এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভ্রমণ  দেখেছি পথে যেতে

  • দ্বাদশ গিরিবর্ত্মের দেশে - ৩

    লেখকের গ্রাহক হোন
    ভ্রমণ | দেখেছি পথে যেতে | ০৭ আগস্ট ২০২৫ | ৭৩ বার পঠিত
  • শ্রীনগর | জোজিলা কার্গিল | লামায়ুরু সিন্ধু-জাঁসকার সঙ্গম পাত্থরসাহিব
    এই লেখাটা ছেড়ে গিয়েছিলাম প্রায় এক বছর আগে। তালেগোলে সময় গড়াতে গড়াতে আরো একবার ঘুরে আসা গেল দ্বাদশ গিরিবর্ত্মের দেশ থেকে। সেবারে লিখতে লিখতে যে সব 'হলেই হতে পারত কিন্তু হয় নি ট্যুর কন্ডাকটারের অজ্ঞান ঔদাসিন্যে' দু:খগুলো উথলে উঠছিল এবারে সেটা সম্পূর্ণ মিটিয়ে আসতে পারার তৃপ্তিতে খুশীমনে আবার হাত দিলাম লেখাটায়। গতবার আর এবারের অভিজ্ঞতা পাশাপাশিই চলবে।

     তাহলে চলুন যাই ৩১শে আগস্ট ২০২৪ এর সকালে। প্রাতরাশ সেরে আমাদের বেশ কিছুক্ষণ বসতে হল। আসিরভাই তৈরী নন তখনো। গাড়ি ধুয়েমুছে নিজে তৈরী হতে হতে বাজল নটা। ট্যুর কন্ডাকটার বিল মিটিয়ে আসার পরে যখন গাড়ি ছাড়ল ততক্ষণে প্রায় সাড়ে নটা। পাহাড়ি এলাকা হিসেবে যথেষ্ট বেলা। শুনলাম আজ আমরা দেখব লামায়ুরু গোম্পা আর লেহ শহরে ঢোকার আগে দু একটা জায়গা। আমার কেমন আবছা মনে হচ্ছিল এইটুকু তো নয়, আরো কিছু তো পথে আসার কথা।

     এইখানে আমার একটা মারাত্মক ভুল হয়েছিল। প্রতিদিনের আনুমানিক যাত্রাপথ আর দ্রষ্টব্যের একটা নোট সঙ্গে নিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল। বারবার চেয়েও ফাইনাল ইটিনেরারি যখন পাই নি তখন এটা বানিয়ে নেওয়া আরো বেশী জরুরী ছিল। আবছা মনে পড়ছিল কার্গিল আর লামায়ুরুর মাঝে একটা মস্তবড় বুদ্ধমূর্তি আছে, আর আলচিও সম্ভবত এই পথেই। কী যেন লিখেছিলাম... মোবাইলে নোট খুঁজতে গিয়ে দেখি নেই নেইই নেইইই।

     
     কার্গিল থেকে লেহ রোডম্যাপ

     আসার ঠিক আগে মোবাইল বদলাতে হয়েছে। নতুন মোবাইলে এই নোটটাই আসে নি। ইমেলেও নেই। যাহ! পরে কার্গিল থেকে লেহ যাত্রাপথের ম্যাপ দেখে বুঝি লামায়ুরু ছাড়াও মুলবেক ও আলচি গোম্পাও পথেই পড়ে। সামান্য ডিট্যুর করেই দেখে নেওয়া যায়। আলচির কথা আমি ট্যুর কন্ডাকটারকে জিজ্ঞাসাও করেছিলাম, 'হ্যাঁ দেখছি' বলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। মুলবেকের গোম্পাটি NH1 এর ধারেই, রাস্তা থেকে ৬৫৬ফিট উঁচুতে পাহাড়ের উপরে স্থাপিত।

     মুলবেক অঞ্চলে গিয়ে কন্ডাকটর মশাই বলেন এখানে পাহাড়ের উপরে একটা মস্ত বুদ্ধমূর্তি আছে, অনেক দূর থেকে দেখা যায়। তখন মুলবেকের বুদ্ধ সম্পর্কে পড়াশোনা করে না আসায় আমরা আর দাঁড়াতে বলিও নি। এটা একেবারে বাজে মিস হয়েছে আমাদের। চলতি গাড়ি থেকে যেটুকু দেখি এক পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা সুবিশাল বুদ্ধমূর্তি। লাদাখের বামিয়ান বলে খ্যাত ৩০ফিট উঁচু মৈত্রেয়বুদ্ধের এই মূর্তি অষ্টম শতকে পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে তৈরী।

     কুষাণযুগে আফগানিস্তান ও ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পাথরে খোদাই করে বুদ্ধমূর্তি বানানোর প্রচলন হয়। সেই ধারা অনুসারেই বামিয়ানের বুদ্ধদ্বয় পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে তৈরী। বামিয়ান ধ্বংস হওয়ার পরে বলা হয় পাথরে খোদাই বুদ্ধমূর্তির মধ্যে মুলবেকের বুদ্ধই সবচেয়ে উঁচু। সেবারে ফিরে আসার পর এসব জেনে বড্ডই দু:,খ হয়েছিল। এবারেও ওদিকটা যাওয়া হয় নি। সুরু ঊপত্যকা ও জাঁসকার উপত্যকায় এরকম পাথরখোদাই মূর্তি আরো কিছু আছে। ইচ্ছে আছে সবকটা মূর্তি ও গোম্পা দেখার জন্য একবার যাবো।

     এপথে দুটো উঁচু পাস পড়ে। নমিকা-লা আর ফোটু-লা। নমিকা-লা উচ্চতা ১২১৯৮ ফিট, পৌঁছে গাড়ি থেকে নামতে না নামতেই হই হই করে একদল সাইকেল আরোহী এসে হাজির। এঁরা আর্মির কোন একটা ডিভিশান থেকে বেরিয়েছেন কার্গিল যুদ্ধের ২৬ বছর উদযাপন করতে। পাসে উপস্থিত সমস্ত পর্যটককে জড়ো করে সবাই মিলে দু তিনখানা ছবি তুললেন। সমরেশদা এঁদের সাথে খানিক গপ্প সপ্প করলেন ততক্ষণ বৌদি আর আমি ঘুরে ঘুরে ছবি তুললাম।

     
     ফোটু-লা

     শ্রীনগরের সেই ঘোলাটে মেঘলা আকাশ ছেড়ে আমরা এখন অতি নীল আকাশের নীচে। এমন চোখ ধাঁধানো নীল যে সানগ্লাস ছাড়া তাকানোই যায় না। তীব্র নীল আকাশ আর হলদে বাদামী পর্বতশ্রেণী, অনেক নীচে কোথাও ঘন সবুজ প্যাচ দেখলে বুঝতে হবে নদী বা জলাশয় কিছু আছে। ফোটু-লা উচ্চতা ১৩৪৭৮ফিট, পৌঁছে আবারো একদফা ছবি তোলা। ফোটু-লায় রাস্তার পাশে একটা চমৎকার ট্যুরিস্ট ম্যাপ বোর্ড আছে।

     
     ট্যুরিস্ট ম্যাপ - ফোটু-লা

     শুনলাম আমরা মধ্যাহ্নভোজ সারবো লেহ শহরে ঢোকার আগে কোন একটা আর্মি ক্যাম্প লাগোয়া ক্যাফেতে। কাজেই এখন আর থামাথামি নেই, সোজা লামায়ুরু। Nope গ্রাম ও গোম্পা সংলগ্ন অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি দেখতে অনেকটা চন্দ্রপৃষ্ঠের মত দেখায় বলে এই এলাকাকে মুনল্যান্ড বলে। স্পিতিভ্যালিতে লোসার ও কাজার মধ্যে এক অংশেও এরকম চন্দ্রপৃষ্ঠের আকৃতি দেখেছি। লামায়ুরুর চন্দ্রভূমি বেশ হলদেটে রঙের। তুলনায় লোসারের পরের চন্দ্রভূমি অনেক সাদাটে, অনেক বেশী চন্দ্রসদৃশ লেগেছে আমার কাছে।

     
     মুনল্যান্ড ১

     
     মুনল্যান্ড ২

     
     মুনল্যান্ড ৩

     রূপম একবার বললেন ওই দেখুন মুনল্যান্ড, তবে গাড়ি দাঁড়ালো না। অবশ্য আমরাও বলি নি। অনেক পর্যটক এখানে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলেন। আমি চলতি গাড়ি থেকেই কয়েকটা ছবি নিলাম। লামায়ুরুতে দেখলাম গোম্পার পার্কিং থেকে বিশেষ হাঁটা নেই। ৫০/- টাকার টিকিট কেটে ঢুকলাম। বাজে দুপুর দুটো, ফলে মূল মন্দির বন্ধ। তবে ঘুরেফিরে অনেকটাই দেখা যায়। লামায়ুরু গোম্পা বহু আগে ইয়াংদ্রুং গোম্পা নামে পরিচিত ছিল।

     
     লামায়ুরু

     
     লামায়ুরু  স্তুপ চোর্তেন 

     এই নাম থেকে বোঝা যায় এই গোম্পা প্রাক বৌদ্ধযুগের তিব্বতী বন ধর্মানুসারি ছিল। বৌদ্ধ প্রভাবে অনেকটাই ঢাকা পড়ে গেলেও বন ধর্ম তার সব বৈশিষ্ট্য হারায় নি। এঁদের ধর্মাচরণে একটা উল্লেখযোগ্য দিক হল চোর্তেন পরিক্রমার সময় এঁরা ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে পরিক্রমা করেন। বৌদ্ধ ও হিন্দুরা ঘড়ির কাঁটার দিকে করেন। এখানকার সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপনা একাদশ শতকের। গোম্পার বারান্দায় বুদ্ধের জীবনের কাহিনী নিয়ে ঝলমলে ম্যুরাল দূর থেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

     
     লামায়ুরু  গুরু পদ্মসম্ভবের মন্দির

     অন্যান্য অনেক গোম্পার মত লামায়ুরুতেও একটা অতিথিশালা আছে যেখানে নামমাত্র খরচে পর্যটকরা গিয়ে থাকতে পারেন। অতিথিশালার নামটা ভারী সুন্দর, নিরঞ্জনা। লেহ বাসস্ট্যান্ড থেকে লামায়ুরুতে আসার জন্য দৈনিক বাস ছাড়ে মে থেকে সেপ্টেম্বর অবধি। এই গোম্পার ভেতরে ভারতী বৌদ্ধ মহাসিদ্ধাই নারোপার সাধনগুহা আছে। মিলারেপার সাথে যুক্ত কিছুও আছে। কিন্তু কী সেটা বুঝিয়ে দেবার মত কাউকে পেলাম না।

     গোম্পা দেখে বেরিয়ে আমরা ঢুকলাম স্যুভেনিয়র দোকানে। বাপরে কি প্রচন্ড দাম সব জিনিষের! খানিক দেখেটেখে আবার রওনা। এতক্ষণে প্রাতরাশ হজম টজম হয়ে তুমূল খিদে পেয়েছে সবারই। কিন্তু সেই আর্মি ক্যাম্প আর আসে না, চলেছি তো চলেইছি। বেলা তিনটের পর পৌঁছানো গেল সেখানে। টোস্টেড স্যান্ডউইচ আর কফি খেয়ে পেটবাবাজিকে শান্ত করে ক্যাম্প সংলগ্ন জ্যাকেট ইত্যাদির দোকানটা দেখতে গিয়ে দেখি বন্ধ, মধ্যাহ্নভোজের বিরতি। খুলবে বিকেল চারটে, মানে আরো আধঘন্টা।

     
     সঙ্গম ভিউপয়েন্ট

     খামোখা আর না দাঁড়িয়ে আবার চলা। লেহমুখী হাইওয়ের এক জায়গায় রূপম বললেন ওই দেখুন সিন্ধু আর জাঁসকারের সঙ্গম। ওবাবা সে তো অনেএএক নীচে। সমরেশদা তাড়াতাড়ি এই নামবো নামবো করে গাড়ি দাঁড় করালেন। নেমে দেখি একে তো নদী, সঙ্গম প্রায় দুশো ফিট নীচে, তায় রোদ্দুরের চোটে পুরোটাই সাদাটে দেখাচ্ছে। শুনলাম নীচে নাকি যাওয়া যাবে না। এই গাড়ি শ্রীনগরের তাই এ সোজা লেহতে ড্রপ করতে পারবে, কোন সাইটসিয়িং করাতে পারবে না।

     
     হাইওয়ে ভিউপয়েন্ট থেকে সিন্ধু জাঁসকারের সঙ্গম

     পরে হোটেলে পৌঁছে আমরা নিজেদের তোলা ছবিগুলো দেখছিলাম। সঙ্গমের কাছাকাছি বেশ কিছু গাড়ি দেখা যাচ্ছে। তার মানে গাড়ি তো যায়। দেখা যাক পরের দিন সাইটসিয়িঙের সময় যাওয়া হয় কিনা। গাড়ি ইতোমধ্যে পাত্থরসাহিব গুরুদ্বোয়ারার সামনে দিয়ে পেরোচ্ছে। রূপম বললেন থাক থাক এখন এতটা পাহাড় চড়ে অক্সিজেনের ঘাটতি করিয়ে দরকার নেই। অনেক উঁচুতে পাহাড়ের উপরে কিছু একটা দেখা যাচ্ছিল বটে।

     এলো ম্যাগনেটিক হিল। যেখানে পাহাড়ের সামনের রাস্তায় একটা নির্দিষ্ট জায়গায় দাগ কাটা আছে। গাড়ি নিউট্রালে রেখে ছেড়ে দিলে আস্তে আস্তে উপরের দিকে ওঠে। সেসব মোটামুটি দায়সারাভাবে দেখা শেষ করে তাড়াতাড়ি হোটেলে। আমাদের নামিয়ে দিয়েই আসিরভাই শ্রীনগর ফেরত যাবেন। দুদিনের রাস্তা, সারারাত চালিয়ে একদিনেই কভার করে নেবেন। ভাবি ওঁর যখন এত তাড়া তাহলে সকালে তো আরো তাড়াতাড়ি তৈরি হওয়া উচিৎ ছিল!

     এই গোটা ট্রিপেই সারথিমশাইদের দেরী আমাদের প্রতিদিন দেরী করিয়েছে। আসলে ট্যুর কন্ডাকটরের তরফে এক্সপেক্টেশান সেট করে দেওয়া দরকার ছিল যে আমরা প্রতিদিন ৭টা কি সাড়ে সাতটায় বেরোব, তার মধ্যেই উনি যেন তৈরী হয়ে থাকেন। সেটা না হওয়ায় অযথা দেরী হয়েছে। যাই হোক লেহতে আমাদের হোটেল কন্টিনেন্টাল লাদাখ। হোটেলটা ভাল, পরিষেবা ভাল, খাওয়া দাওয়া চমৎকার। বিকেল পৌণে পাঁচটা, রোদ্দুর তখনও বেশ কড়া।

     কাট ট্যু ৬ই জুলাই ২০২৫
     ফাইনালি সিন্ধুনদীর জল ছুঁতে পারলাম। ক্কি ঠান্ডা জল বাপস! ওই ২০০ফিট উপর থেকে ওই যে ওই দেখুন জাঁসকার আর সিন্ধুর সঙ্গম, ও এক্কেবারে পোষায় নি গতবার। পরে লেহ সাইটসিয়িঙের দিনেও ওইদিকে যাওয়া হয় নি সময়াভাবে। সে আরেক গল্প, বলছি যথাস্থানে। লেহর লোকাল ড্রাইভার শুনে হেসেই বাঁচেন না। বললেন লেহর সাইটসিয়িঙে ওঁরা সবসময় নীচে নিয়ে যান। যত্ন করে র‍্যাফটিং পয়েন্ট অবধি নিয়ে গেলেন।

     সেখানে চমৎকার বাঁধানো সিঁড়ি। নেমে মহানন্দে খানিক জল ঘাঁটলাম। মুখচোখ ধুলাম। র‍্যাফটিং বোটগুলো ফিরছে একে একে। এমনিতে সিন্ধুর জল সবজে নীল। কিন্তু জুন থেকে গ্লেসিয়ারগলা জল মিশতে থাকে আর জুলাই থেকে বৃষ্টিও শুরু হয়, ফলে জলের রঙ এখানে ঘোলামত। আর জাঁসকার বরাবরই কাদাগোলা রঙের। পরে অন্যদিকে যেখানে এখনো বৃষ্টি শুরু হয় নি, প্রায় সবুজ সিন্ধুর দেখা পেয়েছি। অক্টোবর থেকে মে অবধি এখানে পান্নাসবুজ সিন্ধুর দেখা মেলে।

     
     সিন্ধু জাঁসকার সঙ্গম র‍্যাফটিং পয়েন্ট

     জাঁসকার সিন্ধুর ভিডিও দেখতে চাইলে ইউটিউবে।

     https://youtube.com/shorts/lurgn8ZsXLY?si=7BJPBcMRJBKrUhvp

     ৬ই জুলাই গতবারের না দেখা জায়গাগুলো দেখতে বেরিয়ে প্রথমে গিয়েছিলাম পেট্রোগ্লিফের খোঁজে। সে গল্প আলাদা করে বলার মত। পেট্রোগ্লিফ খুঁজতে খুঁজতে প্রাতরাশ হজম হয়ে বেশ খিদে পেয়ে গেছে। সারথি আংডুভাই বললেন চল আমরা পাত্থরসাহিব গুরুদ্বোয়ারার লঙ্গরে খাবো, আপত্তি নেই তো? না না সে তো নেই, আমি লঙ্গর পেলেই বসে পড়ি। কিন্তু আঁতকে উঠে বললাম এত হাঁটাহাঁটির পর আমি অতটা পাহাড়ে উঠতে পারবো না বাপু। আগে খাওয়া তারপরে পাহাড়ে চড়া।

     আংডুভাই অবাক হয়ে বলে পাহাড়ে কেন? পাত্থরসাহিবে যাবো তো। সে তো মোটেও পাহাড়ের উপরে নয়, একদম রাস্তার পাশে। পাহাড়ের উপরে গুরুদ্বোয়ারা সাহিব আর রাস্তার পাশে পাত্থরসাহিব। এত সাহিব শুনে তো আমার মাথাটা গেল গুলিয়ে। গাড়ি দিব্বি গুটগুট করে রাস্তার পাশে পার্কিঙে গিয়ে দাঁড়ালো। নেমে জুতোটুতো ছেড়ে মাথায় কমলা রুমাল বেঁধে ঢুকলাম পাত্থরসাহিবে। আইব্বাপ সে এক মস্ত পাথর, যাতে নাকি গুরু নানকের দুই কাঁধ ও পিঠের ছাপ আছে বলে প্রচলিত বিশ্বাস।

     
     পাত্থরসাহিব (ঠেস দিয়ে বসায় পিঠ ও কাঁধের ছাপ পড়েছে)

     পাথরটা দেখে বোঝা যায় সুন্দর ঠেস দিয়ে বসার মত। দেখে ঘি চপচপে হালুয়া প্রসাদ খেয়ে গেলাম লঙ্গরে। বাসনের স্ট্যান্ড থেকে থালা আর গেলাস নিয়ে আমি আর আংডুভাই গিয়ে একটা আধাখালি পংক্তিতে গিয়ে মাঝামাঝি যেখান থেকে খালি সেখানে পরপর বসে গেলাম। লঙ্গরে বসার এটাই নিয়ম। যত অবধি ভর্তি তার ঠিক পরে প্রথম লহালি জায়গায় বসতে হয়। আলাদা করে কোন পুরো খালি পংক্তিতে বসা যায় না।

     
     পাত্থরসাহিব পাশ থেকে

     লঙ্গরে যেমন থাকে, ভাত, রুটি, ডাল, দুটো তরকারি, পাঁপড় আর পায়েস। একটা তরকারি ফুরিয়ে গেছে, আবার তৈরী হচ্ছে, আসতে মিনিট পনেরো কুড়ি লাগবে জানিয়ে একজন কচিমত সর্দারজি দু:খ প্রকাশ করে গেলেন। আমি খেয়েদেয়ে, থালা ধোবার জায়গায় পৌঁছে দিয়ে আংডুভাইকে ধীরেসুস্থে খেতে বলে বসিরে এলাম গল্পের খোঁজে। ঢুকেই প্রথম বড় হলের সামনেই একজন বেশ বয়স্ক সর্দারজি বসে আছেন, তাঁর গোঁফ, ভুরু, চোখের পাতা অবধি সাদা ধবধব করছে।

     তাঁকেই গিয়ে পাকড়াও করলাম। 'সর্দারজি এক বাত পুঁছু?' 'হাঞ্জি জরুর বেটা, বোলিয়ে।' অত:পর জানা গেল গুরু নানক সিকিম নেপাল তিব্বত ঘুরে কার্গিল শ্রীনগর হয়ে ফেরার সময় এই অঞ্চলে বেশ কিছুকাল ছিলেন। এখানে বৌদ্ধরাও তাঁকে খুব মান্য করে, এখানে তিনি নানক লামা নামে পরিচিত। তিনি পাহাড়ের নীচে এইখানে বসে শিষ্যদের উপদেশ দিতেন। সেই সময় এই অঞ্চলে এক রাক্ষসের খুব উপদ্রব ছিল। সবাই ভয়ে তটস্থ।

     নানকের উপস্থিতিতে মানুষজন রাক্ষসকে পাত্তা দিচ্ছে না, ভয়কে জয় করে ফেলছে দেখে ভীষণ রেগে রাক্ষস ঠিক করল নানককে মেরে ফেলবে। সেইমত ওওই পাহাড়ের উপর থেকে এই মঅস্ত বড় পাথরটা নানককে লক্ষ্য করে দিল গড়িয়ে। এদিকে নানক তখন ধ্যান করছিলেন, কিছুই জানেন না। পাথরটা কিন্তু গড়গড়িয়ে গড়াতে গড়াতে নানকের কাছাকাছি এসে গলন্ত মোমের মত নরম হয়ে থামল।

     রাক্ষস তো মহা খুশীতে লাফাতে লাফাতে নীচে এসে দেখে নানক দিব্বি ধ্যান করছেন আর পাথরটা তাঁর পিঠে ঠেকনার মত সাপোর্ট দিয়ে রয়েছে। দেখে রেগে আগুন তেলে বেগুন হয়ে রাক্ষস পাথরের উপরে সজোরে পা দিয়ে চাপ দিল যাতে চাপে পড়েই মারা যান গুরু। কিন্তু পাথর তো তখনো মোমের মত নরম, তাই গুরুর কিচ্ছুই হল না, কিন্তু রাক্ষসের পা'টি গেল পাথরে আটকে। রাক্ষস এতক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পেরে নানকের শিষ্য হয়ে গেল। পা টেনে তুলে নেওয়ার পরে পাথরে উপরে রাক্ষসের পায়ের ছাপ রপ্যে গেছে।

     এই হল গিয়ে পাত্থরসাহিবের গল্প। ওই মোমের মত অবস্থায় নানকের পিঠ ও কাঁধের ছাপ রয়ে গেছে তাই এটা বৌদ্ধ ও শিখ উভয় ধর্মের কাছেই পবিত্র। মাঝে বহুকাল এই পাথরের কথা স্থানীয়রা ভুলে ছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী এই লেহ শ্রীনগর হাইওয়ে বানাবার সময় একটা মস্ত বোল্ডার দেখে প্রথমে সরাবার চেষ্টা করে। আর্থ মুভার দিয়েও কোনভাবে সরাতে না পেরে শেষে ডিনামাইট দিয়ে গুঁড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে। তারপর নানা লোকে স্বপ্ন টপ্ন দেখে, বিভিন্ন গোম্পা থেকে লামার এসে বারন করেন ইত্যাদি প্রভৃতি।

     পাহাড়ের উপরের গুরুদ্বোয়ারাসাহিব হল অতি প্রাচীন গুরুদ্বোয়ারা, গুরু নানকের সময় স্থাপিত। শিখদের কাছে দুটিই পবিত্র স্থান। তবে সাধারণ পর্যটক উপরে ওঠে চমৎকার ভিউ পাবার জন্য।  ওখান থেকে চারিদিকের উপত্যকা ও লেহ শহর অপূর্ব দেখায়। আমি অবশ্য গুরুদ্বোয়ারাসাহিবে আর উঠি নি। সর্দারজিকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে লেহ প্যালেসে চলে গিয়েছিলাম। আবার ফেরত যাই ৩১শে আগস্ট ২০২৪এ। হোটেল থেকে সেদিন আর কোথাও যাই নি, অ্যাক্লেমেটাইজ করার জন্য শুয়ে বসে আর অল্পস্বল্প হাঁটাহাঁটি করেই বাকী দিনটুকু কাটিয়ে দিয়েছিলাম। 
     
    (চলবে)
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    শ্রীনগর | জোজিলা কার্গিল | লামায়ুরু সিন্ধু-জাঁসকার সঙ্গম পাত্থরসাহিব
  • ভ্রমণ | ০৭ আগস্ট ২০২৫ | ৭৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • . | ০৭ আগস্ট ২০২৫ ২৩:০৯733099
  • চলুক 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন