণমাধ্যমই তো আর উল্টো কথা বলছে না, সবাই তো একটাই এজেন্ডার কথা বলছে, তখন দেখা গিয়েছিল বেশ কিছু ইউটিউব চ্যানেল, বেশ কিছু বিকল্প খবরের ওয়েবম্যাগাজিন নিরন্তর মানুষের মনে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করছে। সারা দেশে বিভিন্ন ছোট বড় ইউবিউবারদের দেখা গিয়েছিল, নানান খবর করতে, যা মানুষকে ভাবায়। দেখা গিয়েছিল, তাঁরা দেশ জোড়া প্রবল বেকারত্বের কথা, সংবিধান এবং তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করে গিয়েছিলেন তাঁরাই। সেই নির্বাচন আর একটি বিভাজন স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে শুধুমাত্র প্রথাগত, প্রাতিষ্ঠানিক, বহুল প্রচারিত সংবাদমাধ্যমের বিপরীতে দাঁড়িয়ে, ছোট ছোট সংবাদমাধ্যম যাঁদের দর্শকশ্রোতা মূলত সমাজমাধ্যম, তাদের মধ্যে দিয়েও খবর এবং ধারণা তৈরী করা সম্ভব। ইউটিউব-নির্ভর ছোট মাপের সংবাদমাধ্যমের মধ্যে দিয়েও যে বড় প্রাতিষ্ঠানিক সাংবাদিকতাকে পরাজিত করা যায়, তা ঐ নির্বাচন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। কোনও প্রতিষ্ঠানে কাজ না করে বহু সাংবাদিক স্বাধীন ভাবে এই ভোটের খবর করেছেন। কেন করেছেন? শুধুমাত্র কি তাঁরা নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপির আদর্শের বিরোধী, না কি আরো অন্য কোনও কারণ আছে?
যদি খেয়াল করা যায়, ২০১৪ সালের পরের থেকে ধীরে ধীরে ভারতের মূল ধারার সংবাদমাধ্যমগুলোর মালিকানা চলে গেছে মূলত আদানি আম্বানির হাতে। যার ফলে খবর যা সম্প্রচারিত হয়েছে, তা মূলত সরকারের তাঁবেদারি ছাড়া কিছু হয়নি। ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে, এই গণমাধ্যমগুলো যেভাবে উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দুত্বের প্রচার করেছিল, তার ফলে দেখা গেল যে বহু সাংবাদিক মনস্থির করে ফেলেছিলেন, তাঁরা হয় ছোট ছোট খবরের সংস্থা নিজেরা তৈরী করবেন, নয় নিজেরাই ইউটিউব চ্যানেল খুলবেন। শুধুমাত্র সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করার একটা বড় কারণ, বেশ কিছু ‘সাংবাদিক’ বুঝতে পারছিলেন যে জনসাধারণের কাছে, প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা কমছে। গত ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ঐ রকম সাফল্য পাওয়া বিজেপির বিরুদ্ধে যে এ বার ২০২৪ সালে দেশের নানা জায়গায়, নানা বিষয়ে ব্যাপক ক্ষোভ জমেছে, প্রথাগত টিভি চ্যানেল বা অন্য মাধ্যমে প্রচারিত খবর দেখলে তার আন্দাজ পাওয়া যায়নি। এ বার সংসদে বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়িয়ে বহু দূর চলে যাওয়ার যে ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন, তা প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের দ্বারা সাধারণ মানুষের কাছে পৌছেছে। সেই ঘোষণা এক বার নয়, বার বার সম্প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু প্রচলিত গণমাধ্যম যে প্রশ্ন করেনি, তা হল এই দাবির যৌক্তিকতা কতটা, বা এই দাবির বাস্তবতা কতটা?
ঐ নির্বাচনে প্রচলিত গণমাধ্যম, যাঁদেরকে পরিভাষায় আমরা গোদী মিডিয়া বলে থাকি, তাঁরা এই সত্যিটা বুঝতে পারছে, যে তাঁদের প্রোপাগান্ডা আর মানুষকে আকৃষ্ট করছে না এবং এই ধরনের ইউটিউব চ্যানেলগুলো বন্ধ করার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে বেশী বেশী দর্শক যে আঞ্চলিক এবং হিন্দি ভাষার ইউটিউব চ্যানেলগুলো দেখছেন, তা যেনতেন প্রকারে বন্ধ করতে হবে। শুধুমাত্র সরকারি আইন দিয়ে যদি বন্ধ না করা যায়, তাহলে বিকল্প পদ্ধতি নিতে হবে। প্রয়োজনে ঐ ইউটিউবারদের চ্যানেলগুলোকেই উড়িয়ে দিতে হবে, এবং তার জন্য যদি ইউটিউবকেও কাজে লাগাতে হয়, বা অন্য যেকোনো পদ্ধতি নিতে হয়, নিতে হবে। এক্ষেত্রে এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল বা এএনআই এবং প্রেস ট্রাষ্ট অফ ইন্ডিয়া বা পিটিআই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। এই দুটি সংবাদ সংস্থাই মূলত সরকারের সবরকম খবর করে থাকে, তাঁদের থেকেই অন্যান্য সংবাদমাধ্যম খবর সংগ্রহ করে থাকে। যাঁরাই ঐ খবর সংগ্রহ করেন, তাঁরা স্বত্ব বাবদ বেশ কিছু টাকা দিয়ে থাকেন এএনআই এবং পিটিআইকে। এটাই নিয়ম।
অনেক ইউটিউবার যারা কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের বিষয়বস্তু তৈরি করেন তারা অভিযোগ করেছেন যে এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল (এএনআই) অনুমতি ছাড়াই পরবর্তী ক্লিপগুলি ব্যবহার করার জন্য অতিরিক্ত অর্থ দাবি করেছে। এই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা যুক্তি এবং কপিরাইট আইনের উভয় দিকই দেখা প্রয়োজন।
একজন ইউটিউবার মোহক মঙ্গল, যিনি এই ধরনের ভিডিও ভাষ্য এবং ব্যাখ্যা তৈরি করেন, "প্রিয় এএনআই" শিরোনামের একটি ভিডিওতে, তার ভিডিওতে ক্লিপগুলি ব্যবহার করার জন্য ঐ সংবাদ সংস্থাকে তার কাছ থেকে ৪০-৫০ লক্ষ টাকা দাবি করার অভিযোগ করেছেন। তিনি আরও অভিযোগ করেছেন যে এএনআই অন্যান্য অনেক বিষয়বস্তু নির্মাতাদের সঙ্গেও এটি করেছে, কারো কারো কাছ থেকে বার্ষিক সাবস্ক্রিপশনের বিনিময়ে এই অর্থ চাপ দিয়ে বের করেছে তারপরে তাদের ভিডিও ক্লিপগুলি ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মোহক মঙ্গল। মঙ্গল দাবি করেছেন যে এএনআই তাঁর ভিডিওতে কয়েক সেকেন্ডের ফুটেজ ব্যবহার করার জন্য একাধিক স্ট্রাইক জারি করেছে যা তিনি "ন্যায্য ব্যবহার" বলে বর্ণনা করেছেন। এদিকে, দ্য রিপোর্টার্স কালেক্টিভ অভিযোগ করেছে যে এই পদ্ধতিটি এজেন্সিকে "ইউটিউবারদের সাথে দামি লাইসেন্সিং চুক্তির" করার চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। কপিরাইট মালিকদের স্ট্রাইক বা ইউটিউবকে বলে স্ট্রাইক করানোর মাধ্যমে এটা হচ্ছে জোর করে সেই চুক্তিতে সই করানোর চেষ্টা। তাদের বিষয়বস্তু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা হয়েছে দাবি করে এএনআই ও ইউটিউবকে স্ট্রাইক করা হয়েছে বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। ইউটিউব একটি ভিডিও স্ট্রাইক করে যখন একজন ইউটিউবারের বিরুদ্ধে কপিরাইট লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে৷ ৯০ দিনের মধ্যে এর মধ্যে তিনটি এইরকম স্ট্রাইক হলে চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে যায়।
এক্ষেত্রে এএনআইয়ের অবস্থান কী?
আইন অনুসারে, এএনআইয়ের খবরের ফুটেজের উপর তাঁর কপিরাইট বলবৎ করার অধিকার রয়েছে। মূল সংবাদ সংগ্রহকারীরা, যেমন নিউজ এজেন্সি বা প্রিন্ট মিডিয়া বা টেলিভিশন চ্যানেলে, বিষয়বস্তু উত্পাদনের জন্য উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নিয়ে থাকে এবং বিগ টেককে তারা সংবাদ নিবন্ধ এবং ভিডিওগুলির সাথে লিঙ্ক করে লাভের জন্য দায়বদ্ধ করার চেষ্টা করছে। দি রিপোর্টার্স কালেক্টিভের প্রশ্নের জবাবে, এএনআই একটি বিবৃতি জারি করেছে যাতে বলা হয়েছে: “বিষয়বস্তুর একচেটিয়া কপিরাইট ধারক হিসাবে, এএনআইয়ের কাছে তার কাজ জনসাধারণের কাছে যোগাযোগ করার বা তার ব্যবহারের লাইসেন্স দেওয়ার একমাত্র আইনি অধিকার রয়েছে৷ ইউটিউবের কপিরাইট নীতি বা আইনি পদক্ষেপের মতো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে—এই অধিকারগুলি প্রয়োগ করা চাঁদাবাজি নয়। এটি সম্পত্তির আইনগত সুরক্ষা, যেমন কপিরাইট আইন দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে। যে কেউ আমাদের অধিকার নিয়ে বিতর্ক করলে আইনি আশ্রয় নিতেই পারেন।” সম্প্রতি, এএনআই একটি কপিরাইট লঙ্ঘনের মামলা দায়ের করে অভিযোগ করেছে যে ওপেনএআই তার এআই মডেলগুলিকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য যথাযথ অনুমোদন ছাড়াই তার কপিরাইটযুক্ত সামগ্রী ব্যবহার করেছে।
ইউটিউবের কপিরাইট নীতি কী?
ইউটিউবের কপিরাইট নীতি বলে যে নির্মাতাদের অবশ্যই তাঁদের নিজস্ব সামগ্রী সহ ভিডিও আপলোড করতে হবে বা অনুমতি নিয়ে অন্যের সামগ্রী ব্যবহার করতে হবে, কিছু ক্ষেত্রে, তারা শিক্ষাগত উদ্দেশ্যে এবং সংবাদ প্রতিবেদনের মতো অনুমতি ছাড়াই পরবর্তীটি করতে পারবেন৷ এটাকে ন্যায্য ব্যবহার বলা যেতে পারে। এটাও তাঁদের একটা নীতি, যা প্রতিটি দেশের জন্য আলাদা। সর্বোপরি, ইউটিউব কপিরাইট স্ট্রাইক ফাইল করার উপর জোর দিয়ে রেখেছে, যেটি অনুমতি ছাড়াই ভিডিওতে ব্যবহৃত কপিরাইটযুক্ত সামগ্রীর উপর দাবি করা যেতে পারে, যাঁরা কপিরাইটের অধিকারী তাঁরা যদি মনে করেন যে এই ধরনের বিষয়বস্তু নির্মাণ করলেও তাঁরা ঐ ধরনের স্ট্রাইক করাবেন না, তাহলে তা নাও করাতে পারেন। এটা সম্পূর্ণ তাঁদের নিজেদের বিচক্ষণতার বিষয়। তবে একটা কথা মনে রাখা দরকার ইউটিউব এইধরনের কোনও স্ট্রাইক করার কথা কোনও ইউটিউবারকে জানানোর আগে স্ট্রাইকটি প্রাথমিকভাবে পর্যালোচনা করে। সেইসময়ে কপিরাইট স্ট্রাইকের বিষয়টি নিজেদের মধ্যেই রাখে এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি আদালতের উপর ছাড়ে। যদি দুই পক্ষই আদালতের কাছে যেতে পছন্দ করে, তাহলে সেই আদালতের সিদ্ধান্তকেই ইউটিউব চূড়ান্ত বলে মান্যতা দেয়।
তবে এই ধরনের স্ট্রাইক কিন্তু আজকে প্রথম হলো এমনটা নয়। ২০২৩ সালেও একজন ইউটিউবারের ক্ষেত্রে এই ধরনের স্ট্রাইক করা হয়েছিল, তবে সেই সময়ে এইরকম চ্যানেল বন্ধের হুমকি ছিল এমনটা নয়। লোকসভা এবং রাজ্যসভা টিভির ক্লিপ ব্যবহার করা নিয়ে প্রসারভারতী এইরকম অভিযোগ এনেছিল। বিভিন্ন সাংবাদিক, যাঁরা বিভিন্ন মিডিয়া হাউসের চাকরি ছেড়ে নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল খুলেছেন, তাঁরাও এই বিষয়টা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। এনডিটিভির প্রাক্তন সাংবাদিক রভীশকুমার দি রিপোর্টার্স কালেক্টিভকে জানিয়েছেন, তিনিও নানান অসুবিধার সম্মুখীন হন, কোন ক্লিপে কপিরাইট আছে, কোন ক্লিপে নেই, এই বুঝতে বুঝতে বিস্তর সময় চলে যায়। নিয়মটাও যেহেতু পরিষ্কার নয়, তাই নানান সময়ে সমস্যা হয়।
কপিরাইট আইন কী বলে?
১৯৫৭ সালের কপিরাইট আইন, স্রষ্টা এবং লেখকদের তাদের সৃষ্টির একচেটিয়া অধিকার প্রদান করে, কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত তাদের ব্যবহার এবং বিতরণ নিয়ন্ত্রণ করার অনুমতি দেয়, যাকে "ন্যায্য লেনদেন" বলা হয়। ন্যায্য লেনদেন, অর্থাৎ ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে, গবেষণা, সমালোচনা, পর্যালোচনা, বা সংবাদ প্রতিবেদনের জন্য ব্যবহারের অনুমতি দেয়, যদি এই ধরনের ব্যবহার কপিরাইট মালিকের বাণিজ্যিক স্বার্থের প্রতি অসুবিধা না সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, একাডেমিক কাজের উদ্ধৃতি বা পর্যালোচনায় ঐ ক্লিপ দেওয়া যেতে পারে কিন্তু উল্লেখযোগ্য হলো তা বিপণন যোগ্য না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। আইনটি শেষবার ২০১২ সালে ইউপিএ ২ আমলে সংশোধিত হয়েছিল৷ তারপর থেকে, বিজেপি এই বিষয়ে অজ্ঞ এবং উদাসীন ছিল৷ ডিজিটাল স্পেসকে গণতান্ত্রিক করার জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কারকে উপেক্ষা করে তারা "ডিজিটাল ইন্ডিয়া" এর মতো চটকদার স্লোগান দিতে ব্যস্ত। এটি স্বাধীন নির্মাতাদের চাপে ফেলে দিয়েছে। একদিকে, এএনআই জাতীয় সংবাদ সংস্থার মতো বেশ কিছু সংস্থা মোটা টাকা দাবি করছে, অন্যদিকে শক্তিশালী কর্পোরেশনগুলি আইনি ভয় থেকে জবাবদিহি করা এড়াচ্ছে।
ক্ষুদ্র ইউটিউবার, তৃণমূল স্তরের রিপোর্টার, ডিজিটাল ব্যঙ্গাত্মক চ্যানেলগুলোকে মূল্য দিতে হচ্ছে। স্বাধীন মিডিয়া এবং বিষয়বস্তু নির্মাতারা যে চ্যালেঞ্জগুলির সম্মুখীন হয় সেগুলির জন্য ব্যাপক এবং সহানুভূতিশীল আলোচনার প্রয়োজন৷ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রকৃতপক্ষে সেন্সরশিপের দ্বারা হুমকির সম্মুখীন কিন্তু সেই সাথে পুরানো আইন, শোষণমূলক প্ল্যাটফর্ম এবং এমন একটি সরকার যা কাজ করতে অস্বীকার করে তার মেলবন্ধনটার উদ্দেশ্য কি তবে বিকল্প সংবাদমাধ্যমের মুখ বন্ধ করা? এই প্রশ্নটাই ঘুরে ফিরে আসছে।