এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ক্যাম্পাসের মা এবং নজরদারি 

    Ritriban chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৮ জুলাই ২০২৫ | ১৫৫ বার পঠিত
  • মানসিক অবসাদ এবং দিশেহারা ভাব সাম্প্রতিক কালের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কখনো প্রকটভাবে, আবার কখনো বা প্রচ্ছন্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। এর দায় শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়ে, সমাজ তার পিঠ বাঁচাতে পারবেনা। বিপুল সিলেবাস, প্রতিযোগিতা, চাকরীর অভাব, গবেষণার ফেলোশিপের টাকায় সংসার টানা, অপরের উন্নতি, সরকারি চাকরিতেও সুরক্ষার অভাব, উচ্চশিক্ষার দ্বারা পি এইচ ডির পরেও চাকরিহীনতা, উপযুক্ত গবেষণাভিত্তিক পেপারের অভাব, ব্যক্তিগত জীবনে প্রেমভালোবাসা-ব্রেকাপ ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে আজকাল অনেকেই। এরফলে আত্মহত্যার ঘটনাও মাঝেমধ্যেই খবরের শিরোনামে আসে। এই বিষয়টি যে একেবারেই নতুন তাও কিন্তু নয়। তবে এইধরনের খবর মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য "ঝটপট ঝোড়ো খবর", "১০০ মিনিটে ২০০ খবর", “রাত বারোটায় রুদ্ধশ্বাস বারো" ইত্যাদি রয়েছে। কিছু নিউজ চ্যানেল এর সাংবাদিকদের রাস্তার মাঝখানে, সিগনাল এ দাঁড়িয়ে তারস্বরে চিৎকার করে খবর রিপোর্ট করতে শোনা এবং দেখা যায়। একটাই খবর বারবার কাট করে ওই একই স্বরে করতে দেখে অনেকেই হেসে ফেলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার এনারা কেউই হয়ত এমনটা চান না। কিন্তু চাকরী তাঁদের থেকে ওই উচ্চস্বর, ওই রোদ বা বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে রিপোর্ট করাটা ডিমান্ড করে। না করলে আপ্প্রেইজালে গণ্ডগোল হবে এবং অন্যের পদোন্নতি ফলাও করে দেখানো হবে। যেকোনো চাকরীতে ঢুকতে গেলেই ২-৩ বছর অভিজ্ঞতা না থাকলে নামমাত্র পারিশ্রমিক নিতে পারলে নাও নইলে অন্য চাকরী। সরকারি চাকরীর নোটিফিকেশান এই বছরে বেরোলে অন্ততপক্ষে ৮-৯ মাস কিম্বা ১-১.৫ বছর পরে পরীক্ষা। রেজাল্ট এবং নিয়োগ তো অনেক দূরের কথা। স্কুলে বা কলেজে শিশুদের বা ছাত্রছাত্রীদের ভর্তির ফি আকাশছোঁয়া। কস্টকাটিঙের নাম করে নামী প্রাইভেট কোম্পানিগুলোতে যেকোনো মুহূর্তে কর্মীছাঁটাই, অফিসের কোণঠাসা করা রাজনীতি, অর্থাৎ সামাজিক জীব হিসেবে আজকের দিনে ভারতবর্ষের অগণিত মানুষ নানা কারণে এই অবসাদের শিকার। 
    এহেন অবসাদের বাড়বাড়ন্ততে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অবসাদ দূরীকরণে নানাবিধ পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এক্ষেত্রে একেবারে অভিনব উদ্যোগ হল ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের মনের কথা জানতে মা'দের নিয়োগ। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন মহিলা কর্মচারী এবং অধ্যাপিকাদের এই বিশেষ কর্মসূচীর জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে যারা সময়ে সময়ে ছাত্রছাত্রীদের মানসিক অবস্থার খেয়াল রাখবেন। এইধরনের উদ্যোগ দুটি দিক থেকে বিপদজনকঃ 
     
    ১) এই কর্মসূচী পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচায়ক, কারণ ক্যাম্পাসের মা'দের, ছাত্রছাত্রীদের সেবায় নিযুক্ত হওয়া যেন একটি 'প্রত্যাশিত ভূমিকা' যা শুধু নারীদের থেকেই পাওয়া যেতে পারে। স্নেহমমতা ভিত্তিক কাজ নারীদেরকেই মানায় এমনটাই ইঙ্গিত করে এই উদ্যোগ। এককালে শিশুদের দায়িত্বপালনের ভার মহিলাদের কর্তব্য বলা হত এবং ফলস্বরূপ বিয়ের পর মহিলাদের চাকরীতে মোটের অপর না'ই বলা হত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিতে। ইদানীং এই বিধিনিষেধকে অনেকসময় 'আত্মত্যাগ' বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায় অহরহ। প্রসঙ্গত উল্ল্যেখ্য যে, মায়েরা যদি শিশুদের ক্রেশে রেখে কাজে অথবা পার্টিতে যান, তবে তার চরিত্রহনন থেকে দায়িত্ববোধহীনতা, নানাবিধ অভিযোগ উঠতেই থাকে। এক্ষেত্রে বলা ভালো যে শিশুলালনের সংজ্ঞা আপেক্ষিক এবং পরিবর্তনশীল। এহেন পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসের মায়েরা কি ধরনের লালনে অংশগ্রহণ করবেন সেটা যেমন একটি প্রশ্ন তেমনি তাঁরা এই ছাত্রছাত্রীদের মানসিক অবস্থার বিষয়ে কাকে রিপোর্ট করবেন বা জানাবেন সেটাও একটি চিন্তার বিষয়। এই চিন্তা থেকেই আসে নজরদারির প্রশ্ন। 

    ২) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের দায়িত্ব নেন। কিন্তু এই দায়িত্বপালন এবং নজরদারির মধ্যে যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে তা হামেশাই অতিক্রম হয়ে যায়। এর ফলস্বরূপ আসে নীতিপুলিশি। তেমনি লালন বা স্নেহের আড়ালে নজরদারি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষানবিশদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করবেন প্রতিষ্ঠানগুলো। অফিস, লাইব্রেরী, স্কুল, কলেজের ক্লাস বিভিন্ন জায়গায় সিসি ক্যামেরা, বায়োমেট্রিক ইত্যাদির দ্বারা নজরদারির জালে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে মানুষকে। কোন ছাত্র আমিষ খাবে না নিরামিষ, কে কি ধরনের পোশাক পরছেন, কোন পত্রপত্রিকায় লেখা ছাপছেন, কোন ছাত্রী রাতে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ইত্যাদি নানাবিধ খবরের নিরিখে তৈরি হয় কিছু প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মাবলী (পড়ুন বিধিনিষেধ)। এই নিয়মের অবাধ্য হলেই বিপদ অর্থাৎ শাস্তি। প্রসঙ্গত উল্ল্যেখ্য, যেসব অধ্যাপক বা অধ্যাপিকারা বিবিধ প্রতিবাদমিছিলে শামিল ছিলেন ছাত্রবয়সে তাঁরাও চাকরীর পর এই নিয়মের কাছে নতিস্বীকার করে নিয়মমাফিক হোস্টেল চেকিং করতে আসেন। হোস্টেল চেকিং আরেকধরনের খুব বিপদজনক একটি নজরদারির উদাহরণ যার ফলস্বরূপ ওয়ার্ডেনদের বিপুল ক্ষমতাধারী প্রশাসক বানিয়ে দেওয়া হয় যেই ক্ষমতাবলে তাঁরা দিন বা রাতের যেকোনো সময়ে হোস্টেলে ছাত্রছাত্রীদের রুমে ঢুকে এই ধরনের জ্ঞান আহরণ করেন যা এই প্রাতিষ্ঠানিক বিধিনিষেধকে আরও ঋদ্ধ করে। এরফলে প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত জীবন বা সময় বলে কোনটাই থাকেনা। এই সহজ সত্যগুলো সম্পর্কে অবহিত হওয়া সত্বেও নির্বাক কর্মচারীর মতো নজরদারি প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে চলেছেন এই ক্ষমতাধারীরা। এইসকল জ্ঞানের ভিত্তিতে তৈরি হয় হোস্টেলে ঢোকা এবং বেরনোর সময় নির্ধারণ, পোশাক বা খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের চেষ্টা (যাকে প্রাতিষ্ঠানিক ভাষায় 'শুধরে দেওয়া' বলে), ইত্যাদি নানান নিয়মাবলী। এই ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শুধরে দেওয়ার পদ্ধতি ঠিক কতটা অবসাদ দূর করতে পারছে তা নিয়ে তর্কের অবকাশ থাকে, তবে প্রাপ্তবয়স্কদের শিশু হিসেবে গণ্য করা এবং স্নেহমাখা লালনের আড়ালে নজরদারিকেন্দ্রিক বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেওয়া একটি টোটালিটারিয়ান সমাজব্যবস্থার সর্বগ্রাসী শাসনকেই প্রচ্ছন্নভাবে ফুটিয়ে তোলে।   

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন