ছবি: রমিত
প্রঃ অপারেশন কাগার কি এবং বাস্তবে সেটা কীভাবে কার্যকর করা হয়েছে সেটা আপনি সংক্ষেপে বর্ণনা করুন?
উঃ ২০২৩ এর ডিসেম্বরে বিজেপি ছত্তিসগড়ে ক্ষমতায় আসার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ রায়পুরে ঘোষণা করেন যে মাওবাদীদের শীঘ্রই নিকেশ করা হবে। এই সময় থেকে আমরা অপারেশন কাগার সম্পর্কে শুনতে পাই এবং সেনাদের সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। তিনি আসার পর বিদ্রোহ দমন করার অভিযান উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পায়।
প্রঃ মাওবাদীদের অবলুপ্ত করার ঘোষণার পর বাস্তবে আপনি কী কী পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন?
উঃ ২০২৪ এর জানুয়ারির পর থেকে সংঘর্ষের ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে, যার মধ্যে অধিকাংশই ভুয়ো। এই ধরণের ঘটনা এখনো চলছে। অপারেশন গ্রিন হান্টের বিপরীতে, অপারেশন কাগার-এর নির্দিষ্ট সময়সীমা আছে। ডেডলাইন হচ্ছে, মার্চ ২০২৬ এর মধ্যে মাওবাদীদের শেষ করে দেওয়া হবে। রাজ্য ও কেন্দ্র উভয় জায়গাতেই বিজেপি সরকার হওয়াতে বর্তমানে আক্রমণের তীব্রতা অনেক বেশি।
প্রঃ কোন অঞ্চল এবং কোন সম্প্রদায় এই অপারেশনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে?
উঃ মাওবাদীদের ঘাঁটি দক্ষিণ বস্তারের অবিভক্ত দান্তেওয়াড়া, যার মধ্যে বর্তমানের বিজাপুর, দান্তেওয়াড়া, সুকমা জেলা অন্তর্ভুক্ত, নারায়ণপুরের অবুঝমাড় অঞ্চল এবং উত্তরের কাঁকের জেলায় সবচেয়ে তীব্র দমনপীড়ন হয়েছে। এইসব অঞ্চলে প্রধান যে আদিবাসী সম্প্রদায় বাস করেন তাঁরা হলেন গোন্ড। যদিও তেলেঙ্গানা, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র প্রভাবিত হয়েছে, অপারেশনের মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে বস্তার এবং ঝাড়খন্ড।
প্রঃ রাষ্ট্র কী ভাবে অপারেশন কাগার-কে ন্যায্য মনে করছে এবং সেটা বাস্তবে আপনি যা প্রত্যক্ষ করছেন তার সাথে কীভাবে তুলনীয়?
উঃ রাষ্ট্র দাবী করছে মাওবাদীরা উন্নয়ন বিরোধী এবং তাঁরা কাজে বাধা দিচ্ছে বিশেষ করে যেখানে খনন কার্য চলছে। এঁদেরকে সন্তাসবাদী হিসাবে প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। এঁদের একটা রাজনৈতিক কর্মসূচি আছে যাতে গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা এবং কর্পোরেট শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কথা আছে, এর বিন্দুমাত্র উল্লেখ আপনি সরকারি আখ্যানে পাবেন না।
প্রঃ অপারেশন কাগার বস্তারের আদিবাসীদের দৈনন্দিন জীবনের ওপর কী প্রভাব ফেলেছে?
উঃ যে আদিবাসীরা সংঘর্ষ এলাকায় বসবাস করেন তাঁদের জীবন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে তাঁরা কোথাও নিরাপদ নন। মাওবাদীদের সাথে সম্পর্ক আছে শুধুমাত্র এই সন্দেহের ভিত্তিতে তাঁদের যখন তখন গ্রেপ্তার করা হতে পারে, ইউএপিএ এর মতো দানবীয় আইনের অধীনে ভুয়ো অভিযোগে কারাবন্দী করা হতে পারে, দিনের পর দিন পুলিশি হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে, এমনকি বলপ্রয়োগ করে তাঁকে ‘আত্মসমর্পণ’ করতে বাধ্য করা হতে পারে। অনেক আদিবাসী বনে মহুয়া এবং অন্যান্য ফলমূল সংগ্রহ করতে গিয়ে ভুয়ো সংঘর্ষে মারা গেছেন। ১০ই মে, ২০২৪ বিজাপুর জেলায় পিড়িয়া এবং ইতাভার গ্রামে ঘরের কাছে তেন্দু পাতা কুড়ানর সময় দশজনকে গুলি করে মারা হয় এবং আরও ছয়জন গুলিবিদ্ধ হন। পুলিশের মতে এরা সব মাওবাদী যারা সংঘর্ষে মারা গেছে কিন্তু গ্রামবাসীরা বলছেন সেদিন কোনও সংঘর্ষই হয়নি। আহত ছয়জনের মধ্যে এক চোদ্দ পনেরো বছরের কিশোর ছিল যার একাধিক গুলির ক্ষত ছিল। আমি যখন গ্রামে যাই সে একটা খাটে শুয়ে ছিল। পরিবারের সদস্যরা তাকে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছিল, তাঁদের আশঙ্কা পুলিশ তাকে মাওবাদী বলে গ্রেপ্তার করে নিতে পারে। অপারেশন শুরু হওয়ার পর থেকে এরকম শতাধিক ব্যক্তিকে ভুয়ো সংঘর্ষে খুন করা হয়েছে।
নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের নিয়ে সংগঠিত সঙ্গম, যেগুলি হল মাওবাদীদের সাথে সংযোগ স্থাপনকারী গ্রাম কমিটি, তাঁরা বিদ্রোহীরা যখন এলাকায় আসেন তাঁদের খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করে সাহায্য করেন। এই কাজও এখন অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয় এবং অনেককে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়।
মৃত্যু, গ্রেপ্তার নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা, এছাড়া হেনস্থা, নজরদারি তো আকছার হচ্ছে। বস্তারে চারশোর অধিক নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প আছে। গভীর অঞ্চলে প্রতি তিন চার কিলোমিটার পর ক্যাম্প। প্রত্যেককে রাস্তায় আটকান হয় এবং জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বহু ক্ষেত্রে মোবাইল বাজেয়াপ্ত করা হয় কিন্তু কোনও রিসিট দেওয়া হয় না; মোবাইলের দামের ব্যাপারটা তো আছেই এছাড়াও ভয় হচ্ছে ভুয়ো নথি সেখানে প্রতিস্থাপন করে সেই ব্যক্তিকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হতে পারে।
প্রঃ সাধারণ মানুষ কি অপারেশন কাগার এবং মাওবাদীরা যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে প্রস্তুত সেটা জানে?
উঃ কিছু লোক যাঁরা খবরাখবর রাখেন তাঁরা জানেন, বাকিরা তো গ্রেপ্তারি, আত্মসমর্পণ, দমনপীড়ন এসবের থেকে যে কোনও ভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। ২০২৪ এর অক্টোবরে মূলবাসী বাঁচাও মঞ্চ নিষিদ্ধ হওয়ার পর প্রকাশ্যে প্রতিবাদ তো বন্ধই হয়ে গেছে। সারপঞ্চ এবং স্থানীয় নেতারা যাঁরা এর আগে প্রয়োজনের তাগিদে সরকার ও মাওবাদীদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন, এখন উভয় পক্ষই তাঁদের সন্দেহ করে।
প্রঃ পেসা (PESA) যা পঞ্চম তফসিল এলাকায় আদিবাসীদের স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার অঙ্গীকার, সেটা কি মানা হয়?
উঃ বস্তারের সাতটি জেলা সংবিধানের পঞ্চম তফসিল অনুযায়ী তফসিল এলাকা হিসাবে চিহ্নিত হলেও আদিবাসীদের জন্য যে সব রক্ষাকবচ নির্ধারিত করা হয়েছিল তার কোনটাই কার্যকর করা যায়নি। পেসা প্রণয়ন হয় ১৯৯৬ সালে কিন্তু তার নিয়মাবলী গঠিত হয় ২০২২ সালে, যার ফলে প্রায় দুই দশক ধরে সেটা নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে। এটা আদিবাসীদের বিরাট ক্ষতি করেছে কারণ মাঝের সময়ে সরকার, গ্রাম সভার মাধ্যমে আদিবাসীদের সাথে কোনও আলোচনা ছাড়াই, যেটা পেসা আইন অনুযায়ী করা উচিত ছিল, বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে বহু জমি দখল করেছে। মাওবাদীদের ঘাঁটি অঞ্চলে গ্রাম পঞ্চায়েত শুধুমাত্র কাগুজে সংগঠন। তাঁদের চাপে পঞ্চায়েতের কর্মকর্তারা শহরে বাস করে এবং কদাচিৎ তাঁদের নিজের এলাকায় সক্রিয় হতে দেখা যায়। এমনকি অঙ্গনবাদী কর্মীদের মতো সরকারি কর্মচারীরা নিয়মিত মাহিনা নেওয়া সত্ত্বেও অঙ্গনবাদীতে হাজির থাকে না। বিদ্রোহীদের দ্বারা প্রভাবিত এলাকায় যেখানে তাঁরা বিকল্প জনাতনা সরকার পরিচালনা করেন, বেশির ভাগ সরকারি প্রকল্পের প্রায় কোনও অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।
প্রঃ জাতীয় স্তরের মিডিয়াতে অপারেশন কাগার এত কম আলোচিত কেন?
উঃ কারণটা সারা দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মিডিয়া সংস্থাগুলি অধিকাংশই কর্পোরেট বা কোনও ধনকুবের শিল্পপতি গোষ্ঠীর ধামাধরা হওয়ার কারণে বিষয়বস্তু এবং খবর সংগ্রহ এখন কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। রাজনৈতিক ঘটনা রিপোর্ট করা এখন একটা চ্যালেঞ্জ। যাঁরা বেশি সাহস দেখানর চেষ্টা করেছেন, তাঁদের প্রবল চাপের মোকাবিলা করতে হয়েছে, যেমন ২০২৩ এ বিবিসি।
যদিও বিশদ আকারে বা বিশ্লেষনাত্মক ভাবে স্পর্শকাতর রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে চর্চা এখন সীমিত হয়ে গেছে, ইংরাজিতে হিন্দুস্তান টাইমস, দ্য হিন্দু, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, এবং টাইমস অফ ইন্ডিয়া এবং হিন্দিতে দৈনিক ভাস্কর, পত্রিকা, নবভারত, নই দুনিয়া এবং আরও কয়েকটি সংবাদপত্র এই অঞ্চল নিয়ে লেখালেখি করে। এছাড়া স্বাধীন সাংবাদিকরা ওয়েব পোর্টাল বা ইউ টিউব চ্যানেল চালান যেগুলি এলাকার জমিন স্তরের ঘটনাবলীর ওপর রিপোর্টিং করে।
প্রঃ এই অঞ্চল থেকে অভিযোগ দায়ের হলে আদালত এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলির প্রতিক্রিয়া কী রকম হয়?
উঃ দূরত্ব ও খরচার কারণে উচ্চতর আদালতের নাগাল পাওয়া এখানকার মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য। নানা বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও মানবাধিকার সংগঠন এবং তাঁদের কর্মীরা বহু ঘটনা হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, এনএইচআরসি পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। প্রায় সব ক্ষেত্রেই শুনানিতে অত্যধিক বিলম্ব হয়েছে এবং অবশেষে মামলা খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি শীর্ষ আদালত যে সংগঠনকে ২০১১ সালে বেআইনি ঘোষণা করেছিল সেই সালওয়া জুলুম-এর মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী মামলা সেটাও এই বছরের মে মাসে কোনও ঠিকঠাক শুনানি ছাড়াই খারিজ করা হয়েছে। বিজাপুর জেলার দুটি কুখ্যাত ঘটনা --- ২০১২ সালে সার্কেগুড়া এবং ২০১৩য় এদেস্মেত্তা গ্রামে ---- বীজ উৎসবের সময় সতেরো জন এবং আট জন যথাক্রমে মারা যান। জাস্টিস ভি কে আগরওয়াল-এর নেতৃত্বে যে বিচাবিভাগীয় তদন্ত হয় তাতে দুটি ঘটনাই ভুয়ো সংঘর্ষ প্রমাণিত হয় যাতে শিশুরাও নিহত হয়। রাজ্য বিধানসভায় সেই রিপোর্ট পেশ করা সত্ত্বেও কোনও শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। এমনকি একটা এফআইআরও দায়ের করা হয়নি।
সম্প্রতি মূলবাসী বাঁচাও মঞ্চ নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে একটি পিটিশন করা হয় সেটাও খারিজ হয়ে যায়। কিছু আইনজীবী এখন সুপ্রিম কোর্টে এই ইস্যু উত্থাপন করার চেষ্টা করছে।
প্রঃ অপারেশন কাগারের কারণে আইনজীবী, অ্যাক্টিভিস্ট, সাংবাদিকরা কি দমনপীড়নের সম্মুখিন হয়েছেন?
উঃ এর আগের অনেক অপারেশনের মতো কাগারের সময়ও অনেককে ঘটনাস্থলে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছে। আমাদের দীর্ঘ পথ ঘুরে যেতে হয়েছে, বারবার পরীক্ষার সম্মুখিন হতে হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে হুমকিও দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনী সব সময় বলে এগুলো নাকি আমাদের নিরাপত্তার জন্যই প্রয়োজন, কিন্তু আমরা তো জানি আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের ঘটনাস্থলে যাওয়া আটকান।
প্রঃ ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়গুলির জন্য কী ধরণের আইনি ও নাগরিক পরিষেবা সবচেয়ে প্রয়োজন?
উঃ সংকটের সময় লালফিতেয় বাঁধা যে ব্যবস্থা সেটি মোকাবিলা করার জন্য গ্রামবাসীদের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। শিক্ষার অভাব এবং বাইরের জগতের সাথে পরিচিতি কম হওয়াই এটার মূল কারণ, এছাড়া হিন্দিতে কথা বলতেও তাঁরা অত সড়গড় নন। যেমন, গ্রামের লোকদের যখন গ্রেপ্তার করা হয় তখন তাঁদের খোঁজার জন্য পরিবারের সদস্যদের সাহায্য প্রয়োজন হয়। দিনের পর দিন তাঁদের কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না যা প্রবল উদ্বেগের কারণ হয়। অনেক সময় মহিলাদের, প্রায়শই শিশু কোলে নিয়ে, থানার সামনে দেখা যায়। প্রহরীরা তাঁদের ভিতরে ঢুকতে দেয় না, আর ঢুকতে পারলেও পুলিশ আধিকারিক তাঁদের প্রয়োজনীয় খবর দেন না। পিড়িয়া ও ইতাভার গ্রামের ঘটনায় যেখানে বহু লোক মারা গেছিলেন এবং অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, পরিবারের সদস্যরা লম্বা রাস্তা হেঁটে কিংবা ট্র্যাক্টরে চড়ে জেলা সদরে পৌঁছেছিলেন; তাঁদের প্রিয় মানুষদের সম্পর্কে তাঁরা দুশ্চিন্তায় ছিলেন --- তাঁরা কি বেঁচে আছেন নাকি তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য লক-আপে রেখে দেওয়া হয়েছে। এই ধরণের সময়ে আত্মীয়স্বজনরা আমার মতো মানুষকে খোঁজ করেন এবং আমরা যে ভাবে পারি সাহায্য করি। কেউ ভুয়ো সংঘর্ষে মারা গেলে মৃতদেহ পাওয়ার জন্য, পুলিশে অভিযোগ জানানোর জন্য, এমনকি আদালতে পিটিশন করার জন্যও, সাহায্যের প্রয়োজন হয়। কারাবন্দীদের আত্মীয়দের, আইনি প্রতিনিধিত্ব ছাড়াও নানা ধরণের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। সহজ কথায় যখনই কোনও গোলমাল হয়, জরুরি ভিত্তিতে মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন হয়।
প্রঃ হত্যাকান্ডের পর পুলিশ কি মৃতদেহ পরিবারকে দেয়?
উঃ এত বছরের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা দেয়, যদিও বিলম্ব হয়, ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত। কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে এনকাউন্টারে, যখন কেউ মারা যান পুলিশ তাড়াতাড়ি শেষকৃত্য করার জন্য পরিবারকে চাপ দেয়, এমনকি সেটা নিশ্চিত করতে তারা গ্রামে কিংবা শ্মশানে চলে যায়।
প্রঃ পুলিশ কেন মৃতদেহ দিতে দেরি করে কিংবা একেবারে অস্বীকার করে?
উঃ কখনো দেরি হওয়ার কারণ থাকে; যেমন মৃতের ফটো এবং যদিবা পরিচিতি জানা যায়, আত্মীয়রা মৃতদেহ দাবী করার জন্য আসেন না। আবার কখনো ইচ্ছাকৃত ভাবে দেরি করা হয়, দিনের দিন কেটে গেলেও মৃত ব্যক্তির ফটো প্রচার করা হয় না। এছাড়া জেলা হাসপাতালে মৃতদেহ সংরক্ষণের ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার কারণে, দেহে পচন ধরে এবং ব্যক্তিকে শনাক্ত করা মুশকিল হয়ে পড়ে। এসব ক্ষেত্রে বোঝা যায়, ডাল মেঁ কুছ কালা হ্যায়!
২২ থেকে ২৭ মে আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে বিলম্ব করার একটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করি। ২০ মে নারায়ণপুর জেলার অবুঝমাড় জঙ্গলে একটি গুরুতর সংঘর্ষে ২৮ জন মাওবাদী মারা যান। পরে মাওবাদীদের একটি প্রেস বিবৃতি থেকে জানা যায় যে তাঁরা একটি মৃতদেহ নিয়ে গেছেন। বাকি দেহ পুলিশ নারায়ণপুরে নিয়ে এসে জেলা হাসপাতালের শবকক্ষে রেখে দেয়। সেখানে ঠাণ্ডা রাখার কোনও ব্যবস্থা নেই। ২২শে মে ওয়ারাঙ্গালের মৃত মাওবাদী উগেন্দ্র ওরফে বিবেকের পরিবারের সাথে আমি যাই। তাঁরা আমার সাহায্য চান কারণ তাঁরা হিন্দি বলতে পারেন না। পরের কয়েক দিনে অন্ধ্র প্রদেশ ও তেলেঙ্গানা থেকে আরও চারটি পরিবার আসে। দুজন বরিষ্ঠ মাওবাদী, কেশব রাও ওরফে বাসবরাজু, সাধারণ সম্পাদক, সিপিআই (মাওবাদী) এবং সাজ্জা ভেঙ্কট নাগেশ্বর রাও ওরফে নবীন, এঁদের মধ্যে এই দুজনের পরিবারও ছিলেন। এই পাঁচ পরিবার এবং বস্তারের গ্রামের মৃত মাওবাদীদের পরিবার আধার-এর মতো প্রয়োজনীয় নথি দেখায়। বস্তারের মৃতদেহ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয় কিন্তু তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্র প্রদেশের পরিবারগুলিকে, কোনও বিশ্বাসযোগ্য কারণ ছাড়াই, অপেক্ষা করিয়ে রাখা হয় এবং দিনের পর দিন হেনস্থা করা হয়। ২৭ তারিখে আমাদের জানান হয় যে দেহগুলিতে পচন ধরে গেছে তাই সেগুলি নারায়ণপুরেই সৎকার করা উচিত। পরিবার অস্বীকার করে কারণ তাঁরা প্রচুর খরচ করে গ্রাম থেকে ফ্রিজার অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে এসেছে এবং সেখানে অন্য সদস্যরা অপেক্ষা করছেন কারণ তাঁরা মৃত স্বজনকে বাড়ি ছাড়ার পর কয়েক দশক ধরে দেখেননি। সেই সন্ধ্যায় প্রচুর পুলিশের উপস্থিতিতে, মৃতের আত্মীয়দের না জানিয়ে পুলিশ লুকিয়ে দেহগুলি দাহ করে দেয়। বস্তারের ইনস্পেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ পরে দাবী করে যে কোনও আইনি দাবীদার মৃতদেহ গ্রহণ করতে আসেননি।
আমার বিশ্বাস মৃতদেহ পরিবারের কাছে সমর্পণ না করার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক। সরকারের আশঙ্কা ছিল যে যদি বাসবরাজুর দেহ তাঁর নিজের জায়গা শ্রীকাকুলামে নিয়ে যেতে দেওয়া হয় তাহলে সেখানে প্রতিবাদে মিছিল, মিটিং হবে কারণ যদিও একটা সংঘর্ষ হয়েছিল, এটা পরিস্কার নয় যে বাসবরাজু লড়াইয়ে মারা গেছিলেন না তারপরে, যখন তাঁকে হয়তো কাবু করে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
পরিবারকে মৃতদেহ সমর্পণ না করার কারণে সরকার সংবিধানের ধারা ২১ লংঘন করেছে। ভারতীয় আদালতের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এই ধারা মৃতর মর্যাদা রক্ষা করার অধিকার তুলে ধরে। এর অর্থ মৃতদেহকে সম্মান করতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে দেহ যেন সতর্ক ভাবে রাখা হয়, এবং তা যেন অপবিত্র, অপমানজনক ভাবে, কোনও নিয়ম কানুন ছাড়াই দাহ করা না হয়। একই ভাবে ধারা ২১ অনুযায়ী ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে প্রিয়জনের দেহ সৎকারের অধিকার পরিবারের আছে। যথাযথ আইনি কারণ ছাড়া যদি এই অধিকার অস্বীকার করা হয় তাহলে সেটা ব্যক্তির মর্যাদা এবং তাঁর সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় স্বাধীনতা লংঘন করা হবে।
প্রঃ মৃতদের প্রতি আচরণের কারণে কেউ কি কোনও আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে?
উঃ আমি আশা করছি বাসবরাজুর পরিবারের সদস্যরা কিছু একটা করতে পারেন। বাসবরাজু এবং অন্যান্যদের পুলিশের হেফাজতে দাহ করার কারণে মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। এর ফলে পরবর্তি সংঘর্ষের ঘটনাগুলিতে যেমন জুন মাসে যখন কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য সুধাকর এবং ভাস্কর মারা যান, তাঁদের মৃতদেহ কোনও বিলম্ব না করে পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
প্রঃ আপনার কি মনে হয় অপারেশন কাগার সম্পদশালী আদিবাসী অঞ্চলে প্রশাসনের সামরিকীকরণের এক বৃহত্তর প্রস্তুতি?
উঃ একদম। সরকার বিভিন্ন কর্পোরেশনের সাথে খনন নিয়ে এমওইউ (MOU) সই করেছে। চুক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আর কোনও রকম বিলম্ব সম্ভব নয়। মনে হচ্ছে কর্পোরেট, বিশেষ করে আদানি, যাতে দখল কায়েম করতে পারে অপারেশন কাগার সেটার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। যেমন এনএমডিসি একটা টিলা ফোঁপরা করে দিয়েছে, এখন আর একটাকে নিশানা করেছে, যে কারণে প্রতিবাদ দানা বাঁধছে।
প্রঃ মাওবাদীরা যে এখন যুদ্ধবিরতির ইচ্ছা প্রকাশ করছে, এটা আপনি কী ভাবে দেখেন?
উঃ মাওবাদীরা যুদ্ধবিরতি ও আলোচনা করতে চাইছেন কারণ তাঁদের নিজেদের বাস্তব সামর্থ্য সম্পর্কে ধারণা আছে। কিন্তু রাষ্ট্র এটা মানতে রাজি নয় বরঞ্চ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তারা আক্রমণ আরও তীব্র করছে এবং সমস্ত মাওবাদী নেতা ও ক্যাডারদের শারীরিক ভাবে শেষ করে দিতে চাইছে। সাধারণ মানুষের মৃত্যু কোলাট্যারাল ডেমেজ বলে চালিয়ে দেওয়া হবে।
প্রঃ মাওবাদী প্রতিরোধের অনুপস্থিতিতে, আপনি কি মনে করেন আদিবাসী বিদ্রোহের নতুন রূপ বিকশিত হবে?
উঃ দেশের অন্যান্য আদিবাসী অঞ্চলের মতো বস্তারের আদিবাসীদের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস আছে, যা ব্রিটিশ শাসনের সময়ও দেখা গেছে। নতুন রাজনৈতিক সংগঠন এবং আন্দোলন বিকাশ লাভের সম্ভাবনা আছে। মূলবাসী বাঁচাও মঞ্চ যুবক-যুবতীদের নেতৃত্বে একটি গণ সংগঠন যা ২০২১ থেকে প্রকাশ্যে এবং গণতান্ত্রিক ভাবে আন্দোলন করছিল, সেটা অক্টোবর ২০২৪ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কিন্তু এটা আরও বাড়ান হবে। এমবিএম-এর অনেক নেতা, কর্মী এখন ইউএপিএ আইনের অধীনে জেলে। বস্তারে এখন স্বাধীন গণআন্দোলনের প্রয়োজন কিন্তু যে হারে সামরিকীকরণ হচ্ছে তাতে প্রতিবাদ করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
প্রঃ সরকারের কি উচিত মাওবাদীদের সাথে আলোচনা শুরু করা বিশেষ করে তাঁরা যখন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে?
উঃ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। মার্চ মাসের শেষ থেকে সিপিআই (মাওবাদী) ছয়বার প্রেস বিবৃতি দিয়ে যুদ্ধবিরতি ও রাজনৈতিক আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। কিন্তু সরকার কোনও ইচ্ছা প্রকাশ করেনি। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার জানিয়ে দিয়েছে আত্মসমর্পণ ছাড়া মাওবাদীদের কাছে আর কোনও রাস্তা খোলা নেই। এর আগে বলা হচ্ছিল মাওবাদীরা আলোচনার জন্য আসতে পারেন কিন্তু কোনও মধ্যস্থতাকারী ছাড়া, যেটা বিপজ্জনক কারণ অতীতে এই ধরণের পরিস্থিতিতে কয়েকজন মারা গেছেন।
আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি যখন কর্পোরেশন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দখল করে নিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ এবং তাঁদের দল বিজেপি এই পরিবর্তনের কান্ডারি। মনে রাখবেন মে, ২০১৪ নির্বাচনে জিতে কার বিমানে চড়ে মোদী, তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী, এবং হবু প্রধানমন্ত্রী, দিল্লিতে পদার্পণ করেছিলেনঃ সেটাই তো ইঙ্গিতবহ। ফ্যাসিস্ট হিন্দুত্ববাদীরা আমাদের গণতন্ত্রকে অন্তর্ঘাত করছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এ এক বিপজ্জনক মুহূর্ত এবং আমাদের সবার এই বিষয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।