২০১০-এ কলেজে উঠে কাম আউট করি। তার আগে সমকামিতা নিয়ে ধারণা ছিল না একেবারেই। মনে যে প্রশ্নগুলো আসত, সেগুলোকে গল্পের আকারে লিখে লুকিয়ে রাখতাম। কাউকে দেখে ভাল লাগলে প্রশ্নগুলো আরও বাড়ত।
কলেজে কলেজে ফর্ম ভরতে ভরতে একটি মেয়েকে ভাল লাগল। খুব ভাল লাগে – এটা ছাড়া আর কিছু বুঝিনি, তবে অস্বাভাবিকও লাগেনি কিছু। খুব অল্প দিনে অনেকটা সময় কাটাতে শুরু করলাম। তাও পুরোনো প্রশ্নগুলো ফিরে এল না। তখন আমি একটা পাঁচ বছর বয়সী সম্পর্কে আছি, একজন পুরুষেরই সঙ্গে। লং ডিসটেন্স যদিও।
এক রাতে সেই মেয়েটি কাছে এল। আলাদা করে কিছু ভাবতে হয়নি আমাকে। পুরো ব্যাপারটা খুব খারাপ ভাবে শেষ হলেও আমার সেই প্রশ্নগুলোর মুখ আবার খুলে গেল এবং পরের দিন সকালেই আমি আমার পুরুষ বন্ধুটিকে সব কথা খুলে বললাম। বললাম, “এ রকম আমার কখনও হয়নি। এত স্বাভাবিক, এত ভিতর থেকে উঠে আসা কথা শরীরে মনে। আমার মনে হয় আমি সমকামী”।
সেই প্রথম কাম আউট করা, সেইভাবে।
আমার পুরুষ বন্ধুটি কিন্তু মানতে চাইল না। বলল, “আমি কাছে থাকি না তো, ওই একটা মিউচ্যুয়াল মাস্টারবেশন মতো হয়েছে। হতেই পারে। ওটা নিয়ে ভেব না। খারাপ লাগারও কিছু নেই”।
কিন্তু কী করে ভাবব না? মেয়েটি যাবার সময়ে বলে গেছে, “তুই যা করলি, তুই ছেলে হলে আমাকে গলায় দড়ি দিতে হত”। আমি কষ্ট পেয়েছিলাম, অপরাধবোধ হয়নি।
ওর স্পর্শে, ওর প্রত্যাখ্যানে আমার যা হয়েছিল, তা আগে কখনও হয়নি। আমি পড়াশোনা শুরু করলাম নিজেকে আরও জানতে, যেটাও আগে কখনও করিনি। আমার ওই সম্পর্ক থেকে একটা ব্রেক চাইলাম। পুরুষটি বলল, “সমকামী মেয়েদের জীবনে একটা গ্ল্যামার থাকে। তোমার হয়তো ওই গ্ল্যামারটা ভাল লাগছে?”
এই কথাটা মনে পড়লে আজও বুঝি না কী উত্তর আমি দিতাম সমকামী হবার এই যুক্তিতে। তার আগে এই পুরুষটির সঙ্গে শারীরিক নৈকট্য হলেও সবটা হয়নি। ও কলকাতায় এল যাতে সেটাও চেষ্টা করে দেখা যায়। অ্যাসিড টেস্টের মত। পারলাম না।
আমার বন্ধুদের মধ্যে যেন বোমা পড়ল। কেউ ভাবতে পারেনি আমি ওই সম্পর্কে কখনও থাকব না, এমন হতে পারে। আর কারণটা জানাতে শুরু করলাম সবাইকেই, কিছু না লুকিয়ে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে কিছু মানুষের সঙ্গে আলাপ হল। সমকামী ও রূপান্তরকামী নারীপুরুষ সকলে। একটা অদ্ভুত জগৎ। সবটার সঙ্গে নিজেকে না মেলাতে পারলেও, চেষ্টা করতাম – যতটা পারা যায় জ্ঞান সঞ্চয় করতে। মনে হত, আর কোনও পরীক্ষা কি আছে, যা থেকে বোঝা যাবে আমি কী? আমার তো কোনও সমকামী সম্পর্কও নেই। কী করে প্রমাণ দেব, যে আমি সমকামী? কী করে বাকিদের বোঝাব, যে আমার সম্পর্ক ভাঙার আর কোনও কারণ নেই এটা ছাড়া? কী করে জাস্টিফাই করব আমার দাবি?
একজন রূপান্তরকামী মানুষের সঙ্গে প্রথম একটা সম্পর্ক হল। বুঝিনি সে সমকামী নয়। সে কিন্তু জানত। সে চেয়েছিল আমি যেন তার নারী শরীর দেখে কাছে আসি। সেটা হবার পর সে আমার পুরুষ হয়ে উঠতে চাইল। তখন সরে এলাম। তবে ওই সম্পর্কটা হওয়ায় বাড়িতে কাম আউট করতে পারলাম। বাড়িতে বার বার, বার বার কাম আউট করার সেই শুরু হল।
অনেক কথা অনেক জায়গায় শুনেছি, যেমন আমরা সবাই শুনি। প্রথম দিন থেকে প্রাউড ছিলাম, কিছু লুকোতে চাইনি তো বটেই, বরং মানুষের প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করতাম, যেখানে গলা তোলার প্রয়োজন হত, তাও করতাম। বাড়ি থেকে চুপ করাতে পারেনি। আমার গল্পটাকে বদলে দিতেও না।
কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে আলাদা করে কাউকে কিছু বলিনি। তখন যার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, তাকে কোনওভাবেই আউট করানো যেত না, তাই তার কথা এমনিও কাউকে বলতে পারতাম না। আবার সেই এক জিনিস। সমকামী সম্পর্ক না থাকলে প্রমাণ করব কী করে, আমি কী? তাই ওই ব্যাপারে কথা হত না নতুন করে। মাঝে মাঝে বলার চেষ্টা করেছি আমার নিজের বিষয়েই, অবশ্যই প্রসঙ্গ উঠলে তবেই। অনেকে বোঝেনি, অনেকে চোখ বুজে থেকেছে, আর বাকি অল্প কয়েকজন নিজেকে লুকোতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রাউড হলেও আউট লাউডটা কমল আমার।
কিন্তু এই লুকিয়ে লুকিয়ে থাকা তো আমার ধাতে নেই। সহ্য হচ্ছিল না। এমন কারোর সঙ্গে থাকতে চাইতাম, যাতে কিছু আর লুকোতে না হয়। সেটাই খুঁজে বেড়াতে বেড়াতে পরপর অনেকগুলো ভুল করলাম। সেই ভুলের মধ্যে থাকতে থাকতে জীবন নানা দিকে বাঁক নিল। আমাকে আজ এনে দাঁড় করিয়েছে একটা কানা গলির সামনে। আজ বেঁচে যে আছি, তার জন্য অবশ্যই কৃতজ্ঞ। কিন্তু যেভাবে চেয়েছিলাম, সেটা হয়ে ওঠেনি। লুকোতে হয় না, কিন্তু প্রকাশ করার কারণও খুঁজে পাই না। সম্পর্কে আছি, একসঙ্গে থাকি, কিন্তু বন্ধু পরিচয় দেওয়াটাই অভ্যেস করছি। যে মানুষ আমাকে নিয়ে প্রাউড নয়, আমার লাউডনেস যার সমস্যার কারণ, তার সঙ্গে থাকতে থাকতে গুটিয়ে যাওয়ার সঙ্গে লড়াই করাটাই যদি আউট হওয়া হয়, তবে আমি এখনও অবধি আউট। আমার জীবন রঙিন না হলেও, রামধনুর রঙ যে দিকে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ছে, এটা আমাকে আনন্দ দেয়। আমার গর্ব হয়। যে, যেভাবে, যেখানেই থাকি না কেন, প্রাইড ভালবাসায় ভরে যাচ্ছে, দেখতে পাই।