আমার প্রচণ্ড অস্বস্তি হয়, যখন আমার অনূভূতিগুলোকে কথায় ব্যক্ত করতে পারি না, বিশেষ করে এমন সময়ে যখন আমার অভিজ্ঞতাগুলোকে অন্যরা নিজেদের মত করে ব্যাখ্যা করে তাদের ব্যাখ্যাটা আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এরকম সময়গুলোয় নারীবাদী সাহিত্য আমার সহায় হয়। অধ্যাপক-লেখিকা এলিসন কাফের তাঁর বই ‘ফেমিনিস্ট, ক্যুইর, ক্রিপ’-এ লিখছেন: “আমি কখনো কোনো ভবিষ্যৎ বক্তার কাছে যাইনি; কাউকে কোনো স্ফটিক গোলোকে আমার ভবিষ্যত দেখে দিতে বলিনি। চায়ের কাপের তলানিতে বা তারায় তারায় কেউ আমার ভবিষ্যৎ লক্ষণ গণনা করেনি। ফর্চুন কুকি থেকে ট্যারট কার্ড-এর কোনো প্রয়োজন পড়েনি। আমার হুইলচেয়ার, আমার ক্ষতচিহ্ন, আর হাতের অবস্থা দেখেই তারা বুঝে যায় যা বোঝার। আমার ভবিষ্যৎ আমার শরীরে লেখা আছে।”
আমাকেও আমার ভবিষ্যৎ বহু আগে থেকে শোনানো শুরু হয়েছে৷ একজন সহপাঠী আমাকে বলেছিল, যে আমার কোনোদিনই ভাল কেরিয়ার হবে না, যদি আমি ক্যুইয়র পরিচয় নিয়েই এগোতে চাই। আমার স্কুলের একজন শিক্ষক বলেছিলেন, যে আমার সুরক্ষিত ভবিষ্যতের একমাত্র রাস্তা হচ্ছে সংরক্ষণের মাধ্যমে চাকরি নেওয়া, কারণ আমি দলিত। এছাড়া আমরা নাকি কোনো কম্মের নই। এটা বলা হয়েছিল, যে আমি নাকি কোনোদিন সুখী হব না, আমার পুরো আমিটাকে কেউ পুরোটা মেনে নেবে না। আমাকে নিজেকে ভেঙে নিতে হবে, যে টুকরোগুলো সমাজ মান্য হবে, সেগুলোই আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে, বাকিগুলোকে সমাধিস্থ করে দিতে হবে চিরতরে। বড় হওয়ার সময়ে বুঝেছিলাম, আমার মত অনেক মানুষ যাঁরা প্রান্তিকতার মধ্যে জীবন যাপন করেন, তাঁদেরকে নিয়মিত বলা হয়েছে তাঁরা কেমন হতে পারেন ভবিষ্যতে আর তাঁরা কোথায় কাজ করবেন। এমন ভবিষ্যৎ, যেটা তাঁদের জাতি, লিঙ্গ, শ্রেণী আর সক্ষমতার দ্বারা নির্ধারণ হবে। কেউ ছক ভেঙে বেরোতে পারবে না – এটাই চূড়ান্ত নিয়ম, এটাই ভবিতব্য, এটাই ললাট লিখন।
কিন্তু এখন এই ভবিতব্যগুলো পুনর্লিখিত হচ্ছে, সামাজিক ন্যায় আর অন্তর্ভুক্তিকরণের মাধ্যমে।
যদিও সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকরণ তার পূর্ণরূপে এখনো বহুদূর, ছোট ছোট ধাপ নেওয়া হচ্ছে, কিছু সংলাপ শুরু হয়েছে। তবে এই সংলাপগুলোর বেশিরভাগই বৈচিত্র্য আর অন্তর্ভুক্তি সংক্রান্ত নীতি বিষয়ক, নানান পরিচয়ের মান্যতা প্রদান, আর প্রান্তিক মানুষজনের প্রতি একটু আলাদা মনোযোগ যাতে তাঁরা নানান জায়গায় চাকরি পেতে আবেদন করেন। বিশেষ করে স্টার্টআপ, নন-প্রফিট সংস্থা, ছোট ছোট ফর প্রফিট কর্মক্ষেত্রগুলো যেগুলো সামাজিক ন্যায় এবং অন্তর্ভুক্তির প্রতি দায়বদ্ধ। এদের বেশিরভাগ কর্মখালির বিজ্ঞাপনগুলোয় লেখা হয় “আমরা সম-সুযোগে বিশ্বাসী চাকুরীদাতা এবং প্রান্তিক গোষ্ঠী যেমন প্রান্তিক জাতি, লিঙ্গ, যৌনতা এবং দক্ষতার মানুষদের আবেদন জানাতে উৎসাহিত করি।”
কিন্তু, আমরা যখন “সমান সুযোগ”-এর কথা বলছি, আমরা কি ইক্যুইটি-র থেকে সরে যাচ্ছি?
প্রফেসর ক্যাফের তার বই-এ ক্রিপ্ টাইমের ব্যাপারে বলছেন। ব্যাখ্যাটা এই রকম:
“ক্রিপ টাইম শুধু সময়ের নমনীয়তাকে বৃদ্ধি করায় তাই নয়, বরং বিস্ফোরিত করায়; এর জন্য প্রয়োজন কোনো বিশেষ সময়কালে কী হয় আর কী হতে পারে সেই ধারণায় একটা মৌলিক বদল আনার, এটা বোঝার যে “কোনো কাজে কতক্ষণ লাগে” এই সাধারণ ধারণাগুলো কিছু বিশেষ শরীর আর মনের ভিত্তিতে গঠিত। প্রতিবন্ধী শরীর আর মনকে সেই সাধারণ ঘড়ির অনুপাতে বিকৃত করতে বাধ্য করার থেকে, ক্রিপ টাইমে ঘড়িকে বদলানো হয় প্রতিবন্ধী শরীর আর মনের ক্ষমতা অনুযায়ী চলার জন্য।”
বাইরের জগতটা ক্রিপ টাইমে চলে না। এই দুনিয়া কিছু নির্দিষ্ট রকমের সক্রিয়তা আর সচলতা চায়। আমাদের সেটার ভিত্তিতে মাপা হয়, সেটার ভিত্তিতে আমাদের উত্তরণ বা যোগ্যতার বিচার হয়।
প্রান্তিক লিঙ্গ, যৌনতা, জাতি আর সক্ষমতার মানুষকে যুগ যুগ ধরে ক্রমাগতভাবে নিপীড়ন করা হয়েছে, যেটা তাদের অধ্যয়ন/কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা, সক্রিয়তা, নিজের সম্বন্ধের বোধ আর তাদের জীবনের থেকে চাওয়া-পাওয়াগুলো নির্ধারণ করে। সব ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত শ্রম দিতে হয় তাদের, এমনকি এমন জায়গায় কাজ করার কথাও ভাবতে হয়, যেখানে তারা বহুযুগ ধরে অপাংক্তেয়। কিন্তু যখন এদের কোনো কর্মখালির জন্য ভাবা হয়, তাদের বিচারের ভিত্তি হয় সক্ষম-স্বীয়লৈঙ্গিক (সিসজেন্ডার) - বিষমকামাদর্শী (হেট্রোনর্মেটিভ) – উচ্চজাতির কর্মক্ষমতার ভিত্তিতে। এটা একটা এমন প্রক্রিয়া, যা সবচেয়ে বেশি প্রিভিলেজড বা সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষকে প্রশ্রয়-আনুকূল্য বাড়িয়ে দেয় আন্ডারপ্রিভিলেজড সুবিধাহীন মানুষের থেকে।
যখন আমি পড়ি, “আমরা প্রান্তিক মানুষকে আবেদন জানাতে উৎসাহ দিই”, আমি আসলে এটা শুনতে পাই – ‘আমরা তোমাদের প্রান্তিক হওয়ার জন্য ছেঁটে ফেলব না, যেটা সাধারণত ঘটে, কিন্তু আমরা তোমাকে এখন “সমান সুযোগ” দেব অন্যান্য প্রিভিলেজড মানুষের সাথে প্রতিযোগিতায় আসার।’
আমি যেটা বলতে চাইছি, সেটা হল “প্রান্তিক মানুষের ইতিহাস আর প্রান্তিকতা যাপনের অভিজ্ঞতাগুলোকে স্বীকার না করে বা তার জন্য পরিসর না বানিয়ে অন্তর্ভুক্তি কি সত্যিই সম্ভব?”
প্রান্তিক মানুষরা শূন্যমার্গে বাস করেন না
আমি পশ্চিমবঙ্গের ধোপা জাতির মানুষ। আমার দাদু-দিদার প্রজন্ম বাংলাদেশ থেকে দেশভাগের সময় এদিকে আসে। আমি এমন পরিবারে বড় হয়েছি, যেখানে কেউ ইংরেজি পড়েনি। আমি বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়েছি। কিন্তু এখন যখন আমি ইংরেজি বলি, আমার এই শ্রমটা অদৃশ্য থাকে বেশিরভাগ মানুষের কাছে। বেশিরভাগ দলিত মানুষই উচ্চশিক্ষার কথা ভাবতে পারেন না, কারণ তাঁরা ইংরেজিতে সড়গড় নন। আমি যখন আমার কথা বলি একজন ক্যুইয়র-লিঙ্গ অদ্বয়ী (নন-বাইনারি) মানুষ হিসেবে, তখন এই টার্ম বোঝার এবং নিজেকে ব্যক্ত করতে পারার যে মানসিক শ্রম আছে, সেটা দেখতে পাওয়া যায় না। আমাদের শ্রম বেশিরভাগ সময়েই অদৃশ্য থাকে।
অদৃশ্যায়ন হল ক্ষমতাসীন মানুষের রাজনীতি, দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার উপায়। আমরা সবাই সমান এই বোধের মাধ্যমে একটা উপশম আসে।
কিন্তু, আমরা তো সেটা নই।
দলিত অলৈঙ্গিক অদ্বয়ী মানুষ হওয়ার কারণে আমি বড় হতে হতে ভাবতাম, যে উচ্চাকাঙ্খা এমন এক প্রিভিলেজ, যা কেবল এক শ্রেণীর এবং লিঙ্গপরিচয়ের মানুষেরই হতে পারে। আমার মত মানুষরা তাদের শৈশব কাটায় বুলিড হয়ে, কোণঠাসা হয়ে। আমরা নিজের ক্ষমতার ব্যাপারে নিজেরাই সন্দিহান। আধুনিক বিহেভিওরাল বিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা দীর্ঘদিন বৈষম্যের শিকার আর সামাজিকভাবে যাদের অবস্থান বিপন্ন, তাঁদের আত্মবিশ্বাস কম হয়, নিজের দক্ষতার বোধ কম হয়, নিজের সম্বন্ধে অনেক বেশি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন তাঁরা।
বেশিরভাগ ক্যুইয়র-ট্রান্স মানুষ অল্প বয়সে স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়, বা এমন পরিসরগুলোয় কাজ করতে বা পড়তে বাধ্য হয়, যেখানে তাদের সমস্যা কম পোয়াতে হবে। আমাদের ইচ্ছেগুলো, উচ্চাকাঙ্খা বা প্রত্যাশাগুলো এমন পরিসর বা সম্ভাবনার আশেপাশেই ঘোরাফেরা করে, যেগুলো আমাদের অন্তত বুলি না করে, হ্যাটা না করে, বিপদে না ফেলে অস্তিত্ব রক্ষা করতে দেবে। ব্যক্তি থেকে ব্যবস্থা সবই আমাদের সমস্যা বাড়াতে ওস্তাদ। যাঁরা এরকম অবস্থায় কেরিয়ারের উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে ভাবেন, তাঁদের এই প্রতিকূল ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে সার্ভাইভ করতে হয়। অথচ এই ব্যবস্থায় আমাদের স্বকীয়তা বা শ্রমের মর্যাদা দেওয়া হয় না।
একজন বান্ধবী, যিনি দলিত – একটা ইন্টারভিউ-এ বসেছিলেন, যার জব ডেস্ক্রিপশনে আলাদা করে বলা ছিল – তাঁরা দলিত বহুজন গোষ্ঠী থেকে মানুষকে নিয়োগ করতে চান। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় যে তিনি জাতি, লিঙ্গ আর প্রান্তিকতার সম্বন্ধে ইংরেজি লেখালেখি পড়তে পড়তে বড় হয়েছেন কিনা। তিনি হননি। বেশিরভাগ দলিত মানুষই ইংরেজি সাহিত্য পড়তে পড়তে বড় হন না। যেটা তাঁর ছিল, সেটা ছিল জাতি-ভিত্তিক বৈষম্য-বিরোধী আন্দোলনে কাজ করার দীর্ঘ বিস্তৃত অভিজ্ঞতা, আর ব্যক্তিগত যাপনের অভিজ্ঞতা। সেটাকে ‘জ্ঞান’ হিসেবে ধরা হলই না।
এই ইন্টারভিউয়ের ফলে আমার বান্ধবীর মনে প্রশ্ন এল, যখন প্রান্তিক গোষ্ঠীর বাইরের মানুষজন প্রান্তিকতার জন্য পরিসর বানাতে চান, তখন কি তাঁরা প্রান্তিকতাকে নিজেদের মতন করে ব্যাখ্যা করাটা, যেটা হয়তো সঠিক নয়, সেই ঝুঁকিটা অনুভব করতে পারেন?
তাঁরা কি কর্মপ্রার্থীদের বাস্তবিকতার ব্যাপারে পুরো অজ্ঞ হয়ে তাদের দক্ষতার বিচার করেন?
কঠিন প্রশ্নটা হচ্ছে, নিয়োগকারীরা "অযোগ্য" মানুষদের নিয়োগ করবেন কেন?
যোগ্যতা ব্যাপারটা একটা রূপকথা। কারণ, একজন মানুষ কতটা ‘যোগ্য’, তার অনেকটাই নির্ণয় হয় তাদের জাতি, শ্রেণী, লিঙ্গ, যৌনপরিচয়, প্রতিবন্ধকতা প্রভৃতির দ্বারা, যেটা তারা কী কী সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন, তা নির্ণয় করে। কে কিসের যোগ্য – সেটা নিয়ে তর্কটা নয়। তর্কটা এটা, যে আমরা কী করে ঠিক করি কে যোগ্য। আমরা যেভাবে দক্ষতা, জ্ঞান, আর অভিজ্ঞতাকে বিচার করি, সেটার মূল্যায়ণ হওয়া দরকার। প্রতিষ্ঠান আর সংস্থাদের প্রান্তিক – দলিত, ক্যুইয়র, প্রতিবন্ধী – মানুষের যাপনের অভিজ্ঞতাকে বুঝতে হবে, জ্ঞান হিসেবে, দক্ষতা হিসেবে, অভিজ্ঞতা হিসেবে মান্যতা দিতে হবে। এদের সম্ভাবনাকে উদযাপন করতে হবে, আপন করে নিতে হবে।
দীর্ঘকালীন প্রান্তিকতার সমাধান প্রান্তিক মানুষকে অপ্রান্তিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে প্রতিযোগিতার রেস লড়িয়ে দিয়ে নয়। এই রেসটা কখনোই সমান শুরুর রেখা থেকে শুরু হয় না। যেটা সাধারণত হয়ে থাকে, সেটা হল – প্রিভিলেজড মানুষজন জিতে যায়, বা প্রান্তিক মানুষকে অনেক বেশি শ্রম দিতে হয় জেতার জন্য। প্রান্তিক মানুষের শ্রম আর কৃতিত্বকে যেমন কুর্নিশ জানানো জরুরি, তেমনি এটাও স্বীকার করা জরুরি – নিজেদের দক্ষতা বা ক্ষমতা সমান হওয়ার যে প্রমাণ তাঁদের থেকে চাওয়া হয়, সেটা সাম্যের নামে একটা কুনাট্য।
যদি আপনারা প্রান্তিক মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে চান, আপনাদের তরফ থেকে একটু বেশি শ্রম দিতে হবে। তাদের পরিচয়কে মান্যতা দিলেই হবে না – এমন একটা পরিসর বানাতে হবে, যা তাদের উত্তরণের সহায়ক হবে। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে, তাদের শিক্ষার জন্য ধৈর্যশীল হতে হবে। এটা সম্মিলিত সামাজিক দায়িত্ব।
কর্পোরেটরা অনেক সময়েই লোক দেখানো প্রতিনিধিত্ব, পিঙ্ক ওয়াশিং ইত্যাদি করে সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকরণকে একটা গয়ংগচ্ছ পদ্ধতিতে চালানোর ভুল করে ফেলে। সামাজিক দায়িত্ব পালন হচ্ছে – এটা ভেবেই করা হয়। অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে সরব হওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। ধন্যবাদ, কোনো পরিবর্তনই ছোট নয়। কিন্তু সমান গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেই পরিবর্তনের ব্যাপারে দায়িত্বশীল হওয়া, সেটা যাতে দীর্ঘস্থায়ী হয় তা নিশ্চিত করা, আর সচেতনভাবে সক্রিয় হওয়া।