এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভ্রমণ  দেখেছি পথে যেতে

  • দ্বাদশ গিরিবর্ত্মের দেশে - ১

    লেখকের গ্রাহক হোন
    ভ্রমণ | দেখেছি পথে যেতে | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪১৯ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)

  •  
    কারাকোরাম ও হিমালয় পর্বতশ্রেণীর মাঝে রঙ বেরঙের রুক্ষ পর্বত আর  বিস্তৃত পাথর, বালুকাময় ভূমি, মাঝে মাঝে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া পান্নাসবুজ নদী ও নদীখাত, কোথাও সামান্য কিছু গুল্ম কোথাও বা মাটিছোঁয়া কিছু ঘাস, অতি উজ্জ্বল নীল জলের কয়েকটা হ্রদ নিয়ে অপ্রাকৃত সৌন্দর্য্যের লাদাখ যখন পর্যটকদের জন্য প্রথম উন্মুক্ত হয় ১৯৭০ এর দশকে, তখনো বছরে ছয়মাসের বেশী সময় এই অঞ্চল ঢাকা পড়ে থাকত পুরু বরফের চাদরে। রাস্তা বলতেও বিশেষ কিছু ছিল না। উত্তরে কারাকোরাম পাস পেরিয়ে চীনের জিনজিয়াং, দক্ষিণে হিমালয়, হিমাচল প্রদেশ,পশ্চিমে জম্মু কাশ্মীর ও পাকিস্তানের গিলগিট বালতিস্তান আর পূর্বে তিব্বত ও আকসাই চীন এই হল লাদাখের সীমানা। ‘লা’ শব্দের মানে উঁচু গিরিপথ আর দাখ হল দেশ বা অঞ্চল। লাদাখ শব্দের আক্ষরিক অর্থ সুউচ্চ গিরিবর্ত্মের দেশ।

    অতীতে শীতে ছয়মাস বা তার কিছু বেশী সময় লাদাখ বাইরের পৃথিবীর সাথে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকত, গ্রীষ্মেও যাতায়াত খুব সুগম ছিল না। যাতায়াতের পথ বলতে এই গিরিপথগুলোই ভরসা, তখনও এখনও। মোটরগাড়ি চলার উপযুক্ত পৃথিবীর উচ্চতম প্রথম ও দ্বিতীয় গিরিপথ এই লাদাখেই। গুরুত্বের বিচারে বারোটা গিরিপথকে মুখ্য ধরা হয়। এগুলো হল
    ১) উমলিং লা (১৯০২৪ফিট / ৫৭৯৯ মিটার)
    ২) খারদুঙ লা (১৭৯৮২ ফিট /৫৩৫৯ মিটার) 
    ৩) চাঙ লা  (১৭৬৮৮ ফিট / ৫৩৯১ মিটার)
    ৪) তাগলাঙ লা
    ৫) বড়া-লাচা লা
    ৬) লুঙ্গালাচা লা (লাচুঙ লা)
    ৭) পেনসি লা
    ৮) নমিকা লা
    ৯) ফোতু লা
    ১০) জোজি লা
    ১১) কারা-তাঘ লা (কারাকোরাম পাস) 
    ১২) কোঙ্কা লা

    এখন অবশ্য আকাশপথে যোগাযোগের সুবিধা থাকায় এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর বহুল উপস্থিতির ফলে সারা বছরই যাতায়াত থাকে। তবে তীব্র শীতের ৫-৬ মাস সাধারণ পর্যটকের চলাচল প্রায় বন্ধই থাকে। বেশ কিছ জায়গায় যাবার অনুমতিও সাধারণত দেওয়া হয় না। মোটামুটি এপ্রিলের শেষ, মে’র শুরু থেকে অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত পর্যটকের আনাগোণা থাকে। কোনওবার তুষারপাত আগে শুরু হলে, পর্যটনও অক্টোবরের মাঝামাঝিই বন্ধ হয়ে যায়। তিব্বতের সাথে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও তিব্বতী বৌদ্ধমতাবলম্বী একাধিক গোম্পার উপস্থিতির কারণেই এই অঞ্চলে প্রচুর লামার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। তিব্বতী বৌদ্ধমতে লামারা অত্যন্ত সম্মানিত আধ্যাত্মিক গুরু। এইজন্য লাদাখ যেমন গিরিবর্ত্মের দেশ, তেমনই লামাদের দেশ নামেও পরিচিত।

    তো এহেন লাদাখ আমার স্বপ্নের গন্তব্য হয়ে আছে সেই ১৯৯৮ সাল থেকেই। সেই সময় ম্যাকলিয়ডগঞ্জে বেড়াতে গিয়ে দালাই লামার বক্তব্যে লাদাখের কথা প্রথম শুনি। তারপরে তো নানা বইপত্র ইত্যাদি। কার্গিলযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কার্গিল ওয়্যার মেমোরিয়াল ইত্যাদিও হয়ে দাঁড়ায় পর্যটনস্থল। শ্রীনগর থেকে সড়কপথে লেহ গিয়ে লাদাখের অন্যান্য অংশ ঘুরে পরে মানালি হয়ে ফিরলে প্রায় পুরো সার্কিট ঘোরা যায়। তাছাড়া অ্যাক্লিমেটাইজেশানও বেশ ভালভাবে হয়। আকাশপথে সরাসরি লেহ গিয়ে নামলে সেটা হয় না। সেক্ষেত্রে লেহতে অন্তত দুইদিন থেকে ফুসফুসকে কম অক্সিজেনে কাজ চালাতে শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হয় আর কি। লাদাখ এমনিতে বেশ ব্যায়বহুল জায়গা, গাড়িভাড়া যথেষ্ট বেশী। আর গণপরিবহন প্রায় নেইই বলতে গেলে। ফলে সোলো ট্রিপ খুবই খরচসাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায়।

    খুব বড় গ্রুপের সাথে যাওয়াও খুব একটা সুবিধেজনক হবে না। বিশেষ করে আমার যে সব ব্যপারে আগ্রহ, সেরকম গ্রুপ ট্যুরে পাওয়া সহজ নয়। তো অরুণাচল ট্রিপে  আলাপ হওয়া সমরেশ হালদার-দাদার সাথে বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনা চলছিল কীভাবে টেম্পো ট্রাভেলার কাটিয়ে ইনোভা বা জাইলো্ জাতীয় ছোট গাড়িতে ভ্রমণটা  করা যায়। সেই সূত্রেই রূপম মুখার্জিকে বলা (ইনিই অরূণাচল ট্রিপ অ্যারেঞ্জ করেছিলেন), এবং উনি একটা ট্যুর প্ল্যান দিলেনও। আমি তাতে হানলে যোগ করতে বলায় রাজীও হলেন। সমরেশদা বৌদির যাওয়ার উপযুক্ত সময় ধরে ঠিক হল আগস্টের শেষে রওনা হব, শ্রীনগর পৌঁছে সেখান থেকে যাত্রা শুরু। আমরা তো যাওয়া আসার টিকিট কেটে তৈরী। একটা ছোট সমস্যা যা দেখলাম হানলে ঢোকানোর পরে ১২ রাত ১৩ দিনের বিস্তারিত প্ল্যানটা আর পাওয়াই গেল না।

    প্রচুর ফলোয়াপের পরে খুবই স্কেচি একটা আউটলাইন পাওয়া গিয়েছিল যাত্রার দুই তিনদিন আগে, তো সেটা তখন তেমন সমস্যাজনক মনে হয় নি। পরে গিয়ে বুঝেছিলাম মুশকিলটা কোথায় হয়েছে। তো যাক সে কথা আপাতত, যথাস্থানে বলবো। পরিকল্পনামাফিক ২৮শে আগস্ট দুপুরে কলকাতা থেকে শ্রীনগরগামী বিমানে চেপে বসা গেল। বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ শ্রীনগর পৌঁছে দেখি ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে। পছন্দ করে ডানদিকের জানলায় সিট নিয়েছিলাম, কিন্তু হায় পুরো হিমালয়ান রেঞ্জই পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের আড়ালে লুকিয়ে রইলো। হোটেল যাওয়ার পথে সারথি জানালেন গতকাল অর্থাৎ ২৭ অবধি তীব্র গরম ছিল, আজই সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমরা মনোরম আবহাওয়া পাবো। আমাদের গন্তব্য হোটেল বেলমন্ট। এমনিতে ভালই, খাওয়াদাওয়াও মন্দ নয়।

    হোটেলে  ঘরে ঢুকে দেখি রীতিমত সিলিং ফ্যান, এসি লাগানো। রাতে পাখা চালাতেও হয়েছে। এর পরেও লেহ, কারগিল, মানালিতে ঘরে স্ট্যান্ড ফ্যান দেখেছি। চালাতেও হয়েছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিঙের ঠ্যালা ভালই বোঝা যাচ্ছে এমনকি হিমালয়ের অন্দরেও। ঘরে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে পনির পকোড়া আর চা খেয়ে খানিক গল্পস্বল্প করা গেল। রূপমের গ্রুপের অন্যান্য যাত্রীরা যাত্রা বাতিল করায় আমি সমরেশ হালদারদাদা আর বৌদি এই তিনজনই পর্যটক। রূপমও এসেছেন আমাদের সাথে। মোট ৪ জন। রাতে খাবার পর হোটেলের সামনে হাঁটতে বেরিয়ে দেখা গেল অল্প অল্প শিনশিনে ঠান্ডা, উইনচিটার হলেই চলে যায়। আমি এনেছি একটামাত্র ডাউন জ্যাকেট, খারদুং-লা, প্যাঙগঙের কথা ভেবে। আর একটা ফ্লিস। সমরেশদাও ওইরকম একটা মোটা জ্যাকেট। উনি বললেন একটা উইনচিটার চাইই চাই।

    বেলমন্ট হোটেলটা একটু ঘিঞ্জিমত জায়গায়, জানলা দিয়ে তাকালে আরো চাট্টি হোটেলের দেওয়াল বা বড়জোর হোটেলের গেটখানা দেখা যায়। ভেতরেও লবি বা কমন এরিয়া বলতে বিশেষ কিছু নেই। একরাত্তির থাকার জন্য ঠিকই আছে, তার বেশী নয়। আমরা অবশ্য দুই রাত থাকবো। শুনলাম ডাল লেক নাকি পায়ে হেঁটে ৫-৭ মি্নিট। কিন্তু  নাহ পরে দেখলাম ডাল লেকের নিকটতম প্রান্তও অন্তত সোয়া দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার হবে। গুগলে দেখালো দশ কিলোমিটার। রাত ন’টার পরে বড়রাস্তার অধিকাংশ দোকানই বন্ধ, একটামাত্র জ্যাকেটের দোকান খোলা দেখে উইনচিটারের খোঁজে সমরেশদা দাঁড়ালেন। উইনচিটার পাওয়া গেল না বটে, তবে বৌদি একটা পাতলা জ্যাকেট নিয়ে নিলেন। হোটেলে ফিরে ঘুম, পরেরদিন প্রাতরাশের পরে শ্রীনগর দেখতে বেরোন হবে।

    ২৯ তারিখ সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। বেরিয়ে আমরা প্রথমে চললাম শঙ্করাচার্য্যের মন্দির। জবরওয়ান পর্বতশ্রেণীর শঙ্করাচার্য্য পাহাড়ের উপরে অবস্থিত শঙ্করাচার্য্যের মন্দিরটা কাশ্মীরের প্রাচীনতম মন্দির। কলহনের লেখায় পাওয়া যায় “গোপাদ্রি” পাহাড়ে এই মন্দির তৈরীর জন্য খ্রীষ্টপূর্ব ৩৭১ সনে মহারাজ গোপাদিত্য ব্রাহ্মণদের জমি দান করেন, মন্দির বানিয়ে দেন। পরে খ্রীষ্টিয় অষ্টম শতকে আদি শঙ্করাচার্য্য এই মন্দির পরিদর্শনে আসেন। সেই থেকেই মন্দিরের নাম শঙ্করাচার্য্য মন্দির নামে পরিচিত হয়। ভেতরের বিগ্রহ শিবলিঙ্গ। মন্দিরে যাবার জন্য রাস্তা থেকে ২৩২খানা সিঁড়ি ভেঙে মন্দিরের উঠোন চত্বরে পৌঁছাতে হয়। পরে মূল মন্দিরে যেতে আরো ৩২টা সিঁড়ি, জুতো খুলে ওঠা। রাস্তা থেকে মন্দির চত্বর অবধি যাবার সিঁড়ি বেশ সহজগম্য, সমান উচ্চতার পরিস্কার মসৃণ পাথরের ধাপ। তবে চত্বর থেকে মূল মন্দিরে যাবার সিঁড়ি বেশ খাড়া।
     
     
    মন্দিরে যাবার সিঁড়ি 

    রাস্তা থেকে সিঁড়িতে পা দেবার আগেই সিয়ারপিএফের তল্লাশীকেন্দ্র। ক্যামেরার ব্যাগ পার্স খুলে দেখার পরে দেহ তল্লাশী সেরে তবেই সিঁড়ির দিকে যাওয়া। বৃষ্টি শুরু হয় নি, আকাশ মেঘে ভরা আর অল্প অল্প হাওয়া। সহজেই উঠে পড়া গেল। জুতো খোলার ঝঞ্ঝাটে না গিয়ে আমি মন্দির চত্বর ঘুরে ঘুরে দেখতে লেগে যাই। চত্বর থেকে ডাল লেকসহ শ্রীনগর শহরের অতি চমৎকার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। মেঘলা দিন হওয়ায় ছবি তেমন ভাল হল না, কি আর করা! পরবর্তী গন্তব্য বোটানিকাল গার্ডেন। সেখানে পৌঁছে রূপম জানালেন  এই বাগান দেখা শেষ করে বেরিয়ে আমরা যেন এখানকার অটো নিয়ে পরীমহল ও চশমেশাহী দেখে আসি। বাইরের গাড়ি ওই রাস্তায় যেতে দেয় না, স্থানীয় অটো নিয়েই যেতে হয়।
     
     
    মন্দির 

    কাশ্মীর লাদাখ জুড়ে এই ধরণের সিন্ডিকেটবাজী পরেও বেশ কয়েক জায়গায় পেয়েছি। বাইরের গাড়ি নিয়ে সেই সেই অঞ্চলের সাইটসিয়িং করা যাবেই না, স্থানীয় গাড়ি নিতে হবে। এমনকি বাইরের গাড়ি নির্দিষ্ট পয়েন্টে ড্রপ করতে এলেও বিভিন্ন জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। সারথিমশাই গাড়ি নিয়ে পার্কিঙে চলে গেলেন, আমরা তিনটে বাগান দেখা শেষ করে আবার এখানেই ফিরবো। পার্স আর ক্যামেরার ব্যাগ নিয়ে নেমেছি, রেনকোট আর হাইকিঙ স্টিক গাড়িতেই রয়ে গেল। বোটানিকাল গার্ডেনে ঢোকার টিকিট  ৩০ টাকা। এই সব বাগানগুলো মিলিয়েই একত্রে মুঘল গার্ডেন বলা হয়। অতি চমৎকার সাজানো্ বাগান, ভেতরে একটা লেক ফো্য়ারা ইত্যাদি। খানিক ঘো্রাঘুরি করতে না করতেই টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হল, আমরাও তাড়াতাড়ি বেরিয়ে অটোস্ট্যান্ডে হাজির। পরী মহল যাবার ভাড়া নির্দিষ্ট, ১০০ টাকা।
     

    মন্দির চত্বর  থেকে শহর


    বোটানিকাল গার্ডেন 

    পরীমহল তৈরী্ করেছিলেন দারা শিকো্হ ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ। সাতটা সোপানবিশিস্ট  পরী মহল ধাপে ধাপে উঠে গেছে জবরওয়ান পর্বতশ্রেণীর একেবারে উপরের দিকে। সোপান বা চত্বরগুলো্তে দাঁড়ালে শ্রীনগর শহর ও্ ডাললেকের দক্ষিণ্ পশ্চিম দিকের অপূর্ব ভিউ পাওয়া যায়। একদম উপরের ধাপের ফোয়ারা থেকে জল বয়ে গেছে নীচের ধাপ অবধি বিভিন্ন ফাঁকফোকর আর ছোট সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে। এখানকার গোলাপের সংগ্রহ দেখার মত। কথিত আছে এখানে দারা শিকোহ্র পাঠাগারও্ ছিল, তিনি ১৬৪০ খ্রী্স্টাব্দ অবধি এখানে বাস করে গেছেন। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে খানিক। পরবর্তী্ গন্তব্য চশমেশাহী। অটোভাড়া ৭০/-ঢোকার টিকিট ৩০/-। আলি মর্দান খান, সম্রাট শাহজাহানের আদেশে তাঁর পুত্র দারা শিকোহ্র জন্য এই বাগান নির্মাণ্ করেন।
     

    পরী মহল 
     

    পরী মহল থেকে ডাল লেক 
     
    একটা প্রাকৃতিক ঝর্ণাকে কেন্দ্র করে তিনটে ধাপে নির্মিত চশমেশাহী। কথিত আছে কাশ্মী্রের প্রাচীন এক সাধ্বী্ রূপা ভবানী্ খুঁজে পান এই ঝর্ণা এবং তাঁর অনুসারীদের নামানুসারে এর নাম হ্য় চশমেশাহিবী। মুঘল গার্ডেনগুলো্র মধ্যে এটাই সবচেয়ে ছোটো্, তবে এও অতি সুন্দর,যত্নে সাজানো বাগান। বৃষ্টির তী্ব্রতা বাড়ায় মস্ত বড় চিনারগাছের নীচের এক বেঞ্চে বসি আমরা। ভেজা ঘাস, ভেজা চিনার পাইনপাতার গন্ধ গোলাপের আবছা গন্ধ আর কটা বাচ্চার হৈ চৈ সাথে বৃষ্টির ঝিপ ঝিপ আওয়াজ অদ্ভুত প্রশান্তি ছড়িয়ে যায় স্নায়ুমন্ড্লী্তে। আমার রেনকোট গাড়িতেই রয়ে গেছে হাইকিং স্টিকের সাথে। সমরেশদা বৌ্দি ছাতা রেনকোট আনেনই নি। অতএব তিনজনে ভিজতে ভিজতে বেরো্লাম ফেরার অটো ধরতে। চশমেশাহীর বাইরে বেশ কিছু কাশ্মিরী্ পোযাক,শাল ও্ হাতের কাজের জিনিযের দো্কান।
     


    বৌদি আর আমি ঘুরেফিরে খানিক দেখি। পোষাকের মান আন্দাজে দাম কমই মনে হল। আমরা কিছুই কিনবো না শুনে ওঁরা একটু মুযড়ে পড়েন। ‘খুব ভাল কো্য়ালিটির কেসর’ (জাফরান) এনে দিতে চান। সেসব প্রলোভন কাটিয়ে আমরা ফিরতি অটো ধরি। এখান থেকে বোটানিকাল গার্ডেন উৎরাইপথে এক কিলো্মিটারের সামান্য কিছু বেশী। সার্কিটহাউসের বিশাল বাগানের পাঁচিলের ধার ঘেঁযে চিনার পাইন পপলারের ছায়ায় ঢাকা পথে হেঁটে আসতে ভালই লাগত, কিন্তু বৃষ্টিতেঁ তা সম্ভব নয়। অটোভাড়া ৭০/-। এখানে সব রুটে বাঁধা রেট্, সুবিধেজনক। দরাদরির ঝামেলা নেই। পার্কিঙে ফিরে গাড়িতে চেপে হাজির হওয়া গেল রাজা ধাবা,সম্পূর্ণ্ নিরামিশ। কেন দ্য হো্যাই নিরামিশ? কোথায় কাশ্মীর এসে ‘ওয়াজওয়ান’ খাব তা না নিরামিশ! সারথিমশাই সোজা এখানেই এনে ঢুকিয়ে দিলেন ... অগত্যা!


    বৃষ্টিভেজা ডাল লেক 

    রাজা ধাবার খাবার বিশেষ সুবিধের নয়। তন্দুরি রুটি আধকাঁচা ছিল। পালক পনির মোটামুটি। কাহওয়া (কাশ্মিরী চা) করেই না, সাধারণ চা’ও তখন হবে না। যাই হোক এত বৃষ্টিতে শালিমার, নিশাতবাগে গিয়ে লাভ নেই ঘোরা যাবে না, শিকারা রাইডও তাই। রূ্পম বলছেন হোটেলে ফিরে যেতে, এদিকে বেড়াতে এসে ভর দুপুরে ওই ঘিঞ্জি হোটেলে ফেরার ইচ্ছে মোটেই নেই আমাদের। এলোমেলো্ হাঁটতে থাকি আমরা নানারকম দোকানপাটের মধ্যে দিয়ে। বৃষ্টির দিন হওয়াতে রাস্তার অস্থায়ী্ দোকান অধিকাংশ খোলে নি, পর্যটকের সংখ্যাও নামমাত্র। একসময় হোটেলে ফেরা ছাড়া উপায় থাকে না। যদিও গাড়িতে উঠে সারথিকে বলেছিলাম আমাদের লালচওকে নামিয়ে দিতে, তা তিনি কী্ বুঝলেন কে জানে, সোওজা নিয়ে হোটেলের রাস্তায় হাজির করলেন। ঠিক হল সন্ধ্যে ৬টা নাগাদ আমরা অটো ধরে লালচওকে যাবো, আপাতত যে যার ঘরে বিশ্রাম।

    লালচওক শ্রীনগরের প্রাণকেন্দ্র। মহারাজা হরি সিংএর সাথে লড়াই করার সময়ে বামপন্থী কর্মী্রা রাশিয়ার বিপ্লবে অনুপ্রাণিত হয়ে এই চওকের নাম রাখেন লালচওক। ১৯৪৮ সালে এখানেই প্রথম ভারতীয় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন জওহরলাল নেহেরু, প্রতিশ্রুতি দেন রেফারেন্ডাম ভোটের আয়োজন করারও। এই চও্কে দাঁড়িয়েই শেখ আবদুল্লা জম্মু ও্ কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত ঘোষণা করেন। আমরা পৌছালাম প্রায় সাতটা নাগাদ, দিনের আলো তখনো পুরোপুরি মোছে নি। বৃষ্টি অবশ্য থেমেছে। এদিকে সমরেশদা সেই সকাল থেকে একমনে ‘বিচার চাই আরজিকর
                                                                                                                                       আমার চাই উইনচিটার
    ’ জপে চলেছেন। অতএব প্রথম তারই খোঁজে এদিক ও্দিক ঢুঁ মারা,জিজ্ঞাসাবাদ। তা বড়রাস্তা থেকে  একটু ভেতরের দিকে খাসা একখানা দোকান পাওয়া গেল।
     

    লাল চওক  ক্লক টাওয়ার (ঘন্টাঘর ) 

    ‘কেনাকাটা ব্যক্তিগত ব্যপার দেখাশোনা ফ্রি’ মোডে দেখতে গিয়ে আমারো একখানা বেশ পছন্দ হয়ে গেল। দুজনে দুখানা কিনে সেখান থেকে বেরিয়ে চললাম যে যার মত জায়গাটা ঘুরে দেখতে। আমি গেলাম ‘বেস্টসেলার বুকস্টোর’ খুঁজতে। চওকের ঘন্টাঘরের কাছে এটুকুই জানা। পাঠ্যপুস্তকের কেজো্ দোকানে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল সামনের মস্ত বিল্ডিঙের ওইপাশে। সেপাশে গিয়ে দেখা গেল সেখানে সব খাবারের দোকান। সেখানে আবার বলল সোজা গিয়ে বাঁয়ে। ডাইনে বাঁয়ে সামনে পেছনে করেও কো্নভাবেই সে দোকানকে খুঁজে বের করতে আর পারলাম না। গুগলও্ বিশেষ সাহায্য করতে পারল না। মনমরা হয়ে দেখা করার নির্দিষ্ট স্থানেই ফিরলাম। ততক্ষণে বৃষ্টি আবার নেমেছে। এরপরে তো হোটেলে ফিরে খেয়েদেয়ে ঘুম। কাল থেকে যাত্রা  লাদাখের পথে।      
     
    May be an image of 8 people and text
    ছবি সৌজন্য ঃ রূপম মুখার্জি 
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ভ্রমণ | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪১৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাপাঙ্গুল | 49.36.***.*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:১৫537893
  • দারুণ। এটা শুরু হবার অপেক্ষা ছিল। 
  • dc | 2402:e280:2141:1e8:4979:6598:ffb4:***:*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২২:২৩537895
  • বাঃ আবার একটা ভ্রূমনকাহিনী শুরু হয়েছে। ক্লক টাওয়ারের ছবিগুলো অসাধারন! 
  • . | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২২:৪৬537896
  • এ জিনিস শিবাজির ভিডিওতে হবার না। ফোটোতে যে রংগুলো ধরা পড়েছে সেগুলোও। চলুক।
  • aranya | 2601:84:4600:5410:2920:6417:449:***:*** | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৪:৫৭537899
  • সুন্দর 
  • | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:০৫537910
  • সবাইকে ধন্যবাদ। 
     
    ভিডিও ব্লগ আর লেখা ব্লগ তো আলাদা।  ভিডিও করা অনেক বেশী পরিশ্রমের। আবার অন্যদিকে ওঁরা ভিডো বানিয়ে পয়সা পান আর আমরা পয়সা খচ্চা করে ঘুরতে যাই। এইসব আর কি। 
  • স্বাতী রায় | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২২:২৪537912
  • ক্লক টাওয়ারের ছবিটা সত্যিই অসাধারণ হয়েছে। 
  • গবু | 202.8.***.*** | ০৫ অক্টোবর ২০২৪ ১৫:৩১538257
  • ছবি আসছেনা তো ?
  • | ০৫ অক্টোবর ২০২৪ ১৮:১৩538261
  • এইরে! কী কী ছবি কোথায় ছিল তাই তো মনে নেই! 
    এই গুরু  কর্তৃপক্ষের ছবি নিয়ে  এরকম ঔদাসিন্যের জন্য ভ্রমণ কাহিনী এখানে লেখাই ছাড়তে হবে দেখি। sad
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন