এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  খ্যাঁটন  চেখেছি পথে যেতে

  • পথের বাঁকে, স্বাদের ঝোঁকে – ৬ পর্ব

    সুকান্ত ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    খ্যাঁটন | চেখেছি পথে যেতে | ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ | ৮৪ বার পঠিত


  •                              পেনাং (মালয়েশিয়া) - স্ট্রীটফুড
                                             -----------------------


     
    রয়টার্স নাকি ২০১২ সালে ইংল্যান্ডের পর্যটকদের মধ্যে একটা সার্ভে করেছিল, যেখানে তাদের বেছে নিতে বলা হয়েছিল স্ট্রিট ফুডের জন্য পৃথিবীরে বিখ্যাত শহরগুলিকে।  তার মধ্যে মালয়েশিয়ার পেনাং আসে তৃতীয় স্থানে – এবং ইন্টারেষ্টিংলি প্রথম দুটি জায়গাও এই এশিয়ার শহরই দখল করেছে – প্রথম স্থানে থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্কক এবং দ্বিতীয় স্থানে সিঙ্গাপুর।  ষষ্ঠ স্থানে আছে ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটি।  সত্যি কথা বলতে কি এই র‍্যাঙ্কিং নিয়ে বিশেষ দ্বিমত হবার চান্স নেই – এশিয়ার যে শহরগুলির নাম করা হয়েছে, তাদের স্ট্রীট ফুড সত্যিই অসাধারণ।  তবে আমাকে বললে, আমি হয়ত সিঙ্গাপুরের জায়গায় মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরকে রাখতাম। আর প্রথম দশটি স্থানে যেখানে ঠাঁই নিতে পেরেছে এশিয়ার চারটি শহর, তাই এই কথা মেনে নিতে কোন বাধা নেই যে, স্ট্রীট ফুডের স্বর্গ হল এই এশিয়ার নানা শহর।  থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কাম্বোডিয়ার কিছু জায়গা নিয়ে আগেই লিখেই, এবং সামনেও লিখবো।  আজকে লেখায় শুধুই পেনাং –
     
    মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে হল গিয়ে পেনাং – আপনি ড্রাইভ করতে পারেন, বা ট্রেন, বাস ইত্যদিও নিতে পারেন। তবে সবচেয়ে সুবিধা মনে হয় ফ্লাইট নিলে – খুব একটা খরচের নয় আগে থেকে বুকিং করলে। মিনিট ৫০ এর মধ্যে পৌঁছে দেবে আপনাকে পেনাং-এ।  আন্দামান সাগরের কোল ঘেঁষে এই দ্বীপ - জর্জ টাউনের রঙিন দেয়ালচিত্র, উপনিবেশিক স্থাপত্য এবং সবুজে মোড়া পাহাড় – সব মিলিয়ে জমজমাট।  তবে এই সব জায়গার পাশাপাশি পেনাং-এর আসল পরিচয় লুকিয়ে আছে এর রাস্তায়, হকার সেন্টারের প্রাণবন্ত ভিড়ে যেখানে মিশেছে চীন, ভারত, মালয় এবং পেরানাকান (স্থানীয় চীনা-মালয় মিশ্র সংস্কৃতি) সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।   



    পেনাং-এর ইতিহাস শুরু হয় মূলত ১৭৮৬ সালে, যখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফ্রান্সিস লাইট জর্জ টাউন শহর প্রতিষ্ঠা করেন।  পূর্বে এটি প্রিন্স অফ ওয়েলস দ্বীপ নামে পরিচিত ছিল।  এর ভৌগোলিক অবস্থান এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত করেছিল।  মালাক্কা এবং সিঙ্গাপুরের সাথে মিলে এটি ব্রিটিশ রাজের 'স্ট্রেইটস সেটেলমেন্টস'-এর রাজধানী হিসেবেও কাজ করেছে।  ১৯৬৯‑এ ফ্রি-পোর্ট মর্যাদা হারালেও ঐতিহ্য সংরক্ষণ কৌশল ও কমিউনিটি‑ভিত্তিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শহরটি ২০০৮‑এ ইউনেস্কো স্বীকৃতি পায়—“মালাক্কা প্রণালীর বহুসাংস্কৃতিক বাণিজ্যনগর” হিসেবে।

    ফ্রান্সিস লাইট যখন এই দ্বীপকে বাণিজ্যিক বন্দরে পরিণত করলেন, তখন থেকেই পেনাং হয়ে উঠল মানুষের আগমনস্থল — চীন, ভারত, আরব, ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা অঞ্চল থেকে মানুষ এখানে এসে থিতু হতে লাগল।  কেউ এল ব্যবসা করতে, কেউ শ্রমিক (রাবার‑টিন খনির কাজে দক্ষিণ ভারত ও দক্ষিণ চীন থেকে) হিসেবে, কেউ আবার নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে।  এই মানুষের সঙ্গেই এলো তাদের রান্নাঘরের স্মৃতি। কেউ সঙ্গে আনল শুকনো নুডল, কেউ মশলা, কেউ রান্নার কৌশল। রাস্তার ধারে ছোট স্টল বসিয়ে তারা নিজেদের মতো করে খাবার বানাতে শুরু করল—সস্তা, দ্রুত, কিন্তু স্বাদে গভীর। এভাবেই পেনাংয়ের স্ট্রিট ফুডের ভিত্তি তৈরি হয়।
     
    বর্তমানে পেনাং শুধু পর্যটকদের গন্তব্য নয়, জর্জ টাউন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে অবসরকালীন জীবনের অন্যতম সেরা শহর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।  ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান থেকে আসা বহু অবসরপ্রাপ্ত মানুষ এখানে নতুন জীবন শুরু করেছেন।  কারণটা খুব সাধারণ — জীবনযাত্রা তুলনামূলক সস্তা, স্বাস্থ্য পরিষেবা ভালো, আর খাবার অসাধারণ।   জর্জ টাউনের উত্তর দিকে অবস্থিত তানজুং বুঙ্গাহ এবং বাতু ফেরিঙ্গি - এর মতো জায়গাগুলিতে বহু বিদেশীকে আপনি দেখতে পেয়ে যাবেন যারা এখানে স্থায়ীভাবে বাস করছে।



    পেনাং-এর স্ট্রিট ফুডের বিবর্তন তার উপনিবেশিক ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে গেছে - ব্রিটিশ শাসনের অধীনে, জর্জ টাউন যখন ব্যস্ত বন্দরে পরিণত হয়, তখন দ্রুত খাবারের চাহিদা মেটাতে বন্দরের শ্রমিক এবং অভিবাসীরা পথের পাশে ছোট ছোট স্টল বানাতে শুরু করে।  এই স্টলগুলোতে তখন মূলত স্থানীয় খাবার পাওয়া যেত - মালয়, চীনা (বিশেষত হক্কিয়েন, ক্যান্টোনিজ), এবং ভারতীয় তামিল।ব্রিটিশ আমলে চা-পানের সংস্কৃতি এল, তৈরি হলো কোপিতিয়াম—লোকাল কফিশপ। চাইনিজ অভিবাসীরা নিয়ে এলেন উচ্চ আঁচে রান্নার কৌশল, ভারতীয় মুসলিমরা নিয়ে এলেন নাসি কন্দর।  প্রতিটি উপনিবেশ ও অভিবাসন পেনাংয়ের খাবারে নতুন স্তর যোগ করেছে।

    তবে দীর্ঘদিন একসাথে থাকলে যা হয় আর কি – বাকি জায়গার মত এখানকার খাবারেও মিশতে থাকে পারস্পরিক সংস্কৃতি।  নুডলস বা ভাতের মতো স্থানীয় খাবারের সাথে ভারতীয় মশলার ব্যবহারের মিশ্রণ ঘটে।  ব্রিটিশরা তাদের সাথে কিছু নতুন উপাদান বা রান্নার পদ্ধতি আনলেও, পেনাং-এর স্ট্রিট ফুড মূলত টিকে আছে এখানে আসা অন্য অভিবাসীদের বহু বছরের পুরনো রন্ধনশৈলীর ওপর ভিত্তি করে।  তবে মনে করা হয় এই ‘স্ট্রিট ফুড’ সংস্কৃতিকে আরও জনপ্রিয় এবং সহজলভ্য করার পিছনে প্রধান ভূমিকা ছিল চীনা অভিবাসীদের।  

    পেনাং-এর খাদ্য সংস্কৃতিতে পেরানাকান বা নায়োনা রন্ধনশৈলী এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে।  এটি স্থানীয় মালয় উপাদান (যেমন - নারকেল দুধ, লেমনগ্রাস, গালানগাল, সাম্বাল) এবং চীনা রান্নার কৌশল (যেমন - ভাজা বা স্ট্যু করা) এর এক দারুণ সংমিশ্রণ।  



    পেনাং-এ আসা পর্যটকদের কাছে হিট খাবার কোনগুলি সেগুলি এবার দেখে নেওয়া যাক – নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই লিষ্ট কভার করলে আপনি বাকি কিছু খুব একটা মিস করবেন না! অন্যভাবে বলতে গেলে পেনাং বেড়াতে গিয়ে এইগুলোর কিছু কিছু ট্রাই না করে ফিরে আসা মানে ভ্রমণ অসম্পূর্ণঃ
     
    চার কুয়ে তেওঃ এ হলো পেনাং-এর সিগনেচার ডিশ।  চ্যাপ্টা ভাতের নুডলসকে (কুটে তেও) উচ্চ তাপে চাইনিজ সয়াসস, চিংড়ি, ককলস (এক ধরনের শেলফিশ), বিন স্প্রাউট এবং ডিম দিয়ে ভাজা হয়।  অথেন্টিক চার কুয়ে তেও সবসময় কাঠকয়লার উনুনে তৈরি হয়।  ব্রিটিশ উপনিবেশিক যুগে, পেনাং ছিল একটি ব্যস্ত বন্দর। এই খাবারটি মূলত দিনমজুর, জেলে এবং শ্রমিকদের জন্য তৈরি করা হত।  সস্তা এবং সহজে তৈরি এই খাবারটি ছিল দিনের শেষে পেট ভরানোর সহজ উপায়।  প্রথম দিকে এই খাবারে চিঙড়ি ইত্যাদি থাকত না – পরের দিকে এগুলো যোগ করে খাবার আরো সুস্বাদু করে তোলে।  বড়লোকেরা এই রান্নায় পরের দিকে শূকরের চর্বি ব্যবহার করা শুরু করে - যা একে একটি ধোঁয়াটে স্বাদ দেয়।
     


    পেনাং আসাম লাকসাঃ লাকসা আপনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সব জায়গাতেই পেয়ে যাবেন, কিন্তু পেনাং এর লাকসা এখানকার নিজস্ব সংস্করণ।  এর সম্পর্কে বলা হয় - প্রথম চামচে অবাক, দ্বিতীয় চামচে প্রেম! এই ডিসটি মালয় মশলা এবং চীনা নুডলসের মিশ্রণে পেরানাকান সম্প্রদায়ের হাত ধরে গড়ে উঠেছে।  'আসাম' শব্দের অর্থ তেঁতুল, যা এই স্যুপে টক স্বাদ যোগ করে।  এর ঝোল সাধারণত সেদ্ধ করা বা ছিঁড়ে নেওয়া ম্যাকেরেল মাছের মাংস, আসাম (তেঁতুল), লেমনগ্রাস এবং অন্যান্য মশলা দিয়ে তৈরি করা হয়। স্যু পটি পরিবেশন করা হয় ঘন ভাতের নুডলস, তাজা শসা, পেঁয়াজ, আনারস এবং পুদিনা পাতা দিয়ে।



    হকিয়েন মি বা পেনাং প্রন মিঃ পেনাং-এর এই নুডল স্যুপটি মূলত চীনা বংশোদ্ভূত হক্কিয়েন সম্প্রদায় দ্বারা জনপ্রিয় হয়েছিল।  এর ট্যাগ লাইন আপনি ধরে নিতে পারেন, “দরিদ্র শ্রমিকের সুস্বাদু খাবার” টাইপের।  শুরুতে সস্তা এবং সহজলভ্য উপাদান ব্যবহার করা হত – পরের দিকে চিঙড়ি বা শূয়োরের মাংসের ব্যাবহার শুরু হয় এই ডিসে।  হলুদ এবং সরু সাদা ভাতের নুডলসকে চিংড়ি এবং শূকরের মাংসের একটি মশলাদার ঝোল দিয়ে পরিবেশন করা হয়।  এর ঝোলে চিংড়ির মাথা এবং খোসা সেদ্ধ করে তৈরি হওয়া স্বাদ এটিকে এক অন্য মাত্রা দেয়।  সাধারণত এতে চিংড়ি, শুয়োরের মাংসের টুকরা, মাছের বল, বীন স্প্রাউট এবং ডিম থাকে।  এটি মালয়েশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে "হকিয়েন মি" নামে পরিচিত হলেও, পেনাং-এ এর বিশেষত্ব তুলে ধরতে একে প্রায়শই "পেনাং প্রন মি" বলা হয়, কারণ ঝোলে চিংড়ির স্বাদই প্রধান।



    কারি মিঃ নারকেল দুধ, কারি পেস্ট আর মশলা দিয়ে বানানো ঘন, মশলাদার ঝোলের মধ্যে ডিম নুডল ও চালের নুডলের মিশ্রণ থাকে।  উপর থেকে টোফু পাফ, রক্ত টোফু, চিংড়ি, ক্ল্যাম ও বিন স্প্রাউট দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়, স্বাদে একসাথে ঝাল, ক্রিমি আর সুগন্ধি।[



    নাসি কান্দারঃ ১৯০০-এর দশকের প্রথম দিকে চালু হয়ে পেনাং-এর তামিল মুসলিম ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে এটি জনপ্রিয়তা লাভ করে।  গরম ভাতের ওপর একসাথে একাধিক কারির “বানজির” (বন্যা)—সেই বন্দর শহরের শ্রমজীবী খাবার আজও জনতার প্রিয়। আক্ষরিক অর্থে 'নাসি কান্দার' মানে হলো কাঁধে বহন করা ভাত (নাসি)।  এটি হলো সাদা ভাত, যার সাথে আপনি আপনার পছন্দমতো একাধিক মশলাদার তরকারি (কারি), যেমন- ফ্রাইড চিকেন, প্রন, ফিশ রো, ভেড়ার মাংস বা সবজি নিতে পারেন।   



    নাসি লেমাকঃ নারকেল দুধে রান্না করা সুগন্ধি ভাত, সঙ্গে ঝাল সাম্বাল, ভাজা শুঁটকি ইকান বিলিস, ভাজা চিনাবাদাম, সেদ্ধ ডিম আর শশা স্লাইস থাকে।  কলাপাতায় পিরামিড আকারে মোড়ানো এই প্যাকেট নাস্তা বা হালকা খাবার হিসেবে সারাদিনই খাওয়া যায়।  এটা অবশ্য শুধু পেনাং নয় – দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক জায়গাতেই পাওয়া যায়।



    রোজাকঃ এটি একটি মালয়েশীয় ফলের স্যালাড।  আনারস, শসা, কাঁচা আম, কাঁঠাল এবং টোফুর মতো ফল ও সবজিকে একটি ঘন, মিষ্টি এবং মশলাদার সস দিয়ে মাখিয়ে পরিবেশন করা হয়।  এই সস তৈরি হয় চীনাবাদাম, সাম্বাল বেলাচান (চিলি পেস্ট) এবং তাজা চিংড়ির পেস্ট দিয়ে।  এই সব মেশানোর ফলে এর স্বাদ হয় মিষ্টি, টক, ঝাল এবং নোনতা।   



    লর বকঃ শুয়োরের কিমা, টোফু ও সবজি পাঁচমশলা দিয়ে মেখে পাতলা টোফু–স্কিনে রোল করে ডিপ–ফ্রাই করা হয়। বাইরে ক্রিস্পি আর ভেতরে নরম এই স্ন্যাকস মিষ্টি–নোনা সস ও চিলি সসের সঙ্গে খাওয়া হয়।



    পপিয়াহঃ পাতলা গমের রুটি বা ক্রেপের ভেতরে সেদ্ধ গাজর, অঙ্কুরিত ডাল, ডিম, চিনাবাদাম, কখনও চিংড়ি বা শুয়োরের মাংস ভরে রোল বানানো হয়।  তাজা ও হালকা এই রোলের ভেতরে থাকে নরম পুর আর বাইরে নরম কিন্তু দৃঢ় মোড়ক।

    চেন্ডলঃ এটি পেনাং এর সবচেয়ে জনপ্রিয় মিষ্টি ডেজার্ট।  বরফের কুচি, যার ওপর নারকেলের দুধ, প্যান্ডান পাতা দিয়ে তৈরি সবুজ জেলি নুডলস (চেণ্ডল), এবং গুলা মেলাকা (পাম সুগার সিরাপ) ঢেলে তৈরি করা হয়।  কখনো কখনো এতে লাল শিমও যোগ করা হয়।  পেনাং এর গরমে এটা খেতে হেবি লাগে –



    আন্দামান সী এর মাঝে এক দ্বীপ এই পেনাং, আর তাই এখানে সামুদ্রিক খাবার জনপ্রিয় হবে না সেটা কি আর হয়! বেশীর ভাগ ভালো রেষ্টুরান্টে আপনি পেয়ে যাবেন নানাবিধ সী-ফুডের সম্ভার। নিজের পকেটের ওজন যেমন, তেমন ভাবে পছন্দ কেরে নিতে পারবেন রেষ্টুরান্ট এবং খাবার।  সমুদ্রের কাছে অবস্থানের জন্য এখানে যেহেতু সর্বদা তাজা মাছ এবং শেলফিশ পাওয়া যায়, তাই স্ট্রীট ফুডের স্টল-গুলিও সেজে ওঠে নানাবিধ সুস্বাদু সী-ফুড সম্ভার নিয়ে।  এর মধ্যে জনপ্রিয় হলঃ

    ওয়েস্টার অমলেট বা ওহ চিয়েনঃ এটি পেনাং-এর স্ট্রীট ফুডের অন্যতম জনপ্রিয় সামুদ্রিক পদ।  এটা মূলত ডিম, স্টার্চ এবং ছোট আকারের তাজা ঝিনুক বা ককলস দিয়ে তৈরি হয়।  গরম তাওয়ায় ডিম ও স্টার্চের মিশ্রণ দিয়ে ঝিনুকগুলিকে হালকা ভেজে নেওয়া হয়, যার ফলে বাইরেটা হয় হালকা মুচমুচে এবং ভেতরে থাকে নরম ও আঠালো।  সাথে থাকে স্পাইসি চিলি সস।  



    ইকান বাকারঃ 'ইকান বাকার' মানে হলো গ্রিল করা মাছ।  এখানে বিভিন্ন ধরনের তাজা মাছ (যেমন - স্টিংরে, স্নাপার বা ম্যাকেরেল) মরিচ, হলুদ, পেঁয়াজ এবং অন্যান্য মশলার একটি ঘন সাম্বাল পেস্ট দিয়ে মেরিনেট করা হয়।  তারপর সেই মাছ কলা পাতায় মুড়ে কাঠকয়লার আগুনে সেঁকা হয়।  নরম মাছের মাংসের সাথে সাম্বালের মশলাদার, ঝাল স্বাদ মিশে এক জবরদস্ত জিনিস তৈরী হয়!  



    আসাম পেডাস ইকান বা আসাম ফিশঃ এটি মূলত পেরানাকান এবং মালয় রন্ধনশৈলীর একটি উল্লেখযোগ্য মাছের পদ।  'আসাম' মানে তেঁতুল এবং 'পেডাস' মানে মশলাদার।  মাছকে তেঁতুলের ঘন টক ঝোল, হলুদের গুঁড়ো, লেমনগ্রাস, আদা এবং প্রচুর চিলি দিয়ে রান্না করা হয় এবং সাধারণত ভাতের সাথে পরিবেশন করা হয়।

    চার স্কুইডঃ অনেক হকার সেন্টারে তাজা স্কুইডকে উচ্চ তাপে ভেজে বা গ্রিল করে একটি বিশেষ সস দিয়ে পরিবেশন করা হয়।  সসটি সাধারণত মিষ্টি, টক এবং সাম্বালযুক্ত হয়। 
     
    পেনাং তো খুব বিশাল কিছু এলাকা নিয়ে দ্বীপ নয় – তার মধ্যে দ্বীপের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে জর্জ টাউন এলাকা সবচেয়ে বেশী জমজমাট।  পেনাং—সামনের নীল জলরেখা, পেছনে পাহাড়ি সবুজ; আর মাঝখানে ঔপনিবেশিক যুগের সিটি হল, ক্ল্যান জেটি, ফোর্ট কর্নওয়ালিস, নীল ম্যানশন, মন্দির-মসজিদ-মঠের কোলাজ।  ইউনেস্কোর ভাষায়, পূর্ব‑পশ্চিমের পাঁচশো বছরের বাণিজ্য ও সংস্কৃতি-নদী এখানে ল্যান্ডস্কেপে মিশেছে — ঠিক যেমনটা মিশেছে খাবারে।  বেড়াতে গেলে বেশীর ভাগ লোকজন এই এলাকার আশে পাশেই থাকে।  তাই স্ট্রীট ফুডের সম্ভার এই এলাকতেই বেশী সেটা বলাই বাহুল্য! জর্জ টাউনের কেন্দ্রে অবস্থান করলে পায়ে হেঁটেই পৌঁছে যেতে পারেন এই তিনটি জনপ্রিয় হকার সেন্টারে: চুলিয়া স্ট্রিট হকার ফুড, কিম্বার্লি স্ট্রিট ফুড নাইট মার্কেট, এবং নিউ লেন স্ট্রিট ফুডস্টল।  এলাকা ছোট হলে কি হবে, এই প্রত্যেক জায়গার আবার নিজের স্পেশালিটি আছে খাবারের।  

    যেমন, চুলিয়া স্ট্রিট হকার ফুড, যা কিনা পর্যটকদের মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয়, যেখানে আপনি পেয়ে যাবেন জম্পেশ ভাবে চাইনিজ এবং মালয় খাবারের মিশ্রণ।  এখানে হইহই করে বিক্রী হতে দেখবেন ‘ওয়ান্টন মি’ নুডুলস শুকরের মাংস বা চিংড়ির ডাম্পলিং এর সাথে।   ওদিকে কিম্বার্লি স্ট্রিট ফুড নাইট মার্কেট এলাকায় স্থানীয় লোকজনের ভীড় বেশি টুরিষ্টদের তুলনায়।  এখানের হিট খাবার হচ্ছে ‘ডাক কুয়ে চাপ’, হাঁসের মাংস এবং ডিমের সাথে ভাতের নুডলস স্যুপ।  আর আছে ওয়েষ্টার ওমলেট – যাও কিনা খুব চলে।   নিউ লেন স্ট্রিট ফুডস্টল জর্জ টাউনের মূল অংশের সামান্য বাইরে – কিন্তু এখানে পেনাং এর সব ধরণের স্পেশালিটি পাওয়া যায় বলে, পর্যটকদের কাছে এটা আজকাল মাষ্ট সি হয়ে গ্যাছে!  হকিয়েন মি বা চার কুয়ে তেও এখানে মার্কেটে বেশী জনপ্রিয়।



    পেনাং-এর হকার সেন্টারগুলি সাধারণত বেশ ভিড় এবং কিছুটা কোলাহলপূর্ণ হয়।  বড় রেস্তোরাঁর মতো নিজের স্পেস, সাজসজ্জা এখানে পাবেন না – তবে এটাই এখানকার বিশেষত্ব।  ছোট প্লাস্টিকের টেবিল এবং চেয়ারগুলোতে বসে আপনি আপনার প্রিয়জনের সাথে সময় ভাগ করে নিচ্ছেন – সে এক রোমান্টিক জিনিস। আশেপাশের লোকজনের ভিড় থাকলেও যে নিজেরা চাইলে আলাদা হওয়া যায়, স্ট্রীট ফুডের স্টলগুলিতে খেতে বসলে তা টের পাওয়া যায়।   কোনো কাঁচের দেওয়াল বা এসি-র ঠান্ডা বাতাস নেই - আপনি সরাসরি শহরের শব্দ, গন্ধ আর দৃশ্য — সবকিছুর অংশীদার।  প্রিয়জনের সাথে বসে চারপাশের হকারদের ব্যস্ততা, স্থানীয়দের হাসি-ঠাট্টা দেখা, আর সেইসাথে সুস্বাদু খাবার উপভোগ করা — এটা এক রোমান্টিক সন্ধ্যা কাটানোর জবরদস্ত রেসিপি!
     
    কোন এক ব্লগার দেখলাম লিখেছেন “লিভিং মিউজিয়াম” শব্দবন্ধ পেনাং এর খাবার নিয়ে লিখতে গিয়ে।  খুব পছন্দ হল ওটা -   আন্দামান সাগরের হাওয়ায় জর্জ টাউনের শপ হাউসের ছায়া যখন লম্বা হয়, পেনাং তখন আপনাকে বসতে বলে — প্লাস্টিক স্টুলে, প্লাস্টিক টেবিলে—কিন্তু প্লেটে থাকে ইতিহাস, জায়গার স্মৃতি, মানুষের গল্প।  আপনি যদি খাবারের ভক্ত হন — তবে পেনাং আপনার জন্য সত্যিই স্বাদের “লিভিং মিউজিয়াম”— যেখানে প্রতিটি ডিস একেকটা খাদ্য ইতিহাসের জীবন্ত মিশ্রণ মনে হয়!

    যদি পেনাং যান কোনদিন, সময় করে একদিন সন্ধ্যেটা অন্তত হাতে রেখে দেবেন – আর ট্রাই করে নেবেন স্থানীয় স্ট্রীট ফুড নীচের ম্যাপ অনুসারেঃ


     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • খ্যাঁটন | ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ | ৮৪ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    পত্তাদকাল - %%
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 2405:201:8004:207e:f58f:71e9:48bd:***:*** | ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৪:৪৭736644
  • এই সিরিজটা খুব ভালো হচ্ছে। খাবারের ছবিগুলো দারুণ। আর তাদের ব্যাকগ্রাউন্ডের গল্পাগুলোও খুব ভালো লাগছে। আচ্ছা 'রক্ত টোফু' কী জিনিষ? টোফুর মত নিরীহ শান্ত একটা খাবারের সাথে রক্ত শব্দটা দেখে কেমন যে গা শিরশির করছে! 'বানজির' শব্দটার মানে বন্যা জেনে আমার বেশ ভালো লাগলো। আমার খুব প্রিয় একটা রূপকথার গল্প আছে (সোনালী প্রজাপতি, ইন্দোনেশিয়ার গল্প), তাতে ঝড়-বৃষ্টির রাজার নাম ছিলি 'বনজির'। এখন তার মানেটা বুঝলাম।
  • সুকি | 49.205.***.*** | ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৭:২০736651
  • কেকে, অনেক ধন্যবাদ। 'রক্ত টফু' না লিখে ব্লাড পুডিং লিখলেও হত।  'পিগ ব্লাড কার্ড' কে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ব্লাড টফুও বলা হয়। 
     
    খাবার ছবি বিষয়ে একটা ব্যাপার মনে হয় আগেও লিখেছিলাম - এখানে ব্যবহৃত অনেক খাবারের ছবি আমার নিজের তোলা নয় - ইন্টারনেটের এদিক ওদিক থেকে নেওয়া। আলাদ করে আর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হয় নি। আসলে যখন এই সব জায়গায় ঘুরেছি তখন তাই নিজে আলাদা করে লিখব ভাবি নি, আর তাই সব ডিসের ছবি তুলে রাখা হয় নি।  
  • অরিন | ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ০২:৫৭736677
  • অপূর্ব হয়েছে। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন