মানুষ কত কিছু জমায়। ডাকটিকিট, কয়েন, পুতুল। আমি জল জমাই। এই কথাটা ঠিক আমার নিজের নয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন একবার। উনি নদী জমাতেন। এটাই হলো মুশকিল। যেকোনো ভালো কথাই বলতে যাও, দেখবে কোনো না কোনো বিখ্যাত লেখক সেটা বলে রেখেছেন! যাই হোক, উনি নদী জমাতেন। আমি জমাই জল। মানে বরফের ট্রেতে নয়। কোনো নদী, ঝর্ণা, লেক, সমুদ্রে নামলাম, জলের সাথে আলাপ করলাম। সে আমার সংগ্রহে জমা হয়ে থাকলো। এইরকম ব্যাপার। ছোটছোট নাম না জানা অনেক জল আছে আমার কাছে। বড়বড়ও আছে। হোমরা চোমরা জল তারা সব। একজনের নাম ভূমধ্যসাগর।
আমি ইজরায়েল গেছিলাম একবার। তেল-আভিভের 'বেন গুরিয়ন' এয়ারপোর্টে নেমেছি। ভারী সুন্দর সে শহর। ঐ ভুমধ্য-সাগরের ধারে। রাস্তার একপাশে বিচ, অন্যপাশে সারি দিয়ে ছোটবড় হোটেল, দোকানপাট। আর কী প্রাণবন্ত! বিচের পাশে বাঁধানো ফুটপাথ দিয়ে হাসিখুশি মানুষ দৌড়োচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে যাচ্ছে হাসিখুশি কুকুর। রাত দুটো তিনটের সময়েও সমুদ্রের ধারে বালিতে বসে গিটার বাজায় অল্পবয়সী ছেলে। চমৎকার রুচির পোশাকে একজন মেয়ে হাতে একগোছা গোল করে গোটানো ছবি নিয়ে হেঁটে চলে গেলো যেন রাত তিনটে নয়, সবেই সন্ধ্যে নেমেছে।
রাস্তার ধারে ছোট স্টলে, ঠেলাগাড়িতে প্রাণকাড়া গন্ধের শোয়ার্মা, ফুলকো লাভাশ রুটি বিক্রি হচ্ছে। খাবারওলারা সবাই আমার ভাষা বোঝেননা। তাই বলে অবশ্য কারুর মুখে হাসির কমতি নেই। আমি আঙুল দেখিয়ে ইশারা করি "ঐ ফালাফেল, আর ঐ রুটি। ঐ পানীয়"। দোকানি একগাল হেসে সেই চিনদেশের ভয়ানক পালোয়ানের মত একবার পাঁচটা, একবার আটটা আঙুল তোলেন। "কটা দেবো ফালাফেল?" প্লাস্টিকের ছোট কৌটোয় চারটে পাঁচটা স্যালাড, চাটনি, হামাস। সেগুলোর জন্য পয়সা লাগেনা। আমি হামাস বলি আমেরিকার স্বভাব মতো, কিন্তু ওঁরা হুমিস-হুমুস এর মাঝামাঝি কিছু একটা বলেন। ইজরায়েলের মত সুস্বাদু দেশ কম আছে।
বেকারিতে লাল ইটের গনগনে চুল্লি থেকে তখুনি তখুনি বার করে থরেথরে 'মানাকিশ' আর 'বুরেকা' সাজিয়ে রাখছে। মানাকিশ হলো খাস্তা রুটির মত। তার ওপরে ‘জাটার’ বলে একরকম মশলা মাখানো থাকে, আর অলিভ অয়েল। বুরেকার বাইরেটা মুচমুচে ক্রাস্ট, ভারতীয় প্যাটিসের মত। ভেতরে পুর ভরা। নোন্তাও হয়, মিষ্টিও হয়। আর জেলি ভরা ডোনাট। 'সুফগানিয়ত' বলে তাকে। হানুকা উত্সবের স্পেশ্যাল খাবার।
আমি এটাসেটা কিনে নিয়ে গিয়ে সমুদ্রের ধারে সিমেন্টের ছাতার তলায় গিয়ে বসি। মালিক পেছন থেকে ডেকে, হাসিমুখে একটা চকলেট ভরা ডোনাট আমার ঠোঙার মধ্যে গুঁজে দিলেন -- "ইহুদিদের সব্বাই কিপ্টে বলে। তুমি দেশে ফিরে আমাদের বদনাম কোরো না যেন।"
হানুকার সময়ে, খাস ইজরায়েলে বসে সুফগানিয়ত খাবার কপাল সবার হয় নাকি? ভূমধ্যসাগর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে "জেলি পোরাটা পরে খাও, তারিয়ে তারিয়ে। ওটা বেশি ভালো।"
রোজরোজ এইরকম সব কথা হয় ওর সাথে। কিন্তু আলাপ পুরো হচ্ছে না। রোজই দেখি লাল টিনের বোর্ডের ওপরে সাদা দিয়ে লিখে রেখেছে "নো সুইমিং", ইংরিজি আর হিব্রু দু ভাষাতেই। এ কী অনাছিস্টি কথা! সমুদ্রে নামবো না? বালির ওপরে বসে ঢেউয়ের শব্দের সব কথা বুঝতে পারি না। আমার শ্রবণেন্দ্রিয় মাছের মত, সারা শরীর জুড়ে। স্পর্শেন্দ্রিয় পার্শ্বরেখা মনে আছে? ভেতরে বড্ড ছটফটানি জমা হয়। "কেন মানা? মানা কেন জলে নামা?" জলের কোয়ালিটি কন্ট্রোলের ওপর খুব কড়াকড়ি ওখানে। নিয়মিত দূষণের মাত্রা পরীক্ষা করে দেখা হয়। তাতে পাশ না হলে বিজ্ঞপ্তি উঠবে না! থাকো এখন বসে হাত পা গুটিয়ে!
এই 'কথা শোনা' ব্যপারটায় আবার আমি খুব একটা দক্ষ নই। কিছু করা মানা থাকলে আমার খুব কিছু যায় আসেনা। 'মানা', 'বারণ' এইসব কথাগুলোর গুরুত্ব ভালো করে বোঝার জন্য কোনো একটা অ্যাপ লাগে। সেটা মস্তিষ্কে বসাতে হয়। তা সেই জিনিসটা আমি ডাউনলোড করতে ভুলে গেছি। তাই পরের দিন বিকেলে আমি বালির ওপর হাঁটতে হাঁটতে আস্তে আস্তে জলের গভীরে, আরো গভীরে চলে গেলাম। ভূমধ্য-সাগর বড় লক্ষ্মী। কারুক্কে ভয় দেখায়না। তাই গভীর খাড়াই রাখেনি একেবারে। সাঁতার কাটার মত গভীরতার জল পেতে গেলে অনেক দূর যেতে হবে। জল আমার পায়ে আস্তে আস্তে হাত বোলায়। বলে "আরেকটু আসবে না? আরেকটু"? লাল-সাদা টিনের নোটিসগুলো মাথা নাড়ে, চোখ পাকায়। আমি ওদের উপেক্ষা করে গভীরের দিকে পা বাড়াই।
পুলে অনেকেই সাঁতার কাটেন, কিন্তু ওপেন ওয়াটার সুইমিং একটা পুরোপুরি আলাদা ব্যাপার! সে আবার সমুদ্রে হলে তো কথাই নেই। নোনা জলের ঘনত্বে শরীরের প্লবতা অন্যভাবে কাজ করে। জলের ঢেউয়ের এর দোলা, বাতাসের দোলা। জলের মধ্যে স্টেবিলিটি, ব্যালান্স সব অন্যরকম লাগে। কিন্তু কী যে ভীষণ ভালোলাগার সেই 'অন্যরকম লাগা' তা কথা দিয়ে বোঝানো আমার মত মানুষের পক্ষে সম্ভবই নয়! আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি সুর্যাস্তের রং কতরকম তুলি-ক্রেয়ন-পেনসিল নিয়ে বসেছে। জলের মধ্যে চোখ ডুবিয়ে দেখি সবুজ দোদুল ঢেউ, তার মধ্যে ক্ষুদে ক্ষুদে সোনালি মাছ ফিনফিন করে ভেসে বেড়াচ্ছে। ভূমধ্যসাগর বড় সুন্দর। আমি জলের মধ্যে একটু একটু করে হারিয়ে যাই। ডিসেম্বর মাসেও কী আরামদায়ক গরম জল। থেরাপিউটিক পুলের মত। আমার সব ক্লান্তি, ব্যথা, শক্ত হয়ে বসা গিঁট, জল নিঃশেষে ধুয়ে নেয়। শরীর থেকে, মন থেকে। দূরে বেলাভূমিতে বাচ্চারা খেলছে, খিলখিল করে হাসছে। অনেকে পায়ের পাতা ডোবা জলে দাঁড়িয়ে আছেন। এই পৃথিবীটাতে এত আনন্দ কেন রে?
আরে, ঐ তো দেখি আরেকজন কেউও আমার মত লাল-সাদা টিনের ভুরু কোঁচকানো উপেক্ষা করে সাঁতারে নেমেছেন! আমার থেকে বেশ কিছুটা পেছনে হলেও ঢেউ এর ওঠানামার মধ্যে তার মুখ দেখতে পেলাম। আরে, এ তো আমার চেনা লোক! আমারই হোটেলের ব্রেকফাস্ট কো-অর্ডিনেটর। প্রত্যেক দিনই সকালে তার সাথে আমার দেখা হয়। কথাবার্তা হয়না যদিও। বাদামি বব চুল আর সবুজ চোখের মেয়েটি নীরবে চা কফির ব্যাগ ও পড সাজিয়ে রাখে, কোনো খাবারের ট্রে ফাঁকা হয়ে গেলে নতুন ভর্তি ট্রে এনে বসিয়ে দেয়, টেবিলে টেবিলে সিরাপের পাত্র, জ্যাম-জেলির কৌটো রেখে যায়। আমি তার দিকে হাত তুলে হাসলাম। সেও এক ঝলক হেসে দুটো বুড়ো আঙুল তুলে দেখায়। খাবার ঘরে কোনদিন তাকে হাসতে দেখিনি। কিন্তু এখানে আলাদা ব্যাপার। জলের কাছে গাম্ভীর্যের মুখোশ পরে থাকা যায় না।
খানিক পরে শুনি মাইকে কিছু একটা ঘোষণা হচ্ছে। হিব্রু ভাষায়। আমি সে ভাষার বিন্দু-বিসর্গ বুঝিনা। কানও দিই না। ওমা, ইংরিজিতেও বলছে যে! "যাঁরা সাঁতারে নেমেছেন দয়া করে এখুনি উঠে আসুন।"
দুত্তোর, কে পাত্তা দেয়! কিন্তু... এবারে আরো স্পেসিফিক ভাবে -- "যে দুজন সাঁতারে নেমেছেন, নীল-রুপোলি ও লাল-কালো, প্লিজ আপনারা দুজন উঠে আসুন। আপনাদের সুরক্ষার জন্য আমরা বিশেষ ভাবে চিন্তিত। আমাদের দয়া করুন ও এই মুহূর্তে ফিরে আসুন।" তীক্ষ্ণ হুইসলের আওয়াজ নেই, কোনো রকম হুমকি নেই, কী অনুনয়ের সুরেই না বলছে! আমি নীল-রুপোলির দিকে তাকাই, সে চোখ মটকে মাথা ঝাঁকায়, তীরের দিকে দেখায়। অগত্যা, জল ছপছপ করতে করতে আমরা ফেরার রাস্তা ধরি।
উঠে এসে তার সাথে আর কথা হলো না। আমি বিচের শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে, তখন দেখি সে ভিজে পোশাকেই একটা সাইকেলে উঠে প্যাডেলে চাপ দিয়েছে। অনেক রাত অবধি বসে থাকলাম সমুদ্রের ধারে। আকাশ আস্তে আস্তে বদলে গেলো। হাওয়ার তাপমাত্রা, ঢেউয়ের সুর, চারপাশের রং- শব্দ- গন্ধ সব কতবার অন্য অন্য রকম হয়ে গেলো। একটা বিশাল ছবি যেন কেউ আঁকছে, মুছছে, আবার আঁকছে। প্রতিবার নতুন নতুন করে। অনেকগুলো ছোটছোট ছবি দিয়ে তৈরি একটা বিরাট ছবি। জীবনের। গভীর রাত অবধি।
পরের দিন সকালে অনেকক্ষণ ধরে গড়িমসি করছি। দশটা নাগাদ দরজায় কে টোকা দিলো। খুলে দেখি হাউস-কিপিং এর মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। আমার হাতে একটা বাক্স দিয়ে বললো -- "মিখাল দিয়েছে।"
--"মিখাল কে?"
-- "ব্রেকফাস্ট লেডি। তুমি আজ নীচে যাওনি। তাই আমাকে বলে গেছে যেন তোমায় দিয়ে দিই।"
বাক্স খুলে দেখলাম ভেতরে একটা 'রাগালা'। রাগালা হলো একরকমের মিষ্টি পেস্ট্রির মত। ক্রোয়াসঁ'র মত প্যাঁচানো দেখতে, ভেতরে বাদামের কুচি দেওয়া। আমি বড্ড ভালোবাসি। ব্রেকফাস্টের টেবিলে রোজই থাকে। মিখাল লক্ষ্য করেছে তাহলে?
নিচে এসে তার খোঁজ করলাম। ততক্ষণে অবশ্য ব্রেকফাস্টের পর্ব চুকেবুকে গেছে। হলঘর ফাঁকা। রিসেপশনে যে আর্ট মালিকের মত দেখতে ভদ্রলোক থাকেন তিনি বললেন "ও, মিখালকে খুঁজছেন? সে আজ তাড়াতাড়ি চলে গেছে। ওর বোনের বিয়ে, ছুটি নিয়ে গেছে। তিনদিন পরে আসবে।"
তি-ন-দি-ন? যাঃ!
আমি পরের দিনই তেল-আভিভ থেকে এইলাট চলে গেলাম। মিখালের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। চার বছর হয়ে গেলো। তাকে একই রকম স্পষ্ট মনে আছে। আমি জানি যদিও আমার নামটা পর্যন্ত জানে না, তবু সেও আমাকে এতটুকু ভোলেনি। এক নিয়মভাঙা অবাধ্যতার বিকেলে, বেগুনি আকাশের তলায় ভূমধ্য-সাগর আমাদের দুজনকে একটা অদ্ভুত সম্পর্কে বেঁধে দিয়েছিলো। মিখাল, নীল-রুপোলি, আমার সাগর-তুতো আপনজন।
'সাগর-তুতো আপনজন' শব্দটা একদম হৃদয়ের তারে নাড়া দিল। অসাধারণ।
ওহোহোহোহো , বাঘু বেকার, একেবারে দিলের মধ্যে চাকু চালিয়ে দিলে গো। তোমার আছে জল আর আমার আছে সূর্যাস্ত। সবাই আমরা স্পেকট্রামের কোথাও একটা বিলং করি। মিখাল কে পড়ে আমার মিগুয়েল কে মনে পড়ে গেলো।
দারুণ
ভালো লাগলো
দারুণ