এবারে লেহতে প্রথম দফায় চারদিন ও পরে আরো তিনদিন থাকায় মার্কেটে যাওয়া হয়েছে বহুবার। প্যালেস থেকে ফিরেও গিয়েছিলাম। এই জুন জুলাই মাসে লেহতে অন্ধকার হয় প্রায় রাত আটটায়। অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত মার্কেট থাকে ফাঁকা ফাঁকা, খাবার দোকানগুলো সবে তন্দুরে আগুন দিচ্ছে। হয়ত ছোট একটা তন্দুর জ্বলছে অল্পস্বল্প কিছু বানিয়ে দেবার জন্য।
লেহ মার্কেট - সন্ধ্যে হয় হয়।মার্কেটের এল পয়েন্টের কোণায় এক মস্ত মসজিদ। মসজিদের পাশের গলি দিয়ে ঢুকে একটু এগিয়ে ডানদিকে আরো সরু একটা গলি দিয়ে ঢুকে দেড়শো মিটার মত এগোলে এক মস্ত গুরুদ্বোয়ারা। ওইখানেই সেন্ট্রাল এশিয়ান মিউজিয়াম। এইটে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল কিন্তু মিউজিয়ামের সংস্কার চলছে বলে দর্শক আনাগোণা বন্ধ ছিল। এই গুরুদ্বোয়ারার সামনেই এক বয়স্ক ভদ্রলোক তন্দুর নিয়ে দাঁড়িয়ে ইয়ারকন্দি মাটন সিঙাড়া বানান। ছোট্ট ছোট্ট সিঙাড়া, যার লাদাখি নাম সামসো। এক প্লেট ৪০/- টাকা, ৬ পিস। অতি ভাল খেতে।
মসজিদ - ওই ডানদিকের গলি দিয়ে গিয়ে আবার ডানদিকে ঘুরতে হবে।একদিন রাতের খাওয়া এই সামসো দিয়েই সেরেছিলাম। সোলো ট্র্যাভেলের একটা দারুণ দিক হল বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন পেশার লোকজনের সাথে বন্ধুত্ব হওয়া। এবারে যেমন হল তাশিখুড়ো, অব্রে আর স্টেফানি, আংডুভাই, করিতকর্মা কর্মা, স্ট্যানজিন শেরিং।
তাশিখুড়োর দোকান Tashi's Crafts লেহ মার্কেটের ভেতরে পোস্ট অফিসের পাশের রাস্তা দিয়ে বেশ খানিকটা ভেতরে ঢুকে ডানদিকে। এঁর কথা অণুর পোস্টে পেয়েছিলাম। গতবার জায়গাটা বেরও করেছিলাম কিন্তু দোকানে ঢোকার সময় হয় নি। এবারে তাই এসে প্রথমদিনই ঢুঁ মারলাম। সাতরঙা টুপি মাফলার সব ৩০০- ৩৫০ রেঞ্জে। ওই জিনিষই মানালির ম্যালে ৯০০- ১২০০ চায় দেখেছি। তাশিখুড়োর বউ খুড়িমা নিজে হাতে এগুলো বোনেন। একেবারে নিখুঁত বুনন।
তাশিখুড়োর দোকানকিন্তু এহ বাহ্য। তাশিখুড়ো আগে ১৯৭৪ - ৭৭ কলকাতায় আসতেন পসরা নিয়ে। আমি কলকাতার কাছাকাছিই থাকি শুনে কি খুশী। বর্ধমানেও এসেছেন কয়েক বছর। উনি আমাকে চা না খাইয়ে ছাড়বেনই না। গেলেই প্রথম কথা কেনাকাটি পরে হবে আগে বোসো, চা খাও। আমি চা খাই না শুনে ভারী দু:খিত। ওঁর দোকানের পাথরের কানের দুল, ব্রেসলেট, মালা খুড়োর বানানো। বলেছেন সামনের বছর আমার জন্য একটা সাতরঙা উলেন সোয়েটার খুড়িমাকে দিয়ে বুনিয়ে রাখবেন।
অব্রে আর স্টেফানি আমাদের হোমস্টেতেই ছিল। এসেছে প্যারিস থেকে। হেমিস ফেস্টিভালে যাবে, গাড়ি বুক করেছে। হোমস্টের স্ট্যানি আমার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন যাতে শেয়ারিঙে দুপক্ষেরই টাকা একটু কম লাগে। অত:পর ফরাসী ইংরিজি আর বাঙালি ইংরিজিতে বন্ধুত্ব জমে গেল। ওরা আজ, ৬ তারিখ সকালে গেল মার্কাভ্যালি ট্রেকিঙে। ফিরে আবার যাবে সার্কো সেখান থেকে হাইক করে সোমোরিরি। তারপর এখান থেকে রাজস্থান, তামিলনাড়ু ইত্যাদি। খুব ঘাম হচ্ছে দেখে আমি ওদের শুধু জল না খেয়ে ওয়ারএস মেশানো জল খেতে বলেছিলাম। পরে মেসেজ করেছে তাতে ওদের বেশ উপকার হচ্ছে।
অব্রে স্টেফানি আমাদের এই গাড়ির সারথি ছিলেন আংডুভাই। লাদাখি বুদ্ধিস্ট, গুরু রিনপোচের অনুসারী। শে প্যালেসের গল্প, নামগিয়াল রাজাদের নানা যুদ্ধের গল্প, দ্রুকপাদের গল্পস্বল্প ইনি আমাকে অনর্গল বলে যাচ্ছিলেন। এঁর সাথেই গিয়েছিলাম লেহ'র আশেপাশে ঘুরতে। শহর থেকে সিন্ধু জাঁসকার সঙ্গমের দিকে যেতে এক জায়গায় একটা মূলতানি মাটির পাহাড় আছে। লোকে বেড়াতে এসে নাকি সেখান থেকে খাবলা খাবলা মূলতানি মাটি নিয়ে যায়। সে আংডুভাই আমাকে এনে দেবেনই। যতই বলি ওসব মাখি না, লাগবে না। উনি ততই বিমর্ষ হয়ে পড়েন।
মাঝেরজন আংডুভাইপ্রথমদিন লেহ মার্কেটের ভেতরে ঘুরছি আর এটা ওটা ছবি তুলছি, কোথা থেকে ঝুপ্পুস লোমের একজন সুন্দরী ভদ্রমহিলা এসে বলেছিলেন ওহে মনুষ্য ওসব কি খিচিক খিচিক ছবি তুলছ আমার ছবি না তুলে? সত্যি তো। তাড়াতাড়ি বসে পড়ে ছবি তুললাম। তখন তিনি এগিয়ে এসে একদম মুখের সামনে মাথাটা এগিয়ে দিয়ে বললেন দ্যাখো এই কানের পেছনটায় আমার হাত যায় না। তোমাকে আমার ছবি তুলতে দিয়েছি, এই জায়গাটা ভাল করে চুলকে দিয়ে দামটা দিয়ে যাও বাপু।
ঝুপ্পুস লোমওলা সুন্দরী*তাশিখুড়ো ছবি তুলতে চান নি আমিও আর জোর করি নি।
*বাকী দুজনের কথা পরে আসবে।
(চলবে)