"ধুত, এরকম চরম বোরিং কাজ জানলে কোন হতভাগা এ চুলোয় আসতো! ওঁর এত নাম কেন? এই মিস 'রোহা'র?"
"আমি জানিনা। চুপ কর, নইলে এখুনি ঝাড় খেতে হবে!"
"আমাদের দেশের বইয়ের গোয়েন্দারা পটাপট খুনী ধরে, সেলিব্রিটিদের বকা দেয়, সুন্দরী পুলিশরা তাদের সাথে ছ্দ্ম-ঝগড়া করে, কিন্তু সঙ্গে নিয়েও ঘোরে। তোদের?"
"আমাদের? আমাদের বইয়ের গোয়েন্দাদের লোকে 'বিখ্যাত প্রাইভেট ডিটেক্টিভ দ্য গ্রেট বিতংস চ্যাটার্জী' বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। টীনেজার ছোকরাকে দেখে লোকে বলে 'ও, তুমিইই গোয়েন্দা অর্ক? কাগজে যার নাম বেরিয়েছিলো?"
"হৈঃ, বক্কাবাজি থামা মুখপোড়া! বই এর গোয়েন্দা হবার লোভ থাকলে গাঁজায় দম দিগে যা। এখানে কি তোদের দুটোকে আমি মুখ দেখবার জন্য এনেছি?"
প্রথম চারটে সংলাপ ডনির আর আমার। শেষের মধুর ভাষণটি মিস রোহার। সিকিউরিটি চীফ।
ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন কোর্সে আমাদের পড়তে হয়েছিলো 'রিটেল সিকিউরিটি অ্যান্ড লস প্রিভেনশন'। তো 'শপ লিফটিং' নিয়ে শেখানোর সময় আমাদের মেন্টর বললেন "ভালো করে শিখতে চাইলে রোহা অ্যাডেলবার্টোর কাছে এক মাস ইন্টার্ন হয়ে থাকো। বই পড়ে সব হয়না। এ লাইনে ওঁর মত এক্সপার্ট কম আছে।" অনেক রিটেল দোকানই তাদের জিনিষপত্র পাহারা দেবার দায়িত্ব কোনো এজেন্সীকে দেয়। সেরকম বড় বিজনেস চেন বা দোকান হলে তাদের ইন হাউস ডিটেক্টিভ থাকেন, এইসব কাজের জন্য। রোহা অ্যাডেলবার্টোর এজেন্সী দীর্ঘদিন নামীদামী দোকানের সাথে কাজ করে আসছে।
রোহার অফিস ঘরের অর্ধেকটা জুড়েই ট্রোফি ক্যাবিনেট। বছর ষাটের ভদ্রমহিলা। গোলগাল, সাদা ফুরফুরে চুল। দেখে মনে হয় মিষ্টি দিদিমাটি। কিন্তু বাপ রে কী মেজাজ তাঁর! আর কথার ধার! কিন্তু ওঁর কাছেই আমাদের মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে। উনি আমাদের শপ-লিফটিং এর ঘাঁতঘোঁত শেখাবেন। কেমন করে হাতে কলমে চুরি ধরতে হয়, চোর ধরতে হয়।
আমরা বেশ নামডাক ওয়ালা একটা ডিপার্টমেন্ট স্টোরের সিসিটিভির ফুটেজ দেখার কাজ করছিলাম। না, লাইভ নয়। সে দেখার জন্য তাদের মাইনে করা লোক থাকে। আমরা অন্য কোণে বসে দুজন রেকর্ডেড টেপ দেখি। মিস রোহা যতক্ষণ থামতে না বলবেন ততক্ষণ। কিছুই ঘটছেনা, খালি লোক ঢুকছে, ঘুরছে, এটা সেটা নেড়েচেড়ে দেখছে, এইই দেখা। ঘন্টার পর ঘন্টা। ডনি ছটফট করে। আমার চোখ ঘুমে ঢুলে আসে। কিন্তু কথা বলতে গেলে ঐ রকম বকুনি খাবে!
রোহার মনে হয়তো একটু দয়া হয়ে থাকবে। উনি আমাদের টেবিলের পাশে এসে বললেন "এই টেপে চুরি দেখতে পাবি না। কিন্তু খুব ভালো করে লোকজনের চলাফেরা, ভাব ভঙ্গী দেখা শিখতে হয়। সেটার তুখোড় প্র্যাকটিস থাকলে পরে এতটুকু একচুল অস্বাভাবিক ধরণ দেখলেই তোর চোখে সেটা করকরে বালির মত লাগবে। এই শপ লিফটিং এ চুরি হয়ে যাবার পর কাউকে ধরা প্রায় অসম্ভব কাজ। আগে থেকে চোরকে চিনতে হবে। নজর করতে হবে। "
হাবভাব দেখে অনেক কিছু চেনা যায়। যারা অ্যামেচার চোর তারা সাধারণত নার্ভাস ধরণের হয়। এদিক ওদিক তাকাবে। দোকানের কর্মচারীদের দেখলে হয় মুখ ফিরিয়ে নেবে, নয় র্যাকের পেছনে চলে যাবার চেষ্টা করবে। যদি দেখো কেউ হাতে করে কোনো জিনিষ তুলে নিয়ে দেখছে আর সেই সময়ই বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে কাছাকাছি কেউ আছে কিনা, বুঝবে এ একজন সম্ভাব্য চোর। পেশাদার চোরেরা অবশ্য একেবারে উল্টো। তাদের স্মার্টনেস আর কনফিডেন্স একেবারে ঝকঝকে হয়। পোষাক-আষাকও। দামী জামাকাপড়, গয়না বা অন্য অ্যাকসেসরিজ, সব এমন ফ্যাশন-দুরুস্ত হবে যাতে লোকে কল্পনাও করতে না পারে যে এ চোর। এদের তাহলে চিনবে কেমন করে? ঐ জন্যও ক্যামেরার ফুটেজ টেপ স্টাডি করতে হয়। এরা সাধারণত কোনো দোকানে অনেকবার করে আসে। প্রথমে বারেবারে দোকানে ঘুরে ঘুরে দেখে নেয় এখানে সিকিউরিটির ব্যবস্থা কেমন। ফ্লোরের কর্মচারীরা কতখানি সতর্ক। দোকানের কোন কোন অংশগুলোয় লোকজন কম। তারপরে আরো কয়েকটা ট্রিপ লাগে মোটামুটি দোকানটার কোথায় কী ধরণের জিনিষ আছে তার একটা মেন্টাল ম্যাপিং করতে। কোন জিনিষটা সে টার্গেট করবে, সেখান থেকে চেক আউট পয়েন্ট কত দূর, দিনের কোন সময়টায় বেশি ভিড় থাকবে, এইসব বুঝে নিতে হয়। এই চোররা আলাদা পোষাকে, অন্য রকম হেয়ার স্টাইল ও মেক-আপ করে বারবার দোকানে আসে। দোকানের কর্মচারীদের পক্ষে তো এত লোকের মধ্যে কাউকেই ওভাবে মনে রাখা সম্ভব না। রিটেল সিকিউরিটি হিসেবে তোমারই কাজ ভালো ভাবে খুঁটিয়ে দেখতে শেখা যে এক লোক নানা রকম সাজে ফ্রিকোয়েন্টলি আসছে কিনা। এলে অবশ্যই তার ওপর কড়া নজর রাখতে হবে। আরো আছে চোর চেনার উপায়। ধরো গরমের সময়ে কেউ জোব্বা মত জামা পরে এলো, কেউ বড় জিম-ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে ঢুকেছে, কেউ অন্য কোনো দোকানের নাম লেখা মুখ খোলা থলে নিয়ে ঘুরছে, এদের সবাইকেই একটু খুঁটিয়ে লক্ষ্য করা দরকার।
জিমব্যাগ, থলি এসবের কথায় মনে এলো, পেশাদার দোকান-চোরদের ব্যবস্থাপনা শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে! কেউকেউ এমন বাক্স নিয়ে আসে যা বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে ঠিক যেন গিফ্ট র্যাপ করা একটা প্যাকেট। কিন্তু তার ওপরটা আসলে একটা কব্জা দেওয়া ঢাকনা। ওর ওপরে কিছু রাখলেই টুক করে ঢাকনার একদিকটা ফাঁক হয়ে জিনিষটা ভেতরে চলে যাবে। কেউ হয়তো নিয়ে এলো একটা হ্যান্ডব্যাগ, যার তলাটা কারিগর দিয়ে বিশেষ ভাবে বানানো। কেউ যখন খেয়াল করছেনা, ব্যাগটা একটা কিছুর ওপর রাখলে, এবার একটু নাড়াচাড়া করলেই তলার ফাঁক দিয়ে সেটা চলে গেলো ভেতরে। ফল্স বটম ওয়ালা ব্যাগ ও আনে অনেকে। ফিটিং রুমে কোনো জামা ট্রাই করতে নিয়ে গেলো। গেলো পাঁচটা, বেরিয়ে এলো চারটে, অথ্চ হ্যান্ডব্যাগ কেউ চেক করতে চাইলেও দেখা যাবে তার মধ্যে জামাটামা নেই। আর বহু পুরনো সেই ট্রিক তো আছেই, হিন্দী সিনেমাতেও দেখিয়েছে, নকল পেট লাগিয়ে 'প্রেগন্যান্ট'মহিলা চোর।
আরেক দল খুব ইন্টারেস্টিং চোর আছে। তাদের বলে 'থাই ওয়র্কার্স'। এদের বিশেষ তালিম থাকে। নাম থেকেই আঁচ পাওয়া যায় তালিমটা কী ধরনের। দুই উরুর মাঝে কোনো জিনিষ চেপে ধরে রেখেও এরা স্বচ্ছন্দে হাঁটাচলা করতে পারে। পরনে লম্বা স্কার্ট বা ম্যাক্সি ড্রেস থাকলে দু পায়ের ফাঁকে পার্ফিউমের বোতল, গয়নার কৌটো থেকে আরম্ভ করে এমনকী ছোটখাটো ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট্সও এরা দিব্যি সুন্দর পা-সাফাই করে নিয়ে যেতে পারে।
পেশাদার চোরদের বেশির ভাগেরই বয়স পঁচিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। অ্যামেচার চোর এই বয়সের রেঞ্জের বাইরেও অনেক আছে। অ্যামেচারদের শতকরা পঁচিশ ভাগই টীনেজার ছেলেমেয়ে। এদের বেশি দেখবে স্কুলের কাছাকাছি অথবা যেখানে স্কুলের বাস স্টপ তার কাছের কনভিনিয়েন্ট স্টোরগুলোতে। এই বয়সের চোরেরা একসাথে অনেক জন দোকানে আসে। ওদের স্ট্র্যাটেজি হলো, দু একজন জিনিষ তুলবে আর বাকিরা তাদের ঘিরে থাকবে যাতে কারুর নজরে না পড়ে। টীনেজের মেয়েরা বেশি নেয় কসমেটিকস, কস্টিউম গয়না, পার্ফিউম, সিগারেট, ক্যান্ডি। আর ছেলেদের বেশির ভাগের লক্ষ্য হলো ডিওডোরেন্ট, আফ্টারশেভ আর কন্ট্রাসেপ্টিভ। রোহা আমাদের বলেছিলেন এইসব ছেলেমেয়েদের বেশির ভাগই যথেষ্ট স্বচ্ছল পরিবারের। পকেটমানির কোনো কমতি নেই এদের। তাও চুরি করে কেন? কিছুটা নিষিদ্ধ অ্যাডভেঞ্চারের লোভ, কিছুটা নিজেকে 'ডেয়ার ডেভিল' কিম্বা 'বুদ্ধিমান' বলে অন্যের সামনে প্রমাণ করার চেষ্টা। কেউকেউ বলে "শুধু দেখছিলাম ধরা না পড়ে কতবার আমি এমনটা করতে পারি।" কী অদ্ভুত মানসিকতা, না?
আরো অদ্ভুত লাগে যখন দেখা যায় চোর কোনো 'সিনিয়র সিটিজেন' গ্রুপে পড়ার মত বয়স্ক মানুষ। এঁদের মধ্যে কোনো একটা নিরাপত্তার অভাব কাজ করে। হয়তো মনে হয় রিটায়ার করার পর যা পয়সা আছে তাতে সব খরচ কুলোবেনা। সেইজন্যই সুযোগ পেলেই বিনা পয়সায় যা পাওয়া যায় তাই এঁদের লাভ। এঁদের মধ্যে বেশির ভাগ নেন ওভার দ্য কাউন্টার ওষুধ, কোনো খাবার জিনিষ, আর নয়তো ছোটোখাটো জামা। হয়তো একটা টিশার্ট, বা স্কার্ফ, মোজা কি অন্তর্বাস, এইসব।
অ্যামেচার চোরেরা এমন সব জিনিষই নেবে যা তারা নিজেরা ব্যবহার করে। কিন্তু পেশাদার বড় চোর, যারা দামী জিনিষ হাতায় তাদের আলাদা ব্যবস্থা থাকে। এদের সাথে যোগাযোগ থাকে 'ফেন্স'দের। ফেন্স মানে যারা চোরাই জিনিষ বাজারে বিক্রি করে। আর এই দোকান থেকে জিনিষ তুলে নিয়ে গিয়ে চোরা কারবারিদের সাথে মিলে বিক্রি করার পুরো প্রসেসটাকে বলে 'ফেন্সিং'। আমি তো ফেন্সিং বলতে এতদিন বুঝতাম সরু তরোয়াল নিয়ে লড়াই। ডনি বুঝতো বেড়া দেওয়া!
এই ফেন্সদের চক্র কিন্তু খুব সহজ জিনিষ নয়। রোহা আমাদের সাবধান করে দিয়েছিলেন -- "সিকিউরিটি স্টাফদের দেখলেই হাঁদার মত বিশ্বাস করবিনা। ফেন্সদের মূল অনেক গভীর অব্দি ছড়িয়ে আছে। ওরাই এমন অনেক লোক দেখানো সিকিউরিটি এজেন্সী খুলে রাখে যাদের কাজই চুরিতে সাহায্য করা। যেকোনো সিকিউরিটিকে কাজে বহাল করার আগেই তাদের এজেন্সীর ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করাটা অবশ্য কর্তব্য।"
অ্যামেরিকাত্র রিটেল ইন্ডাস্ট্রিতে প্রত্যেকদিন শুধুমাত্র এই শপ-লিফটিং এর জন্যই মোট বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়। সংখ্যাটা শুনে আমরা থ' হয়ে গেছিলাম! কী উপায় তাহলে এই চুরি আটকানোর? এটুকু তো আমরা সবাই জানি যে অনেক দোকানেই ক্যামেরা লাগানো থাকে। যেসব জায়গা চট করে নজরে পড়েনা তেমন কোণা গুলোতে কনভেক্স আয়নাও লাগানো থাকে। যা দিয়ে দূরে বসেও নজর রাখা চলে। কিছুকিছু দোকানে দুমুখো আয়নাও লাগায়। হয়তো জামা কাপড়ের দোকানে তুমি ভাবছো সামনের আয়নাটায় টুক করে দেখে নেবে এই জ্যাকেটটা তোমায় কেমন মানাচ্ছে। কিন্তু আয়নার অন্য দিকটা আসলে জানলা। সেখানে থানা দিয়ে মিস রোহার মত জাঁদরেল সিকিউরিটি অফিসার বসে তোমার চাল-চলনের মাপ নিচ্ছেন। কোনো কোনো দোকানে ইলেক্ট্রনিক ট্যাগিং এর ব্যবস্থা থাকে। জিনিষপত্রে এমন একটা প্লাস্টিক বা ফাইবারের ট্যাগ লাগানো যেটা এমনি এমনি খোলা যায়না। চেক-আউট কাউন্টারে নিয়ে গেলে সেখানের কর্মচারীই বিশেষ একটা যন্ত্র দিয়ে ওটা খুলে দেবেন। তখন দাম না দিয়ে তো আর উপায় নেই। এমনিতে জোর করে খুলতে গেলে জিনিষটাই নষ্ট হয়ে যাবে। আর ঐ ট্যাগ না খুলে দোকান থেকে বেরোতে গেলেই দরজার কাছে অ্যালার্ম বেজে উঠবে। তবে ইলেক্ট্রনিক ট্যাগের দাম আছে। ছোটোখাটো দোকান অত কুলিয়ে উঠতে পারেনা। তাদের জন্য কম পয়সায় আছে 'ইংক ট্যাগ'। এখানে জোর করে ট্যাগ খুলতে গেলে কালির মত রং বেরিয়ে জিনিষটায় পুরো লেপে যাবে। তখন আর সে নিয়ে গিয়েই লাভ কী?
তবে চোর ধরার থেকেও বেশি কার্য্যকরী হলো চুরি আটকানো। চোরকে ডিসকারেজ করা। রোহা আমাদের শিখিয়েছিলেন যে "চোরকে সবসময় বুঝিয়ে দিতে হয় যে বাপু, তোমার ওপর কিন্তু নজর রাখা হচ্ছে।"
কেমন করে করবে তা? ফ্লোরের কর্মচারীদের ট্রেনিং দিয়ে রাখবে। ইন-হাউস সিকিউরিটি হিসেবে কারুর ওপর সন্দেহ হলো, তুমি ফ্লোর ম্যানেজারকে জানালে। তখুনি যেন একজন কর্মচারী গিয়ে সম্ভাব্য চোরকে খুব মিষ্টি করে বলেন -- "আপনার কোনো অসুবিধা হচ্ছেনা তো? যা চাইছেন সব খুঁজে পাচ্ছেন?"
এতে চোর বুঝে যাবে তাকে কেউ দেখছে। চুরি ওখানেই আটকে দেওয়া গেলো। অবশ্য এই জিনিষটা কারুকে সন্দেহ হোক বা না হোক, নিয়মিত চালিয়ে যাওয়া উচিৎ। সব সময় সিকিউরিটির চোখে সবকিছু নাও পড়তে পারে তো? ক্রেতারা একে ভালো কাস্টোমার কেয়ার হিসেবেই দেখেন।
একটা খুব সহজ অথচ কাজের উপায় হলো দু চারজন উর্দিধারী সিকিউরিটিকে দোকানে রাখা। এঁদের দেখলেই চোর বুঝে যাবে যে এই দোকানে নজরদারির জন্য পাকা লোক রয়েছে, কাজেই এখানে হাত সাফাই সোজা কাজ হবেনা। কোনো কোনো দোকানে আন্ডার-কভার সিকিউরিটিও থাকেন। কিন্তু সেখানে কর্তৃপক্ষের সম্ভবত চুরি আটকানোর থেকে চোর ধরার ওপরেই গুরুত্ব দেওয়া বেশি পছন্দ।
রোহা আরো বলেছিলেন -- "যদি দেখিসও কেউ টপ করে কোনো জিনিষ তুলে নিলো, তখুনি তাকে ধরতে যাবিনা। চালাক চোর অনেক সময়েই বলে 'আমি তো এর দামই দিতাম। তোমার সাহস কত যে আমাকে চোর বলো! হেনাতেনা!' এমনি কান্ড ঘটালে তোরাই আতান্তরে পড়বি! তার ওপর নজর রাখ। যদি কাউন্টারে গিয়ে জিনিষটার দাম না দিলো, তখন বেরোবার সময় তাকে আটকাতে হবে।"
আটকানোর পরেও নানা নিয়ম আছে। দোকানের একজন প্রতিনিধির উপস্থিতিতে তাকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে যেতে হয়। তারপর পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ যতক্ষণ না আসছে, তোমার কাজ তাকে পাহারা দেওয়া।
খুবই আশ্চর্য্যের ব্যপার হলো, বা ততটা হয়তো আশ্চর্য্যেরও নয়, যে অনেক সময়েই দোকানে চুরি হয় 'ভেতর থেকে'। কর্মচারীদের মধ্যেই কেউ শপ-লিফটিং করেন। এ ব্যপারে একটা নিয়ম আছে। তাকে আমরা বলি ৮০-১০-১০ নিয়ম। দোকানের কর্মচারীদের মধ্যে সাধারণত ১০% হন আদ্যন্ত সৎ, কোন অবস্থাতেই তাঁরা কোনো অসততার রাস্তায় যাবেননা। আরো ১০% থাকেন যাঁদের নীতিবোধ অনেক আল্গা। তাঁরা সুযোগ পেলেই এটা সেটা নিজের ভেবে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। বাকী ৮০% পার্সেন্টকে বলে 'ফলোয়ার' বা অনুসারী। এঁরা এমনিতে বেশ মানুষ, কিন্তু যদি দেখেন এই দোকানে হামেশাই অন্য কর্মচারীরা জিনিষপত্র তুলে নিয়ে যাচ্ছে, হয়তো কোনোদিন দুটো বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে গেলো, বা কেউ পেনসিল- আঠার টিউব নিয়ে যায়, তাহলে এঁরাও ভাববেন "এ নিছক নির্দোষ ব্যাপার। ও সবাই করে। এতে তেমন দোষের কিছু নেই।"
এই জন্যই, ৮০-১০-১০ নিয়ম অনুযায়ী দোকানের কর্তৃপক্ষের উচিৎ সবার কাছেই স্পষ্ট করে দেওয়া যে এ দোকানে চুরি আটকানো আর চুরি ধরা, এই ব্যাপার গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এখানে ও'কাজ করলে কাউকেই রেহাই দেওয়া হবেনা, সে বাইরের চোরই হোক কি ঘরের। এর ফলে ঐ ১০% অসৎ কর্মচারীকে হয়তো ঠেকানো যাবেনা। কিন্তু ৮০ % অনুসারীরা কেউই অসৎ রাস্তায় নামবেননা।
এত সবকিছুর পরেও কী আর শপ-লিফটিং হয়না? হয় ঠিকই। কোনো ব্যবস্থাই ফুল-প্রুফ নয়। তবু যতটুকু আটকানো যায় আর কী!
একমাস শিক্ষা-নবীশির পরে যখন চলে আসবো, শুনতে পেলাম দোকানটার সিকিউরিটি ম্যানেজার মিস রোহাকে জিজ্ঞেস করছেন -- "আপনার লোকদের পয়সাকড়ি কিছু দিতে হবে নাকি ম্যাডাম?"
রোহা অম্লান বদনে বললেন - "না। ওরা নিজেদের গরজে কাজ শিখতে এসেছে। দুজনকে দু প্যাকেট সিগারেট দিয়ে বিদায় করে দিন।"
আমরা নিক্কথায় বিদায় হয়ে গেলাম। অবশ্য কয়েকদিন পরে দেখি ডাকে দুটো খাম এসেছে। আমার আর ডনির নামে। রোহা অ্যাডেলবার্টো নিজে হাতে লিখে দিয়েছেন "অমুক নামের ব্যক্তিটি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে আমার কাছে রিটেল সিকিউরিটি ও লস প্রিভেনশনের কাজ করিয়াছে। ইহার বিশ্বস্ততা ও কর্মদক্ষতা সন্দেহাতীত।"
তার নীচে তাঁর সই ও শীলমোহর। 'পয়সাকড়ি'র থেকে এর দাম কিছু কম নাকি?