আমি হাঁটছিলাম। কোথাও যাওয়ার জন্য নয়। বনের রাস্তা দিয়ে শুধুই হেঁটে চলা। এখানে ধূসর হয়ে মেঘ নেমে আসে। গাছগুলো, পাতাগুলো পর্যন্ত এক্কেবারে চুপচাপ। হাওয়াও। চুপচাপ। শব্দের দরকার হয় না আজকাল আর আমার। কোনো কথা শোনার নেই। বলার নেই। কোনোই কথা।
আমি একটা আলমারির মধ্যে জন্মেছিলাম। আমাকে শেখানো হয়েছিল এটাই বাড়ি। এই ঘর, ঐ ঘর, এখানেই জানলা, দরজা, মানুষ, জন। সমাজ বলে একটা লোক আছে। সে-ই সব ঠিক করে দেয় কোনটা কী। সে-ই ঠিক করে দিয়েছিল আমি কে, আমার নাম কী, আমায় দেখতে কেমন। সমাজের কথা শুনে যারা চলে না, তারা দুষ্টু লোক। তাদের একানড়েরা ঝুলির ভেতর বাঁধবে, তারপর তালগাছ থেকে ছুঁড়ে পানাপুকুরে ফেলে দেবে। দুষ্টু লোকদের ডুবে মরে যেতে হয়।
আমি ডুবে মরে গেছিলাম। খুব কষ্টের জিনিস সেটা। অন্ধকার, অন্ধকার, আর অন্ধকার। লোকে ভাবে মরে গেলে একেবারেই সব চুকেবুকে গেল। ঝাড়া হাত পা, আপদ বিদায়। কিন্তু তা একেবারেই সত্যি নয়। মরা একটা চক্রাকার অনন্ত ঘটনা। প্রত্যেকদিন একইভাবে ঘটতে থাকে। যাদের চোখ আছে, তারা দেখতে পায় – প্রত্যেকদিন মৃত্যু তোমায় মুছে দিচ্ছে, আবার মুছে দিচ্ছে, আবারো। যাদের চোখ নেই, তারা ভাবে লোকটা দিব্যি তো ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। হাসছে, কথা বলছে। এর আবার অসুবিধাটা কোথায়?
অসুবিধা একটা আয়নার মধ্যে। সেখানে তাকিয়ে আমি দেখতে পাই, আমি সেই বলে দেওয়া ‘দুষ্টু লোক’। তার চেয়েও বেশি করে আমি দেখতে পাই, আমি সেই না বলে দেওয়া অ-দুষ্টু লোকি। ‘লোকি’, নরওয়ের দেবতা। তিনি ‘জেন্ডার ফ্লুয়িড’ ছিলেন।
আমার নিজের জন্য কষ্ট হয় না। কষ্ট হয় সেইসব লোকদের জন্য, যারা নিজেদের জানা দুনিয়াটুকুর বাইরের কোনো কিছুকে বুঝতেই পারে না। অমুক অমুক লক্ষণ থাকলে ইনি পুরুষ, অমুক অমুক থাকলে ইনি নারী। খুব বেশি হলে উভলিঙ্গ অবধি বোঝা যায় (মেনে নেওয়া অবশ্য চলে না, তবু বোঝা যায়), ব্যস! আমার আয়নার মধ্যে একটা পুরো দুনিয়া আছে যেখানে জেন্ডার, বৃষ্টির পরের নরম আলোর মত অনেকগুলো রং ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে পারে। আমার এই দুনিয়ায় ভালোবাসার জন্য আমাকে শুধু পুরুষে আবদ্ধ থাকতে হয় না, শুধু নারীতেও না। ভালোবাসা কোমল জলের মত আকার বদলাতে পারে অবিরত। আকৃতি, রূপ, সৌন্দর্য্য। রোদ্দুরের গুঁড়ো আর জলের কণা পলকে এক রং থেকে অন্য রঙে গড়িয়ে যেতে পারে। এই বেগুনি, এই নীল, এই সবুজ, কমলা, লাল। যারা চোখ বন্ধ করে রাখে, অসুবিধা তাদের। তাদের সাদাকালো, সীমাবদ্ধ দুনিয়ার কথা ভাবলে আমার কষ্ট হয়।
রং কিন্তু খুব অদ্ভুত জিনিস, জান? এর মধ্যে জাদু থাকে। রং তোমাকে ডাকবে। মাঝ সমুদ্রের ঘুর্ণি চোরাস্রোতের মত ভীষণ জোরালো তার টান। যতখানি শক্তিশালী মহাকর্ষ হলে ব্ল্যাকহোলের সৃষ্টি হয়, সেই রকম মহাশক্তি দিয়ে রং আমাকে হিঁচড়ে এনেছিল। আমার মনের প্রতিটা বিন্দুর মধ্যে থেকে লোকের ভয়, কথার ভয়, ভয়ের ভয় ,উপড়ে, ছিঁড়েখুঁড়ে এনেছিল। সেই উথালপাথাল উপেক্ষা করার সাধ্য কারুর নেই। সে টানে মরণ-চক্রের সৌরজগৎ থেকে গ্রহতারা কক্ষপথচ্যুত হয়ে আসে। সেদিন সেই মহাপ্রলয়ের দিনে, তাণ্ডবের বুকের মধ্যিখানে চোখ রেখে, আমি দেখতে পেয়েছিলাম যে তুচ্ছ মরার ভয় আর নেই আমার কোনো। তার থেকেও অনেক বড় ভয় আমি কাটিয়ে উঠতে পেরেছি – বাঁচার ভয়।
আলমারির বাইরের দুনিয়াটা অনেকই অন্যরকম। বেরিয়ে এলেই সব খেলায় জিৎ হয় না। অনেকই হার। মানুষ হারিয়ে যায়। বন্ধুত্ব, ভালোবাসা। আপনজনেরা নিজেকে বোঝাতে থাকেন – “এ নিশ্চয়ই সত্যি নয়”। ডিনায়াল দিয়ে, আবছা কথাবার্তা দিয়ে নিজেদের অস্বস্তিকে অন্যরকম সাজিয়ে রাখেন। তাতে তোমার সত্ত্বাকে অস্বীকার করা হল তো হল! নিজেদের অস্বস্তি মন পেতে কেউ নিতে চায় না।
এই প্রত্যেকটা ‘না নেওয়া’ একেকটা লম্বা, ধারালো, খোঁচামুখ কাঁটার মত। তোমার পায়ে বিঁধে যাবে। বুকে গেঁথে যাবে। কিন্তু তাতেই বা কী বদলায়? রক্তঝরা একটা অভ্যেসের ব্যাপার। তুমি যদি একে ভয় না কর, তাহলে থাকবে ও-ও নিজের মত। সহাবস্থানে। আস্তে আস্তে অনেক প্রয়োজনই ফুরিয়ে যায় জীবন থেকে। ব্যথাহীন, রক্তপাতহীন দিন কাটানোর যে চাহিদা, তার প্রয়োজনও আমার ফুরিয়ে গেছে।
আমি হাঁটছি। কোত্থাও পৌঁছনোর তাড়া নেই আমার এখন আর। কোত্থাও পৌঁছনোর দরকারও নেই। আমার মধ্যেকার আমি, আমার ভালোবাসার আমি, আর আমার নিজের পরম ভালোবাসা... হাত ধরে চলছি এই রাস্তা বেয়ে। সবসময় কোথাও না কোথাও পৌঁছতেই বা হবে কেন?