ভ্যালি অব দ্য কিংস থেকে বেরিয়ে আসতে ঘড়ির কাঁটা প্রায় বারোটা ছুঁই ছুঁই! উপত্যকা তখন রোদে ভেসে যাচ্ছে, বেশ গরম বেড়ে গেছে; পার্কিং এ বাসে উঠতেই সুশান্ত আর সামাহ আমাদের সকলের হাতে এক এক করে ধরিয়ে দিল চনমনে আইসক্রিম। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল! কিন্তু তারপরেই একখানি দুঃসংবাদ। কার্নাকের মন্দির, যা আমাদের দেখার কথা ছিল গতকাল বিকেলে, সেটা এখন দেখা হবে, কিন্তু সময়ের অভাবে সেজন্যে বাদ পড়বে হ্যাৎসেপশুটের দাইর-এল-বাহারির মন্দির। মানে দেখা হবে কিন্তু তা বাইরে থেকে, ভিতরে প্রবেশ করার সময় পাওয়া যাবে না, যেহেতু আমরা কার্নাকের মন্দির দেখে মধ্যাহ্নভোজ সেরে সোজা রওনা দেবো হুরগাদা। পৌঁছোতে সন্ধ্যে পেরিয়ে যাবে। আমাদের পুরো প্ল্যানে এইটুকুই কলঙ্ক রয়ে গেল তাহলে। তবে যা দেখলাম বা দেখবো তাই বা কম কী! সেই একই পাহাড়ি উপত্যকার রাস্তা দিয়ে খানিক চলার পরেই দূর থেকে দেখা গেল ফারাও হ্যাৎসেপশুটের মন্দির। প্রাচীন তো বটেই, এমনকি আধুনিক মিশরেও মনে হয় নারীদের জন্যে নির্মিত এবং নির্দিষ্ট মন্দির দুটি, একটি আবু সিম্বেলের নেফারতারির মন্দির, অপরটি দাইর-এল-বাহরিতে হ্যাৎসেপশুটের মন্দির। হ্যাৎসেপশুটের যেকটি প্রতিকৃতি বা মূর্তি পাওয়া গেছে, সেসব সাক্ষ্য দেয়, তিনি ছিলেন সুন্দরী আর তার সঙ্গে ইতিহাস যোগ করে, তিনি ছিলেন ব্যক্তিত্বময়ী এবং শিক্ষিত।
অষ্টাদশ রাজবংশের ফারাও প্রথম থুৎমোস এবং তাঁর পাটরাণী আহমোসের কন্যা ছিলেন হ্যাৎসেপশুট। সৎভাই দ্বিতীয় থুৎমোসের সঙ্গে পরে তাঁর বিবাহ হয় এবং পরে তাঁদের কন্যার সঙ্গে বিবাহ হয় সৎ-পুত্র তৃতীয় থুৎমোসের। এতরকম থুৎমোস (এর সঙ্গে আছে রামেসিস আর আমেনহোটেপ) শুনলে অবধারিত-ভাবে বাঙালীর মনে পড়বেই ‘আমার নাম হিজিবিজ্বিজ্, আমার ভায়ের নাম হিজিবিজ্বিজ্, আমার বাবার নাম হিজিবিজ্বিজ্’ অথবা ‘আমার মামার নাম তকাই, আমার খুড়োর নাম তকাই, আমার মেসোর নাম তকাই, আমার শ্বশুরের নাম তকাই’। তো হেন থুৎমোস বংশের হীরকখন্ডটি ছিলেন হ্যাৎসেপশুট, শিক্ষা-দীক্ষা-ব্যক্তিত্বে এবং রাজত্ব পরিচালনায়। দ্বিতীয় থুৎমোসের অকালমৃত্যুর পর যখন তৃতীয় থুৎমোস খুবই ছোট, তখন রাজ্যপরিচালনার ভার তুলে নেন হ্যাৎসেপশুট, আর কয়েক বছরের মধ্যেই নিজেকে ফারাও বলে ঘোষণা করেন। যদিও তাঁর ফারাও হওয়ার পথ এত মসৃণ ছিল না। মিশরের জনগণের মন পেতে হাজির করতে হয়েছিল এক অভিনব গল্পের, যেখানে দেবতা আমুন প্রথম থুৎমোসের রূপ ধরে এসে মিলিত হয়েছিলেন রাণী আহমোসের সঙ্গে আর আমুনের আশীর্বাদে বা ঔরসে আহমোসের গর্ভে এসেছিলেন হ্যাৎসেপশুট, সুতরাং তিনি দেবকন্যা এবং যোগ্য ফারাও। ভেবে দেখলে আমাদের রামায়ণ-মহাভারতের নায়কদের জন্মের গল্প প্রায় একইরকম – দেবতার আশীর্বাদে অথবা শিকড় বেটে খেয়ে অথবা কোনো বায়বীয় পথে কোথা থেকে কি হইয়া গেল, রাণী গর্ভবতী হইলেন। মিশর ঘুরে আসার পর এখন কেমন সন্দেহ হয়, এই প্রাচীনতর সভ্যতাগুলোর মধ্যে হয়ত সেযুগে যোগাযোগ ছিল বা ঘটেছিল, হয়ত মুখে মুখে প্রচার হয়েছিল এই গল্পগুলোর-ও, যা থেকে নতুন গল্প অনুপ্রেরণা পেয়েছিল, কি জানি! এছাড়াও হ্যাৎসেপশুটের মূর্তি, ছবি বা রিলিফে আনা হল পুরুষ ফারাও-এর অবয়ব, ছেঁটে ফেলা হল নারীত্বের প্রকাশটুকু, জুড়ে দেওয়া হল নকল দাড়ি, তৈরী হল স্ফিংক্স (দ্বিতীয় পর্বে এসব আমরা দেখে এসেছি, আবার দেখবো কার্নাকের মন্দিরে) হ্যাৎসেপশুটের প্রায় বাইশ বছরের রাজত্বকালে (১৪৭৯ থেকে ১৪৫৮ খ্রীষ্টপূর্ব) মিশরে বিশেষ যুদ্ধবিগ্রহের কথা শোনা যায় না (শুধু দুটি বাদে, কানান এবং নুবিয়ায়, তবে সেসব নেহাৎ ছোটোখাটো দস্যুদমন ধরণের, গায়ে পড়ে যুদ্ধ নয়), বরং শান্তি-সমৃদ্ধি ছিল। পুন্তের সঙ্গে মিশরের বাণিজ্যের যোগাযোগ-ও ঘটেছিল এই সময়ে ফারাও-রাণীর নিজের উদ্যোগে, মূলতঃ মজবুত কাঠ, রজন, পশুর চামড়া, সোনা আর নানারকম সুগন্ধী, মশলা ইত্যাদি আমদানী করা হত পুন্ত থেকে। এই পুন্ত দেশটি ছিল অধুনা লোহিত সাগরের একেবারে প্রান্তে মিশরের দক্ষিণে। এই যে আমাদের মন্দিরে যাওয়া হল না, এই মন্দিরে পুন্তের সাথে মিশরের বাণিজ্যের কিছু ছবি/রিলিফ রয়ে গেছে, সেটুকু দেখা হল না। আর দেখা হল না কিছু রিলিফ যেখানে বোঝা যায় বেশ ইচ্ছাকৃতভাবেই হ্যাৎসেপশুটের নামের কার্তুশ মুছে দেওয়া হয়েছে, এর পাশেই থেকে গেছে পরবর্তী ফারাও তৃতীয় থুৎমোসের কার্তুশ। এখনও পর্যন্ত মনে করা হয় তৃতীয় থুৎমোস প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় এই তিন থুৎমোসের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে মাঝে কোনো নারী ফারাও-এর অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণভাবে মুছে দিতেই একাজ করেছিলেন, তবে এমনও হতে পারে এ-কাজ হয়েছিল তৃতীয় থুৎমোসের মৃত্যুর পর অথবা আরও পরে! প্রশ্ন উঠতেই পারে, মিশর কি কোনোকালেই এক নারীকে ফারাও হিসেবে চেয়েছিল বা মেনে নিয়েছিল মনে-প্রাণে? এই প্রশ্ন নিয়ে তর্ক চললেও, ইতিহাস বলে, সেই নারী ফারাও-এর রাজত্বেই মিশর ছিল সবচেয়ে সুখে, শুধু যুদ্ধ নয়, বাণিজ্য দিয়েও যে প্রতিবেশী রাজ্য বা দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং শান্তি স্থাপন করা যায় এও হ্যাৎসেপশুট দেখিয়েছিলেন।
হ্যাৎসেপশুটের মন্দির
মন্দিরের দুটি তল মূলতঃ, প্রথম তলে ওঠার জন্যে মাটি থেকে উপরের দিকে চলে গেছে লম্বা ঢালু একটি পথ। দুই তলেই শুরুতে লম্বা থামের সারি। দ্বিতলে থামের সঙ্গে রয়েছে হ্যাৎসেপশুটের মূর্তি , কিন্তু মাত্র চার-পাঁচটি অবশিষ্ট আছে এখন। এর পিছনে নাকি আছে আরও একটি চাতাল। আমরা নীচ থেকেই মন্দির দেখলাম; সামাহ তাড়া দিল যাতে কার্নাকে আমরা বেশী সময় কাটাতে পারি। অতএব ফিরে এসে এবার আমরা ধেয়ে চললাম কার্নাকের মন্দিরের পথে, অর্থাৎ আবার আমরা ফিরবো নীলনদের পূর্বপাড়ে।
অ্যভিনিউ অব স্ফিংক্স - দূরে কার্নাকের মন্দির
লাক্সর মন্দির থেকে কার্নাকের মন্দির পর্যন্ত ছিল একটি সুপ্রাচীন রাস্তা, যার নাম ‘Alley of Sphinxes’ বা ‘Avenue of Sphinxes’। এই রাস্তাটি ছিল প্রায় দু-কিলোমিটার দীর্ঘ। আমরা বাস থেকেই দেখলাম সেই রাস্তা আর তার দুপাশে স্ফিংক্স-এর সারি, যদিও অধিকাংশ-ই ভাঙা। বাসের একদিকে রয়েছে লাক্সর মন্দির, অন্যদিকে কার্নাক। আর আমাদের বাস এই অ্যাভিনিউ-এর উপর দিয়ে একটি সেতু পার হয়ে এগিয়ে চলল। এই স্ফিঙ্কস-গুলির কিছু তৈরী হয়েছিল ফারাও তুতানখামুনের আমলে, কিছু তৃতীয় আমেনহোটেপের আমলে আর বাকিটুকু ফারাও প্রথম নেকতানেবো-র সময়ে। প্রায় মিনিট পনেরো পরে আমরা এসে দাঁড়ালাম কার্নাক মন্দিরের পার্কিং-এ। নেমে আমাদের হাতে সামাহ টিকিট ধরিয়ে দিল। ভিজিটর সেন্টারে প্রবেশ করে একটি বেশ বড় হলঘরে নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হয়ে দেখি ঘরের মাঝখানে পুরো মন্দির চত্বরের একটি প্রতিরূপ কাচের বাক্সে রাখা রয়েছে। আর একপাশে দু-দুটি সেই পরপারে যাওয়ার নৌকো, একটি হোরাসের, একটি আমুনের। এখান থেকে বেরিয়ে বেশ কিছুটা ফাঁকা এলাকা পেরিয়ে মন্দিরের তোরণ, তার আগে রয়েছে দুটি ওবেলিস্ক আর দুপাশে সারি দিয়ে ভেড়া-মুখী আমুনের আদলে স্ফিংকস। ওবেলিস্ক দুটি অবশ্য ছোটো, নির্মাণ করিয়েছিলেন ফারাও দ্বিতীয় সেতি। আর স্ফিংকসগুলির পায়ের কাছে দ্বিতীয় রামেসিসের ছোটো মূর্তি যা দেখে সহজেই নির্মাতার কথা জানা যায়। কার্নাক মন্দিরের প্রধান দেবদেবীরা হলেন তিনজন, আমুন, মাত এবং মন্টু। মন্টু ছিলেন যুদ্ধের দেবতা। কার্নাকের একেবারে উত্তরদিকে এঁর মন্দিরটি এখন প্রায় পুরোটাই ধ্বংসাবশেষ! মাত-এর মন্দিরটির অবস্থাও ভগ্নদশা। মাত হলেন আমুন-এর স্ত্রী। এই দুটি মন্দিরই অবশ্য কার্নাকের মূল মন্দির চত্বর থেকে কিছুটা দূরত্বে। দেখার বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই, তাই আমরা ওদিকে আর গেলাম না। এই মন্দিরের নির্মাণ ধাপে ধাপে বিভিন্ন যুগের ফারাওদের রাজত্বকাল জুড়ে হয়েছে। প্রায় ২০০০ খ্রীষ্টপূর্বের আশেপাশে এর পত্তন। প্রত্যেক ফারাও-ই নাকি চাইতেন এখানে, এই আমুন বা আমুন-রা-এর মন্দিরে নিজের নাম খোদাই করা থাক আর কিছু স্থাপত্যকার্য থাক, এতে নাকি অমরত্ব লাভ করা যায়। এই মন্দিরের একটি বিশেষত্ব হল, যখন যে ফারাও স্থাপত্য বানিয়েছেন, দরকার মত আগের স্থাপত্যগুলিকে ধূলিসাৎ করে তার উপর নিজের নির্মাণ করেছেন। তাও গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু স্থাপত্য এত হাজার বছর পরেও টিকে গেছে।
কার্নাক মন্দিরের ভিজিটর সেন্টার
নৌকোর মডেল, সামনে হোরাসের নৌকো পিছনে আমুনের
কার্নাক মন্দিরের প্রবেশপথ - সামনে দুটি ছোটো আধভাঙ্গা ওবেলিস্ক আর দু-সারি আমুনের অবয়বে স্ফিংক্স
কার্নাক মন্দিরে সব মিলিয়ে প্রায় দশটি তোরণদ্বার আছে। এর মধ্যে মূল চত্বরে আছে ছটি তোরণ। প্রথম তোরণটি সম্ভবতঃ কুশাইট রাজবংশের ফারাওদের তৈরী, এটি পেরনোর পর একটি বিশাল প্রাঙ্গণ। এর ডানদিকে রয়েছে ফারাও তৃতীয় রামেসিসের নির্মিত ছোটো একটি মন্দির। মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে দুদিক জুড়ে হায়রোগ্লিফ কুঁদে কুঁদে লেখা রয়েছে নাকি তৃতীয় রামেসিসের বিভিন্ন যুদ্ধজয়ের কাহিনী! ভিতরে ঢুকে একটি খোলা চত্বরের তিনদিকে ঘেরা, দুইদিকে দুই সারি তৃতীয় রামেসিসের মূর্তি, যদিও কোনোটিই অক্ষত নেই আর। সামনে একটি ছোটো হাইপোস্টাইল হল। এরপর তিনটি গর্ভগৃহ যেখানে পূজিত হতেন আমুন, মাত আর তাঁদের পুত্র খোনসু। শুধুমাত্র ফারাও এবং প্রধান পুরোহিতেরই দেবতাদের মূর্তির দিকে তাকানোর অধিকার ছিল। মন্দিরে থেকে বেরিয়ে মূল প্রাঙ্গণে ফিরে এসে দেখলাম দ্বিতীয় রামেসিসের একটি সুউচ্চ গ্র্যানাইটের মূর্তি, পায়ের কাছে নেফারতারির ছোটো একটি মূর্তি, নেফারতারির এই মূর্তিটি প্রায় অক্ষত।
তৃতীয় রামেসিসের মন্দির
দ্বিতীয় রামেসিস ও নেফারতারি
দ্বিতীয় তোরণ পার হয়ে এরপর এই মন্দিরের বিখ্যাত হাইপোস্টাইল হল আর তার আকাশচুম্বী থামের সারি। ঘাড় উঁচু করে সেইসব থামের গায়ে আঁকা রঙিন কারুকাজ দেখতে সত্যি ঘাড় ব্যথা হওয়ার জোগাড়! দ্বিতীয় তোরণটি সম্ভবতঃ উনিশতম রাজবংশের আমলে নির্মিত। এই হলের অধিকাংশটাই নির্মাণ করেছিলেন ফারাও প্রথম সেতি আর দ্বিতীয় রামেসিস – পিতাপুত্র মিলে। থামের গায়ে সুন্দর রঙিন কারুকাজ, আমুন-রা-এর রিলিফ, ছবি, সেতি আর রামেসিস তো আছেনই, দেওয়ালে অন্যান্য ফারাওদের ছবিও রয়েছে। এই হলের উত্তরের দেওয়ালে রয়েছে প্রথম সেতি-র বিভিন্ন যুদ্ধজয়ের (অধুনা সিরিয়া ও লেবাননের বিভিন্ন অঞ্চলে হওয়া যুদ্ধ) রিলিফ, আর দক্ষিণের দেওয়ালে দ্বিতীয় রামেসিসের কাদেশের যুদ্ধের (পর্ব ৬ দ্রষ্টব্য) শান্তি-চুক্তির কিছু অংশ হায়রোগ্লিফে খোদাই করা। এই হল থেকে বেরনোর পথে তৃতীয় তোরণটি তৈরী করিয়েছিলেন ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপ। এই তোরণ পার হলে দ্বাদশ রাজবংশের ফারাও সেনুসারেত-এর একটি প্যাভিলিয়ন (যা মাটির নীচ থেকে খননকার্যের ফলে পাওয়া), আর তারপর সামনেই ফারাও প্রথম থুৎমোসের ওবেলিস্ক। প্রথম থুৎমোস দুটি ওবেলিস্ক নির্মাণ করিয়েছিলেন, যা ছিল কার্নাক মন্দিরের প্রথম ওবেলিস্ক, এখন অবশ্য একটিই অবশিষ্ট আছে। এরপর চতুর্থ এবং পঞ্চম তোরণ দুটি-ই নির্মাণ করেছিলেন প্রথম থুৎমোস। এই চত্বরটির অধিকাংশই এখন ভগ্নাবশেষ। যদিও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রথম থুৎমোসের কন্যা ফারাও হ্যাৎসেপশুটের সাড়ে ঊনত্রিশ মিটার উচ্চতার ওবেলিস্ক যেটি প্রথম থুৎমোসের ওবেলিস্কের চেয়েও উচ্চতর। একটিমাত্র সুবিশাল অখন্ড গ্র্যানাইট পাথরকে কেটে এই ওবেলিস্ক তৈরী করা হত, পাথর আনা হত আসোয়ান থেকে নীলনদ বেয়ে, আর তারপর সেই ওবেলিস্কে খোদাই করা হত হায়রোগ্লিফ, কার্তুশ, ছোটোখাটো রিলিফ, সব সম্পন্ন হলে তারপর শায়িত অবস্থা থেকে খাড়া করে দাঁড় করানো হত, দেখে বোঝা যায় কি বিরাট কর্মযজ্ঞ চলত। হ্যাৎসেপশুটের আরেকটি ওবেলিস্ক অবশ্য ভেঙে দুভাগ হয়ে যাওয়ায়, উপরের ভালো অংশটিকে পাশেই একটি চত্বরে স্থাপন করা হয়েছে। এরপর ষষ্ঠ তোরণ, যেটি আকারে অনেকাংশে ছোটো, নির্মাণ করিয়েছিলেন ফারাও তৃতীয় থুৎমোস। সবশেষে গর্ভগৃহ, আর তার পূর্বদিকে তৃতীয় থুৎমোসের নির্মিত আমন-রা কে উৎসর্গীকৃত মন্দির। তৃতীয় থুৎমোস, হ্যাৎসেপশুটের মৃত্যুর পর তাঁর একক রাজত্বকালে প্রায় সতেরোটি যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন, তার স্মারক হিসেবে নাকি এই মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। এখন অবশ্য এগুলির ধ্বংসাবশেষ ছাড়া কিছু নেই।
হাইপোস্টাইল হলের কারুকার্যময় গগনচুম্বী থামের সারি
কাদেশের শান্তিচুক্তির কিছু অংশ মন্দিরের গায়ে
আরও কিছু লিপি খোদাই করা - সম্ভবতঃ প্রথম সেতির যুদ্ধজয়ের বর্ণনা
প্রথম থুৎমোসের ওবেলিস্ক
হ্যাৎসেপশুটের ওবেলিস্ক - ধ্বংসস্তূপের মাঝে
পিতা-পুত্রীর ওবেলিস্ক (বাঁয়ে প্রথম থুৎমোস,ডানে হ্যাৎসেপশুট)
হ্যাৎসেপশুটের অর্ধভগ্ন দ্বিতীয় ওবেলিস্কের উপরের অংশটুকু
স্কারাব (খেপের) ও তিনটি ওবেলিস্ক একসাথে - ওদিকে প্রদক্ষিণ চলছে স্কারাবের চারপাশে
ফেরার পথে ডানপাশে রয়েছে আরও চারটি তোরণ। সপ্তম তোরণটি তৃতীয় থুৎমোসের, অষ্টমটি হ্যাৎসেপশুটের, নবম আর দশম তোরণটি যথাক্রমে ফারাও তুতানখামুন এবং হোরেমহেব-এর নির্মিত। এই চত্বরের পাশেই রয়েছে পবিত্র হ্রদ, যেখানে পুজোর নানা আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন হত। আর রয়েছে বিখ্যাত সূর্য-দেবতার প্রতীক স্কারাব বিটল (খেপের) অর্থাৎ গুবরে পোকার একটি বড় গ্র্যানাইটের মূর্তি, যার নির্মাণ করিয়েছিলেন ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপ। এর চারপাশে তিনবার প্রদক্ষিণ করলে নাকি অভীষ্ট সিদ্ধি হয়। অনেকেই দেখলাম প্রদক্ষিণ করছেন। আমরা পাশের অর্ধভগ্ন হ্যাৎসেপশুটের দ্বিতীয় ওবেলিস্কটি কাছ থেকে ভালো করে দেখে এলাম। এই চত্বরটি থেকে একই ফ্রেমে স্কারাব সহ তিনটি ওবেলিস্ক-কে সুন্দর ধরা গেল। দেখতে দেখতে কখন যে ঘন্টা আড়াই কেটে গেছে বুঝতেই পারি নি। সামাহ-র তাড়ায় সম্বিত ফেরে। ততক্ষণে দলের অন্য পর্যটকরা পার্কিং এর কাছে চলে গিয়েছে। কার্নাকের এই সুবিশাল মন্দিরকে বিদায় জানিয়ে আমরাও ফিরে চললাম জোর কদমে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।