বাংলার ইতিহাস যখন যতখানি পড়ার সুযোগ হয়েছে তখনই নানা জায়গায় দেখছি কয়েক লাইনে একটা ঘটনা লেখা, পাল রাজাদের বিরুদ্ধে সামন্ত বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের ফলে বরেন্দ্রভূমি স্বাধীন হয়। খুব বেশি জানার সুযোগ হয়নি কখনই। আমি মনে করতাম এইটা একটা ছোটখাটো ঘটনা, ইতিহাসে এর তাৎপর্য আমার বুঝে আসে নাই কখনই। শেরপুরেকেও টিপু শাহ ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে স্বাধীন রাখছিল, কিন্তু আমাদের কাছে এইটা বিরাট মনে হলেও ইতিহাসের পাতায় খুব বড় কিছু না। আমি স্বাধীন বরেন্দ্রভূমি বলতেও তেমন কিছু অনুমান করে ছিলাম। সেই ভুল ভাঙল এবার।
বাংলায় পাল রাজারা দীর্ঘদিন শাসন করেছেন। শশাঙ্ক পালের মাধ্যমে যে পাল বংশের শুরু ( আনুমানিক ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১৬১ খ্রিস্টাব্দ) সেই পাল বংশের শেষ দিকে এসে উত্তর বঙ্গের খেটে খাওয়া কৃষক শ্রেণীর এক বিদ্রোহে তারা ক্ষমতা হারান। গৌড়ে প্রতিষ্ঠা পায় কৈবর্ত শাসন! এইটা এক অভূতপূর্ব ঘটনা। এইটা বাংলার বুকে প্রথম শোষিত শ্রেণীর উত্থানের গল্প। দিব্বোক নামের এক কৈবর্ত রাজার নেতৃত্বে গৌড়ের মত রাজধানীতে কৈবর্ত শাসন শুরু হয়। কৈবর্তরা মূলত কৃষক শ্রেণী ছিল। জেলের কাজও করত তারা। পালদের কাছে বা আশেপাশের রাজ্যের মানুষদের কাছে তারা ছিল বর্বর। কৈবর্তের জীবন যাপন অনেকটাই বর্বরের মতোই ছিল, এটা সত্য। কিন্তু তা আমরা পরিমাপ করছি কোন মানদণ্ড দিয়ে?
সত্যেন সেন এই বিদ্রোহ নিয়ে লিখেছেন অসাধারণ এক উপন্যাস বিদ্রোহী কৈবর্ত। আমার জ্ঞান চক্ষু উন্মোচিত হয়েছে এই উপন্যাস পড়েই। ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস তো অনেকেই পড়ছি, আমি এইটাও তেমন কিছুই আশা করে বই নিয়ে যখন বসলাম তখন একটা ঝাটকা খেলাম। সত্যেন সেনের লেখার সাথে পরিচিত ছিলাম। লেখার ভঙ্গি আমার পরিচিত। কিন্তু এখানে যেন সব অন্য রকম। এক টানে আমাকে নিয়ে চলে গেলেন তৎকালীন গৌড় জনপথে! কৈবর্ত প্রধান দিব্বোক যে সেই সময় এবং অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় অসাধারণ চরিত্রের নেতা ছিলেন তা যেন দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে। ক্ষমতা নিয়েই কৈবর্ত রাজা দিব্বোক ঘোষণা দেন এতদিন রাজা কর নিত ফসলের ছয় ভাগের এক ভাগ, এবার থেকে নিবে আট ভাগের এক ভাগ! এইটা ওই সময়ের হিসেবে বিপ্লবী চিন্তা ভাবনা, কৈবর্তরা তাদের দেবতা ওলান ঠাকুরের উদ্দেশ্যে নরবলি দিত, সবার অমতে দিব্বোক প্রথম বছরেই নরবলি বন্ধ ঘোষণা করেন। ধর্ম বড় নেশা, এই নেশায় মাতালরা এইটা মেনে নিতে রাজি ছিল না। দিব্বোক প্রথম বছরে পারে নাই কিন্তু পরবর্তীতে দিব্বোক এত জনপ্রিয় হয় যে জনগণ দিব্বোককে খুশি করতে নিজেরাই নরবলি বন্ধ করে দেয়।
দিব্বোক যে তীরের বিষে মৃত্যুর মুখোমুখি সেই তীর যে মেরেছিল সে এসে মাফ চাচ্ছে, বলছে ভুল করেছি! দিব্বোক তাঁর চরিত্রের অসাধারণত্ব ফুটিয়ে তুললেন, সত্যেন সেন অপূর্ব দক্ষতায় আঁকলেন সেই দৃশ্য, দিব্বোক বলছেন -
"আকান তুমি আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী, তাই না?
হ্যাঁ, উত্তর দিল আকান।
তবে তার পরিবর্তে আমি তোমার জীবন চাই। আমার জীবন দিতে আমি প্রস্তুত আছি।
বেশ ভাল কথা তোমার জীবন নিয়ে নিলাম আমি। তোমার জীবন এখন থেকে তোমার নয় আমার। আমার আদেশ রইল, এই জীবন তুমি দেশের কাজে বিলিয়ে দিবে।... প্রতিজ্ঞা কর, আমার এই কথা তুমি রাখবে!"
আহা! কী অসাধারণ, দেবতা যেন!
দিব্বোকের শাসন এত চমৎকার ছিল যে আশেপাশের ছোটখাটো অনেক রাজ্যই স্বেচ্ছায় চলে আসছিল কৈবর্ত শাসনের ছায়াতলে। উপন্যাস শেষ হয় এখানেই। কিন্তু ইতিহাস থেমে থাকে না। দিব্বোকের পরে দিব্বোকের ভাই রুদোক শাসন করেন গৌড়, এরপরে রুদোকের ছেলে ভীম করেন শাসন। এরপরে পাল রাজারা আবার গৌড় শাসন ফিরে পান। কিন্তু যদি কৈবর্ত শাসন টিকে থাকত তাহলে কত চমৎকারই না হত! সেদিন যদি কৈবর্তরা পরাজিত না হত তাহলে এই অঞ্চলের চেহারা অন্য রকম হত। শিল্প সংস্কৃতি সবকিছুর একটি একান্ত দেশজ রূপ দেখা যেত, যে দেশজ রুপ ক্রমেই ব্যাপ্তভাবে বিকাশ হত, তা হত বাংলার মাটি থেকে জাত। কৈবর্তদের পতনের পরে তাদের সবই নষ্ট হল। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রোমিলা থাপর উল্লেখ করেছেন, কৈবর্তরা একসময় ক্ষত্রিয় বলে বিবেচিত হত, কিন্তু পালদের হাতে পতনের পরে কৈবর্তরা, যারা কৃষিজীবী সমাজভুক্ত ছিল, তারা সৎশূদ্র বলে গন্য হওয়া শুরু করল।
সত্যেন সেন শুধুই ইতিহাসের পথে না হেঁটে কৈবর্ত জীবনের ভিতরে ঢুকেছেন। উপন্যাসিক হিসেবে নিজের যে মার্ক্সবাদ আদর্শ সেখান থেকে দেখেছেন জীবনের গল্প। কৈবর্ত বিদ্রোহ যে শ্রেণী বিদ্রোহ, বাংলার প্রথম শ্রেণী বিদ্রোহ তা তিনি সুনিপুণ ভাবে তুলে আনছেন। তার লেখার স্টাইল দারুণ ভাবেই তা প্রমাণ করেছে। দেশপ্রেমের গল্প, মানবতার গল্প যুদ্ধ, শাসক শোষিতের যুদ্ধের গল্প উপন্যাস জুড়েই আছে আর আছে যা আগেই বললাম, দিব্বোক নামের অসাধারণ এক জীবন্ত ঐতিহাসিক চরিত্রের অসাধারণ বর্ণনা। ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস তাই খুব বেশি কিছু বলা বইয়ের রসের জন্য ঝুঁকি পূর্ণ। পড়ার আমন্ত্রণ রইল।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।