টুথপেস্ট বা দাঁত মাজার ব্রাশের বিজ্ঞাপনে গলায় স্টেথোস্কোপ ঝোলানো ডেন্টিস্ট দেখে হাসাহাসি করি তো আমরা? কিন্তু যেটা আমাদের চোখ বা কান এড়িয়ে যায় - ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে লেখা - "ইন্ডিয়ান অমুক অ্যাসোসিয়েশন আমাদের ব্র্যান্ড সুপারিশ করেন" । না, এই লেখা টুথপেস্ট বা ব্রাশ সম্পর্কিত নয়। বরং দৈনন্দিন জীবনে তার চেয়ে ঢের বেশি ব্যবহার হয় এবং আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর যার সরাসরি প্রভাব আছে - পানীয় জল সংক্রান্ত। মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে পানীয় জল শোধনে যে "ফিল্টার" ব্যবহার হয়, সেগুলোর বিজ্ঞাপনের সাম্প্রতিক একটি দাবি নিয়ে আমার কিছু প্রশ্ন আছে । এই প্রশ্নগুলো কিছুটা কালো সাদার মাঝে - ধূসর । আর আমার কিছু ধারণা বা "হাইপোথেসিস" এর কথাও বলব, এগুলোর সপক্ষে আমার কাছে অকাট্য প্রমাণ নেই, সেও স্বীকার করে নিচ্ছি আগেই। তবু প্রশ্নগুলো থাক ...
ভারতে শহর মফস্বল নির্বিশেষে আজকাল বিত্তশালী পরিবারে আর.ও. (রিভার্স ওসমোসিস) ফিল্টার ব্যবহার হয়। পরিবেশের ওপর এর ক্ষতিকারক প্রভাব আছে - এই সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য পেপার ( কাকে ধরবো "নির্ভরযোগ্য" - সামান্য বিশদে একটু বাদেই বলছি) ইন্টারনেটে একদম অনায়াসে পাওয়া যায়।
টিভি বা খবরের কাগজের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনে , এই বছর দুই- তিনেক হলো চোখে পড়ছে - "কপার চার্জড", "কপার বুস্টেড", "কপার ফর্টিফায়েড" এর মত শব্দবন্ধ । একটু খুঁজে দেখলাম ভারতের বিক্রির সংখ্যার নিরিখে প্রথম আটটি ফিল্টার কোম্পানির প্রত্যেকটির এক বা একাধিক মডেলে এই তামা সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য (ফিচার) আছে । এদের মধ্যে আবার চারটি কোম্পানি জলে "বাইরে থেকে তামা যোগ" করে ক্ষান্ত দিচ্ছে না, এক বা একাধিক মডেলে তামার তৈরি জলের ট্যাংক আছে। সাধারণত এই ট্যাংকগুলো আট বা দশ লিটারের হয়, অস্যার্থ - ভালো পরিমাণের তামা লাগে এগুলো তৈরিতে। প্রত্যেকটি কোম্পানির ওয়েবসাইটে "বাইরে থেকে তামা যোগ" এর "সায়েন্স" এর ব্যাপারে কী বলছে ঘেঁটে দেখলাম। মজার (বা ভয়ের) ব্যাপার তেমন বিশদে কিচ্ছু নেই । দুটি কোম্পানি লিখেছে "ইলেকট্রো কেমিক্যাল ডিসলিউশন" - ব্যাস আর একটি কথাও নেই। তামার ইলেকট্রোড থেকে কপার আয়ন রিলিজ কীভাবে কন্ট্রোল করা হয়, তামার পরিমাণ পরিশোধনের পর কীভাবে মাপা হয় সর্বোচ্চ সীমা পেরিয়ে গেলো কিনা - এসব নিয়ে একটা শব্দও নেই। বাকিরা অবশ্য আরও সরেস - "কপার কার্টিজ ম্যাক্স" এই ধরণের মার্কেটিং জার্গন এর আড়ালে লুকানো আছে রহস্য। আর কে না জানে পেটেন্টেড টেকনোলজি মানেই হাইফাই জিনিস !
WHO র পানীয় জলে তামার পরিমাণের গাইডলাইন বলছে সর্বোচ্চ পরিমাণ ২ মিলিগ্রাম/ লিটার, BIS (ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস) বলছে ০.০৫- ১.৫ মিলিগ্রাম / লিটার । আমেরিকান সরকারি সংস্থা EPA (ট্যাপ বা কল তৈরির ধাতুতে যেহেতু তামা থাকতে পারে) এর সর্বোচ্চ মাত্রা বেঁধে দিয়েছে ১.৩ মিলিগ্রাম / লিটার এ। আর একটি পারিভাষিক শব্দ হলো - Tolerable Upper Intake Level এর অর্থ সর্বোচ্চ পরিমাণ, যে পর্যন্ত কোনো কিছু (এক্ষেত্রে তামা মেশানো জল) মানুষের ক্ষতি করছে এমনটা দেখা (observe) যায় না। একটু খটোমটো পারিভাষিক শব্দ হলেও মোটামুটি মানে যে পরিমাণের পর থেকে সেই জিনিসের বিষক্রিয়া হবে। পানীয় জলে তামার এই পরিমাণ কত? আমেরিকান ন্যাশনাল একাডেমি অফ মেডিসিন বলছে ১০ মিলিগ্রাম / প্রতিদিন (গড়ে ৩ লিটার পানীয় জল ছাড়াও কিন্তু একাধিক খাবার এর মাধ্যমে তামা ঢুকছে আমাদের শরীরে) । তাহলে ফিল্টারের তামা মেশানো জল খেয়েও সর্বোচ্চ ১০ মিলিগ্রাম এর নিচে তামা ঢুকছে আমাদের শরীরে - এটা নিশ্চিত করবে কে? আর এই কপার আয়ন রিলিজের মেকানিজম এর কন্ট্রোল অর্থাৎ মাত্রা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতির ব্যাপারে একটি কথাও পেলাম না কিন্তু কোথাও। এবার আসি তামার ট্যাংক এর কথায়। জলে কতটা তামা লিচ (leach) করবে তামার ট্যাংকের দেওয়াল থেকে তার বেশ কয়েকটি প্যারামিটার এর তিনটি হলো - জলের অম্লত্ব (এসিডিটি) - যত অম্ল তত তামা লিচ করবে ,তাপমাত্রা - যত বেশি তাপমাত্রা তত বেশি তামা লিচ করবে আর কতক্ষণ জল তামার সংস্পর্শে আছে । আর ও ফিল্টার এর কার্যপ্রণালী (working principle) এমনই যে তা ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়ামের মত ধাতু de - minaralize করে বা নিষ্কাশন করে (pH বাফারিং ক্যাপাসিটি কমায়) , এদিকে জলে দ্রবীভূত কার্বন ডাই অক্সাইড এর জন্য আর ও ফিল্টারের জলের pH সংখ্যা ৭ এর সামান্য নিচে থাকে। অর্থাৎ কিছুটা এসিডিক। ভারতের মতো দেশে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ৪০ এর ওপর দীর্ঘ সময় থেকে যাওয়া তেমন বিরল নয়। তাহলে এসব যোগ করে কী দাঁড়ায়?
এবার প্রশ্ন শরীরে অতিরিক্ত তামা কী ক্ষতি করে? প্রথম ক্ষতি করে আমাদের পাচন তন্ত্রের। দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির তালিকায় রয়েছে লিভার ও কিডনি স্থায়ী ক্ষতি।
এবার পরের প্রশ্ন হলো জলে তামা থাকলে লাভ কী / কি হয়? হ্যাঁ, নির্ভরযোগ্য পিয়ার রিভিউড রিসার্চ বলছে ল্যাবরেটরিতে কন্ট্রোলড এনভায়রনমেন্ট এ তামার এন্টি মাইক্রোবিয়াল প্রপার্টি আছে। কী রকম মাইক্রোব? ই কোলাই, টাইফয়েড, কলেরা ইত্যাদি জীবাণুর কোষের দেওয়ালের ক্ষতি করে তামা, এদের ডিএনএ স্ট্রাকচার আক্রমণ করে মেরে ফেলে। কিন্তু RO প্রক্রিয়া সঠিক থাকলে সেই পদ্ধতিতেই এসব জীবাণু আটকে যাওয়ার কথা, আর ট্যাংকে আল্ট্রা ভায়োলেট ল্যাম্প থাকে রি- গ্রোথ আটকানোর জন্য। তাহলে তামার কাজটা কী?
যেকোনো যন্ত্র, যার সাথে মানুষের স্বাস্থ্য জড়িত সেখানে উন্নত দেশে সবসময় "রেগুলেটরি বডি" (আমাদের দেশে ফিল্টার এর জন্য তেমন কিছু রেগুলেশন খুঁজে পেলাম না কিন্তু) বাজারে বিক্রির ছাড়পত্র দেবার সময় "বেনিফিট রিস্ক অ্যানালাইসিস" করে । এটিও একটি পারিভাষিক শব্দ । বিশদে জানতে খুব ইচ্ছে করলে সার্চ করুন ISO 14971. অর্থাৎ তামা জলে মেশানোর এতটা "রিস্ক" যে আমরা নিচ্ছি , তার "বেনিফিট" যা পাওয়া যাচ্ছে সেটা রিস্কের তুলনায় কতটা বেশি। কারো জানা থাকলে বলবেন , আমি অন্তত সায়েন্টিফিক বেনিফিট কিছু ভেবে বের করতে পারলাম না ।
এইবার ফের ফিরে আসি অমুক দ্বারা সুপারিশ করা / অনুমোদিত / রিসার্চ বলছে এই ধরণের দাবির সারবত্তা খুঁজতে। সেই ইন্ডিয়ান কী যেন অ্যাশসিয়েশন আছে - যারা আপনাকে বলে এই ফিল্টার বা এই ব্রাশ তাঁরা সুপারিশ করছেন - ব্যাপারটা কী? ব্যাপারটা হলো ওটাও বিজ্ঞাপন, ভারতীয় ডাক্তারের একটি অ- সরকারি সংস্থা যারা টাকার বিনিময়ে তাদের লোগো ও সুপারিশ এর উল্লেখ বিজ্ঞাপনে করতে দেয় । তারা কোনো আইনি বা রেগুলেটরি বডি না। আমার কথা বিশ্বাস না হলে , নিজেই খুঁজে দেখুন ওঁদের ওয়েবসাইট এ কী লেখা। এরপর আছে "রিসার্চ বলে"!! বিশ্বাসে মিলায় বস্তু... খুব সংক্ষেপে কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট বলে একটা বস্তু হয়, সেটা পাবলিকেশন এর সাথে উল্লেখ করতে হয়। না উল্লেখ করলে সেটা পুরো জালি। যেমন উনিজির করা রিসার্চে দেখা গ্যাছে উনিজি ভীষণ ভালো মানুষ এইরকম আর কি। একমাত্র পিয়ার রিভিউড জার্নালকে "নির্ভরযোগ্য" ধরা যায়। সেখানেও অনেক ঘোর প্যাঁচ আছে, তাতে ঢুকে লাভ নেই।
এবার সবচে জরুরি প্রশ্ন বিজ্ঞানভিত্তিক কিছু লাভ না থাকলেও কোম্পানি গুলো এত কাঠ খড় পুড়িয়ে কেনো তামা তামা করছে? আমার হাইপোথেসিস ভারতীয় বিত্তশালী সমাজে বিজ্ঞান চেতনার অভাব এবং শেষ দশ পনেরো বছরে হঠাৎ চেগে ওঠা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ। পতঞ্জলির সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে যেখানে ইউনিলিভারের মত বহুজাতিক সংস্থাকে বলতে হয় - আপনার টুথপেস্টে নুন আছে? কয়লা আছে?
আপনার ঘিলুতে গোবর আছে!!!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।