'অপ্রত্যাশিত' বলে একজন লোক আছে। আনেক্সপেক্টেড। এমন অদ্ভুত অদ্ভুত সময়ে অদ্ভুত ভাবে নিঃশব্দে এসে ও তোমার কাছে দাঁড়াবে যে তোমার বিস্ময়ের আর শেষ থাকবেনা। অথচ ওকে জিজ্ঞেস করলেই দেখবে মাথা নাড়ছে। অদ্ভুত ভাবে আসা কেন হবে? ও তো আগেই জানিয়ে দিয়েছে,নিজের নাম দিয়েই। তাহলে অবাক হও কেন? অবাক হলে, ওয়েল, ইট'স টোটালি অন ইউ। আমি অবাক হয়েছিলাম, আবার হইওনি; যখন অপ্রত্যাশিত সেইদিন, সেই সময়ে আমার কাঁধে চুপচাপ হাত রেখেছিলো, ঘোরতর অন্ধকারে তিন আর চার নম্বর কোর্সের মাঝখানে। আমি অন্যরকম শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। ধনুকের ছিলার মত টানটান আমার স্নায়ুতন্ত্রে "টং টং টং" .... কিছু ছিঁড়ে যাচ্ছিলো। এমন শব্দ শুনলে প্রথমেই ভয়ের ঝাপ্টা এসে মনে লাগে। তারপর বুঝতে পারি কোথাও কোনো বাঁধন টান সহ্য করতে না পেরে ছিঁড়ে যাচ্ছে। বাঁধনই। 'স্বাদ'এর সবটুকু পাবার, সবটুকু বোঝার চাহিদার শেকল। ডিজায়ার, গ্র্যাস্পিং, ক্রেভিং। "যেতে দাও", অপ্রত্যাশিত ফিসফিস করে বলে, "লেট গো"। এই অভিজ্ঞতাটা ম্যানিপুলেট করতে চেষ্টা করছি কেন আমি? চাইছি অন্য সবাই যে পরিমাণে স্বাদ পাচ্ছে, আমিও যেন ততটাই পাই। অথবা চাইছি রোজদিন, "নর্ম্যাল" সিচুয়েশনে খাবার সময় আমার অভিজ্ঞতা ঠিক যেমন হয়, এও তাই হোক। ম্যানিপুলেশন, কন্ট্রোল। আমরা নিজেরাই নিজেদের বাঁধতে থাকি অহরহ, এই শক্ত তারগুলো দিয়ে।
লম্বা নিঃশ্বাস পড়ে একটা। হারানোর জন্য তৈরী হয়ে, হারার জন্য তৈরী হয়ে, আমি শক্ত করে ধরে রাখা মুঠি খুলে ছটফটানো চাহিদার হাত ছেড়ে দিলাম। চার নম্বর কোর্স তখন টেবিলে এসে আলতো করে টোকা মারছে।
এবার যে এসেছে তাকে একটা আঙুল দিয়ে ছুয়েঁছি আমি। গোল শেপ, গরম। নীচে কোনো গাঢ় তরল ভিজেভিজে হয়ে আছে। জিভের ওপরে কতকগুলো স্বাদ হাত ধরাধরি করে নাচতে নাচতে চলে গেলো। গ্রীষ্মের স্বাদ, সুগন্ধের স্বাদ, উষ্ণতার। আমি খুব ধীরে মনের মধ্যে তাকাই। কেউ একটা ছবি আঁকছে সেখানে। জলরঙের মত ব্লেন্ডেড, কিনারা-বিহীণ ছবি। প্লেটের মধ্যিখানে মোটা একটা লাল রঙের ব্রাশ স্ট্রোক। টমেটো, রেড ওয়াইন, রসুন -- মারিনারা স্যস? সরু ফিতের মত সবুজ তাজা গন্ধ। বেসিল নিশ্চয়ই। আর ঐ গোল বলের মত জিনিষটা? ভাজা একটা পরত পেলাম সবার ওপরে, ভেতরটা ক্রীমি, মুখে মিলিয়ে গেলো। তোমার নাম 'আরাঞ্চিনি' না? ইতালিয়ান, ভাজা ভাতের চপের মত? অভিজ্ঞতা এবার আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। শেকলহীন নিশ্চিন্ততার হাসি।
আমার অল্প পরিমাণে সিনেস্থেশিয়া আছে। ইন্দ্রিয়-ঘনত্ব। এক ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি গিয়ে অন্য ইন্দ্রিয়ের ঘাড়ে চাপে। আজকে এই চোখহীনতার মধ্যিখানে এসে আমার মনে হলো সিনেস্থেশিয়া ব্যাপারটা আমার শুধু শরীরেরই নয়, মনেরও। মনে হওয়া গুলোও তো যে যার জায়গায় কিছুতেই থাকছেনা দেখি। এই রেস্টুরেন্ট, এই একটা খাবার টেবিল এতক্ষণে স্পষ্ট করেই আমার কাছে একটা আর্ট গ্যালারী হয়ে গেছে। একটা ছবির একজিবিশন। ‘অপ্রত্যাশিত’ দুটো বুড়ো আঙুল তুলে দেখালো আমার দিকে। আর আমি গিয়ে দাঁড়ালাম পাঁচ নম্বর ছবির সামনে।
আমার টোল খাওয়া ঘ্রাণশক্তি আমাকে কিছু তাজা সবুজ ছবি দেখায়। পাতা, আবার পাতা। দু তিন রকম বুনো স্বাদ। আর কোনো একটা ফল আছে। স্পষ্ট একটা চৌকো মত ফ্রুটি স্বাদ পাচ্ছি। কিন্তু কিছুতেই ডিকোড করতে পারিনা এ কোন ফল। ভারী অদ্ভুত এই অনুভূতিটা জানো? ব্যাপারটা এমনি, যেন তুমি সাঁতার জানো, কিন্তু কেউ তোমার পা দুটো বেঁধে জলে ফেলে দিয়েছে। হয়তো শুধু হাত দিয়েই তুমি ভেসে থাকতে পারবে। তবু বোধশক্তি কেমন একটা দুর্বোধ্য শকে থমকে যায়। সত্যি কি পারবে?
আরো গভীরতা আছে এই ছবিটায়। একটা ধারালো টক-মিষ্টি টান, এক ঝলক। বালসামিক ছাড়া আর কেই বা হতে পারে? আর আছে কুড়মুড়ে ছোটছোট কতকগুলো কারা। যেমন পুরনো ছবিতে পর্দার ফাঁক থেকে শেরাবরা উঁকি দিতো, তেমনি। এরা মনে হয় পেয়াঁজভাজা। ক্যারামেলাইজড অনিয়ন নয়, ফ্রেঞ্চ-ফ্রায়েড। কেমন যেন একটা গভীর প্রশান্তি এবার আস্তে আস্তে ছেয়ে যেতে থাকে আমার ভেতরটা জুড়ে। কুলিনারি দুনিয়াতে আমার প্যাশন, আমার প্রথাগত শিক্ষা, আমার বহুদিন ধরে অনেক যত্নে তিলেতিলে সঞ্চয় করা উপলব্ধি, আমাকে ছেড়ে যায়নি। তাদের ধরা হাতের ওম দিয়ে আমি এবার নতুন করে চোখ ফিরে পাই।
মুশকিল হচ্ছে কোনো কিছুতেই সব ভালো পাবেনা তুমি। কেউ একজন না একজন থাকেই যে হতাশ করে। আমার একেক সময় মনে হয় এদের খুব ভেবেচিন্তেই পাঠানো হয়। কেয়ারফুলি ডিজাইনড, স্ট্র্যাটেজিক্যালি প্লেসড। যাতে ভালোর ভালোত্বটা আরো বেশি করে তুমি বুঝতে পারো। কোনো ভিজুয়াল আর্টের চারপাশের নেগেটিভ স্পেসের মত। আমাদের ছ'নম্বর কোর্স সেইরকম ছিলো। হতাশাজনক।
একটা নোন্তা মুচমুচে কিছু, তার ভেতরে একটা নোন্তা পুর আর পাশে একটা মোলায়েম মিষ্টিমিষ্টি জিনিষ। কোনো পরত নেই, সিম্ফনি নেই, স্বাদের ওঠাপড়া, চমক কিচ্ছু নেই। ফ্ল্যাট, মনোটোনাস, রহস্যহীন। পাফপেস্ট্রি, খুব সম্ভবত ব্ল্যাকবীন বা মাশরুমের পুর আর ম্যাশড স্যুইট পটেটো। আনাড়ী রাঁধিয়েরা এমনি বানায়। কি জানি, হয়তো সত্যিই স্ট্র্যাটেজিক্যালি প্লেসড।
রাস্তা শেষ হয়ে আসছে। দূরে কোথাও যেন একটা স্টেশনের ঘন্টি শোনা যায়। রাত্রি এখন আর রাত্রি নেই আমার কাছে। অব্যক্ত একটা ভালোলাগায় মনের ভেতরটা ভরে ওঠার অনুভূতি নিয়ে আমি শেষ কোর্সের হাতে হাত রাখি। ডেসার্ট।
পেলব ছোঁয়া। একটা গন্ধ আমার টাকরার পেছনদিকে, গলার সামনে দিকে ছড়িয়ে যায়। রীচ, লাশাস গন্ধ। যে বাংলা প্রতিশব্দ দিয়ে লিখলে এর ঠিক বর্ণনা হতো সে আর মনে পড়েনি আমার। সেন্সরি এক্সপেরিয়েন্সের ক্লাইম্যাক্সে এসে ভাষার দেশকালের সীমার আমি আর পরোয়া করিনা। যে অনুভূতি এমনিতেই অবর্ণনীয়, তাকে ভাষায় বাঁধতে যাওয়াই এক বাতুলতা। একটা খুব সেনশুয়াল স্পর্শ আমার জিভে খেলা করছিলো তখন। ঐ গন্ধ, নিঃসন্দেহে ক্যারামেল। প্লেন ক্যারামেল নয়, সঙ্গে আরো কিছু আছে। রহস্য তৈরী না করে ও থাকবে কেন? ঐ স্পর্শ, মাখনের মত নরম, সিল্কি। পীনাট বাটার? নাঃ, বাদাম নেই এখানে। কে তুমি? কে গো? আরো একজন ছিলো। গোলালো। সে আমার জিভের ওপরে টং করে পিয়ানোর একটা কী বাজিয়ে দিলো। এক লহমায় এক ঝাঁক সেঁকা নারকোল কোরা ঝটপট করে উড়ে গেলো সেখান দিয়ে। আর তার পরেই গাঢ়, বিশুদ্ধ বিলাসের মত ডার্ক চকলেট। অ্যাবসোল্যুটলি ফুডগ্যাজমিক ডার্ক চকোলেট। পরিপূর্ণতা আমাকে ডুবিয়ে নিতে থাকে। আরো গভীরে। আরোও গভীরে।
রাত ভোর হয়ে এলো। ঘাটের পৈঠার শেষ ধাপে এসে দাঁড়ালে পর আমাদের দু-তিন মিনিট সময় দেওয়া হয়। কন্টেমপ্লেট করার জন্য। ঐ ঘোর অন্ধকারে চোখ খুলে রাখা না রাখা সমান। তবু আমি চোখ বন্ধ করি। মাথা নোয়াই এই প্রগাঢ় অভিজ্ঞতার কাছে। চারপাশে অনেক লোক অনেক কথা বলছে -- "দারুণ হলো কিন্তু, তাই না? আরে হ্যাঁ, ব্যপক, কোনো কথা হবেনা। ধুত, আমার তো গায়েই আদ্ধেক খাবার পড়ে গেলো! যাই বলো না দেখে কিন্তু তত মজা থাকেনা" ইত্যাদি। সব কথার থেকে অনেক দূরে চলে যেতে যেতে আমি জানতে পারি যে এখানে এই অন্ধকারে আজ আমি নতুন করে জন্ম নিয়েছি। আমি বুঝতে পারি দেখার জন্য চোখ জিনিষটার আদৌ দরকার হয়না। আমি উপলব্ধি করতে পারি যে অভ্যাসের শক্ত দেওয়ালটা একবার ডিঙিয়ে নিতে পারলেই ওপাশে একটা বিশাল দুনিয়া পড়ে আছে যার কথা আমার জানা কোনো ভাষা দিয়ে বলা-লেখা যায়না। এই নিকষজাত নতুন আমি আজ রং শুনতে পারি, গন্ধ দেখতে পাই। স্বাদ ছুঁতে আর স্পর্শ শুনতে, কিম্বা খেতে। এর থেকে বড় বাজি কেউই কি কোনোদিন জিততে পারে জীবনে? এখানে জিততেই এসেছিলাম আমি, বলেছিলাম না?
টেবিল ছেড়ে বাইরের দিকে, আলোর দিকে, 'স্বাভাবিক' দুনিয়ার দিকে হাঁটতে হাঁটতে আমার অন্ধকারের জন্য মনকেমন করতে শুরু করে।
~~~
.