শ্রীনগর লেহ জাতীয় সড়ক বরাবর কিছুদূর এগোতে পাশ থেকে সঙ্গ নেয় দ্রাস নদী। দুপাশের সুউচ্চ পর্বতশ্রেণী সম্পূর্ণ ন্যাড়া, বাদামী খয়েরি রয়েরি রঙ, কোথাও আলগা মাটি পাথর। কিন্তু নদীর দুপাশ একেবারে ঘন সবুজ গালিচা বিছানো। মূলত দেওদার গাছই বেশী চোখে পড়ল। কোথাও কোথাও ছোট ছোট খেত, অল্প কয়েকটা মাটির বাড়ি। রূপম আগেই বলেছিলেন ওয়্যার মেমোরিয়াল আর কার্গিল শহরের মাঝামাঝি কোথাও একটা দূরের ঘন সবুজ গাছের মধ্যে একটা মসজিদের ঝকঝকে সোনালি গম্বুজ দেখা যায়, সে নাকি অদ্ভুত সুন্দর লাগে দেখতে। জায়গামত সারথিকে বলে গাড়ি দাঁড় করিয়েও দিলেন। হুড়মুড়িয়ে নেমে দেখি সত্যিই বড় সুন্দর। চারিদিকে বাদামীর নানা শেডে উঠে যাওয়া সারি সারি পাহাড়, অনেক নীচে এক নদীকে ঘিরে ঘন গাঢ় সবুজ উপত্যকা, আর তার মাঝখানে ঝকঝকে সোনালী গম্বুজ আর তিনটে মিনার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক মসজিদ। বেলা প্রায় সাড়ে তিনটে, আকাশে এলোমেলো কিছু মেঘ ওদিকের কোণটা ছায়াছায়া করে রেখেছে আর একপাশ থেকে আসা প্রখর সূর্যকিরণ পড়ে সোনালী গম্বুজ আর মিনার যেন জ্বলছে। গোটা দৃশ্যটা মনে হচ্ছে ভার্মিয়ের আঁকা কোন ছবি, শুধু থ্রি ডাইমেনশানাল এই যা। এমন অপার্থিব আলোমাখা দৃশ্যকে ধরে রাখবে এমন ক্যামেরা আজও তৈরী হয় নি। তবু কিছু ছবি তো তুলতেই হয় যাতে পরে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে এই মুহূর্তটায় ফিরে যাওয়া যায়। টিপিকাল ট্যুরিস্ট স্পটের বাইরে অপরূপ এই দৃশ্যটা দেখানোর জন্য রূপমকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু তিনখানা মিনার কেন? বরাবর তো মসজিদে চারটে মিনারই দেখেছি। আসিফভাইকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল শিয়া মসজিদে তিনখানাই মিনার থাকে। এই অঞ্চলে শিয়া মুসলমানের প্রাধান্য বেশী তাই পরেও আরো কিছু তিন মিনারওয়ালা মসজিদ দেখেছি। ... ...
তো এহেন লাদাখ আমার স্বপ্নের গন্তব্য হয়ে আছে সেই ১৯৯৮ সাল থেকেই। সেই সময় ম্যাকলিয়ডগঞ্জে বেড়াতে গিয়ে দালাই লামার বক্তব্যে লাদাখের কথা প্রথম শুনি। তারপরে তো নানা বইপত্র ইত্যাদি। কার্গিলযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কার্গিল ওয়্যার মেমোরিয়াল ইত্যাদিও হয়ে দাঁড়ায় পর্যটনস্থল। শ্রীনগর থেকে সড়কপথে লেহ গিয়ে লাদাখের অন্যান্য অংশ ঘুরে পরে মানালি হয়ে ফিরলে প্রায় পুরো সার্কিট ঘোরা যায়। তাছাড়া অ্যাক্লিমেটাইজেশানও বেশ ভালভাবে হয়। আকাশপথে সরাসরি লেহ গিয়ে নামলে সেটা হয় না। সেক্ষেত্রে লেহতে অন্তত দুইদিন থেকে ফুসফুসকে কম অক্সিজেনে কাজ চালাতে শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হয় আর কি। লাদাখ এমনিতে বেশ ব্যায়বহুল জায়গা, গাড়িভাড়া যথেষ্ট বেশী। আর গণপরিবহন প্রায় নেইই বলতে গেলে। ফলে সোলো ট্রিপ খুবই খরচসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। খুব বড় গ্রুপের সাথে যাওয়াও খুব একটা সুবিধেজনক হবে না। বিশেষ করে আমার যে সব ব্যপারে আগ্রহ, সেরকম গ্রুপ ট্যুরে পাওয়া সহজ নয়। তো অরুণাচল ট্রিপে আলাপ হওয়া সমরেশ হালদার-দাদার সাথে বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনা চলছিল কীভাবে টেম্পো ট্রাভেলার কাটিয়ে ইনোভা বা জাইলো্ জাতীয় ছোট গাড়িতে ভ্রমণটা করা যায়। সেই সূত্রেই রূপম মুখার্জিকে বলা (ইনিই অরূণাচল ট্রিপ অ্যারেঞ্জ করেছিলেন), এবং উনি একটা ট্যুর প্ল্যান দিলেনও। আমি তাতে হানলে যোগ করতে বলায় রাজীও হলেন। সমরেশদা বৌদির যাওয়ার উপযুক্ত সময় ধরে ঠিক হল আগস্টের শেষে রওনা হব, শ্রীনগর পৌঁছে সেখান থেকে যাত্রা শুরু। আমরা তো যাওয়া আসার টিকিট কেটে তৈরী। একটা ছোট সমস্যা যা দেখলাম হানলে ঢোকানোর পরে ১২ রাত ১৩ দিনের বিস্তারিত প্ল্যানটা আর পাওয়াই গেল না। প্রচুর ফলোয়াপের পরে খুবই স্কেচি একটা আউটলাইন পাওয়া গিয়েছিল যাত্রার দুই তিনদিন আগে, তো সেটা তখন তেমন সমস্যাজনক মনে হয় নি। পরে গিয়ে বুঝেছিলাম মুশকিলটা কোথায় হয়েছে। তো যাক সে কথা আপাতত, যথাস্থানে বলবো। পরিকল্পনামাফিক ২৮শে আগস্ট দুপুরে কলকাতা থেকে শ্রীনগরগামী বিমানে চেপে বসা গেল। বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ শ্রীনগর পৌঁছে দেখি ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে। পছন্দ করে ডানদিকের জানলায় সিট নিয়েছিলাম, কিন্তু হায় পুরো হিমালয়ান রেঞ্জই পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের আড়ালে লুকিয়ে রইলো। হোটেল যাওয়ার পথে সারথি জানালেন গতকাল অর্থাৎ ২৭ অবধি তীব্র গরম ছিল, আজই সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমরা মনোরম আবহাওয়া পাবো। আমাদের গন্তব্য হোটেল বেলমন্ট। এমনিতে ভালই, খাওয়াদাওয়াও মন্দ নয়। ... ...
অষ্টমশ্রেণীতে সবচেয়ে বড় সমস্যা শুরু হল অঙ্ক নিয়ে। সপ্তম পর্যন্ত পাটীগণিত নিজে নিজেই পারতাম। পঞ্চম আর ষষ্ঠশ্রেণীতে দাদু যা শিখিয়েছিল তাতেই হয়ে যেত। খুব সামান্য কিছু কখনও হয়ত দাদুকে জিগ্যেস করতাম, সেও নিজে তো জানিই একবার দাদুকে বলে নেওয়া। বীজগণিত শুরু হয়েছিল সপ্তম শ্রেণীতে, সে শুরুর দিকে অসুবিধে হলেও মোটামুটি পেরে গেছি। দাদু বীজগণিত দেখাতে চাইত না, আর হাফ ইয়ার্লির আগেই ছোটমামার বিয়ের দিনে দাদু সেই যে পড়ে গেল, আর তো কোন অঙ্কই দেখাতে পারল না। কিন্তু এখন তো বীজগণিত বেশ কঠিন লাগে, এমনকি পাটীগণিতেও মাঝে মাঝেই আটকে যাই। অঞ্জলীদি কতগুলো বাড়ীর কাজ দিয়ে রাখেন, না করে নিয়ে গেলে খুব বকেন তো বটেই, মা'কে বলেও দেন। মা ভাবে আমি মন দিয়ে করার চেষ্টা করি না, কখনও ঠাঁই ঠাঁই করে দুটো থাপ্পড় দেয়, কখনও আমার দ্বারা যে কিস্যু হবে না সেটুকু বলে নিজের কপালের দোষ দেয়। একদিন ভয়ে ভয়ে বড়মামার কাছে নিয়ে গেলাম অঙ্কের বই আর খাতা। বড়মামা খানিকক্ষণ দেখে করেও দিল অঙ্কটা, খানিকটা বুঝিয়েও দিল। তাতে বাকী অধ্যায়টা নিজে নিজেই করে ফেলতে পারলাম। সেই থেকে মাঝে মাঝেই অঙ্ক নিয়ে যেতে লাগলাম বড়মামার কাছে। বড়মামাকে এমনিতে আমার একটু ভয় ভয় লাগে, খুব একটা বেশী কথা বলে না। কোনোকারণে বড়মামার ভুরুদুটো প্রায় সবসময়ই অল্প কুঁচকে থাকে। বড়্মামা ওঠে খুব ভোরে, প্রায় দিদার সঙ্গে সঙ্গেই। সাড়ে ছটা থেকে সাতটার মধ্যে বেরিয়ে যায়, হেঁটে হেঁটে আটটার আগেই পৌঁছে যায় রিষড়ার অ্যালকালি। অ্যালকালির ভোঁ আমাদের বাড়ী থেকে শোনা যায় না, বেশ অনেকটা দূর। বেলা দশটা নাগাদ টিফিনওলা, একটা রোগা ছেলে সাইকেলের দুইদিকে অনেকগুলো টিফিন ক্যারিয়ার ঝুলিয়ে এসে দাঁড়ায়। বড়মাইমা কিম্বা দিদা গিয়ে একটা ভাত, ডাল, মাছের ঝোল ভরা হিন্ডালিয়ামের তিনথাক টিফিন ক্যারিয়ার দেয় তাকে, সে শোঁও করে সাইকেল বেঁকিয়ে চলে যায়। একটা দেড়টা নাগাদ এসে খালি টিফিনকারিটা ফেরত দিয়ে যায়। কোনও একটা বাড়ীর টিফিনকারি থাকে ওর কাছে, যার মাঝখানের আর ওপরের বাটিদুটো টোল খাওয়া, ওপরের বাটিটার টোলের পাশে কালো কালো দানা দানা মত, দেখে কেমন বিশ্রী লাগে। আরেকটা টিফিনকারি আছে তামার তৈরী বোধহয়, টাট, কোশাকুশির মত ঝলমল করে। বাটিগুলো একটু ছোট, ফলে পুরো টিফিনকারিটাই অন্যগুলোর থেকে কম লম্বা। আমার খুব পছন্দ ওটা, যতক্ষণ টিফিনওলা অপেক্ষা করে, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি। ... ...
আবার সেই গাদাগাদা অচেনা লোক, সেই একগাদা হাবিজাবি মন্ত্র আর বারবার করে 'প্রেত প্রেত' করতে লাগল ঠাকুরমশাই। আবার আমার ইচ্ছে করে এই ঠাকুরমশাই নামের লোকটাকে ধাঁইধাঁই করে মারতে। মীনামার মত ভালমানুষ যে কাউকে কোনোদিন একটু জোরে বকে নি, সবসময় হাসিহাসি মুখে থাকত, তাকেই এই পাজী লোকটা 'প্রেত প্রেত' বলছে! আমাকে যারা যারা ভালবাসত তাদেরকে এই ঠাকুরমশাইরা 'প্রেত' বলে ডাকে আর তারপর একগাদা কাপড়চোপড়, বাসনপত্র, খাবারদাবার এমনকি বিছানা বালিশ, ছাতা পর্যন্ত পোঁটলা বেঁধে নিয়ে চলে যায়!! এই নামাবলি জড়ানো একটু কুঁজোমত লোকগুলোর প্রতি এক তীব্র বিতৃষ্ণা, প্রায় বিদ্বেষ জন্ম নিতে থাকে আমার মনে। ... ...
ঝলমলে সোশ্যাল মিডিয়া আর স্মার্টসিটির বাইরে কবে থেকে যেন হেঁটেই চলেছে আরেকটা ভারত। এতদিনে তাদের অন্তত নামটুকু নথিবদ্ধ থাকার কথা ছিল সরকারের কাছে। কথা ছিল, কিন্তু নেই আসলে, আর সেজন্য আমরা ন্যুনতম লজ্জিতও নই, প্রশ্নও করি না কেন অভিবাসী শ্রমিকদের তালিকা নেই সরকারের কাছে? কেন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও গ্রামীণ মেয়েদের এত হাঁটতে হবে শুধুমাত্র জলের জন্য? বইটা আমাদের জ্বলন্ত এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় ‘সুনাগরিক’এর দায়িত্ব পালন করি নি আমরাও। ... ...
মেঠোবই – বাঙলার জীববৈচিত্র্য পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র্য পর্ষদ ... ...
পরপর দুটি স্মৃতিকথা পড়া হয়। প্রথম বাশারাত পীর লিখিত ‘কার্ফ্যিউড নাইট’ এবং সেই সূত্রে রেফারেন্স পেয়েই বিপ্রতীপের আখ্যান রাহুল পন্ডিতা লিখিত ‘আওয়ার মুন হ্যাজ ব্লাড ক্লটস’। পীরের লেখা আমাকে আমূল কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। আফস্পা নামক আইনটি এবং সেই রক্ষাকবচের আড়ালে কাশ্মীর বা মণিপুরে ভারতীয় সেনার দানবীয় রূপের কিছু কিছু কথা জানা ছিল, জানা ছিল না এই ভয়াবহ অত্যাচার আর অবিশ্বাসের আবহাওয়ার। জানা ছিল না সরকার তথা সেনাবাহিনী অথবা সন্ত্রাসবাদী তথা স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীর এই দুই পক্ষের মধ্যে কোন একটির আওতায় থাকতে বাধ্য প্রতিটি মানুষ। জানা ছিল না এমনকি পক্ষাবলম্বনের পরেও সেই পক্ষের মধ্যে থাকতে পারে অজস্র ছোট পক্ষ যাদের মধ্যের বাদানুবাদে যেকোন মুহূর্তে বিপন্ন হতে পারে মানুষের সর্বস্ব। প্রায় নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে পীর লিখে গেছেন কাশ্মীরের অসহায় বিপন্ন দিনরাতের জ্বলেপুড়ে যাওয়ার কাহিনী। পন্ডিতা নিজে কাশ্মিরী পন্ডিত, লেখা সত্যি বলতে কি বড় বেশী পার্টিজান, খুব যে ভাল লেগেছে পড়তে তা নয়, কিন্তু এ বইও আমার জন্য আই ওপনার। কাশ্মীরি পন্ডিতদের আতঙ্ক ও অসহায় পলায়ন ঠিক এভাবে জানা ছিল না। ... ...