ইদ উপলক্ষে সবাই আমাদের শহরে ফিরে এসেছিল। নতুন বাংলাদেশে নতুন ইদ! সবার সাথে দেখা হওয়া, এক সাথে দেখা হওয়া হচ্ছিল না। বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন, সবার অবস্থা, সবার চিন্তা ভাবনা জানার সুযোগ হল এই সুযোগে। যথারীতি এই মিছিলে সবাই আছে, পাঁড় ইউনুস ভক্ত আছে, বিএনপি আছে, আওয়ামীলীগ আছে, মুক্তিযুদ্ধ আছে। জাশি আছি, কিন্তু তাদের থেকে দূরেই থাকি এখন। বিশ্বাস করতে পারি না।
ইদের আগেরদিন আমার পরিচিত একজন ঘোষণা দিল সে এবার ইদের নামাজ পড়বে না। আমি একটু হোঁচট খেলাম। কেন? ধর্ম কর্ম সম্পর্কে উদাসীন হচ্ছি আমি, ওর আবার কী হল? আমি একটা প্রশ্নও করি নাই। বুঝতে চাইলাম ওর মনোভাব। বুঝলাম এইটা অন্য কেস! সে মনে করছে এই সময়ে ইদের নামাজ পড়তে যাওয়া উচিত না। দেশ এখন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, এখন ইদের নামাজ ফরজ না! হইছে না কাম? ওর সাথে তর্কে গেলাম না, শুধু চিন্তা করলাম মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তো মানুষ ইদের নামাজ পড়ছে, তাহলে এখন সমস্যা কী? ওকে বলে লাভ নাই। এইটা হচ্ছে ওর বিশ্বাস। আর হচ্ছে শেখ হাসিনা, আওয়ামীলীগের প্রতি অন্ধ প্রেম। এরাই সবচেয়ে বিপদে আছে। বুঝতেছে না আপাতত আওয়ামীলীগের রাজনীতি স্থগিত। জীবদ্দশায় আবার আওয়ামীলীগের উত্থান দেখতে পারবে এমন সম্ভবনা কম। সত্যরে সহজে নিতে পারছে না। এই হার্ডকোর সমর্থকেরা সামনে আরও হতাশ হবে, আর স্বপ্ন দেখবে আবার আসবে সুদিন।
এই যে পরিস্থিতি, এর অবস্থা আরও খারাপ হবে। কারণ দেশের অবস্থা খারাপ হতে থাকবে। তাই আরও বেশি খারাপ লাগবে। পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক সরকারের কিন্তু তাতে ভ্রুক্ষেপ নাই। সরকারের সমস্ত যন্ত্র একটা কাজই করে যাচ্ছে তা হচ্ছে ইউনুস পীরকে পাঁচ বছর চাই এইটা জোরেশোরে প্রচার করে যাওয়া! কিসের নির্বাচন কিসের কী? পাঁচ বছর চাই! হুট করেই এক যোগে এই প্রচার শুরু হয়েছে, অনলাইন অফালাইলে। কী মধু ইউনুসে? ইনফ্লেশন বাড়তেই আছে, বাড়তেই আছে। জানুয়ারি থেকে মার্চের একটা হিসাব দেখলাম, নামার কোন ইঙ্গিত নাই, বাড়ছেই শুধু। কিন্তু সরকারের কথা হচ্ছে সব দুর্দান্ত চলছে। এমন আর দেখে নাই মানুষ!
রোজায় রেকর্ড তিন বিলিয়ন রেমিটেন্স আসছে। এইটা একটা ভালো খবর। এর সাথে সরকারের কোন সম্পর্ক আছে কি না আমার জানা নাই। সরকার এমন কোন নতুন কাজ করে নাই যে এই রেমিটেন্সের কৃতিত্ব সরকার নিবে। গত বছর থেকেই বাড়তির দিকে ছিল। এবার রেকর্ড পরিমাণ আসছে। এইটা যদি মনে করা হয় সরকারের প্রতি আস্থার কারণে মানুষ বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠিয়েছে তাই এত পরিমাণ আসছে, তাহলে সরকারকে কৃতিত্ব দেওয়া যায়, এইটা সরকারের প্রাপ্য। কিন্তু তিন বিলয়নেই তো শেষ না। আমাদের রিজার্ভ ছিল রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন। বিশ্ব ব্যাংক নানা তত্ত্ব দিয়ে বলছিল যে অত হবে না, ঋণ আছে, ওগুলা বাদ দিতে হবে। দিলে পরেও তো চল্লিশের মত ছিল রিজার্ভ। করোনা, ইউক্রেন যুদ্ধ ইত্যাদি কারণে নামা শুরু হয় এই রিজার্ভ। ইউনুসের তো ওই পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে বা ওইদিকে যাচ্ছে এমন একটা কর্ম পরিকল্পনা দেখাইতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ নাই বললেই, চলে, গার্মেন্টস বন্ধ হাজারের ওপরে, আমেরিকা দিয়েছে বিশাল শুল্ক চাপিয়ে। আর আমরা যদি এর বিপরীতে বলি রেকর্ড রেমিটেন্স এসেছে, আলহামদুল্লিলাহ তাইলে বিপদ না?
বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান করছে এক ছেলেকে। কই থেকে জানি এনে বসায় দিছে। নানা সময় বাড়তি কথা বলে। ওর যে কাজ সেই কাজের খোঁজ নাই, আউল ফাউল যত কথা। এই মহা জ্ঞানী বলছে আমেরিকার বাড়তি শুল্ক কোন সমস্যা না, এইটা ভালোই হয়েছে! এখন অর্থনীতি আর সহজ জিনিস না, অত জটিল কথা তো আমরা বুঝি না। যতখানি ঘিলু আছে মাথায় তাতে এইটা বুঝি যে বাড়তি শুল্ক কখনই ভালো হতে পারে না। কিন্তু আমার কথায় কাজ হবে? মানুষ হুমড়ি খেয়ে তার কথাই শুনছি, বাহ বাহ করে যাচ্ছে। এই ছেলে বিনিয়োগ সম্মেলনে একটা প্রেজেন্টেশন দিছে বিনিয়োগকারীদের সামনে। ইউনুস ভক্ত সকলে সমস্বরে সারাদিন ধরে এমন দেখি নাই, এমন স্মার্ট কাওকে দেখি নাই, ব্লা ব্লা ব্লা বলে যেতেই আছে। কাজের কাজ কী হইছে? ২০২৩ থেকে কথা হচ্ছে ব্রিকসের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বাংলাদেশে লোন দিবে। ২০২৪ এর জানুয়ারীতেও ডেইলী স্টারে এ নিয়ে রিপোর্টও হইছে। এইটার পুরো অবদান শেখ হাসিনার। ব্রিক্স নিয়া তার অবস্থানের কারণেই এই পর্যায় পর্যন্ত আসা গেছিল। আর ব্যাংক কি বিনিয়োগ করে? ব্যাংক দিলে দিবে লোণ, কিন্তু একশ কোটি টাকা বিনিয়োগ এনে ফেলছে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে সকাল থেকে। একদল একনিষ্ঠ তেলবাজ পাইছে নোবেল ম্যান! এই তেলবাজেরা যখন যা পায় তাই মারহাবা মারহাবা বলে প্রচার শুরু করে। কিশোর উপদেষ্টা আসিফের ফেসবুক পেজ থেকে আট মাসেই বাংলাদেশ ১২৩ নাম্বার শক্তিশালী দেশ থেকে ৪৭ তম হয়ে গেছে! ইউএসের এক জরিপে এইটা পাওয়া গেছে। ব্যাস, আর কিছু দেখার নাই। সবাই মিলে শুরু করে দিল। দেখছ ইউনুস ম্যাজিক! দেখলাম ম্যাজিক, কী সেই ম্যাজিক? এই প্রতিবেদন গত বছরের! এই বছরের জরিপ এখনও প্রকাশই করেনি। আর যেটা বলছে ওইটাও সত্য না, পাওয়ার আর ইকোনমির র্যাংক এক করে দেখাচ্ছে ছাগলেরা। ভাই, ম্যাজিক তো আমরা দেখার জন্যই বসে আছি, ভাঁওতাবাজি করেন কেন? দেখান কিছু, আমরা মুগ্ধ হই! শুধু এইটা, এমন আরও অজস্র নমুনা আছে তাদের মিথ্যাচারের। চিন নদীর দুইপারে বাধ দিবে, ওইটাকে প্রচার করছে এই যে বাধের বিপরীতে বাধ বানানো শুরু হচ্ছে! এবার আর রক্ষা নাই। আরে ছাগল, বাধের নিচে বাধ দিয়া কোনদিন কোন দেশ বন্যা এড়াইতে পারছে? ওই যে ঐতিহাসিক আইকিউ! যাবে কই?
এখন পর্যন্ত, এই আট মাসে যা করেছে তা সব বিগত সরকারের অবদান। চিনের সাথে যে চুক্তি ফুক্তি করে আসল এগুলার ফাইল পর্যায়ের কাজ আগের সরকারি করে গেছে। ঢাকায় বিনিয়োগ সম্মেলন হচ্ছে। কই কই থেকে জানি বিনিয়োগকারীদের ধরে আনছে। যে যে প্রজেক্ট দেখাচ্ছে সবই আগের সরকারের করা। চট্টগ্রামে যে ইপিজেড দেখানো হয়েছে তা আগে তৈরিই করা হয়েছিল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য। এই সরকার ক্ষমতায় বসেই কর্ণফুলী টানেল নিয়ে নানা বক্তব্য দিয়ে ছিল। ওইটা না কি শুধু শুধু বানানো হইছে। টাকা নষ্ট। যে টাকা টানেলের পিছনে খরচ হয় সেই টাকা উঠে না টোল থেকে। অথচ এই টানেলটা বানানোই হয়েছিল ওই পাশে যে শিল্প অঞ্চল তৈরি করা হবে, বিদেশি যে বিনিয়োগকারীরা আসবে তাদের জন্য। তাদেরকে সহজ রাস্তায় প্রজেক্ট পর্যন্ত যাওয়ার জন্য। সবাই ইচ্ছা মত গালি দিল। এখন ওই প্রজেক্ট দেখানো হচ্ছে।
আট মাস অল্প সময়, জানি আমি। তো তাই বলেন। শুধু শুধু কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টা করছে কেন? অভিজ্ঞতা নাই সে নিজেই বলছে কয়েকটা সাক্ষাৎকারে। যার অভিজ্ঞতা নাই সে কেন মাখাবে? সে যতটুকু না করলেই না অতটুকু করে কোনমতে শেষ করবে দায়িত্ব। না, তিনি নিজেই বলছেন অভিজ্ঞতা নাই, ফেইল মারলে কিছু করার নাই। আবার নানান জায়গায় হাত দিয়ে সর্বনাশের চূড়ান্ত করে ছাড়ছে। তার হাত দিতে হয় আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিতে, তার মাথা ঢুকাতে হয় সংবিধানে। এদিকে প্রধান যে কাজ, আইন শৃঙ্খলা তাতে দুইটা বড় বড় গোল্লা মেরে বসে আছে!
আমি স্বীকার করি আর না করি, দেশে এখন বেশ বড় একটা অংশ ইউনুসপ্রেমে অন্ধ হয়ে রয়েছে। অশ্বডিম্ব প্রসব করলেও বাহ বাহ করে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। তাদের তারিফের চোটে আমাদেরকেই দ্বিধায় পড়তে হয় যে আসলে কী হচ্ছে? একটু ঘাটাঘাটি করলে দেখি যথারীতি গোল্লা! এদিকে খারাপ সংবাদের শেষ নাই। এইটা যখন লিখছি তখন ভারতের স্থল বন্দর ব্যবহার করে যে পণ্য রপ্তানি করত বাংলাদেশ সেই সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। কেন এমন হল? ইউনুস সাহেব থাইল্যান্ডে মোদীর সাথে দেখা করলেন, কী হল যে এমন একটা সুবিধা বন্ধ হয়ে গেল? এর উত্তর দিবে না কেউ কিন্তু যা বলবে তা হচ্ছে এইসবে কোন সমস্যা হবে না আমাদের! আমাদের কোন সময়েই সমস্যা হয় না, এদিকে সব ফুতুর হয়ে যাচ্ছে। কারখানা বন্ধ, কাজের তীব্র অভাব। যার ফল সরাসরি পড়ছে আইন শৃঙ্খলার ওপরে।
বয়কটের ধুম লাগছিল কিছুদিন আগে, আমি বয়কটের যে অন্য অর্থ আছে তা নিয়ে লিখছিলাম। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছিল আমি ইজরাইলকেই সমর্থন দিচ্ছি কি না তা নিয়ে। আমি বলছি বাংলাদেশে বয়কটের আলাদা অর্থ আছে। এখানে এর সাথে রাজনীতি জড়িত। ভারত বয়কট, কোক বয়কট, ফ্রান্স বয়কট এইসব ছিল সেই রাজনীতির অংশ। আমার মতামত কোন তথ্য প্রমাণ না। তাই কেউ অস্বীকার করতে পারে, করেছেও। এখন আসুন প্রমাণে। সরকার পতন হয়েছে, আওয়ামীলীগ সরকার নাই। এখন আর বয়কট নাই। রাজপথে মিছিল নাই, ফ্রান্স এখন ভালো! পাঠ্য বইয়ে শরীফ শরীফা নিয়ে তুলকালাম করে ফেলেছিল যে মহাজন সে এখন শীত নিদ্রায়, এদিকে সমকামী লোকজন নতুন দলের ভিতরে বসে আছে। কেউ টান মেরে বইয়ের পাতাও ছিঁড়ে না। সমকামী নিয়ে আমার তো সমস্যা নাই। যারা এতদিন এইটাকে ইস্যু বানিয়ে যা না তা বলে গেল তারা এখন চুপ, এইটাই শুধু বলার আছে আমার।
গাজায় এখন ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চলছে। দুই একজন আবেগে কোক বয়কটের নাম মুখে নিচ্ছে কিন্তু তা আবেগেই, আগের সেই ক্যাম্পেইন চোখে পড়ে নাই আমার। কারণ এগুলার কোনটার লক্ষ্যই যা দেখানো হয়েছে তা ছিল না, দেখার দাঁত আর খাওয়ার দাঁত সব সময়ই আলাদা ছিল। বয়কটের থেকে প্রকট কাণ্ড হয়ে গেল দেশে। এইটা কেন হল? কোক বয়কটের জন্য? না, তার জন্য না।
ইজরাইল বিরোধী বিক্ষোভ দুনিয়া জুড়েই চলছে। বাংলাদেশের মুসলমানরা ইজরাইল বিরোধী আন্দোলনে নামে নাই, তারা শুরু করেছে মুসলমান বাদে সবার বিরুদ্ধে আন্দোলন। যে আমেরিকায় বিশাল মিছিল হচ্ছে গণহত্যার প্রতিবাদে সেই জনগণকেও এরা অভিশাপ দিচ্ছে। ইউরোপও হচ্ছে প্রতিবাদ কিন্তু আমাদের চোখে সব সমান। ফলাফল? বাটা, কেএফসি, পুমা, ডোমিনোজ পিৎজাসহ আরও বেশ কিছু দোকান ভাংচুর, লুটপাট! এমন প্রতিবাদ আর কোথাও কোনদিন কেউ দেখছে কি না সন্দেহ আছে আমার। পুলিশের মহাপরিদর্শক ডয়েচে ভেলকে জানিয়েছে পুলিশের কিছুই করার ছিল না। হাজার হাজার মানুষ যখন নামে এই সব কাজে তখন তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কী করার আছে? নির্লজ্জের মত গাজার গণহত্যার প্রতিবাদে চুরি করে গেল মানুষ, আমরা সেই জাতির অংশ হিসেবে এখন কোথায় মুখ লুকাব বলেন?
কেন এমন হল? কারণ এই দুর্দান্ত সরকার এতদিনে এইটা হতে দিয়ে আসছে। এখন আশ্চর্য হওয়ার ভান করলে তো চলবে না। একই বৃত্তে আবার ঘুরপাক খাচ্ছে সবাই। প্রতিবাদের নামে লুটপাট হল দেখে অবাক হচ্ছে! আরে কী আশা করেন সবাই? সরকার থেকে শুরু করে সমস্ত আবালেরা মনে করে লুটেরারা শুধু তাদের মন পছন্দ জায়গায় লুটপাট করবে? দিনের পর দিন, মাসের পরে মাস চলে গেছে একটা শব্দ করেন নাই এই লুটেরাদের বিরুদ্ধে। প্রশ্রয় দিছেন, আশ্রয় দিছেন, জেল থেকে মুক্তি দিছেন দাগি আসামিদের। আর আশা করছেন সব স্বাভাবিক ভাবে চলবে? দেশে এত এত আন্দোলন হয়েছে, ইতিহাস হয়ে রয়েছে এমন আন্দোলন হয়েছে, এমন লুটপাট কয়বার কয় জায়গায় হয়েছে? যে বিদ্যা শিখছে এইটা এখন ভুলে যাবে? প্রয়োগ করার জন্য চেষ্টা করবে না? এখন যখন দেশ চালাতে গিয়ে দেখছেন এই জিনিস চালাতে শান্তি দরকার, এই জিনিস চালাতে সুস্থ পরিবেশ দরকার, রাষ্ট্র চালাতে বিদেশি বিনিয়োগ দরকার, প্রতিবেশী দরকার তখন আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছেন এই সময় এরা কেন এমন লুটপাট করল? রাষ্ট্র চালাতে, এই ছাগলদের চালাতে কী কী করতে হয় এখন একটু ঘিলুতে ঢুকছে?
আশা হচ্ছে মব বাহিনী সরকারের মন মত মব করবে! ভালো মব খারাপ মবের একটা তালিকা দিয়ে দিলেই হয়। এই এই মব আমরা সহ্য করব, সমর্থন দিব, লাগলে সেনাবাহিনী দাঁড়িয়ে থেকে মব সুষ্ঠ অনুষ্ঠিত হতে সাহায্য করব, আর এই এই মব আমরা সহ্য করব না, মবের পরে তীব্র প্রতিবাদ জানাব। এখন মবমারানিরা বুঝলে হয়, যে না আমার আইকিউ! সারা দুনিয়ায় প্রতিবাদ হচ্ছে, আমরা সবাইকে দেখিয়ে দিলাম আমাদের চরিত্র। এতদিনেও যাদের সন্দেহ যায় নাই আমাদের চরিত্র নিয়ে, আশা করছি এবার আর কেউ দ্বিধা করবে না আমাদের গালি দিতে। গাজা থেকে চিৎকার করে বলবে, ভাই তোরা এক কাজ কর, তোরা কোন কাজ করিস না আমাদের জন্য। না করলেই বরং আল্লার রহমত আসার সম্ভবনা বেশি। না হলে যে নিরপরাধ দোকান গুলো লুট হল তাদের আহাজারির আঁচ আমাদের গায়েও লাগতে পারে! আমরা এমনেই ক্লান্ত, এই পাপের বোঝা আর নিতে পারব না!
এখানেই শেষ না, আরও আজব মানুষ বাস করে এই দেশে। গাজায় ঘটে যাওয়া হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ করতে গিয়ে কেউ কেউ চোখ রাখছে হিন্দুরা কী করছে তার ওপরে! একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আরেকটা অন্যায় উস্কে দেওয়ার পায়তারা। হিন্দুরা না কি কেউ প্রতিবাদ করছে না? এক ঢিলে দুই পাখি! প্রতিবাদ জানানোও হল আবার একটু হিন্দুদেরকে ভড়কে দেওয়াও গেল, ডাবল পয়েন্ট কামাই! তরতর করে বেহেশত! আর কী চাই?
এদের নিয়ে কতদূর যাব আমরা? হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করে এমনেই? আজকে থেকে আরও দশ বছর আগে, হোলি আর্টিজেনের ঘটনা ঘটারও আগে আমি আমার এক ছোটভাইকে কথা প্রসঙ্গে বলছিলাম বাংলাদেশের সামনে একটা সমস্যা বাদে আর কোন সমস্যা নাই। অর্থনীতি না, রাজনীতি না, বিপদ একটাই, তা হচ্ছে জঙ্গিবাদ! তখন দানা বাধা শুরু করেছিল নানা দিক থেকে। ঠিক কী কী মাথায় নিয়ে বলেছিলাম তা মানে নাই আজ। কিন্তু আমি জানতাম এইটাই বড় বিপদ আমাদের। আল্লার কী কাম, এরপরেই জঙ্গিবাদের চরম বহিঃপ্রকাশ দেখলাম আমরা। এবং এখন বুঝতেছি যে জঙ্গিদের উত্থান শেষ হয় নাই তখন, আরও গুছিয়ে, আরও শক্তি সঞ্চয় করে, আটঘাট বেঁধে নেমেছে তারা। আর আমরা যারা ঢাল ছাড়া নিধিরাম সরকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছি এই শক্তিকে প্রতিহত করতে তারা এখন পর্যন্ত জানিই না শক্তিটা কতটা শক্তিশালী, এর চেহারা কত ভয়ংকর, কতটা বিধ্বংসী। আমরা হাবলার মত চিৎকার করেই যাচ্ছি, করেই যাচ্ছি, এদিকে তারা এখন ক্ষমতায় বসে কয় ১৬ বছর ধর্ম পালন করতে দেয় নাই ফ্যাসিস্ট সরকার!
বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করার যন্ত্রণা আছে। আপনি যাকে একদম পছন্দ করেন না, যার কথা মানেই প্রলাপ, তার সেই প্রলাপ বকার স্বাধীনতাই বাক স্বাধীনতা। আপনি যা পছন্দ করেন তা বলবে আর আপনি বলবেন আমি তো কথা বলতে দিচ্ছিই, কাওকে তো বাধা দেই নাই, এইটা বাক স্বাধীনতা না। এই সব কিছু যন্ত্রণা আছে সুনাগরিকের, আপনি মানবিক হবেন, আপনি মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাস করবেন অথচ আপনার অপছন্দের লোকের অকারণ হেনস্থায় চুপ থেকে মজা নিবেন, এইটা হবে না। অন্যায় হলে তার প্রতিবাদ করতেই হবে তা সে আপনার পছন্দের হোক বা অপছন্দের হোক। আমি সুনাগরিক লিখছি, মানবিক লিখছি, আসলে এইটা মানুষেরই ধর্ম। এ না হলে মানুষ বলা কঠিন হবে আমার পক্ষে। এই যে শাহরিয়ার কবিরকে হত্যা মামলায় হেনস্তা করা হচ্ছে, অসুস্থ একটা লোককে রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে এইটা অন্যায় হচ্ছে। শাহরিয়ার কবির মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে পরিমাণ লেখালেখি করেছে তা অবিশ্বাস্য। এখন কি সেই দায় মিটাচ্ছে? মুক্তিযুদ্ধ এখন অপাংক্তেয় বিষয় এই দেশে। সেই সূত্রেই অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন শাহরিয়ার কবির? নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়, একাত্তরের যিশু, বাভারিয়ার রহস্যময় দূর্গসহ দুর্দান্ত সব কিশোর উপন্যাস লেখা শাহরিয়ার কবিরের কী হবে? আমরা হেরে যাচ্ছে কোথায়? কাদের কাছে?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকেও ধরা হয়েছে, হত্যা মামলায়। আসলে কোন অপরাধ? আসল অপরাধ ভদ্র মহিলা রাজাকারদের ফাঁসি নিশ্চিত করে ছিলেন। ট্রাইব্যুনালের অন্যতম আইনজীবী তিনি। তাঁকে সেই শাস্তি পেটে হবে না? মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে দেশের মেরুদণ্ডরা। আরেক পক্ষ নিচ্ছে মজা। দারুণ হইছে, খা মারা এখন, এইটাই হচ্ছে তাদের উচ্ছ্বাস।
এই যে নিজেদের ঘরনার বুদ্ধিজীবীদের হেনস্থায় চুপ করে থাকার সংস্কৃতি চালু হচ্ছে তা ভালো হচ্ছে না। অসুস্থ লোককে নির্যাতন করা হচ্ছে তা যে প্যারামিটার তৈরি করছে তা খুব ভয়ংকর একটা সংস্কৃতি তৈরি করছে। সামাল দিতে পারবেন না। মুশকিল হচ্ছে কোথায় জানেন? মুশকিল হচ্ছে আমাদের, যারা নিজেকে মানুষ মনে করি। তাই আজকে যারা চুপ করে রইলেন তারা যখন আজকের দিনের জন্য খেসারত দিবেন তখনও আমাদেরই প্রতিবাদ করতে হবে। আমরা চুপ করে থাকলে আরাম পাব কিন্তু তাতে মানুষের খাতা থেকে নাম কাটা যাবে। যেমন এখন অনেকের নাম কাটা যাচ্ছে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।