ছবি: ঈপ্সিতা পাল ভৌমিক
ইয়ে... ওপরের নামটা আমি কি বলে যেন... হ্যাঁ, একটু ধার করেছি। আজকাল পালিশিত ভাষা পলিসিতে 'অনুপ্রাণিত' দিয়ে অবশ্য সুন্দর কাজ চালানো যায়। কিন্তু ওলে-লুকৈয়ে আজ রাত্রে আমায় এসে চেপে ধরলে স্বীকার করা ছাড়া গতি থাকবে না যে নামটা আমি চুরি.... মানে ঐ যে ইয়ে... হ্যাঁ ধার করেছি।
হুঁ, ওলে-লুকৈয়ে, লোকটার নাম। যে চোখে ধূলো দেয়। দেখুন, এই অনুপ্রেরণা-ধার-চুরি গত ঝামেলা গুলোর জন্য আমি মোটেই দায়ী নই। এই সমস্তটার জন্য দায়ী একমাত্র হ্যান্স ক্রিশ্চান অ্যান্ডারসন। ঐ বুড়ো ওলে-লোকৈয়ে কে যখন উনিই আমার ঘাড়ে চাপিয়েছেন তখন এই নাম টুকু ওঁর থেকে ধার নেওয়াতে আমি কিচ্ছু খারাপ দেখিনা।
তো, ওলে-লুকৈয়ে, লোকটার নাম, যে চোখে ধূলো দেয়। কখন যে ও ঘরে ঢোকে অনেক চেষ্টা করেও দেখতে পাইনি কোনদিন। কিন্তু চুপিচুপি দেবে চোখের মধ্যে এক মুঠো মিহি ধুলো ছুঁড়ে। তখন চোখ আর খুলে রাখা অসম্ভব, দু পাতা এক হয়ে যাবেই। তার পরের টুকু তো আপনার জানাই আছে। কিছু না কিছু দেখাতে ভালোবাসে ও। হয় কোথাও নিয়ে যাবে আপনাকে হাত ধরে, কিম্বা যাদুর ছড়িটা এমন ঘোরাবে যে তা আপনি এসে উপস্থিত হবে আপনার সামনে। কিন্তু দেখতে আপনাকে হবেই, বন্ধ দুটো মাত্তর চোখের মধ্যে পালিয়ে যাবার জায়গা কোথায়?
পুরো একটা সপ্তাহ ধরে বুড়ো ওলে-লুকৈয়ে আমার কাছে রোজ এসেছিলো। বইতে এমনিই লেখা আছে, কাজেই এমনিই হতে হয়। আমি বলছি আপনাকে শুনুন। তার বাইরে যাবার উপায় নেই কারণ বইতে যেমন লেখা থাকে তেমনটিই হয় সব সময়।
সোমবার: ওলে-লুকৈয়ে এসেই আমাকে বেজায় তাড়া দিয়েছিলো। খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে ইশকুল যাবার। এই বুড়ো বয়সে যে ইশকুল কেন তা জিগ্যেস করার কথা আমার মনে আসেনি। বন্ধ চোখের তলায় ঠিক ওসব বুদ্ধিমান প্রশ্নরা ঠিক থাকা পছন্দ করে না। তাছাড়া কিছু ভালো করে স্থির করে ওঠার আগেই ও আমাকে ঠেলে ফেলে দিলো। একটা মস্ত কালো হাঁড়িতে ভাত ফুটছে, তার মধ্যে। ভেতরে কিন্তু ভাত বা গরম কিছুই দেখা গেলোনা। বরং সত্যি করে একটা ক্লাস বসেছে, কিন্তু শেষ হবারো মুখে। আমি ঢুকলেও কেউ মুখ তুলে তাকালো না। সবাই খাতায় অঙ্ক লিখছে। কালোবোর্ডে একটা বিরাট অঙ্ক লেখা। তাতে মাত্র দুটোই সংখ্যা; ইনফিনিটি আর ফ্যাক্টোরিয়াল এন। ফ্যাক্টোরিয়াল এন... n! তো ওদের একের থেকে অন্যকে বিয়োগ করে, যে বিয়োগফল হবে তার সাথে একটাকে যোগ করতে হবে, অন্যটাকে গুণ। আবার যোগফলকে গুণফল দিয়ে ভাগ করে যে ভাগশেষ রইলো তাকে বর্গমূল করে.... বাদ দিন, আমি অঙ্কে বরাবরই কাঁচা। সবার দেখাদেখি খাতায় অঙ্কটা টুকে নিতে চেষ্টা করতেই দিদিমণি বললেন 'বড্ড দেরি করে ফেলেছো। তাঁর মুখে নাক, ঠোঁট, ভুরু কপাল কিচ্ছু নেই, শুধু একটা পুরু চশমা, শুধু দুটো জ্বলজ্বলে কাঁচ যার ওপারে কি আছে দেখা যায় না।
বড্ড। দেরি। করে ফেলেছো। আমি ওপর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ভাতের হাঁড়ির ঢাকনাটা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চারদিকে খালি বুগ বুগ বুগ। ফুটছে। জল, চাল। ফুটছে। ঢাকনাটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ক্লাসের সব ক'জন পড়ুয়া এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে। ওদের প্রত্যেকের মুখে...... শুধু পুরু চশমা, দুটো জ্বলজ্বলে কাঁচ ওপারে কি আছে দেখা যায় না।
মঙ্গলবার: ইশকুলের কথা বলে চোখ পাকাতেই ওলে-লুকৈয়ে বলেছিলো 'আজ তাহলে একটু বেড়াতে যাবে নাকি?' নিয়ে আমার দিকে একটা স্নো-গ্লোব বাড়িয়ে ধরলো। একটু পরেই দেখলাম আমার চারদিকে বরফের কুচি উড়ছে। নিঝুম দুপুর, ভারী মেঘলা আকাশ থেকে নিঃশব্দে বরফ পড়েই চলেছে। এই রকমটা আমার বড় ভালো লাগে। দুনিয়ায় যেন কোনকিছু খোঁচাঅলা নেই, কোথাও কোন ধারালো কিনারা নেই। সব মোলায়েম গোলালো হয়ে যায়। কাঠের বাড়িটার নিচু ছাদের কোণ গুলোও গলে যাওয়া আইসক্রীমের মত মোলায়েম হয়েছিলো। জানলার তলা অব্দি বরফ জমেছে। এক্কেবারে চুপের মধ্যে দিয়ে আমি ভেতরে ঢুকলাম। কেউ নেই। খালি একজন অন্যমনস্ক গন্ধ। দুধ-মধু-দারচিনি, আর মনে হয় সেই যে ম্যাডাগাস্কার আর মেক্সিকোয় যে অর্কিড ফুল ফোটে যার কালো কালো শুঁটি গন্ধদানায় ভরা, সেই। নামটা কি যে! মনে পড়ছে না।
আমার মনের মধ্যে তখুনি ভীষণ ভালোলাগা একটা মনখারাপ কথা বলছিলো। আমাকে দেখালো চারদিকে প্যাকিং বাক্স ভর্তি 'আজিজের রাখালী', 'আলতাজবা', 'সাশা-আলিওশা'। আরো ছিলো, টেবিলের ওপরে লাল সাদা বরফি আঁকা টিনের ড্রাম, পাতলা কাগজের পাল দেওয়া সেই লাল বোম্বেটের জাহাজটা। ঐ কোণে ওক কাঠের ক্রেট থেকে টিনের সেপাই তাকাচ্ছিলো, 'দেখি চিনতে পারে কিনা' এমনি একটা ভাব ওর মুখে। ওর পাশেই কানছেঁড়া রস্কো কুকুর বাচ্চা, উল ওঠা ওঠা। ছোট-বড়ো নুড়ি পাথর, যাদের আমি লাল-গোলাপী রং করেছিলাম। হাতল ভাঙা সেই পেটমোটা নাশপাতি জগ, তার মধ্যে রংপেন্সিল ওদের ভাঙা শীষ নিয়ে এখনো বসেছিলো। নিঝুম বরফ জমা দুপুর, একলা চেনা চেনা গন্ধ, আর চেনা চেনা ওরা সবাই ছবিটাতে ফিসফিস করে কে যেন বলতে লাগলো 'হায় গায়েবী। হায় গায়েবী'। আমার মনের মধ্যে মনখারাপও দীর্ঘশ্বাসের মতো আকূল গলায় কেঁদে উঠলো....'হায় গায়েবী। 'হায় গায়েবী, কোথা গায়েবী।'
বুধবার: ওলে-লুকৈয়ে আমার সামনে হাতের মুঠো খুলতেই দেখলাম দুটো কি যেন রয়েছে। একটা লাল পাথর, ঝকমকে। আরেকটা সাদা, নিটোল গোল। আজ কিছু বলেনি ও। আমি লাল টা তুলে নিতেই দেখি ওর ভেতরে কিছু যেন নড়ছে চড়ছে। চোখের কাছে আনতে ভেতরটা পষ্ট দেখতে পেলাম। ৮বি বাসস্ট্যান্ডের পাশের বাজার খানা। মাটিতে চট পেতে বসেছে সব। দর দাম, আলু বেগুন, মুরগীর পালক মাছের মুড়ো, কমলালেবুর খোসা চায়ের ভাঁড়, ঠেলা আর ঠেলি। নর্দমাটার পাশে দুটো বাচ্চা বসে আছে। আরে! কালিয়া আর গেঁড়ি। ভারতীর ছেলে মেয়ে। এই ছয় আর চার। ভারতী ওদের এখানে ছেড়ে দিয়ে কার বাড়ি কাজে গেলো? কেউ একটা পচা বেদানা ফেলে দিয়েছিলো। গেঁড়ি আর কালিয়া তাই ভাগ করে খাচ্ছে। কি হাসি কি হাসি দুজনের। ওদের কোলে, পায়ের কাছে ছড়িয়ে আছে অনেক কটা লাল পাথর, ঠিক এই রকম। মাণিক।
সাদা গোল খানার ভেতরেও ছিলো। একটা চমৎকার ঘর। সোনার পালং, মখমলের গদি। রাজা শুয়েছিলেন একা একা। একটা পাপিয়া পাখি ডাকছে কোথায়। অথচ বাইরে ভরা বাদর। রাজা শুয়ে আছেন একা একা। জেগে। রাণী দূরে মন্দিরে। মন্দিরের নাম কুম্ভশ্যাম। রাত বাড়ে, কাটে, শেষ হয়..... আবার অন্য রাত। বাড়ে, কাটে, শেষ হয়। আবার অন্য রাত। রাণী? গান আসে শুধু অনেক দূর থেকে 'ম্যায়নে চাকর রাখো জী'। একলা রাজা। রোজ রোজ। আর ব্যথা। বালিশের তলায় অনেক কটা সাদা নিটোল গোল, ঠিক এই রকম। মুক্তো।
বৃহস্পতিবার: পিংকিদিকে যে এখানে দেখতে পাবো তা ভাবিনি। বহুদিন, এমনকি আমার ইশকুল শেষ হবারও আগে থেকে ও সেই কোথায় যেন থাকে। মিনু পিসির কাছে ওদের সুন্দর বাড়ি লাল গাড়ির ছবি দেখা যায়, আর ঝলমলে একটা বিশাল সাঁকোর সামনে দাঁড়ানো ঝলমলে হাসি পিংকি দি। তো সেই তাকে এখানে দেখবো তা ভাবিনি। আচ্ছা আপনি পক্ষীতীর্থ গেছেন নাকি? বা গোমতেশ্বর? সেই রকমই কোন একটা জয়গায় হবে, পিংকি দি অনেক সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে আসছিলো আজকে। সিঁড়ির কাছে এসে সব্বাই নিতান্ত বেকুবের মত হুমায়ুন রাজার কথা ভুলে থাকে। পিংকিদিও পা ফস্কালো। ও পড়ে যাচ্ছে। কত শো যেন সিঁড়ি থেকে ও গড়িয়ে পড়ছে একা একা। ছাদ না ওয়ালা গাড়িটার মত লাল রং মাথায়, কপালে, মুখে ছেয়ে যাচ্ছে প্রতি ধাপে। এই ওলে-লুকৈয়ে কি যে এক জাদু করে, কিছুতেই আপনি হাত পা গুলোকে নিজের বশে রাখতে পারবেন না! আঃ, আমি দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরব কি করে এখন? তবে আমার আগেই ওরা ধরলো ওকে। কতক গুলো বাগান পরিষ্কার করার আঁচড়া। ওরা ওকে ধরলো পড়ার মাঝখানে। আঁচড়ারা ঠিক হাতের মত। ওকে ধরেছে। আঁচড়ারা সব কংকালের হাত। ওকে ধরেছে। প্রত্যেকটা আঙুল দাঁত বার করে। হাসছে, কংকাল প্রত্যেকটা আঙুল দাঁত বার করে। কামড়াচ্ছে ওকে, এখানে ওখানে। আঙুলের জিভ। রক্ত চেটে নেয় ওর মুখ থেকে, বুক থেকে। আঃ, পিংকি দি!
শুক্রবার: এইটা আবার কোন জায়গা? ওলে-লুকৈয়ে আমাকে ডিঙিতে তুলে দিয়েই সরে পড়েছিলো। ব্যস, এখন কোন ঘাটে থামলেন, এরপর কোন দিকে রাস্তা কিছুই জানার উপায় নেই। অবশ্য বৈঠা কোলে চুপ করে বসে দেখা কিছু মন্দ জিনিষ না। এই খানে যেমন অনেক গুলো দিন এসে জড়ো হয়েছিলো। কেউ গনগনে লাল, কেউ বেবাক নীল। দিনের খাতায় একজন বসে দিনের পদ্য লিখছিলো। সে লেখা কেবলই ঝাপসা ঝাপসা হয়ে যায়। যেখানে পৈঠা শেষ হয়েছে সেখানটায় খড়ি দিয়ে কে কি লিখে রেখেছে। দুঃখী কোন দিনের কান্নাবেলার ফিসফিসে কথা সব। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে হয়। কিম্বা ফ্যাকাসে হয়ে আসা অন্য দিনের হাসির রং লেখা থাকতে পারে, আমি দেখিনি। বললাম তো চোখ ফিরিয়ে নিতে হয়। এই রকম দুপুরে মেঘরা পদ্যে নায় ধোয়। বৃষ্টি ঘাটলায় শুধু গুনগুন আর গুনগুন। এই ঝিম সময়ে লাজুক দিনটি হয়তো বসে বসে সেই যে চুরি করে পাওয়া দামাল দিনের সাথের কথা ভাবছিলো। ভালো দেখতে পাইনি আমি.....। আমি শুধু একজন বৃদ্ধ দিনের ঝাপসা মোটা চশমা দেখতে পেলাম। সেই খানে এসেই আমার আজের তুচ্ছ দিন একেবারে পথ হারিয়ে ফেললো। এরপর..... কোন দিকে রাস্তা কিছুই জানার উপায় নেই।
শনিবার: ক্লান্ত লাগছিলো। ওলে লুকৈয়ে বললো 'তাহলে আজ বরং প্যারাডাইসের সেই নৌকোয় ওঠো। মন তাজা হবে।' আবার নৌকো? 'ধুৎ, আমি এক জিনিষ দুবার দেখাইনা কক্ষণো। প্যারাডাইস জানোনা? স্বর্গের বাগিচা। সেখানের নৌকো...'মনে ছিলো, সে নৌকো কোথাও যায়না, খালি জলের ঢেউয়ে দোল খায়। দৃশ্যরাই সব ভেসে যায় তার পাশ দিয়ে। আমারও পাশ দিয়ে নলখাগড়ার বন চলে গেলো। সেখানে ভিজে ঝোপে হাঁসের ছানারা। চুলবুলে হলুদ সুন্দর সব। মাগোঃ, ঐটা কি বড়, কি বিশ্রী ছাই রঙের! নলবনের পরে কোন একটা পুরোনো দিনের শহর ভেসে যাচ্ছিলো। ইঁটের চুল্লির চিমনী দিয়ে বেরিয়ে পড়ে দুনিয়া ঘুরতে যাচ্ছে দুজন মিষ্টি ছেলে মেয়ে। মেয়েটির হাতে রাখালিয়া বাঁকা লাঠি, কুচকুচে ছেলেটির হাতে একটা মই। ও একজন ঝুলঝাড়ুয়া। ঐ শহরটারই কোনো এক বাড়িতে দুজন লোককে দেখা গেল। ওরা ডেকে বলছে 'দেখে যাও ভাই, সম্রাটের জন্য কি চমৎকার কাপড়াই না বুনছি। এমনটি আর কোথাও দেখবে না।' বাস্তবিকই হয়তো। আমি তো এখানেও কিছু দেখতে পেলাম না, ফাঁকা তাঁতটাই কেবল। খানিক পরেই সমুদ্রের গর্জন শোনা গেল। মেঘ করে এসেছে খুব। জলের মধ্যিখান থেকে মাথা জাগানো পাথরে এলো চুলে কে যেন বসেছিলো। ঝোড়ো হাওয়ার শব্দকে ভুল করে আমি গান ভাবলাম। কতকালের সেই সব পুরোনো গান, ওদের কোন ভাষা নেই। শুধু নীল নীল নীল ব্যথা আর চুপ করা সব আকূলতা.... ঝড়ের সমুদ্রে উঠছিলো, পড়ছিলো। মনখারাপ। উঠছিলো, পড়ছিলো।
রবিবার: রবিবার দিন ওলে-লুকৈয়ে এসেই বললো 'গল্প থাক, আজ বরং আমার ভাইয়ের সাথে তোমার আলাপ করিয়ে দিই'। ওর ভাইও এক ঘুমপাড়ানী বুড়ো। কিন্তু সে নাকি একজনের কাছে একবারের বেশী আসেনা। দেখলাম অন্য ঘুমপাড়ানী
বুড়োটাকে। বড় সুপুরুষ। রুপোলী চুল আর কালো মখমলের আলখাল্লা ওর। ভারী শান্ত, ব্যক্তিত্বময়। এই আলাপ টালাপের পর্বে ও আমার সঙ্গে শুধু একটা কথা বললো-'আসবো'। ওলে-লুকৈয়ে কে জিগ্যেস করলাম ওর নাম কি?
বললো- 'মৃত্যু'।