এই লেখাটা ছেড়ে গিয়েছিলাম প্রায় এক বছর আগে। তালেগোলে সময় গড়াতে গড়াতে আরো একবার ঘুরে আসা গেল দ্বাদশ গিরিবর্ত্মের দেশ থেকে। সেবারে লিখতে লিখতে যে সব 'হলেই হতে পারত কিন্তু হয় নি ট্যুর কন্ডাকটারের অজ্ঞান ঔদাসিন্যে' দু:খগুলো উথলে উঠছিল এবারে সেটা সম্পূর্ণ মিটিয়ে আসতে পারার তৃপ্তিতে খুশীমনে আবার হাত দিলাম লেখাটায়। গতবার আর এবারের অভিজ্ঞতা পাশাপাশিই চলবে। ... ...
হেমিস ফেস্টিভাল ২০২৫ ... ...
ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের আফগানিস্তান যাত্রা ... ...
অতএব মনের মধ্যে তৈরী হয়ে ওঠে সুযোগের অপেক্ষায় থেকে আপাতত মিথ্যে ভান করে নেওয়া একটা চতুর মন। নিজের এই মনটাকে আমি নিজেও ঠিক পুরোটা বুঝে উঠতে পারি কি না কে জানে! এই মন আমাকে দিয়ে চন্নামিত্তি নিয়ে মাথায় ঠেকানোর মত একটা ভঙ্গী করায়, আমি দুধ-ঘী-মধুর সুস্বাদু তরল জিভ দিয়ে সুড়ুৎ করে টেনে নিয়ে হাতটা পায়ের তলায় মুছে ফেলি। নিজের মনে অবিরাম দ্বন্দ্ব চলতে থাকে, সকলের চোখের আড়ালে এ আমার কেমন প্রতিবাদ? এ তো ভন্ডামি। মন বলে হ্যাঁ ভন্ডামিই তো, ইস্কুলে ইরাদি যখন বলেছিল ‘তোমায় তো মা দেখিয়ে দেন ট্র্যানশ্লেসান' ত্খনও তো বলে ওঠো নি ‘না না মা তো কিচ্ছু পড়া দেখায় না আমাকে' সেইটে ভন্ডামি ছিল না? আমি বলি আহা তখন ঐটে বললে মা তো ভীষণ রাগ করত। মন বলে আর এইটে বললে বুঝি ক্যাডবেরি কিনে দেবে? আরও অনেক বেশী রাগ করবে। আমি বলি কিন্তু সত্যি যদি সরস্বতী জ্যান্ত হয়ে কম নম্বর পাইয়ে দেয়? মন বলে তাহলে তো বুঝেই যাবে আমরা মানুষরা বানাই না, আর ঠাকুররা রাগ করলে নম্বর কম হয়। আমি ব্যাজার হয়ে বলি তখন বুঝে কি ঘন্টা হবে আমার? মন খুশী হয়ে বলে বলে ধ্যুৎ চল তো আজ তো আর পড়াশোনা নেই, কেউ খোঁজ করবে না, এখন চুপিচুপি ওপরে গিয়ে প্রসাদ আর নবকল্লোলের শারদীয়া সংখ্যার ছবিগুলো দেখি বরং। ... ...
একদিন সুযোগ পেয়েও যাই। ছোটমামারা তখন ফেরত চলে গেছে, দিদাকে নিয়ে ব্ড়মামা, মাইমা গেছে পুর্বাশায় মেজমামার বাড়ী। সেদিন আমি দোতলার ঠাকুরঘরে এসে ঢুকি, ভেতর থেকে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ছোট্ট খাট থেকে নামিয়ে আনি রামকৃষ্ণ, সারদামণি, অন্নদা ঠাকুর, কালীঠাকুর, গনেশঠাকুরের ছবি। দেয়াল থেকে পেড়ে আনি কৃষ্ণরাধার ছবি। তারপর একটা একটা করে ছবির ওপরে উঠে দাঁড়াই, ছবির কাচ যাতে ভেঙে না যায় তাই ঐ ঠাকুরদের বিছানার তোষক নিয়ে ফটোর ওপরে রেখে তার ওপরে দাঁড়াই। সব ফটো জায়গামত রেখে ধার থেকে টেনে আনি লক্ষ্মী আর সরস্বতীর মূর্তি। এই দুটো ঠাকুরের মূর্তি এনে পুজো হয়, ভোগ দেওয়া হয় আর পুজোর পরের দিন আগের বছরের ঠাকুরের বিসর্জন দেওয়া হয়। এই বছরের ঠাকুর ঠাকুরঘরে থাকে। এগুলো মূর্তি ছবি নয়, এগুলোর ওপরে দাঁড়ানো যায় না, তাই পা দিয়ে ওদের শাড়ি ডলে দিই, পায়ের আঙুল দিয়ে মূর্তির মাথার চুলগুলো রগড়ে দিই। তারপর আবার উঠিয়ে বসিয়ে দিয়ে আসি আর মনে মনে বলি, যে ঠাকুরের দোহাই দিয়ে দিদারা এত মিথ্যে বলে, এতবার অন্যায়ভাবে আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখে, সেই ঠাকুরকে পা দিয়ে ডলে রগড়ে দিলাম। ওদের দেখানো 'ঠাকুর দেখবেন ওপর থেকে' এই ভয় আমি করি না। ওদের উত্তরাধিকার আমি বহন করি না, কোনওদিন করবও না। ... ...
পর্দায় তখন উত্তমকুমার। প্রসাদ, উল্টোরথ,নবকল্লোলের পাতায় ছবি দেখা উত্তমকুমার, জিজির মুখে শোনা শিঙাড়া স্টাইলের চুলওয়ালা উত্তমকুমার। ঘন্টা দেড়েক পরে ভাই আর দাঁড়াতে না পেরে আস্তে করে গিয়ে মা'র কোলে শুয়ে পড়ে। মা পর্দা থেকে চোখ না সরিয়েই জিগ্যেস করে কিরে সব পড়েছিস? ভাই দিব্বি ঘাড় নেড়ে আরাম করে শোয় যেন কতই ঘুম পেয়েছে। আমি একটু এগিয়ে দাঁড়াই ভাল করে দেখার জন্য। এদিকে কোথা থেকে কে জানে প্রায় জনা পনেরো বাচ্চা ছেলে, মেয়ে বড় মহিলা চলে এসেছেন টিভি দেখার জন্য। বড়মাইমা তাঁদের জন্য মেঝেতে ঢালা শতরঞ্চি পেতে দিয়েছে। সাড়ে সাতটায় বাংলা খবর হয়, খবর পড়েন ছন্দা সেন। ছোটদি খুব বিজ্ঞের মত বলে ‘জান তো ছন্দা সেনের মাথায় পরচুলা, ওঁর মাথায় এমনিতে চুলটুল বিশেষ নেই।' টিভি দেখতে আসা ছোট ছেলেমেয়েগুলো অবাক হয়ে একবার পর্দায় দেখে একবার ছোটদির দিকে। কেউ কেউ নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে নেয়, কেউ কেউ খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। দাদু বিরক্ত হয়ে গলাখাঁকারি দেয়, দিদা আরো বিরক্ত হয়ে দাদুকে বলে ‘চুপ কইর্যা শুইয়া থাহো, ভালা না লাগলে পাশ ফিইর্যায় শোও।' আরো কতদিন যেন, প্রায় বছর চার পাঁচ, এরকম অনেক চেনা অচেনা লোক আসত টিভি দেখতে, সিনেমার দিন কিম্বা বিশেষ কোনও খেলা দেখানোর দিনে। কোনও কোনওদিন ঘর ভরে গিয়ে বাইরের বারান্দায়ও লোক বসে কিম্বা দাঁড়িয়ে দেখত জানলা দরজার ফাঁক দিয়ে। মস্তবড় প্রায় অচল রেডিওটা তখনও বসানো দাদুর আলমারীর মাথায়, দুপুরে কেউ হয়ত চালিয়ে মহিলামহল শুনল, কিম্বা সকাল সাতটা চল্লিশে রবীন্দ্রসঙ্গীত। কখনও দিনের পর দিন রেডিও চালালেই ঘরঘর করে আওয়াজ হয়, গান বাজে সঙ্গে বাজে ঘ্যাঁওওও আওয়াজ। কেউ না কেউ তখন কান মুচড়ে থামিয়ে দেয় রেডিওটাকে। প্রায় অচল দাদুও কখনও বসে কখনও শুয়ে থাকে। ঘরে অতিরিক্ত লোক, তাদের কথাবার্তা, উজ্জ্বল নীল আলো, কল্পজগতের হাসিকান্না মেলোড্রামায় বিরক্ত হয়ে, অতিষ্ঠ হয়ে কখনও কখনও বিরক্তি প্রকাশ করে ফেলে। কেউ না কেউ ততোধিক বিরক্তি প্রকাশ করে কিংবা ধমক দিয়ে বুঝিয়ে দেয় দাদুর বিরক্তি অসুবিধে, এসবই এখন নিতান্তই মূল্যহীন। চলে ফিরে বেড়ানো লোকগুলির অসুবিধে সৃষ্টি কেবলমাত্র। ছানিপড়া ঘোলা চোখে শুন্য দৃষ্টি নিয়ে টিভির দিকে পিছন ফিরে দেওয়ালের দিকে মুখ করে বসে থাকে দাদু, মেরুদন্ড সোজা রেখে। অল ইন্ডিয়া রেডিও ছেড়ে আমরা কলকাতা দূরদর্শন, দিল্লী দূরদর্শনের যুগে ঢুকে যাই। ... ...
হেলেনা নর্বার্গ-হজ, সোনম ওয়াংচুক এবং লাদাখের পরিবেশ ... ...