ছোটবেলায় একটা কথা আমরা প্রায়ই শুনতাম, নানা প্রসঙ্গে – “সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র”। এখন আর ততটা শুনি না। কেন শুনি না তার নানা কারণ হতে পারে – আমাদের সত্যিই অগ্রগতি হচ্ছে সমাজ হিসেবে যেখানে শুধু সৌন্দর্য্য দিয়ে আমরা কারো যোগ্যতা বিচার করছি না; বা আমি সমাজের একাংশ যেখানে ‘মনে যাহা আসে বলে ফেল’ থেকে সরে এসে সমাজের একাংশের সাথে সময় কাটাচ্ছি যেখানে ‘পটিলিক্যালি কারেক্ট’ কথাবার্তা বলা একটা আবশ্যিক অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়; বা ‘ডাইভারসিটি অ্যান্ড ইনক্লুশন’ ব্যাপারটিতে আমরা অনেকেই সচেতন হয়ে পড়ছি, সে কেউ ব্যক্তিগত ভাবে ব্যাপারটাকে তত গুরুত্বপূর্ণ মনে করুক বা না করুক।
তাহলে তো মনে হতেই পারে এবার যে – যাক আমরা তাহলে যুগের সাথে বাহ্যিক সৌন্দর্য্যের উপর আমাদের যে পক্ষপাত তার থেকে বেরোতে পেরেছি। মানুষকে তার যোগ্যতা দিয়েই কেবল বিচার করছি। হ্যাঁ, এটা হয়ত ঠিক যে যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বৃহত্তর জনগণের স্বার্থে, সেখানে আমরা অনেক সচেতন হয়ে পড়েছি – কিন্তু একই কথা কি বলতে পারি যখন সেই আমরাই কেবলমাত্র ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নিই ব্যক্তিগত কাজের জন্য?
মোটামুটি ভাবে এর উত্তর হল – না। সুন্দর জিনিসের প্রতি পক্ষপাতের উর্দ্ধে আমরা পুরোপুরি উঠতে পারি নি। সচেতন হয়েছি ঠিক, কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক, আমাদের অভিযোজন – আমাদের অবচেতনে সুন্দরের প্রতি পক্ষপাতের বীজ খুব গভীর ভাবে পোঁতা হয়ে আছে। অনেকেই বুক বাজিয়ে বলবেন, আমি এই সবের উর্দ্ধে। কিন্তু প্রচুর সংখ্যক বৈজ্ঞানিক গবেষণা আছে যে প্রমাণ করেছে, আমরা প্রায় কেউই সেই পক্ষপাতের উর্দ্ধে নই। আসলে আমরা অনেক সময় টেরই পাই না যে কি ভাবে আমাদের মস্তিষ্ক কিছু সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের চালিত করেছে।
মানুষের সুন্দরের প্রতি এই পক্ষপাতের দিকটা বলাই বাহুল্য অনেকে নানা ভাবে ব্যবহার করেছে – সবচেয়ে বেশী মনে হয় হয় ব্যবহার করেছে বিজ্ঞাপনদাতারা এবং কনজিউমার মার্কেট। এদের থেকে বেশী কেউ আমাদের ম্যানুপুলেট করে নি – কারণ বাকি সবার থেকে এরা নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে জানে যে মানুষের সৌন্দর্য্য কিভাবে আমাদের সাথে কৌশলের খেলা খেলে – যুগ যুগ ধরে, বারেবারে। এরা জানে আমরা কিভাবে সুন্দর শিশুর মুখের দিকে একটু বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকি, পুরানো দিনে স্লাইডের ব্যবহারের থেকে কেউ পাওয়ার পয়েন্ট ব্যবহার করলে তাকে একটু বেশী এগিয়ে রেখেছি ইত্যাদি।
আমরা ধরে নিই বা মনে করি আকর্ষণীয় মানুষেরা বেশী বুদ্ধিমান, বেশী সৎ, আবেগ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বেশী সামঞ্জস্যপূর্ণ – মানে সাধারণ জনতার সাথে এরা সব ব্যাপারেই এগিয়ে। যদি বাকি সব কিছু কাছাকাছি স্তরের হয়, তাহলে আমরা এখনও যে সুন্দর দেখতে তাকে বেছে নিই কিছু প্রেজেন্ট করার জন্য; এক ওভার বাকি আছে টেষ্ট ম্যাচ শেষ হতে, একটাই উইকেট - কে ব্যাট করবে আমার হয়ে; কে প্লেনে খাবার সার্ভ করবে আমাদের, এমনই পাইলটকেও।
এবার ব্যাপার হল আমি উপরে যা লিখলাম তা আপনি বিশ্বাস নাও করতে পারেন। যদি বলি এগুলো শুধু আমার মত নয়, এই নিয়ে অনেক স্টাডি হয়েছে – এবং যা লিখলাম তা স্ট্যাটিসটিকস এর উপর ভিত্তি করে, তাহলেও আমাদের অনেকের কাছে উত্তর রেডি আছে, “দেয়ার আর লাইজ, ড্যাম লাইজ, অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস”। মানে স্ট্যাটিসটিকস ব্যবহার করে যা কিছু চাও তাই প্রমাণ করা যায়।
কিন্তু এটা সত্যি নয়। স্ট্যাটিসটিকস কোন ক্ষেত্রেই মিথ্যে বলে না যদি তা ঠিক মত ব্যবহার করা হয়। আর এই ক্ষেত্রে মিথ্যে তো নয়ই। কেন নয় সেই সব বিস্তারে এখানে লেখার সুযোগ নেই। শুধু বলি, যাঁরা ওই গবেষণাগুলির স্ট্যাটিসটিকস এ বিশ্বাস করেন নি, বা সৌন্দর্য্যের উপর আমাদের পক্ষপাতের ব্যাখায় – তাঁদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল – ঠিক আছে, এই ব্যখ্যা মানতে হবে না। তাহলে কিসের উপর ভিত্তি করে আপনি ওই বিশেষ ব্যক্রি বা বস্তু পছন্দ করেছিলেন?
তার উত্তর এসেছিল – “ইট জাষ্ট ফেল্ট রাইট”
এর পরে আসবে কোটি টাকার প্রশ্ন, সুন্দর সুন্দর বলে তো হইচই করছ। আমাদের কাছে আসলে সুন্দর তাহলে কি? তোমার কাছে যা সুন্দর, আমার কাছে তো তা সুন্দর নাও হতে পারে!
এই নিয়েও গুচ্ছ গুচ্ছ গবেষণা বা লেখাপত্র আছে। অবশ্যই আমার কাছে যে সুন্দর তা আপনার কাছে নাও হতে পারে। কিন্তু একটা জেনেরিক ব্যাপার আছে, যা আমাদের মস্তিষ্কে প্রোথিত আছে আমাদের বেড়ে ওঠা, আমাদের অভিযোজন এদের সাথে। কেন সুন্দর না ব্যাখ্যা করতে না পারলেও, সুন্দর তা আমাদের মস্তিষ্ক মনে নেয়। যেমন, ঐশ্বর্য্য রাই সুন্দর এটার সাথে দ্বিমত হবে এমন খুব বেশী মানুষ পাবেন না – যদিও প্রায় আমরা অনেকেই ব্যাখ্যা করতে পারব না যে ওকে সুন্দর বলছি কেন!
এগুলো আরো জটিল হয়ে ওঠে গভীরে গেলে – ছোটবেলা থেকে আমরা শিখে আসি যে সুন্দর জিনিস আমাদের জন্য ভালো। এই জন্যই দীর্ঘ সময় হিন্দী সিনেমার (বা অন্য সিনেমাতেও) ভিলেনরা বিশেষ একধরণের দেখতে বা বিশেষ এক ধরণের ব্যবহারের স্টিরিওটাইপ হত বা এখনও হয়। আমাদের মস্তিষ্কে প্রোথিত আছে যে ধারালো, ছুঁচালো, অমসৃণ, বিবর্ণ – এমন সব জিনিস সব বিপদজনক হতে পারে – আর অন্যদিকে মসৃণ জিনিস হল নিরাপদ। তাই মসৃণ ত্বকের মানুষের মুখের উপর আমাদের নজর এবং পক্ষপাত বেশী যায়, ব্রণ ভর্তি বা পক্সের কারণে দাগ থেকে যাওয়া মুখের থেকে। এই এখনও দেখা গ্যাছে যে কোন টিম কালো জার্সি/ড্রেস পরে খেললে, রেফারীরা বেশী সহানুভূতি তাদের উপর দেখায় না। কালো, ধূসর রঙের সাথে জুড়ে আছে এমন ট্যাবু।
শুধু রঙ বা মসৃণতাই নয়, কোন জিনিসের আকারের উপরেরও আমাদের এমন অবচেতন পক্ষপাত আছে। কি মনে হয়, কোন আকারের (সেপ) উপরের আমাদের পক্ষপাত বেশী? এর উত্তর সোজা – আপনারাও জানেন, তবে সেটা দেবার আগে একটা ছোট্ট গল্প শোনানো যাক।
১৯৬৩ সালের কথা – “স্টেট মিউচ্যুয়াল লাইফ ইনসিওরেন্স অব আমেরিকা” কোম্পানী তখন সবে অন্য একটা ইনসিওরেন্স কোম্পানীকে অধিগ্রহণ করেছে। স্বাভাবিক ভাবেই সেই অধিগ্রীহিত কোম্পানীর কর্মচারীদের মানসিক অবস্থা বা ‘মরাল’ তেমন যুতের নয়। তখন সেই বড় কোম্পানীর কর্তারা ভাবতে বসলেন যে কিছু করে কি এই নতুন কর্মচারীদের মরাল এর উন্নতি করা যায়? ডাকা হল তখনকার দিনের বিখ্যাত অ্যাডভার্টাইজ এবং পাবলিক রিলেশন বিশেষজ্ঞ হার্ভে বল-কে। হার্ভের তখন নিজের ফার্ম ছিল ম্যাসাচুয়েটস-এ। তিনি প্রথমে ওই ইন্সিওরেন্স কোম্পানীর প্রস্তাব শুনে ভাবলেন, এ আবার কেমন কাজের অনুরোধ! কিন্তু তবুও বললেন, তিনি ভেবে দেখবেন। হার্ভে-কে খুব বেশী দিন এই নিয়ে ভাবতে হয় নি। ইনফ্যাক্ট যেদিন তিনি এই অ্যাসাইনমেন্টের প্রস্তাব পান, সেই দিনই বিকেলে তিনি ড্রয়িং বোর্ডের সামনে ভাবতে শুরু করে একসময় এঁকে ফেললেন একটা হলুদ বৃত্ত, এবং তার ভিতরে দুটো ছোট বৃত্ত এবং একটি অর্ধবৃত্ত!
চিনতে পারছেন এটা? হ্যাঁ, এই সেই আজকের দিনের বিখ্যাত ‘স্মাইলি’ ফেস। এই কাজের জন্য হার্ভে একমাস পরে চেক পেয়েছিলেন তখনকার দিনে ৪৫ ডলার, যা আজকের দিনে হিসেব করলে প্রায় ৫০০ ডলারের মত। এর পরের কয়েক বছরে কি হতে চলেছে তা মনে হয় হার্ভে নিজেও আন্দাজ করতে পারেন নি – তাঁর দ্বারা সৃষ্ট সেই স্মাইলি ফেস আমেরিকার পোষ্টাল স্ট্যাম্পে স্থান পাবে, ওয়ালমার্টের সিম্বল হিসেবে দেখা যাবে, যা থেকে বানানো হবে ‘বাটন’ বা স্মাইলি চাকতি/বোতাম, কেবলমাত্র ১৯৭১ সালে পাঁচ কোটি বিক্রী হয়েছিল! এ এক প্রত্যক্ষ প্রমাণ কোন এক আকারের স্বাভাবিক সরলতা – যা থেকে আমরা একদম ছোটবেলা থেকেই আকৃষ্ট – বৃত্ত।
তাহলে উত্তর পেয়ে গেলেন তো যে, কোন আকারের (সেপ) উপরের আমাদের পক্ষপাত বেশী? সেই আকার হল গোল বা বৃত্ত।
বিখ্যাত ডিজাইনার-রা আমাদের বৃত্তের প্রতি এই পক্ষপাত-কে বিস্তারে ব্যবহার করবে না, তা তো হয় না! যে কোন জিনিসের মতন, নানা কোম্পানীর লোগো-কেও র্যাঙ্ক করা হয়েছে ক্রেতাদের পছন্দ অনুযায়ী – মানে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ২৫টি লোগো কি, এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা গ্যাছে প্রত্যাশা অনু্যায়ী সেই লোগো গুলিতে ‘বৃত্ত’-র ব্যবহারের প্রাচুর্য্য। বি এম ডব্লু, মার্সিডিজ, নাসা, অ্যাপেল, স্টারবাক্স, পেপসি, লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড, গুগুল, মাষ্টারকার্ড – ইত্যাদি সবজায়গাতেই বৃত্তের ব্যবহার।
যাই হোক, এখানে শুধু কি আকার, রঙ ইত্যাদির উপর আমাদের আকর্ষণ বেশী সেই নিয়ে হালকা আলোচনা করলাম, কিন্তু কেন সেই আকর্ষণ সেই নিয়ে পরিপূর্ণ আরো বই এবং পেপার আছে। হ্যারি বেকউইথ লিখিত ‘আনথিঙ্কিং’ বইটির বিস্তার আরো বেশী। এই বইতে আলোচনা করা হয়েছে আমরা যখন কিছু কিনি, সেই কেনার পিছনে আমাদের অজান্তেই কি ফোর্স কাজ করে, আমাদের অবচেতন পক্ষপাত কিভাবে আমাদের সিদ্ধান্ত-কে প্রভাবিত করে – এবং সবথেকে বড় কথা আমাদের সেই দূর্বলতা ব্যবহার করে কিভাবে মার্কেটিং স্ট্রাটেজি তৈরী করা হয়। আমরা ভেবে নিচ্ছি এটা তো আমার একারই সিদ্ধান্ত, এর মধ্যে কারো প্রভাব নেই – আমরা জানিও না খুব সূক্ষ্ম ভাবে কিভাবে আমাদের সেই সিদ্ধান্ত নেবার কিনারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল কেউ/কারা যাদের অস্তিত্ত্ব সম্পর্কে আমরা সর্বদা অবগতও থাকি না।
অ্যাডভার্টাইজমেন্ট জগতে পাঁচটা প্রধান ব্যাপার – কনসিভ, ডিজাইনিং, পজিশনিং, নেমিং এবং প্যাকেজিং – এগুলো নিয়ে নিয়ত গবেষণা চলেছে। আপনি এবং আমি সেই গবেষণায় নিয়মিত তথ্যের যোগান দিচ্ছে। কিভাবে? ফেসবুক সহ যা কিছু ফ্রী ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ ব্যবহার করে!
হ্যারি বেকউইথ এর ‘আনথিঙ্কিং’ বইটি প্রায় তিনশো পাতার। একবার শুরু করলে শেষ করতেই হবে এমন ইন্টারেষ্টিং।
বইয়ের নামঃ Unthinking – The Surprising Forces Behind What We Buy
লেখকঃ Harry Beckwith
প্রকশকঃ Business Plus, New York, 2011
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।