একটা মাইথোলজির গল্প পেয়েছিলাম। সেদিন মিশরের পুরাণ বলেছিলাম, চাঁদের সাথে পাশা খেলার গল্প। আজ কি একটা নরওয়ের গল্প বলব?
হিন্দুপুরাণে যেমন স্বর্গ, মর্ত্য আর পাতাল এই তিনটে জগৎ আছে, নর্স পুরাণে আছে ন'টা! তার মধ্যে দুটো হলো স্বর্গ। অ্যাসগার্ড আর ভ্যানাহাইম। এছাড়া আছে চির তুষারের রাজ্য নিফলহাইম, আগুনের দুনিয়া মাসপেলহাইম। মর্ত্য, যেখানে মানুষেরা থাকে, তার নাম হলো গিয়ে মিডগার্ড। আল্ফহাইম বলে এক জায়গায় আবার শুধু এল্ফরা থাকে। তারা সব আলোর এল্ফ। আলো না পেলে বাঁচবেনা। আল্ফহাইমে তাই অন্ধ্কার হয়না কক্ষণো। রাতের বেলাও না।
এর উল্টো হলো আবার নিডাভেলির। সেখানের বাসিন্দা বামনের দল। সেখানে বাড়িঘর সব মাটির নিচে। কেননা সুর্যের আলো লাগলেই বামনরা পাথর হয়ে যায়! এই নিডাভেলিরের আরেকটা নাম আছে। বেড়ে খটোমটো নাম -- স্ভার্ট- আল্ফহাইম।
কটা হলো তাহলে? সাতটা?
আচ্ছা, আরো দুই দুনিয়া হলো ইয়োটানহাইম আর হেলহাইম। ইয়োটানহাইমে দৈত্যদের বাস। সে বেশ ভয়ের জায়গা। আর হেলহাইম হলো যাকে বলে মৃত্যুপুরী। হেলহাইমের কথা পরে আরো বলছি।
এই ন' ন'খানা দুনিয়া কিন্তু এ ওর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সে একটা থেকে অন্যটা যতই দূরে হোক না কেন। বিশাল একটা গাছ, যাকে বলে কিনা 'জগৎ-তরু', এই সব্কটা দুনিয়ার মধ্যে যোগসুত্র রেখেছে। এই মহাবৃক্ষের নাম ইগড্রাসিল। সেই গাছের ডালে, মূলে যেসব খেঁকুরে ড্রাগন, ঝগড়ুটে কাঠবেড়ালী, দুটো মহা পাকা কাক ইত্যাদি থাকে তাদের কথা আর নাই বললাম! এমনিতেই ঘটনা জটিল কম নয়।
অ্যাসগার্ডে যে দেবতারা থাকেন তাঁদের বলে 'ইসির'। সেই ইসিরদের মধ্যে কয়েকজনের নাম তো সবাই জানে। দেবতাদের রাজা সর্বজ্ঞানী অদিন, বজ্র-বিদ্যুতের দেবতা শক্তিমান থর, দুষ্টুবুদ্ধির দেবতা মহাধূর্ত লোকী। আরো কত দেবদেবী আছেন, ফ্রিগ, হেমডাল, বল্ডার, বিদার। তো, এই গল্পটা লোকীকে নিয়ে। ঠিক লোকীকে নিয়েও নয়, আসলে তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে।
লোকী যে দুষ্টুবুদ্ধির দেবতা তা তো আগেই বলেছি। তাঁর মত মিষ্টি কথায় লোকের মন ভোলাতে কেউ পারেনা। তার ওপরে লোকী যখন ইচ্ছে যেমন খুশি রূপ নিতে পারেন। আর দেখতেও বেজায় সুন্দর! এ হেন লোকীর স্ত্রীর নাম ছিলো সিগিন। তাঁদের দুই ছেলে, নার্ফি আর ভালি। কিন্তু এই গল্পে এদের নিয়ে কথা হচ্ছেনা। অত সোজাসাপ্টা ব্যপার হলে তো হয়েই যেতো! হুঁ হুঁ, গল্পে অন্য বাঁক আছে। শোনো।
যা দেখা যায়, লোকী মাঝেমাঝেই কাউকে কিছু না বলেকয়ে কোথায় যেন উধাও হয়ে যান। ফিরে আসেন কয়েকমাস পরে। তখন তাঁকে দেখে মনে হয় যেন মনে ভারী ফুর্তি হয়েছে! আবার একই সাথে মুখের মধ্যে কেমন যেন একটা চোরচোর ভাব ছেয়ে থাকে। সিগিন তো ভয়ে ভাবনায় অস্থির! এ লোকটাকে দিয়ে কিচ্ছু বিঃশ্বাস নেই, না জানি কোথায় কী দুষ্কর্ম করে আসছে।
দুষ্কর্ম বলো তো দুষ্কর্ম! আসল ব্যপার হলো সব দেবতাদের চোখের আড়ালে লোকীর আরেকজন স্ত্রী ছিলেন। তাঁর নাম আঙ্গোর্বদা। এই আঙ্গোর্বদা সাক্ষাৎ ইয়োটানহাইমের খাঁটি রক্তের দানবী। সেই কারণেই এত লুকোছাপা! দৈত্য-দানবদের সাথে তো দেবতাদের বরাবরের শত্রুতা। এমন কথাটা তাঁরা জানলে ঘোর অনর্থ বাধাবেন! লুকিয়ে রাখা ছাড়া উপায় কী?
তো যাই হোক, আঙ্গোর্বদা আর লোকীর তিন ছেলেমেয়ে ছিলো।যথারীতি সিগিনের কাছ থেকে, অন্য দেবতাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা ছেলেমেয়ে। কিন্তু লোকী লুকিয়ে রাখতে চাইলে হবেটা কী? দেবরাজ অদিন সবই জেনে গেলেন। অদিন হলেন সর্বজ্ঞ। প্রচুর দাম দিয়ে খাস জ্ঞানের কুয়োর জল খেয়ে তিনি এই ক্ষমতা পেয়েছেন। দুনিয়ার হেন জিনিষটা নেই যা অদিন জানেন না। এক রাতে এক স্বপ্নের মধ্যে অদিন সব দেখতে পেলেন। লোকীর ছেলেমেয়েদের, তাদের বর্তমান- ভবিষ্যৎ, সব!
পরদিন সকালেই রাজার দরবারে লোকীর তলব পড়েছে। অদিন বলেন - " ওহে, আমাকে লুকিয়ে তো চাইলেও তুমি কোনকিছু করতে পারবেনা। কিন্তু যা ঘটিয়ে রেখেছো তার ফল যে কী হবে তার সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাও নেই! যাই হোক, তোমার ঐ ছেলেমেয়ে গুলিকে এই আমার সামনে এনে হাজির করতে হবে। না'হলে যা হবে তা ভাবতেও আমার গা শিউরে ওঠে!"
সামনে এনে হাজির করবেটা কে? লোকীর ওপর অদিন ভরসা করে ছেড়ে দেবেন নাকি? তবেই হয়েছে! তিনি ছেলেমেয়েদের আনার জন্য দেবতাদের এক মস্ত দল পাঠিয়ে দিলেন। দৈত্যদের কাছে মুর্তিমান ত্রাস যে দেবতা সেই থর আর যুদ্ধের দেবতা তাইর সেই দলের মাথা। অনেক দুর্গম রাস্তা, নানা রকম বিপদ আপদ পার হয়ে তাঁরা তো পৌঁছোলেন ইয়োটানহাইমে। গিয়েই সোজা আঙ্গোর্বদার প্রাসাদে হাজির! দেবরাজের পরোয়ানা আছে। ছেলেমেয়েদের এখুনি নিয়ে যেতে হবে। খুবই আশ্চর্য্যের বিষয়, কেউ এতটুকু বাধা দিলোনা। একবার পরোয়ানা দেখতে চাইলোনা পর্যন্ত! দেবতারা মহা উৎসাহে লোকীর তিন ছেলেমেয়েকে ধরে আনার বদলে বেঁধে নিয়ে চলে গেলেন।
আবার সেই উঁচুনিচু রাস্তা, আবার সেই এটাসেটা বিপদ আপদ! চলতে চলতে কত কিই না ঘটলো! সেসব গালগল্পে গিয়ে আর কাজ নেই। অ্যাসগার্ডে পৌঁছে, রাজদরবারে বন্দীদের জিম্মা করে দিয়ে তবে দেবতাদের হাঁফ ছাড়া।
পরদিন বিচারসভায় অদিন এসে দেখেন কী সবচেয়ে বড়টি কষে বাঁধা আছে একটা মস্ত পাইনগাছের সাথে। তার নাম 'ইয়রমুনগান্ডর'। কী খটোমটো নাম না? তা সে নিজেও কিছু সামান্য নয়। লোকী আর আঙ্গোর্বদার বড় ছেলেটি হলো এক মস্ত সাপ! এমনই বিশাল যে অত বড় গাছটার সঙ্গে বেঁধে না রাখলে ভয়েই সবার প্রাণ উড়ে যাবে। তার ওপর সে মুখ দিয়ে বিষ ছেটায়। সেই বিষ যেখানে পড়ে তা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায়! ইয়া বড় অজগর আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হয়ে পলকহীণ দুই চোখ দিয়ে সবকিছু দেখছে!
এর এখন কী ব্যবস্থা করা যায়? অদিন তো স্বপ্নে সবই দেখে রেখেছেন। কী করতে হবে তা তাঁর জানাই আছে। ইয়রমুনগান্ডরকে নিয়ে গিয়ে তিনি মহাসমুদ্রের মধ্যে নামিয়ে দিলেন। বিশাল অজগর হিলহিল করে জলের নীচে গিয়ে পুরো পৃথিবীটাকে পাকে পাকে বেড় দিয়ে জড়িয়ে ফেললো। অদিন ভাবলেন "থাক ওখানে, সবার চোখের আড়ালে। ওপরে থাকলে কখন কাকে কামড়ায়!"
এরপর মেজোজনের পালা। তার হাতে শিকল বেঁধে দু'দিকে তিন তিন জন করে ধরে রেখেছে। সে হলো লোকীর মেয়ে। নাম তার 'হেল'। তাকে যারা ডানপাশ থেকে দেখে তারা মুগ্ধ হয়ে যায়। কী রূপ, কী রূপ! গোলাপফুলের মত রং, তার ওপর মেয়েটা বাবার সবুজ সুন্দর চোখও পেয়েছে । আর লাল প্রবালের মত টুকটুকে ঠোঁট। কিন্তু বাঁপাশ থেকে দেখলে? তুমি শিউরে উঠবে! সেদিকটায় মৃত্যু যেন ছাপ মেরে দিয়েছে! সারা মুখ জুড়ে দগদগে ক্ষত । মাংস পচে খসে পড়ছে। চোখটা গলে গিয়ে শুধু অন্ধকার কোটরের মত হয়ে আছে। ঠোঁট নেই কোনো, মড়ার খুলির দাঁতগুলো বিকট ভাবে সবসময় হাসছে যেন! সভাশুদ্ধু লোকের মুখে কথা জোগায়না! কিন্তু হেল এর কোনো ভয় নেই, ডর নেই। মাথা উঁচু করে, সটান সে অদিনের চোখে চোখ রেখে চেয়ে রয়েছে।
অদিন, বিশ্বপিতা মহাজ্ঞানী অদিন তাকে দেখেই মনেমনে ভাবেন "আরে সর্বনাশ করেছে! এই মেয়ে তো দেখি একদিন মহাশক্তিশালী হবে! এর দ্বারা যে কত অনর্থ হতে পারে তা তো আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি। কিন্তু একে ভুলিয়েভালিয়ে রাখা যায় কী করে?" মুখে শুধু বললেন "বাছা, তোমার কোনো চিন্তা নেই। তোমার প্রাপ্য সন্মান যাতে তুমি পাও আমি সেই ব্যবস্থা করবো। আমি তোমাকে একটা গোটা জগতের রাণী করে দিচ্ছি। তোমার রাজত্বের নাম হোক 'হেলহাইম'। তুমি হবে মৃত আত্মাদের দেবী। যারা শহীদ হয় সেইসব আত্মাদের আমরা 'ভালহাল্লা' বলে বিশেষ এক জায়গায় নিয়ে রাখি। তাদের বাদ দিয়ে বাকী যত লোক, যারা অসুখে, অপঘাতে, বা বুড়ো হয়ে মারা যাবে, সেই সব্বাই গিয়ে পৌঁছোবে তোমার হেলহাইমে। তাদের নিয়ে তুমি মনের সুখে রাজত্ব করো গিয়ে। আর শুধু হাতেই বা যাবে কেন? দেখো তো, আমার রাজকীয় রত্নাগার থেকে তোমার কোনকিছু পছন্দ হচ্ছে নাকি? যেটা ইচ্ছে তুমি সঙ্গে করে নিয়ে যেও এখন।"
অদিনের সংগ্রহশালা থেকে হেল তিনটে জিনিষ বেছে নিলো। একটা বাটি, একটা ছুরি আর বিছানা একটা। বললো " আমার এই বাটির নাম রইলো 'ক্ষিদে', এই ছুরির নাম 'দুর্ভিক্ষ', আর এই বিছানা হলো 'মৃত্যুশয্যা'।"
এই বলে সে অনেক দূরের হেলহাইমে চলে গেলো। দেবতাদের রাজসভায় সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললে। হেল এর কথা শুনে কিন্তু আমার 'প্রত্যুত্পন্নমতিত্ব', 'পরমকল্যাণবরেষু' আর 'কিংকর্তব্যবিমুঢ়'র কথা মনে পড়েছিলো। দেবতাদের কী মনে হয়েছিলো তা অবশ্য জানিনা।
তিন নম্বর কে? তিন নম্বর? তাকে সভায় নিয়ে আসার আগেই অদিন একবার কেঁপে উঠলেন। তিনি জানেন তাঁর জীবনের শেষ দৃশ্য হবে ঐ ঝকঝকে পোখরাজের মত একজোড়া পাটকিলে চোখ। ছুরির মত ধারালো ঐ দু'সারি দাঁত! সেই তৃতীয়্জন, লোকীর ছোট ছেলে।
কিন্তু সে কে, তার কী হলো, সে গল্প আমি পরের দিন বলবো। ধৈর্য্য ধরে থাকো এখন। একদিনে এর থেকে বেশি শুনতে নেই।
উরিত্তারা। গোগ্রাসে গিলছি। এ একেবারে অজানা দেশের নাজানি কী!
কেকে, আপনার অপূর্ব বাচনভঙ্গী। চলুক।
কিছুটা জানি, ছোটবেলায় গল্পে পড়েছিলুম, থর, লোকি, ওডিন এঁরা খুব অপরিচিত নন। তারপরে মার্ভেলে থর এট আল এসেছেন। গড অফ ওয়ার খেলতে গিয়ে ইগ্দ্রাসিলের এ ডাল থেকে ও ডাল করে নিফলহাইম, মুসফেলহাইম সব চষে বেড়াতে হয়েছে ক্রাটোসের সঙ্গে। সেখানেও কিছু কিছু নর্স মিথোলজি বলেছে কিন্তু এইভাবে মজলিশি আঙ্গিকে না। বেশ লাগছে পড়তে।
সুকুমার রায়ের গল্প মনে পড়ে গেলো। ওখানে অবশ্য ছিলো অঙ্গুর্বদা
আঙ্গুরবালা ঃ-)
এই ঈশিরদের সুন্দর সুন্দর নাম লেখা ছিল আমাদের খাতায়। অদীন, ত্র, প্রজ্ঞা, প্রিয়া, হিন্দোল, বলধর, বিদার, হলধর, ইন্দু, সজনী .....
যা বাবা,এই খানে এসে থেমে যাওয়ার মানে হয়!!!
এগুলো অনেক কিছু পড়েছি এদিক সেদিক। কিন্তু কেকের লেখায় যেমন হয় আর কি, একেবারে চুম্বকের মত টেনে রাখে আর কিরম মনে হয় খুব শীতের সন্ধ্যেয় উনুনের পাড়ে বসে গপ্প শুনছি।
চলুক চলুক।
এই লেখাগুলো নিয়ে বই হওয়া উচিত।
ইশ, ফেনরিয়ারের গপ্পটা না বলে এরকম ঝুলিয়ে রাখার মানেই নেই। অবশ্য সে গপ্পোটাও অনেক বড়। আর য়োরমোগুণ্ডার নিয়েও তো আরো গপ্পো আছে। সেই ন্যাজা খাইয়ে দিয়ে তৈরি করা - ইনফাইনাইট লুপ। হেলার গপ্পোটাও ভারি ইয়ে - ওখানের হেলার গল্পের মধ্যে বোধ হয় বালদরের গপ্পোটাই জানি। বাকিগুলো মনে নেই।
বড় ভালো লাগছে। চলুক চলুক
এবার ফেনরির আর টাইর এর ঘটনাটা আপনার এই দারুন লেখার স্টাইলে যা দাঁড়াবে ভাবতেই আর তর সইছে না।
আশায় আশায় বসে আছি উচাটন মন...ফেনরিরের আসতে কত ক্ষন।...
ভালো লাগল