

আমাদের ছোটবেলায় সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন ভূপেন হাজারিকা। আসামের মানুষ। কিন্তু বাংলায় অসম্ভব জনপ্রিয়তা পান। কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। বিখ্যাত লোকগায়ক গণসঙ্গীতকার হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গে আসামের পথে প্রান্তরে গান গেয়েছেন। সেই মানুষ পরে বাঙালি খেদা আন্দোলনের সমর্থক হন এবং বিজেপি দলে যোগ দেন জেনে কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু তা বলে তাঁর গান শোনা বন্ধ করিনি।
শিল্পীর সৃষ্টি আর তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে না মেলানোর শিক্ষা বাবার কাছে পাওয়া। যদিও কমিউনিস্ট পার্টি ছিল অনেকটা বামুনবাদী। দল ছাড়লে বা দল তাঁকে ত্যাগ করলে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা না বলার একটা অলিখিত ঘোষণা ছিল। বাবা এটা মানতেন না। আমিও মানিনি। ফলে সিপিএম ছেড়ে নকশাল হয়ে যাওয়া অসীম ঘোষ ও এমানুর ভাইয়ের সঙ্গে আমার নিবিড় যোগাযোগ ছিল। পরে রাজ কলেজে এবং হোস্টেলে একজন নকশাল বা ছাত্র পরিষদের ছেলের গায়ে আমার সামনে হাত দিতে দিইনি। বরং তাঁদের আশ্রয় দিয়েছি। শ্রীকান্ত রাণা এবং নবকুমারদা ছিলেন নকশাল। হোস্টেলে শ্রীকান্ত রাণা অবাধে থেকেছেন। ওঁদের অনেক বইপত্র দিয়েছেন। শিখেছি। সবচেয়ে লাভ হয়েছিল, 'মার্কসিজম টুডে' একটা পত্রিকা পড়ে। ১৯৮৫তে। সেখানে পি সুন্দরাইয়ার লেখা পড়ে চমকে যাই। সেখানে সুন্দরাইয়া ইন্দিরা গান্ধীকে আধা ফ্যাসিবাদী বলে পূর্ণাঙ্গ ফ্যাসিবাদী আর এস এসের হাত ধরার জন্য সিপিআই (এম) নেতৃত্বের সমালোচনা করেছেন। এবং পার্টির পলিটব্যুরোর সম্পাদক পদ ছেড়ে দিয়ে সাধারণ পার্টি সদস্য হয়ে যাচ্ছেন। এর অভিঘাত সবটা বুঝিনি। বোঝার ক্ষমতাও হয়নি। কেউ বুঝিয়ে দেওয়ার লোকও ছিল না।
এখন বুঝতে পারি, ক্ষমতার রাজনীতিই ছিল প্রধান। নীতি নয়। কংগ্রেস তাই এক নম্বর শত্রু ছিল। যদিও লেখা পত্রে বলা হচ্ছিল, বিষবৃক্ষের দুটি ফল: কংগ্রেস ও বিজেপি। ১৯৮৫-র ঘটনা।
এর দু বছর পর ব্রিগেড মাঠে বাজপেয়ীর সঙ্গে জনসভা। এইদিন আমি প্রথম কফি হাউস যাই। আড্ডা মারতে নয়, পেপটিক আলসারের রোগী, পায়খানা করতে। ঐতিহাসিক এই দিন ভোলার নয়। কলকাতা শহরে এখন যে দু একটি সুলভ শৌচাগার দেখা যায়, তখন তা ছিল না । হয় হাওড়া স্টেশন নয় শিয়ালদহ। অথবা কোনও হোটেল। হোটেলে গেলে পয়সা লাগবে। পাবো কোথায়?
অতএব কফি হাউস যাত্রা। জীবনের প্রথমবার।
তখন কি জানতাম, প্রেসিডেন্সি কলেজে একদিন পড়াতে আসবো! এবং ১৯৮৯ থেকে প্রতি শনিবার বর্ধমান থেকে এসে কফি হাউসে এসে জয়দেব বসুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে গভীর রাতে বর্ধমান ফিরবো!
হচ্ছিল, ভূপেন হাজারিকার কথা। হেমন্ত মান্না রফি কিশোর মুকেশ মানবেন্দ্র সতীনাথ শ্যামল মিত্র সবাই ছিলেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তখন সিপিএম মহলে একটু ব্রাত্য। জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে নাকি 'অয়ি ভুবন মনমোহিনী' গেয়েছেন!
তখন বামপন্থী রাজনীতি কৃষক শ্রমিক খেতমজুর সমাজে খুব জনপ্রিয়। তখনও সিপিএম মধ্যবিত্ত উচ্চ মধ্যবিত্ত বা উকিলের দল নয়, কংগ্রেসিরা বলে, ছোটলোকের পার্টি। লাই দিয়ে মাথায় তুলেছে গরিবদের। কথাই শোনে না আজকাল।
বলা হচ্ছে, শিক্ষক কর্মচারীদের পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি করছে সিপিএম।
তখনও ধনী ও জমিদারদের দল কংগ্রেস পর্যন্ত খেতমজুর ও শ্রমিকদের মাইনে বাড়ানো, শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন বাড়ানোকে ভিক্ষা দেওয়া বলে ব্যঙ্গ করতে সাহস করেনি। করলে লোকে, অশোক মিত্রের ভাষায়, পিঠের চামড়া গুটিয়ে নিত।
ভূপেন হাজারিকার রেকর্ড কিনে বাবা শিবুভাই ও আরেক মাইকওয়ালা জিকরিয়া ভাইকে দিয়েছেন। মানুষ মানুষের জন্য, গঙ্গা আমার মা-- লোকের মুখে মুখে ঘুরতো।
আমাদের এলাকায় তিনটি বিষয় সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসের গবেষকদের জন্য খুবই জরুরি।
এক, মরা সাহেবদের কোট পরে লাঙ্গল চালানো, পুকুরঘাটে বসে দামি কোট পরে মহিলাদের বাসন কোসন মাজা। এবং কোনও কোনও মহিলার কোট পরে সবার সামনে উপায়হীনভাবে পুকুরে পেচ্ছাপ করা।
দুই, সিরাজউদ্দৌলা ও মা মাটি মানুষ, অচল পয়সা, পদক্ষেপ প্রভৃতি জনপ্রিয় যাত্রাপালার সংলাপ। চাষ করতে করতে বা গোরু মোষ চরাতে চরাতে আপন মনে এইসব সংলাপ কথন।
বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, কে তাকে আশা জোগাবে, কে তাকে ভরসা জোগাবে ...
তিন ছিল, ভূপেন হাজারিকার গান।
সম্প্রতি জুবিন গর্গ মারা গেলেন। তাঁর মৃত্যুর আগে আমি তাঁকে সত্য বলতে চিনতাম না। পরে জেনেছি, তাঁর কয়েকটি গান আমার একট প্রিয় ছিল। গায়কের নাম না জেনেই।
এখন তো দেখছি, তিনি অসম্ভব জনপ্রিয়। ১৫ লাখ মানুষ যোগ দিয়েছেন শেষকৃত্যে। মৃত্যুর একমাস পরও তাঁর জন্য তিনসুকিয়াসহ বিস্তীর্ণ আসামে দীপাবলিতে অন্ধকার। হাজার হাজার মানুষ আসছেন সমাধি ক্ষেত্রে। আসছেন। কাঁদছেন। গান গাইছেন। এই জীবন সার্থক।
আরেকটি খবর পড়লাম।
অসমীয়া সংস্কৃতির খবর। জুবিন গর্গের সমাধিস্থলে আসা মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের পা ধুইয়ে দিচ্ছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের তরুণী ও মহিলারা।
এত বিদ্বেষ ছড়িয়েও মানুষের মন সম্পূর্ণ বিষিয়ে তোলা যায়নি। এ তার প্রমাণ। যাবেও না।
পা ধোয়া নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে।
শুধু আসামে কেন, বাংলাতেও এই সংস্কৃতির চল ছিল।
আমাদের বাড়িতে অতিথি এলে তাঁর পা ধুইয়ে দিয়েছি আমরাও।
পরে শুধু জল ঢালার ব্যাপার থাকল। জামাইবাবুদের পায়খানা যাওয়ার সময় বদনা বা ঘটি করে জল বয়ে নিয়ে যেতে ছোটদের। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে। তখন তো ঘরে ঘরে পায়খানা হয়নি। কমবেশি সব জামাইকেই পুকুরপাড়ে ওই কর্মটি করতে হতো।
এখন তো কল, টিপ কল থেকে লাইন কল। আলাদা বাথরুম। পা ধুইয়ে দেওয়া উঠে গেছে। আমাদের গ্রামে, বড়লোক বউ দত্ত কাকিমাকে সত্তর দশকেও দেখেছি, আমাদের গরিব বামুন বন্ধুর পা কাঁসার থালায় রেখে ধুইয়ে মাথার লম্বা চুল দিয়ে মুছে দিতে।
বামুন বন্ধু ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। ছেলের সহপাঠী।
আমরা স্কুলে ওর পিছনে লাগার পর ও আর পা ধোয়াতে দিত না। অন্তত আমাদের সামনে।
এখন পশ্চিমবঙ্গ তোলপাড় ভোটার তালিকা নিয়ে। ১৯৭৭এ আমাদের গ্রামে ভোটার ছিল যতদূর মনে পড়ে ৭৫০এর কাছাকাছি।
২০২৫এ শুনছি ১১২৬।
তবে ২০০২ এবং ২০২৫ এর ভোটার ম্যাপিংয়ে মাত্র ৪৬ শতাংশের কাছাকাছি নাম মিলেছে।
কেন?
আমাদের গ্রামে কোনও লোক বাংলাদেশ বা বিদেশ থেকে গত ৭০ বছরে আসেননি। দেশভাগের পর পরই একজন এসেছিলেন। তাও তিনি মুসলমান। সাদেক বাঙাল।
তিনি কবেই গত হয়েছেন।
কেন মিলছে না?
২৫০+ জন ভোটার শুনছি মহিলা। বিবাহসূত্রে এই গ্রামে এসেছেন।
মহিলাদের আরেকটি সমস্যা আছে। পদবী পরিবর্তন। বাপের বাড়িতে থাকা পদবী শ্বশুরবাড়ি এসে বদলে গেছে।
এই ২৫০+ মহিলাকে বাপের বাড়ি থেকে ২০০২ এর ভোটার তালিকা বা প্রমাণ আনতে হবে।
মুসলিম মেয়েদের আগে পদবী সেভাবে ছিল না। বিয়ের আগে খাতুন। বিয়ের পর বেগম। আর বিধবা হলে বিবি।
১৯৭৭ র ভোটার তালিকায় হিন্দু মহিলাদেরও দাসী বা দেবী দেখা যেত।
এখন সব বদলে গেছে।
পদবী জুটছে। পদবী ছুটছে।
ভালো না মন্দ কী বলবেন?