এরপর আমরা চললাম আরেকটি গন্তব্যে, মাঝসমুদ্রে ব্যানানা বোটে চড়তে। এই বোট বা নৌকোটি রাবারের তৈরী আর হাওয়া ভরে ফোলানো। দেখতে ঠিক পাকা কলার মতো-ই আর রং-ও হলুদ। উপরে ছয় জন করে বসতে পারে, একটি করে আঙটা লাগানো আছে ধরে থাকার জন্যে। এর সামনে একটি মোটরচালিত বোটে এই ব্যানানা বোট বেঁধে দেওয়া হয় আর দুরন্ত গতিতে মোটরবোট চলতে শুরু করলে এই ব্যানানা বোট-ও কোনোমতে টাল সামলে পাল্লা দিয়ে জল কেটে দৌড়োয়। জলের ফোয়ারা, দুরন্ত গতির সাথে শরীরের ভারসাম্য রাখা আর অসীম সমুদ্রের বুকে ছুটে চলা, একেবারে রোমহর্ষক ব্যাপার বটে। সবাই মিলে খুব উপভোগ করলাম এই রাইড। ... ...
লাক্সর মন্দির থেকে কার্নাকের মন্দির পর্যন্ত ছিল একটি সুপ্রাচীন রাস্তা, যার নাম ‘Alley of Sphinxes’ বা ‘Avenue of Sphinxes’। এই রাস্তাটি ছিল প্রায় দু-কিলোমিটার দীর্ঘ। আমরা বাস থেকেই দেখলাম সেই রাস্তা আর তার দুপাশে স্ফিংক্স-এর সারি, যদিও অধিকাংশ-ই ভাঙা। বাসের একদিকে রয়েছে লাক্সর মন্দির, অন্যদিকে কার্নাক। আর আমাদের বাস এই অ্যাভিনিউ-এর উপর দিয়ে একটি সেতু পার হয়ে এগিয়ে চলল। এই স্ফিঙ্কস-গুলির কিছু তৈরী হয়েছিল ফারাও তুতানখামুনের আমলে, কিছু তৃতীয় আমেনহোটেপের আমলে আর বাকিটুকু ফারাও প্রথম নেকতানেবো-র সময়ে। প্রায় মিনিট পনেরো পরে আমরা এসে দাঁড়ালাম কার্নাক মন্দিরের পার্কিং-এ। ... ...
“কবর দাও বা চিতায় পোড়াও, মরলে সবাই মাটি” না, প্রাচীন মিশরের মানুষ অবশ্যই এভাবে ভাবতেন না, বরং জীবনানন্দের কথা ধার করে বলা যায় “মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব থেকে যায়”; আর মৃত্যুর পরের মানবটির জন্যে গড়ে ওঠে একের পর এক স্থাপত্য, ভাস্কর্য, শিল্পকলা! মরলে মানুষ কোথায় যায়, মৃতেরা এ-পৃথিবীতে না ফিরলেও প্রাচীন মিশরে আনুবিস আর ওসাইরিসের পরীক্ষায় পাশ করলে আর এক সুখের দুনিয়ায় (‘দুয়াত’) পৌঁছে যাওয়া যেত। যেখানে যমদূত-দের চাবুক খেতে না হলেও দেবতাদের তুষ্ট করার জন্যে চাষবাস ইত্যাদি করতে হতো আর মৃত্যুর পরেও জীবিতাবস্থার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা যেত। আত্মা নাকি অবিনশ্বর, তায় যদি পাওয়া যায় তিন তিনখানা আত্মা, তাহলে আর দেখে কে! প্রাচীন মিশরের মানুষ বিশ্বাস করতেন জীবিতাবস্থায় মানুষের একটি আত্মা থাকে, তা হল ‘কা’, এই কা শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর মৃত্যুর পর আরও দুই আত্মা এসে হাজির হয়, একজন হল ‘আখ’, আরেকজন ‘বা’। ‘বা’ পাখির রূপ ধরে সমাধি থেকে বেরিয়ে দিনের বেলায় বাইরের পৃথিবীতে ঘুরতে পারে (এরপর মিশরের আকাশে পাখি দেখলে কি মনে পড়বে ভাবুন একবার); আর আখ হল সেই আত্মা যাকে পরীক্ষায় বসতে হয় ওসাইরিস, আনুবিস, মাত প্রমুখ দেবদেবীর সামনে। এই যে পিরামিডে বা পরবর্তীতে ফারাও বা রাণীদের সমাধিতে মমির সঙ্গে কেটে রাখা প্রত্যঙ্গ, ধনদৌলত, ব্যবহৃত জিনিসপত্র এসব দেওয়া হত, তা ঐ কা-এর সুবিধার্থে। মমিফিকেশনের কথা তো আগেই দ্বিতীয় পর্বে বলেছি, এবার বুক অব দ্য ডেড-এর কথা, কারণ আজ আমরা যাব ভ্যালি অব দ্য কিংস-এ। ... ...
আফ্রিকায় নেকড়ে না থাকলেও নীলনদে কুমীরের কোনো অভাব ছিল না। এবং সেসব নাকি ছিল বেশ হিংস্র, বিশেষতঃ এই কোম ওম্বো-র আশেপাশে তাদের প্রচুর সংখ্যায় মিলত। মিশরের মানুষজন নীলনদ পারাপার করতেও ভয় পেতেন রীতিমতো। সেই ভয় আর বিপদ কাটাতে সুতরাং আবির্ভাব হলো দেবতা সোবেক-এর। সোবেক এর দেহ মানুষের হলেও মুখমন্ডল কুমীরের। হোরাসের মুখ যেমন বাজপাখির। সোবেক-এর সঙ্গে হাথোর কেন এক মন্দিরে যুগ্মভাবে পূজিত, সে রহস্য এখনও অধরা! ভক্তরা যেভাবে তাদের ভগবান-কে পেতে চায়; নইলে এই সোবেক ছিলেন হোরাসের কাকা সেথ-এর অনুসারী। অতএব হোরাসের পরম শত্রু। বলা হয়, সেথ যখন হোরাসের কাছে পরাজিত হলেন, তার সঙ্গীসাথীরা কুমীরের রূপ ধরে নীলনদ বেয়ে পলায়ন করেন, সোবেক তাই এই কুমীর-এর প্রতীক এবং দেবতা। আর সোবেক-এর পুজো করলে কুমীরের হাত থেকে মুক্তি। ... ...
আবু সিম্বেল মন্দির লেক নাসের-এর পশ্চিম তীরে আর নীলনদের দ্বিতীয় ক্যাটারাক্ট বা খরস্রোতের কাছে (প্রথমটি ছিল আসোয়ানে)। প্রথম মন্দিরটি অর্থাৎ ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের মন্দিরটি দেবতা আমুন, পিতাহ এবং রা-হোরাখতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত। দ্বিতীয় মন্দিরটি অর্থাৎ রানী নেফারতারির মন্দিরটি দেবী হাথোরের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এই দুটি মন্দির-ই আসোয়ান হাই ড্যাম তৈরীর সময় জলস্তরের উচ্চতা বেড়ে ডুবতে বসেছিল। ইউনেসকোর সহায়তায় মন্দির-দুটিকে খন্ড খন্ড করে মাপ অনুযায়ী কেটে এনে প্রায় ২০০ মিটার দূরে অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে এনে আবার একইভাবে বসানো হয়, প্রায় চার বছর ধরে এই বিপুল কর্মযজ্ঞ চলেছিল। বলা হয়, বেলজোনি, যিনি এই মন্দির দুটিকে নতুন করে আবার জনসমক্ষে আনেন, তাঁকে আবু সিম্বেল নামে একটি বালক পথ দেখিয়ে এই মন্দিরের চত্বরে পৌঁছে দিয়েছিল, সেই থেকেই এই জায়গার নাম হয় আবু সিম্বেল। ... ...
গিজা থেকে দাশুর প্রায় ঘন্টাদেড়েকের রাস্তা, পঞ্চাশ কিলোমিটার মতো, দুই-তৃতীয়াংশ যাওয়ার পর যেখান থেকে মেমফিসের রাস্তা আলাদা হয়ে গেছে, শুরু হলো ম্যাজিক। রাস্তার দুপাশের ছবি যেন হঠাৎ কোনো জাদুকাঠির ছোঁয়ায় বদলে গেল! সবুজ শীতের ফসলের ক্ষেত আর খেজুর গাছের সারি। ঘন নীল আকাশের গায়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, অপূর্ব শোভা এই রাস্তার, সঙ্গে ভর-দুপুরে প্রাণ-জুড়নো ঠান্ডা হাওয়া! সায়িদি বললো, সাক্কারা আর দাশুরের খেজুরের বাগান খুব প্রসিদ্ধ। আর এখানকার এক বাগানের খেজুরের স্বাদ আর মিষ্টত্ব অন্য বাগানের থেকে আলাদা! পরে খেয়ে দেখেওছিলাম সত্যি তাই। আমরা সাক্কারার রাস্তা ছাড়িয়ে আগে চলে গেলাম দাশুরের পথে। দূর থেকে স্টেপ পিরামিড দেখতে পেলাম। দাশুরের পিরামিড চত্বর একেবারেই খাঁ খাঁ মরুভূমির মধ্যে, ঢোকার সময় রীতিমতো গাড়ির লাইসেন্স ইত্যাদি দেখেশুনে ঢুকতে দেওয়া হলো, এই এলাকাটি মিশরীয় সেনার আওতায় ... ...
লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো-এর জন্যে আমরা ঢুকলাম গিজা কমপ্লেক্সের পিছন দিকে। এখান থেকে প্যানোরামিক একটি ভিউ পাওয়া যায় পুরো অঞ্চলটির। খোলা শান-বাঁধানো চত্বরে প্রায় হাজার খানেক বসার চেয়ার। এর একেবারে সামনেই রয়েছে ফারাও খাফ্রের পিরামিড, তার ডানপাশ ঘেঁষে সামনেই গ্রেট স্ফিংক্স। আরও ডানদিকে ফারাও খুফুর পিরামিড। আর খাফ্রের পিরামিডের বাঁদিকে বেশ কিছুটা দূরে ফারাও মেনকাউরে-র পিরামিড। দিনক্ষণ দেখে আসিনি বটে, শুধু আমাদের বিশেষ দিনটুকু মধ্যমণি করে আসা, তাও যখন এই আঁধারে অপ্রত্যাশিতভাবে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় চারদিকে ‘সমুদ্র সফেন’, আর সেই অপূর্ব জ্যোৎস্না সাড়ে চার হাজারের ইতিহাস ধুইয়ে দিচ্ছে চোখের সামনে, সেটুকু দেখে আনন্দে মন ভরে উঠবেই। এই আমাদের প্রথম পিরামিড দেখা, এমন অপার্থিব আবহে! একবার বিরাট থালার মতো চাঁদের দিকে তাকাই, আর একবার পিরামিডের দিকে, সে-শোভা বর্ণনা করার ভাষা নেই! কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে সাতটায় শুরু হলো আমাদের শো। মিশরের ফারাও যুগের প্রাচীন ইতিহাস আর সঙ্গে আলোর খেলা - পিরামিড, স্ফিংক্স, আর পাথরের গায়ে প্রাকৃতিক প্রোজেক্টর স্ক্রীন-এর উপর। ... ...
আলেকজান্দ্রিয়া – ৩৩২ খ্রীষ্টপূর্ব – ম্যাসিডোনিয়ার সম্রাট তৃতীয় আলেকজান্ডার (ওরফে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট) পারস্য জয় করে আজকের গাজা পার হয়ে এসে ঢুকে পড়লেন মিশরে। পারস্যের অত্যাচার আর লুন্ঠন থেকে বাঁচতে মিশর-ও বাধ্য হয়ে বেছে নিল ‘লেসার ইভিল’ আলেকজান্ডারকে (যদিও তাঁর দিগবিজয়ে যাঁরা বাধা দিয়েছেন তাঁদের উপর অত্যাচারের কোনো মাত্রা রাখেননি , পুরু বা পোরাসের গল্প সত্যি ইতিহাস কিনা তা নিয়ে আজকের দিনে ধন্দ আছে) , তায় আবার যুদ্ধবিগ্রহে তিনি মিশরের প্রাচীন ফারাওদের মতো-ই পারদর্শী! তার উপর প্রথমেই মিশরে এসে তিনি দেখতে চাইলেন ‘এপিস বুল’-কে এবং সম্মান জানালেন! ব্যস, মিশরীয়রা মুগ্ধ, নির্ঘাৎ সেই প্রাচীন যুগের-ই কোনো মহান ফারাও এসে গেছেন তাঁদের রক্ষা করতে। সুতরাং নীলনদের উপত্যকা সহজেই বিনা বাধায় ম্যাসিডোনিয়ান সাম্রাজ্যের আওতায় এসে গেল। কিন্তু আলেকজান্ডার আরও উত্তরে গেলেন হোমারের ওডিসি-তে পড়া ফারোস দ্বীপের সন্ধানে, পেলেন এবং তাঁর নিজের নামে একটি শহর স্থাপন করলেন , ব্যবসা-বাণিজ্য আর ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ আর রাজ্যগুলিতে যাতায়াতের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগকারী স্থান হিসেবে। ... ...
মৃত্যুর পর মৃতদেহের মমি তৈরীর পদ্ধতি ছিল যথেষ্ট সময় আর খরচ-সাপেক্ষ। তাই ফারাও, তার পরিবার বা বিশিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া মমি বানানোর চল কম-ই ছিল। মৃত্যুর পর মমি তৈরীর পারদর্শী পুরোহিতের তত্ত্বাবধানে মামিফিকেশনের জন্য নির্দিষ্ট বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হত মৃতদেহ। সেখানে ‘ইবিউ’ নামক স্থানে দেহ ধুয়ে শুদ্ধ করে নেওয়া হতো। তারপর ‘পার নেফার’ নামক স্থানে শুরু হতো সেই দেহের সৌন্দর্য্যায়ন বা মামিফিকেশন। এর বিশদ বর্ণনা অধিকাংশটাই দিয়ে গেছেন গ্রীক পন্ডিত হেরোডোটাস। প্রথমে সরু আর সামনের দিকে বাঁকানো একটি যন্ত্র নাকের গর্ত দিয়ে ঢুকিয়ে মস্তিষ্ক কুরে কুরে বের করে নেওয়া হতো আর সেই ফাঁকা জায়গায় নল দিয়ে পাঠানো হত ক্ষয়রোধী জৈব রস আর সুগন্ধী। এরপর পেটের বাঁদিক চিরে বের করে নেওয়া হতো ফুসফুস, অন্ত্র, যকৃৎ আর পাকস্থলী, ভালো করে নুন মাখিয়ে সেসব রাখা হতো চারটি আলাদা ঢাকা দেওয়া পাত্রে (ক্যানোপিক জার)। এই চারটি পাত্র আবার চারজন দেবতা রক্ষা করতেন। তাঁরা হলেন দেবতা হোরাসের চার ছেলে – ইমসেতি, হাপি, দুয়ামুতেফ আর কেভসেন্যুফ। ... ...
“ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের রাজত্বকালে …” ফ্ল্যাশব্যাক! ক্লাস সিক্স, প্রাচীন যুগের ইতিহাস পড়াচ্ছেন শঙ্করবাবু, তাঁর উদ্যত ডানহাতের তর্জনী আর মধ্যমার সঙ্গে হাই পাওয়ারের চশমার আড়ালে ঘোলাটে চোখ ঘুরে চলেছে ঘরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত, বাঁহাতে ধরা বই যা তাঁর তেমন কোনো কাজে আসে না সিলেবাস মিলিয়ে নেওয়া ছাড়া, সবই যেন তাঁর কন্ঠস্থ! আমাদের উৎসুক মনের সঙ্গে পরিচয় করাচ্ছেন সাড়ে চার হাজার বছরের পুরনো এক সভ্যতার, মিশর নামের দেশে যার উৎপত্তি। খুফু, সেতি, রামেসিস, নেফারতিতি, হ্যাৎসেপশুট নামগুলোর সঙ্গে পরিচয় ঘটছে, পরিচয় ঘটছে অদ্ভুত এক লিপির, ফুল, পাখি, সূর্য এসব দিয়েই যার অক্ষর, শব্দ, বাক্য গড়ে ওঠে! তার নাম হায়রোগ্লিফ! ক্লাস শেষ হতে লাইব্রেরী তন্ন তন্ন করে রেফারেন্স বই ঘেঁটে চলেছি যদি কোথাও কোনো সূত্র পাওয়া যায় এই লিপি শেখার আর নিজের নাম লিখে ফেলার, সাংকেতিক অক্ষরে! হায় রোসেটা পাথর, তোমার নাম সে বালখিল্যরা তখনও শোনে নাই, শোনে নাই শাম্পোলিয়ন বা থমাস ইয়াং-এর নাম! তার জন্যে অপেক্ষা আরও প্রায় বিশটা বছর! আর সামনে থেকে সত্যিকারের সেই দেওয়াল-ভরা রঙচঙে লিপি দেখা – আরও বছর দশ! ইতিহাস বই-এর পাতা থেকে সারি দিয়ে তিনটে পিরামিডের সামনে মধ্যমণি হয়ে বসে থাকা স্ফিঙ্কস স্বপ্নের জাল ছিঁড়ে কোনোদিন ঘোর বাস্তবে নেমে এসে চোখের সামনে ধরা দেবে, ছুঁয়ে দেখবো তাদের, ভাবিনি তো! ... ...