চিয়াং-মাই (থাইল্যান্ড) - স্ট্রীটফুড
-----------------------
থাইল্যান্ডের জনপ্রিয় ভ্রমণের জায়গাগুলি বেশির ভাগই দক্ষিণে - পাটায়া, ব্যাঙ্কক, ফুকেট, ক্রাবি। এই দেশের উত্তর দিকে তুলনামূলক ভাবে খুব বেশি জনতা বেড়াতে যেত না – অন্তত কিছু বছর আগে পর্যন্ত। অবশ্য ১৯২২ সালে ব্যাঙ্কক থেকে উত্তর দিকে ট্রেন চালু হবার আগে এই এলাকাটা প্রায় লোকজনের আনাগোনা থেকে দূরেই ছিল। চিয়াং-মাই এবং চিয়াং-রাই এমনই দুটি জায়গা থাইল্যান্ডের উত্তর দিকে। অবশ্য যে ভাবে টুরিষ্ট যাওয়া বাড়ছে, চিয়াং-মাই কতদিন তার নিজের আকর্ষণ ধরে রাখতে পারবে সন্দেহ বাড়বে। তেমন দিন আর বেশী নেই যখন চিয়াং-মাই নামের ছোট্ট শহরে টুরিষ্টদের প্রায় গায়ে গা ঠেকিয়ে হাঁটতে হবে যেমনটা হয় পাটায়া বা ফুকেট-এ। থাইল্যান্ডের উত্তরে চিয়াং-মাই এক পার্বত্য এলাকা, ব্যাঙ্কক থেকে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দূরত্বে।
সত্যি বলতে কি তখনো পর্যন্ত চিয়াং-মাই নিয়ে বিশাল কিছু জানা ছিল না – শুধু জানতাম খুব সুন্দর একটা। ১২৯৬ সালে রাজা মেংরাই যখন চিয়াং-মাই শহরের প্রতিষ্ঠা করেন, তখন তিনি এই শহরটিকে লান্না সাম্রাজ্যের নতুন রাজধানী বানান। ‘লান্না’ শব্দের অর্থ ‘দশ লক্ষ ধানের ক্ষেত’ আর চিয়াং মাই শব্দের অর্থ থাই ভাষায় "নতুন শহর"। ।ভৌগোলিকভাবে বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার), চীন এবং লাওসের কাছাকাছি হওয়ায় এই অঞ্চলটি ঐতিহাসিকভাবেই সংস্কৃতির মিলনমেলা ছিল বলে ধরে নিতে পারেন। রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা হবার পর সেই ১২৯৬ সাল থেকে ১৫৫৮ সাল পর্যন্ত চিয়াং মাই উত্তর থাইল্যান্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়। এর পর ১৫৫৮ সালে বর্মী বাহিনী শহরটি দখল করে নেয় এবং পরবর্তী দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে লান্না রাজ্য বার্মার অধীনে ছিল। ১৭৭৫ সালে থাই বাহিনী বর্মীদের হারিয়ে দিয়ে শহরটিকে থাইল্যান্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করে।
বর্তমানে চিয়াং মাই উত্তর থাইল্যান্ডের বৃহত্তম শহর এবং একটি প্রধান পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত। এর প্রাচীন শহর, যা প্রাচীর ও পরিখা দ্বারা বেষ্টিত, এবং শত শত বৌদ্ধ মন্দির শহরের সমৃদ্ধ ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। এই শহরটি ধর্মীয় দিক থেকেও খুব তাৎপর্যপূর্ণ। চিয়াং মাই-তে থাইল্যান্ডের অন্য যেকোনো শহরের চেয়ে বেশি বৌদ্ধ মন্দির ('ওয়াট') রয়েছে—পুরো অঞ্চলে প্রায় ৩০০টি মন্দির দেখা যায়। এই শহরের মূল বা 'ওল্ড সিটি' এলাকাটি আজও প্রাচীর ও পরিখা দ্বারা বেষ্টিত। এই প্রাচীরগুলি লান্না রাজ্যের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে এর অতীতকে তুলে ধরে। প্রাচীন ‘থা পায়ে গেট’ হলো সেই সময়ের বণিক, সন্ন্যাসী ও কূটনীতিবিদদের শহরে প্রবেশের প্রধান দ্বার।
https://iili.io/fuujjX2.jpgআজকের দিনে চিয়াং-মাই থাইল্যান্ডের মধ্যে বাণিজ্যগত ভাবে তত গুরুত্বপূর্ণ না হলেও, একসময় কিন্তু এই এলাকা ছিল প্রচুর জমজমাট। ১৯০০ শতকের প্রথম ভাগে এই চিয়াং-মাই রমরম করত সেগুন কাঠের ব্যবসার জন্য। অনেক বিদেশী কোম্পানী এই ব্যবসা করত এবং স্বাভাবিক ভাবেই সেই সব কোম্পানীর ম্যানেজারেরা হত বিদেশী। ঔপনিবেশিক যুগে ইউরোপীয় বণিক ও মিশনারিদের যাতায়াত শুরু হলেও চিয়াং মাই কখনো পুরোপুরি উপনিবেশে পরিণত হয় নি, বরং সীমান্ত শহর হিসেবে নানা জাতিগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছে।
সেই অতীতে ফিরে দেখলে বোঝা যাবে চিয়াং মাইয়ের খাবার সংস্কৃতি ছিল মূলত ঘরের অন্দরমহলে বা রাজকীয় অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ। সাধারণ মানুষ নদীর ধারে বা মন্দিরের আশেপাশের ছোট বাজারে স্থানীয় পণ্য কেনাবেচা করত। স্ট্রীট ফুড বলে তেমন আলাদা করে তেমন কিছু ছিল না – যেমনটা তখনকার সময়ে প্রায় কোন শহরেই ছিল না। তবে বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে যখন নগরায়ন শুরু হলো এবং পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ল, তখন এই ঘরোয়া রান্নাগুলো রাস্তার ধারের ছোট ছোট স্টলে খাবার বিক্রী শুরু হল। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর শহরের প্রাচীন প্রাচীরের গেটগুলোর সামনে বসা বাজারগুলো (চ্যাঙ পুয়াক/নর্থ-গেট নাইট মার্কেট ইত্যাদি) – যেগুলো তো এখন ভোজনরসিকদের ফেবারিট জায়গার পরিণত হয়েছে। সময়ের হিসেবে দেখলে ১৯৬০-এর দশকে থাইল্যান্ডে স্ট্রিট ফুড যে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে তার ছাপ চিয়াং মাইতেও এসে পরে। তবে দীর্ঘদিন ধরে সেই স্ট্রীট ফুড চিয়াং মাই-য়ে কেবল স্থানীয়দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, কারণ তখন তত বেশী পর্যটক এখানে আসত না।
https://iili.io/fuuMHLF.jpgচিয়াং মাই-এর স্ট্রিট ফুডের শিকড় লান্না সংস্কৃতিতে। তবে কিনা প্রাচীনকালে বাণিজ্য পথের কারণে এখানে চীনা মুসলিম, বার্মিজ ও লাওসীয় খাবারের প্রভাব চলে আসে এবং আজকের দিনের আপনি চিয়াং মাইয়ের খাবারে, তা সে রেষ্টুরান্টের জমকালো খাবারই হোক বা রাস্তার ধারের খাবার, ওই সব দেশের খাবারের মিশ্রণ দেখা যায়।
তাহলে এবার প্রশ্ন উঠতে পারে, ট্রাডিশন্যাল লান্না রান্নার ভিত্তি কি? ভিত্তি হল গিয়ে - তাজা হার্ব, লেমনগ্রাস, গালাঙ্গাল, লেমন পাতা, লাল ও সবুজ লঙ্কা, ফারমেন্টেড মাছ বা চিংড়ির ব্যবহার। লান্না ক্যুজিন হল গিয়ে ভাত নির্ভর খাবার - ধীরে রান্না করা ঝোল, শুয়োরের মাংস বা বুনো শাকসবজি — এগুলো স্থানীয় বৈশিষ্ট্য, যা আজও আপনি পাবেন চিয়াং মাইয়ের স্ট্রীট ফুডে।
এবার একটু চট করে দেখে নেওয়া যাক প্রতিবেশী দেশের রান্নার স্টাইল বা কি কি খাবার চিয়াং মাইয়ের খাবারে ছাপ রেখে গেছে। এখানকার স্ট্রিট ফুডের ইতিহাসে চীনা প্রভাব সবথেকে বেশি – বিশেষ করে ঊনবিংশ শতাব্দীতে চীন থেকে আসা চীনা মুসলিম বা ‘হাও’ বণিকদের প্রভাব। বিখ্যাত ডিশ ‘খাও সোয়ে’ এর উৎপত্তিতে এই চীনা মুসলিম এবং বার্মিজ প্রভাব স্পষ্ট। মনে করা হয়, বার্মিজ ডিশ ‘ওন নো খাও সোয়ে’ থেকেই এর উৎপত্তি, যা চীনা বণিকদের হাত ধরে চিয়াং মাইতে এসে বর্তমান রূপ পেয়েছে। মোটের উপর - স্টির-ফ্রাই, নুডল স্যুপ, শুকনো মশালা, সয়া সস আর কিছু ফারমেন্টেড উপকরণের ব্যবহার চীনা প্রভাবের ফল বলে ধরে নেওয়া হয়। আজকের দিনের বিভিন্ন ভাজা নুডল, ডাম্পলিং বা ডিম-সাম ধরনের স্ন্যাক মূলত চীনা-প্রভাবিত, পরে স্থানীয় স্বাদ অনুযায়ী বদলে গেছে।
এর পর আছে বর্মীজ প্রভাব - বার্মার সাথে বছরের পর বছর মারপিট করে যাবার ফলে উত্তর থাই রান্নায় ঢুকে পড়ে বার্মিজ মসলার মিশ্রণ। ধীরে রান্না করা ঝোল আর টক-মিষ্টি শুয়োরের মাংসের ঝোল, যার ক্লাসিক উদাহরণ গ্যাং হাং লে। এতে আদা, তেঁতুল এবং বিশেষ বার্মিজ মসলা ‘হাং লে পাউডার’ ব্যবহার করা হয়, যা থাই কারির মতো ঝোল বা নারকেল দুধের ওপর নির্ভরশীল নয়। এটি সরাসরি বার্মিজ আক্রমণের সময় সৈন্যদের বা রাজকর্মচারীদের মাধ্যমে এখানে প্রবেশ করেছিল বলে দাবি করা হয়। আজকের দিনের চিয়াং-মাইয়ের কারি-বেসড সুপ, টমেটো-নির্ভর ডিপ এবং লাল মরিচ পেস্টের ব্যবহার বার্মিজ রান্নার সাথে মিল রাখে।
https://iili.io/fuuM21a.jpgব্যাংককের বা সেন্ট্রাল থাইল্যান্ডের খাবারের চেয়ে এখানকার খাবার বেশ আলাদা। এখানকার আবহাওয়া কিছুটা ঠান্ডা, তাই খাবারে নারকেল দুধের ব্যবহার কম, বরং ভেষজ মসলা, শুকনো লঙ্কা এবং তিতকুটে স্বাদের ব্যবহার বেশি দেখা যায়। অনেকে বলেন চিয়াং মাইয়ের খাবারে মধ্য থাইল্যান্ডের তুলনায় মিষ্টি কম। অবশ্য আমার কাছে পৃথিবীর কোন খাবার-ই বেশী মিষ্টি লাগে না – সবসময়েই মনে হয় আর একটু মিষ্টি দিলে পারত! তবে সেটা আমার সীমাবদ্ধতা – তাই কোন জিনিসের মিষ্টত্বের লেভেল নিয়ে মতামত দেওয়া আজকাল কমিয়ে দিয়েছি সেগুলো ওয়ান-ডাইমেনশন্যাল হয়ে যায় বলে!
https://iili.io/fuuM9X1.jpgচিয়াং মাই ঘুরতে গেলে ধরে নেওয়া যায় যে সেখানে আপনি খুব বেশী দিন থাকবেন না – বড় জোর দিন চারেক। তাই এই সীমিত সময়ের মধ্যে কোন স্ট্রীট ফুড গুলো ‘মাষ্ট ট্রাই’ দলভুক্ত করা যায় সেটা এবার একটু দেখে নেওয়া যাক।
চিয়াং মাইয়ের অন্যতম প্রধান সিগনেচার ডিশ হল ‘খাও সোয়ে’। এটি মূলত নারকেল দুধ ও কারি পেস্ট দিয়ে তৈরি একটি ঘন স্যুপ, যার মধ্যে থাকে সিদ্ধ ডিমের নুডলস এবং ওপরে ছড়ানো থাকে মচমচে ভাজা নুডলস (ওই যাকে ক্রিসপি নুডুলস বলে আর কি)। সাথে দেওয়া হয় মুরগি বা গরুর মাংস, এবং সাইড ডিশ হিসেবে থাকে কাঁচা পেঁয়াজ, পিকিলড সর্ষে শাক এবং লেবু। সব মিলিয়ে এর স্বাদে আপনি পেয়ে যাবেন ক্রিমি, ঝাল এবং টকের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। বলা হয়ে থাকে যে লান্না ও মুসলিম সংস্কৃতির মেলবন্ধন হিসেবে চিয়াং মাইয়ের সব থেকে সার্থক উদাহরণ হল হলো ‘খাও সোয়ে’। ঊনবিংশ শতাব্দীতে চীন থেকে আসা মুসলিম বা ‘চিন হাও’ বণিকরা যখন মিয়ানমার হয়ে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে উত্তর থাইল্যান্ডে আসতেন, তারা তাদের সাথে এই রান্নার পদ্ধতি নিয়ে আসেন। - যা আগে উল্লেখ করেছি।
https://iili.io/fuuMurG.jpg খাও সোয়েএর পর আসবে ‘সাই উয়া’ যাকে অনেক সময় নর্দার্ন থাই সসেজও বলা হয়। ‘সাই’ অর্থ অন্ত্র এবং ‘উয়া’ অর্থ ভরাট করা। দেখতে সাধারণ সসেজের মতো হলেও এর স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। মাংসের কিমার সাথে লেমনগ্রাস, কাফির লাইম পাতা, এবং প্রচুর ভেষজ মসলা মিশিয়ে এটি গ্রিল করা হয়। অতীতে ফ্রিজ বা সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না। তাই মাংস যাতে নষ্ট না হয়ে যায়, সেজন্য শূকরের মাংসকে মসলা দিয়ে মেখে অন্ত্রের ভেতর ঢুকিয়ে শুকিয়ে বা গ্রিল করে রাখা হতো। একটু হাওয়া দিলে আশেপাশে কেউ রান্না করলে আপনি পথ চলতে চলতেই টের পাবেন – বিয়ারের সাথে স্ন্যাকস হিসেবে এটা দারুণ জমে যায়। প্রায় সব নাইট মার্কেটেই কাঠিতে গরম গরম পরিবেশন করা হয় এ জিনিস।
https://iili.io/fuuMcIS.jpgআছে ‘প্রিক অং’ যা টমেটো এবং শুকরের মাংসের কিমা দিয়ে তৈরি একটু ডিশ – এটা আবার অনেকটা দেখতে অনেকটা বোলোনিজ সসের মতো, কিন্তু স্বাদে ঝাল ও মিষ্টি। একে চিয়াং মাইয়ের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ডিপিং সসও বলা যায়। এটি সাধারণত সেদ্ধ সবজি বা ভাজা শূকরের চামড়া দিয়ে খাওয়া হয়।
https://iili.io/fuuM574.jpg নাম প্রিক“খাও খা মু” নামের ডিশটি যদিও এটি সারা থাইল্যান্ডেই পাওয়া যায়, তবে চিয়াং ‘চ্যাং ফুয়াক গেট’-এর কাছের রাস্তায় যে স্থানীয় ভার্সনটি পাওয়া যায় সেটি নাকি কিংবদন্তিতুল্য – অন্তত এমনটাই দাবি করে আসছে এখনকার টুরিষ্ট এবং ফুড-ব্লগাররা। এটি মূলত একটি চীনা ডিশ যা চীনের ‘তেউচিউ’ রন্ধনশৈলী থেকে এসেছে। শূকরের পা, দারুচিনি, স্টার অ্যানিস, রসুন, সয়া সস এবং পাম সুগারের মিশ্রণে ঘন্টার পর ঘন্টা জ্বাল দেওয়া হয় যাতে মাংস নরম হয়ে হাড় থেকে খুলে পড়ে! এটি ভাতের ওপর পরিবেশন করা হয় এবং সাথে থাকে সেদ্ধ ডিম, ব্লাঞ্চ করা কেইল পাতা এবং রসুনের ভিনেগার।
পর্যটকদের চেয়ে স্থানীয়দের কাছে বেশি প্রিয় এমন একটি খাবার এখানে আছে যার নাম “খানোম জিন নাম গিয়াও” – এটা হল শান সম্প্রদায়ের অবদান। ‘শান’ বা ‘তাই ইয়াই’ জাতিগোষ্ঠী মূলত মিয়ানমার ও উত্তর থাইল্যান্ডের সীমান্তে বসবাস করে। চিয়াং মাইয়ের স্থানীয় উৎসবগুলোতে এই খাবারটি থাকবেই। এটি মূলত চালের তৈরি চিকন নুডলস (খানোম জিন) যা টক-ঝাল ঝোলের সাথে পরিবেশন করা হয়। ঝোলটি তৈরি হয় শূকরের হাড়, টমেটো, শুকনো লঙ্কা এবং ‘ডক গিয়াও’ নামক একটি বিশেষ ফুলের শুকনো অংশ দিয়ে। এছাড়াও এতে থাকে ‘লুয়া দ’ বা শূকরের রক্তের জমাটবাঁধা কিউব যা ঝোলকে ঘন করে। এর স্বাদ কিছুটা টমেটো স্যুপের মতো মনে হলেও, স্থানীয় মসলার ঝাঁজ একে অন্য রকম দ্বাদের করে তোলে।
চিয়াং মাইয়ের প্রায় সব রেস্তোরাঁ এবং স্ট্রিট ফুড স্টলে আপনি পেয়ে যাবেন ‘ক্যাং হাং লে’ যা আদপে বার্মিজ কারির উত্তরাধিকারি। ‘হাং লে’ শব্দটি বার্মিজ ‘হিন লে’ থেকে এসেছে। এই রান্নায় সাধারণত পর্ক বেলি ব্যবহার করা হয়, যেখানে চর্বি ও মাংসের স্তর থাকে। মাংসকে ‘হাং লে পাউডার’ (এক ধরনের গরম মসলা), তেঁতুলের রস, আদা কুচি, রসুন এবং বিশেষ কারি পেস্ট দিয়ে ম্যারিনেট করে দীর্ঘক্ষণ মৃদু আঁচে রান্না করা হয়।
মিষ্টি নিয়ে আলাদা করে আর কিছু লিখছি না – থাইল্যান্ডের অন্য জায়গা গুলির মত চিয়াং মাইয়েও ‘ম্যাংগো স্টিকি রাইস’ ডেজার্ট হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। এ ডেজার্ট আপনি অনেক দোকানেই পেয়ে যাবেন – তবে স্ট্রিট ফুড হিসেবে হয়ত একটু কম – রেষ্টুরান্টে বসে খেলে মনে হয় পুরো আমেজ আসবে। বিশেষজ্ঞদের মতে চিয়াং মাইয়ের স্থানীয় আম এবং আঠালো চালের গুণগত মান নাকি তুলনামূলক ভালো আর তাই এখানকার ম্যাংগো স্টিকিও খেতে ভালো অন্য জায়গার তুলনায়। আমি নিজে আলাদা করে কোন পার্থক্য পাই নি – কারণ সব ম্যাংগো স্টিকি রাইস-ই আমার ভালো লাগে!
https://iili.io/fuuMf7R.jpgথাই রোটি নিয়ে আজকাল প্রচুর রিলস পেয়ে যাবেন সোশ্যাল মিডিয়ায় – বিশেষ করে যিনি বানাচ্ছেন তিনি যদি সুন্দরী হন! এই ওই ইউরোপীয়ান প্যান কেক আর কি। তবে এ জিনিস এখানে ইউরোপীয়ানদের মাধ্যমে আসে নি – এসেছে মুসলিম ব্যবসায়ীদের হাত ধরে ভারত–মালয় বাণিজ্য পথ হয়ে। স্ট্রীট ফুড হিসেবে খুবই জনপ্রিয় চিয়াং মাই তেও। ভিতরে কলা দেওয়া হয় সাধারণত – উপরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় কনডেন্সড মিল্ক এবং চিনি, বা নাটেলা/চকোলেট সস।
নারকেলের পুডিং প্যানকেক যাকে ‘খানোম ক্রক’ বলা হয় তা চিয়াং মাইয়ে খুবই জনপ্রিয় তা সে রাতের বাজার বা সকালের স্ন্যাকস যাই হোক না কেন! এর সাথে আছে থাই স্টাইল ডোনাট বা ছোট ভাজা রুটি ‘পা দং গো’ – সকালে কফি বা সয়া মিল্কের সাথে খাবার জন্য জনপ্রিয়।
স্থানীয় ভাবে বিখ্যাত এবং এখন টুরিষ্টদের কাছে জনপ্রিয় এমন কিছু জায়গা আছে চিয়াং মাইয়ের এদিক ওদিকে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত মনে হয় চ্যাং ফুয়াক গেট নাইট মার্কেট যা সন্ধ্যার পর খাবারের মেলায় পরিণত হয়। এখানকার ‘খাও খা মু’ খুবই বিখ্যাত। যারা একটু শান্ত পরিবেশে খেতে চান, তারা চলে যেতে পারেন চিয়াং মাই সাউথ গেট মার্কেট। এখানকার ‘পা দং গো’ বা থাই ডোনাট খুব জনপ্রিয়। এছাড়া আছে শহরের কেন্দ্রস্থলে ‘সানডে ওয়াকিং স্ট্রিট’ যা প্রতি রবিবার বিশাল বাজারে পরিণত হয়। এই মার্কেটে রাস্তার দুই পাশের খাবারের দোকানগুলিতে তখন আপনি পেয়ে যাবেন গ্রিল করা স্কুইড, কলাপাতা মোড়ানো গ্রিল করা মাছ এবং নানাবিধ রঙিন ফলের জুস।
দিনের বেলার বাজার হিসেবে আপনি পেয়ে যাবেন কাড লুয়াং বা ওয়ারোরট মার্কেট। এখানকার ‘সাই উয়া’ সসেজ সবচেয়ে সুস্বাদু বলে বাজারে চালু আছে। এখান থেকে অনেক টুরিষ্ট আবার ‘নাম প্রিক নুম’ (একধরণের প্যাকেটজাত চিলি পেস্ট) কিনে নিয়ে যায় – ফুড ব্লগাররা বেশ প্রমোট করে আজকাল এই জিনিসটা।
https://iili.io/fuuMlh7.jpg ওয়ারোরট মার্কেটআচ্ছা ফুড ব্লগারদের নিয়ে আলাদা করে আর কি বলব – আজকাল আমষ্টারডামে গিয়ে দেখি কিছু কিছু দোকানের সামনে বিশাল ভিড় – যা আগে তেমন জনপ্রিয় ছিল না। এবং সত্যি বলতে কি সেগুলো যে তেমন স্পেশাল কিছু তেমনও নয় – স্থানীয় এবং আমাদের মত পাবলিক যারা ওখানে নিয়মিত খেয়েছে তাদের মতে। সেই জন্যও হাসির ছলে স্থানীয় লোকজন ওই দোকানগুলিকে ‘টিক টক শপ’ বলে। তা এই টিক-টক শপ আজকাল সারা বিশ্ব জুড়েই – অবশ্য এমন নয় যে ওই দোকান গুলি সবই বাজে বা তাদের নিজস্ব কোন বৈশিষ্ট নেই – ওই যে আপনাকে নিজে বুঝে নিতে হবে!
এমন ভাবেই চিয়াং মাইয়ের একটি বিশেষ স্টল বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়ে গিয়েছিল - চ্যাং ফুয়াক গেটের রাতের বাজারে মাথায় কাউবয় হ্যাট পরে ‘খাও খা মু’ বিক্রি করা একজন ভদ্রমহিলা। ফুড ব্লগাররা এই দোকানের স্টু করা মাংসের প্রশংসা করে করে এমন জায়গায় দাঁড় করিয়েছে যে কিছু বিশেষ দেশের টুরিষ্টরা মনে করে কাউবয় হ্যাট লেডির হাতের এই ডিশটি না খেলে চিয়াং মাই ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে!
https://iili.io/fuuMqep.jpg কাউবয় হ্যাট লেডি তেমনি ‘খাও সোয়ে’ খাবার জন্য জনপ্রিয়তা পেয়েছে একটি ছোট্ট দোকান যার নাম ‘খাও সোয়ে খুন ইয়াই’। ‘খুন ইয়াই’ মানে নাকি দিদিমা! তিনি সারা দিনে মাত্র সকাল দশটা থেকে দুপুর ২ টো পর্যন্ত খোলা রাখেন – তাতেই প্রচুর বিক্রী।
নি মান এলাকায় পেয়ে যাবেন আপনি একটি দোকান যার নাম ‘চেরং ডোই রোস্ট চিকেন’ - এই দোকানটি বিখ্যাত তার ‘গাই ইয়াং’ বা গ্রিল করা মুরগির জন্য। এখানকার গ্রিল করা মুরগির চামড়া মচমচে এবং মাংস নরম, যা তেঁতুলের সসের সাথে পরিবেশন করা হয়।
https://iili.io/fuuMYp2.jpg রোষ্ট চিকেন থাইল্যান্ডের অন্য জায়গায় স্ট্রিট ফুড ট্রাই করেছেন বলে চিয়াং মাই-য়ে আর ট্রাই করার দরকার নেই এমনটা ভাববেন না যেন! চিয়াং মাইয়ে র স্ট্রিট ফুড ব্যাঙ্কক, পাটায়া বা ফুকেটের থেকে বেশ আলাদা – আর সেই পার্থক্যটা মূলত আসে অঞ্চলের খাবার ঐতিহ্য, উপকরণ আর পরিবেশ থেকে। উত্তর থাই (লান্না) কুইজিন যেখানে চিয়াং মাইয়ে র স্ট্রিট ফুডকে গড়ে তুলেছে, সেখানে ব্যাঙ্ককের স্ট্রিট ফুড হল সাউদার্ন থাই স্টাইল নির্ভর এবং তাছাড়া সারা থাইল্যান্ড ও বিদেশি প্রভাবের মিশ্রণ – অন্যদিকে ফুকেট–পাটায়াতে সী-ফুডের পর্যাপ্ততা। চিয়াং মাই গেলে একটু সময় নিয়ে স্থানীয় খাবার খেয়ে দেখুন – উপসংহারে এটাই বলার।