“গতর খাটিয়ে খাই, শ্রমজীবীর মর্যাদা চাই” - স্লোগানে মুখরিত হয়েছিল আকাশ-বাতাস, ২০০১ সালের ৩রা মার্চ। কলকাতার রাস্তায় প্রথমবার, পঁচিশ হাজার যৌনশ্রমিক মা-বোনেরা পা মিলিয়েছিলেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল সেক্স ওয়ার্কার ডে’ উপলক্ষে। তথাকথিত “ভদ্র সমাজ” যাদেরকে ‘পতিতা’ বলে আখ্যা দিয়ে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার অধিকারটুকু দেয় না, সেই যৌনকর্মী মহিলারা সারা পৃথিবী জুড়ে এই দিনে আন্দোলন করেন।
যৌনকর্ম আর পাঁচটা পেশার মতই একটা পেশামাত্র। কারখানার শ্রমিক গতর খাটিয়ে অর্থ উপার্জন করেন, যৌন শ্রমিকও গতর খাটিয়ে অর্থ উপার্জন করেন। পিতৃতন্ত্র আমাদের শেখায় যৌনতা খারাপ, এবং নারীদেহ ভোগের বস্তু। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে আর্থসামাজিকভাবে দুর্বল মহিলাদের অসহায়তাকে হাতিয়ার করে, তাঁদেরকে পাচার করে নিয়ে আসা হয় এবং যৌন দাসত্বে জোর করে ঢুকিয়ে শোষণ করা হয়। কারখানা-শ্রমিকদের যেটুকুও সামাজিক মর্যাদা আছে, সেটুকুও এঁদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়। এই অবস্থার বদলের জন্যে ক্রমাগত আন্দোলন করে চলেছেন যৌনশ্রমিক মা বোনেরা। আমরা যতদিন পিতৃতান্ত্রিক লেন্স দিয়ে যৌনতাকে ট্যাবু হিসেবে দেখব, যৌনকর্মকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করব, ততদিন পিতৃতান্ত্রিক সমাজ তার খিদে মেটাতে আন্ডারগ্রাউন্ড সেক্স ট্রাফিকিং জারি রাখবে, যেখানে পাচার হয়ে আসা মহিলাদের ন্যূনতম মানবাধিকার থাকা তো দূর অস্ত, তাঁদেরকে ট্রেস করা পর্যন্ত অসম্ভব। পিতৃতান্ত্রিক লেন্স সরিয়ে যৌনশ্রমকে আর পাঁচটা কায়িক শ্রমের মত করে দেখলে অবস্থার আমূল পরিবর্তন হতে বাধ্য।
যৌনশ্রমিক মহিলারা তাঁদের আন্দোলনে যে দাবিগুলো রেখেছেন তা হল:
(১) শ্রমিক আইন মেনে নির্দিষ্ট কাজের সময়,
(২) বেআইনি নারী এবং শিশু পাচারের বিরুদ্ধে কড়া আইন,
(৩) শ্রমিক আইন মেনে ন্যূনতম মজুরি,
(৪) বিপদ-যুক্ত পরিবেশে কাজ করার জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা
(৫) যৌনশ্রমিকদের সন্তানদের যাতে কোনোভাবে সামাজিক হেনস্থার শিকার না হতে হয়, তার জন্য আইনি সুরক্ষার দাবির কথা বার বার তোলেন।
২০১১-তে গঠন হওয়া অল ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক অফ সেক্স ওয়ার্কার্স (AINSW)-এর বর্তমান মেম্বার সংখ্যা ৫ মিলিয়ন এবং এঁরা সারা ভারতবর্ষ জুড়ে যৌনকর্মীদের এই সমস্ত দাবিদাওয়া নিয়ে সরব।
নারীবাদী আন্দোলনে SWERF (Sex Work Erasing Radical Feminist) গোষ্ঠী বরাবর যৌন শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে এসেছে। কিন্তু নারীবাদীদের আরেকাংশ ১৯৯৭ সালে সল্ট লেক স্টেডিয়ামে “দা সেক্স ওয়ার্কর্স ম্যানিফেস্টো” প্রকাশ করেছিল প্রথম ন্যাশনাল কনফারেন্স অফ সেক্সওয়ার্কর্স-এ। চার হাজার যৌনকর্মী সেদিন গলা মিলিয়েছিলেন “আমরা কর্মী, যৌন কর্মী” স্লোগানে।
এই কলকাতা শহরের বুকে এশিয়ার সবচেয়ে বড় যৌনপল্লী সোনাগাছি, যেখানে প্রায় সাত হাজারের ওপর যৌনকর্মী কাজ এবং বসবাস করেন। দেবদাসী প্রথা যদিও সমাজ থেকে উঠে গেছে, এখানে পাচার হয়ে আসা বেশিরভাগ মহিলাই দলিত সম্প্রদায়ের, এবং উচ্চবর্ণ “ভদ্র” সমাজের চোখে এঁরা “অচ্ছুৎ” হলেও ভোগের সামগ্রী। সংস্কৃতির পরাকাষ্ঠা ভদ্রবিত্ত বাঙালি সমাজ বিহার, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ থেকে আগত পুরুষদের সোনাগাছি এবং অন্যান্য যৌনপল্লীতে সেক্স ট্যুরিজম করতে আসা সম্পর্কে অবগত হয়েও অস্বস্তিকরভাবে নিশ্চুপ। এঁদের দুরবস্থার কথা জেনেও সমাজ চোখ বন্ধ করে রেখেছে, যার ফলে যৌনশ্রমিকরা যে তিমিরে ছিলেন, সেই তিমিরেই আছেন। যে স্বতঃস্ফুর্ততার সাথে সমাজ সানি লিওনি বা মিয়া খলিফার ছবি চালাচালি করে, তার সিকিভাগ উৎসাহও নিজেদের শহরের যৌনকর্মীদের দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা সুরাহার ব্যাপারে দেখতে পাওয়া যায় না। ভারতীয় আইনে সেক্স ওয়ার্ক লিগ্যাল – সদ্য স্বীকৃতিপ্রাপ্ত – কিন্তু রাষ্ট্র বেশিরভাগ সময়ই যৌনকর্মীদের ভিকটিম হিসেবে দেখে, নতুবা অপরাধী হিসেবে।
বহু রূপান্তরকামী যৌনকর্মীরাও কাজ করেন ঝুঁকির সাথে, কারণ রাষ্ট্রের চোখে ট্রান্সজেন্ডার নারীরা পরিপূর্ণ নারী নন, তাই তাঁদের শোষণ করা আরো সহজ। নারীবাদীদের একাংশ, যাঁরা Trans Exclusionary Radical Feminism (TERF)-এ বিশ্বাস করেন, TERF ফেমিনিস্টরা রূপান্তরকামী নারীদের “নারী” পরিচয়কেই স্বীকৃতি দিতে অপরাগ এবং তাঁরা ট্রান্স নারীদের নারীবাদী আন্দোলনে জায়গা দিতে অস্বীকার করে এসেছে বার বার। তাঁরাও রূপান্তরকামী যৌনকর্মীদের দাবি দাওয়ার পরিপন্থী।
সেই জায়গায় ক্যুইয়র ফেমিনিজম “নারী-পুরুষ”-এর প্রাচীনপন্থী দ্বিবিভাজক লিঙ্গপরিচয়কে নস্যাৎ করে এবং সকল লিঙ্গপরিচয় ব্যক্তির সমানাধিকার দাবি করে। তাই রূপান্তরকামী যৌনকর্মীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন রেখে কলকাতার বুকে ক্যুইয়র মানুষেরা ২০১৯-এর প্রাইড ওয়াকে যৌনকর্মী এবং ট্রান্স মানুষদের ওপর ঘটে চলা রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের বিরুদ্ধে স্লোগানে গলা মিলিয়েছিলেন। এমন দিন শীঘ্র আসুক, যেদিন যৌনকর্মীরা নির্দ্বিধায় নির্ভয়ে সমাজের উদাসীনতা বা চোখ রঙানিকে উপেক্ষা করে বুক ঠুকে বলে উঠুক “সেক্স ওয়ার্কার অ্যান্ড প্রাউড”।